ফেইল সমাচার

সবকিছু নিয়ে ফাজলামো করাটা আমার মজ্জাগত। অধিকাংশ মানুষই এটা নিতে পারে না। ইদানীং আরো পারছে না!সবাই রেগে যাচ্ছে। অনেকটা “সে ফেল করছে, সে ফাজলামো কেন করবে? সে থাকবে মন খারাপ করে! নির্লজ্জ ছেলে! ” এইরকম চিন্তাভাবনা।

আমার আশেপাশের মানুষগুলোর হাবভাব দেখে মনে হয় আমি না, তারাই ফেল করেছে! তারা খুব বিব্রত! কি বলবে খুঁজে পায় না! তাদের বিব্রতভাব দেখে মনে হয় বিরাট পাপ করে ফেলছি। সামনে পড়ে খুব বিপদে ফেলে দিয়েছি। যারা এখনো জানে না, তারা কিছুক্ষণ ইতঃস্তত আশেপাশে ঘুরে,তারপর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে “ভাই কি সংবাদ!? ” ভাবখানা এমন “এমন লজ্জার কথা! কিভাবে জিজ্ঞেস করি! কেউ যদি শুনে ফেলে! ভাইয়ের ভীষণ বেইজ্জতি হবে! ” হাহা।
আগে রাস্তাঘাটে হাটলে হাসিমুখে যাদের সাথে “কি অবস্থা? কেমন আছেন / আছ/ আছিস? ” ইত্যাদি বিনিময় হত এখন তারা চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে যায়।
যারা সান্ত্বনা দিতে আসে তারা চুপ করে পাশে বসে থাকে,তারপর অনেক বিব্রতকর নীরব মুহূর্তের পর উঠে চলে যায়। কি বলে শুরু করলে আমার সবচাইতে কম কষ্ট হবে এটাই ভাবে বোধহয়!
এরকম এক পার্টিকে বল্লাম “কেউতো মারা যায় নি! একটু ফেল করেছি! সান্ত্বনা দিতে আসছ, কিছু বলো! বলে চলে যাও! নিজেকে কষ্ট দিও না! ” হাহা।
অবস্থাদৃষ্টে এখন মনে হচ্ছে কুকুরওয়ালা বাড়িতে যেমন সাইনবোর্ড থাকে “সাবধান! কুকুর! ” আমার সাথেও তেমন অদৃশ্য সাইনবোর্ড লাগানো আছে “সাবধান! ফেল্টু!” হেহে! কেন মনে হচ্ছে? গণ দাবীর মুখে দুদিন রইলাম মন খারাপ করে। মন খারাপ করে বসে থাকি, মন খারাপ করে হাটি। শুধু গুন গুন করে বর্মন সাহেবের গানটা একটু এদিক ওদিক করে গাই “শোনো গো দখিনও হাওয়া!! ফেল করেছি আমি…….. ”
ফালাফল শুন্য। লোকজন আগের মতই বিব্রত! কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল যেটাকে আমি মন খারাপের এক্সপ্রেশন বলে চালিয়ে দিচ্ছি সেটা আসলে মেজাজ খারাপের এক্সপ্রেশন! যার সহজ অনুবাদ হল “সব দোষ এদের। এদের জন্যই আমি ফেল করছি! কথা বলতে আসুক, কাচা খেয়ে ফেলব! ” এই এক্সপ্রেশন নিয়ে আশেপাশের মানুষের কাছ থেকে নীরবতা ছাড়া আর কি আশা করা যায়?
আমি আবার আগের আমাতে ফিরে গেলাম! ঘুরি ফিরি খাই দাই, ইদানীং ফেল করা নিয়েই ফাজলামো করি। আজ একজন বলে ফেল্ল “খুব গর্বের বিষয়! ফেল করছ! না?”
যার কাছ থেকে আসছে একদমই আশা করি নি। ধাক্কা খেলাম। এক ধাক্কায় ৬ বছর পেছনে চলে গেলাম! ২০০৮ সাল। দ্বিতীয়বারের মত মেডিকেল ভর্তি কোচিং করি। এম্নিতেই পায়ের নিচে মাটি নেই তার উপর কোচিং এ একটা মেয়েকে ভাললেগে গেল, পড়াশুনার চেয়ে তাকে নিয়ে আকাশপাতাল ভাবনাটাই বেশি হত। প্রতিদিনই কোচিং শেষে বিকেলে স্টেডিয়ামে গিয়ে দাবা খেলি। সন্ধ্যা হলেই মন খারাপ হয়ে যেত প্রচণ্ড! বাসায় ফিরতে হবে, ইচ্ছে হত না। প্রতিদিনই বাসায় ফিরে দেখতাম আম্মা মন খারাপ করে আছেন। জিজ্ঞেস করলে হাসিমুখে বলেন “কিছু হয় নি! ” আমি ঠিকই খবর পাই কেউ না কেউ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে। হয়ত বাড়িওয়ালার বউ অথবা আরেক ভাড়াটিয়ার বউ! আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বইখাতা নিয়ে বসি। পড়াশুনা হয় না, শুধু প্রমাদ গুনি। আর সৃষ্টিকর্তাকে বলি “আমাকে একটু শক্তি দাও! ”
একদিন ছোটনানা বলেই ফেল্লেন “তোমরা অযথাই একে নিয়ে এত আশা করছ! একে দিয়ে কিছু হবে না! শুধু শুধু টাকা নষ্ট! ” সেদিন খুব লজ্জা পেয়েছিলাম! কিন্তু মুখ লুকাবার জায়গা ছিল না।
সেই বিভীষিকা থেকে সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং আমাকে উদ্ধার করেছেন। উদ্ধার করে ফেলেছেন আরেক বিভীষিকায়। কিন্তু সাথে দিয়েছেন জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান শিক্ষাটা পূজি হিসেবে। আমি কৃতজ্ঞ!
মেডিকেল লাইনে যারা আছেন তারা জানেন ফেল করাটা এখানে ডালভাত! আর আমার মত যারা অলরেডি এর স্বাদ পেয়ে আসছে তাদের কাছে এটা একটা জোক ছাড়া আর কিছু না!
তবুও হয়ত খারাপ লাগে, তবুও মানুষ বিব্রত হয়! আমি এখানে লজ্জার কিছু দেখি না, এর মানে আমি গর্বিত এও না! আমি শুধু বলতে চাচ্ছি এটা হতেই পারে!
আমি এখন আর কারো কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে যাই না, ইন ফ্যাক্ট কোন কিছুই প্রমাণ করতে যাই না। কারণ আমার দৌড় সম্পর্কে আমার বেশ স্পষ্ট ধারণা আছে। আমাকে দিয়ে কি হবে না হবে সেটা সৃষ্টিকর্তা খুব স্পষ্ট করে আমাকে দেখিয়ে দিয়েছেন। সেটাই কি আমার জন্য যথেষ্ট নয়? তাই আমি এখনও নির্লজ্জের মত ফাজলামো করে বেড়াই!
তবু দিনশেষে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে “কেমন আছ? ” খুব বিপদে পড়ে যাই। দ্ব্যর্থবোধক মাথা নেড়ে এড়িয়ে যাই। মনে মনে বলি “তাইতো! কেমন আছি? জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে! ” দিনের শুরুটা ভালই হয় কিন্তু শেষটাতে গিয়েই সব লেজেগুবড়ে যায়। উদ্ভট কোন তিক্ততা দিয়ে শেষ হয়! বয়স বাড়ার সাথেসাথে এইসব দিনগুলির সংখ্যা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে চলেছে! আর ঘুমাতে যাবার আগে মনে হয় “বহুদিন আয়নার ওপাশের লোকটাকে জিজ্ঞেস করা হয় না ‘কেমন আছ?’ “….

১,৮৯৫ বার দেখা হয়েছে

১৯ টি মন্তব্য : “ফেইল সমাচার”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    ফেইল করা কোন ব্যাপার না এইটা কেন যে মানুষজন বোঝে না সেটা আমি বুঝি না। চমৎকার লিখা! 😀


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    মেডিকেল কলেজে ফেল করাটা আমিও অভ্যাসে পরিণত করেছিলাম।
    তবে ফেল করা থেকে প্রতিবার কিছু না কিছু শিখে নিতে হয় -- পরে খুব কাজে লাগে।

    চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়তে পড়তে মানবিকতার পাঠটা সচেতনভাবে চালু রাখতে হবে --- ওটা মেডিকেল কলেজে শেখায়না, সিলেবাসেও নেই। সেখানে ফেল করলে কোথাও পালানোর জায়গা থাকেনা।

    জবাব দিন
  3. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    একটা সময়ে মনে করা হতো, মেডিক্যালে যে যত বেশি দিন পড়ে মানে যত বেশিবার ফেল করে, সে তত বড় ডাক্তার হবে।
    আর সেটা ঠিকও ছিল ঐসময়ের অনেক নামকরা বড় বড় ডাক্তারের জন্য।
    আশির দশকের গোড়ার দিকে আমার খালা কে একবারে পাশ করতে দেখে অনেককেই আফসোস করতেও দেখেছিলাম, আহারে, মেয়েটা পাশ করলো ঠিকই, কিন্তু ভাল ডাক্তার হতে পারবে না।

    বোঝা যাচ্ছে, পারসেপশনটা বদলে গেছে।


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মামুনুর রশীদ খান(২০০১—২০০৭)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।