ওরা আছে! ওরা থাক!!

—হ্যালো।হ্যা বল।
—কিরে।
—কিরে।
—কেমন আছস?
—হু ভাল।তুই?
—ভাল।শোন।
—ক।
—টি শার্ট কিনছিলাম দুইটা। আর একটা প্যান্ট। এখন তো লাগে না। ছোট হয়,টাইট হয়। কি করমু তাইলে?
—আবার?
—আবার কিরে আবার?
—কোত্থেকে কিনছস?
—নাম কইলে তুই চিনবি? তুই কিছু চিনস? ঢাকার কিছু বুঝস? ছাইড়া দিলে তো হারায়ে যাবি!!!
ঘটনা সত্য।বছরে ১-২ বার ঢাকা যাই।রাস্তায় হাটার সময় অলওয়েজ কানে ফোন থাকে,ওপাশ থেকে ইন্সট্রাকশন আসে,আর লোকজনকে জিজ্ঞেস করে এদিক ওদিক যেতে হয়।
এইতো কিছুদিন আগেই চিটাগং থেকে রাত সাড়ে আটটায় সায়েদাবাদ নামলাম। উত্তরা যাব।অনিকদের ফ্ল্যাটে। অনিক ফোনে বলে যাচ্ছ—
‘ বলাকায় চড়ে নর্থ টাওয়ার নাম।
হেল্পাররে ক।
নর্থ টাওয়ার চিনবি তো?
বড় লাল অক্ষরে লেখা আছে “নর্থ টাওয়ার “।
দেখে নামবি।
আইচ্ছা তর দেখতে হইব না।তুই হেল্পাররে ক।
আইচ্ছা হেল্পাররে ফোনটা দে আমি কইয়া দিতাছি।’
আমি বড় লাল লেখা দেখে হোটেল রিজেন্সীর সামনে নেমে পড়লাম। নেমে বিল্ডিং এর নাম পড়ে ভুল ভাঙলো। ভাবলাম এসেই বোধহয় পড়েছি।হাটা দিই।অনিক ফোন করতেছে —
‘কতদুর?’
‘এই…. দুই তিন মিনিট ‘
‘এখন কই? ‘
‘এই…বাসে ….’
হেটেহেটে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গিয়েও যখন নর্থ টাওয়ার পেলাম না,তখন আবার বাস নিলাম।হায় এইবারও নর্থ টাওয়ার যাইতে পারলাম না। R.A.K টাওয়ার দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না!
শেষমেষ নর্থ টাওয়ার নেমে দেখি অনিক দাড়ায়ে আছে!!তার গায়ে লাল গেঞ্জি!!নেমেই বললাম—
‘কুড়িল জ্যামে আটকে গেছি।এত জ্যাম , ঢাকা থাকছ ক্যামনে? ‘
‘আগে বাসায় চল।ঘটনা তো একটা ঘটাইছস।কাউরে কমুনা যা,আমারে ক।’
আমি কইলাম।অনিক বাসায় গিয়া রেজোয়ান,মানিকদের কইয়া দিল।সেদিন খুব হেসেছিলাম।

তাই ছোট ভাইয়ের সাথে ঢাকা বিষয়ক আলোচনায় আর গেলাম না।
—তো যেখান থেকেই কিনস,ট্রায়াল দিয়া কিনস নাই?
—ট্রায়াল তো দিছিলাম।
—তখন লাগল? পরে ছোট হয়ে গেল? মেজিক নাকি?
—তাইলে কি করমু কইলি না? তুই নিবি? তুই নে? তোর তো লাগবে!
—ফেরত দে।
—ক্যান? তুই নে! অসুবিধা কি? পাঠায়ে দিলাম।কিনে ফেলছি পছন্দ কইরা,ফেরত দিলে ক্যামন দেখায়।তরে মানাইব।পাঠায়ে দিলাম।
—দে।
প্রতি তিন চার মাস পর পর আমার ছোট ভাইয়ের সাথে আমাকে এই কনভার্সেশন এর ভিতর দিয়ে যেতে হয়।ঈদসহ অন্যান্য উপলক্ষ্যে তো কথাই নেই।
ঘটনা হল আমার কাপড়চোপড় কেনার জন্য আমার কাছে কোন টাকা দেয়া হয় না। বাসার বক্তব্য হচ্ছে এ টাকা আমি সিগারেট খেয়ে পুড়ায়ে ফেলব।ছোট ভাইয়ের বক্তব্য হল আমার পছন্দ অতি জঘইন্য।তাই কয়েকমাস পরপর সে কাপড়চোপড় কিনবে যেগুলো ট্রায়ালের সময় ঠিক থাকে পরে আর তার গায়ে হয় না!!!ভিতরের কথা হচ্ছে বাসা থেকে একসেট কেনার টাকা দিলে সে দুইসেট পাঠায় আমার কাছে। এই ঈদেও তার ব্যতিক্রম নেই।

আমরা চাচাত,খালাত,ফুপাত,মামাত সব মিলায়ে ১৯ ভাইবোন। আমি,আমার চেয়ে দু বছর বড় এক ফুপাত ভাই,আমার দু বছর ছোট ছোট ভাই, এই তিনজন বড়র সারিতে।বাকিগুলা মাঝারি থেকে পিচ্চি।এরা আমাদের তিনজনকেই শুধুমাত্র “ভাই ” বলে ডাকে। আগে পিছে “বড় ” “ছোট ” কিছু নাই। বিচিত্র কারণে আমরা তিনজন একসাথে দাড়ায়ে থাকলেও যাকে ডাকা হয় শুধুমাত্র সেই রেস্পন্স করে! কনফিউশন হয় না!
আগে ছুটিতে বাড়ি আসলে এই পিচ্চিগুলার কাজ ছিল আমারে “বানায়ে দেয়া “। আমি উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতাম, কেউ পিঠের উপর বসে থাকত, কেউ মনের সাধ মিটায়ে কিলের উপরে কিল বসাত,কেউ চুল ধরে টানাটানি করত! আমি চুপচাপ ঘুমায়ে পড়তাম।
একটু বড় হয়ে যখন এরা স্কুলে ভর্তি হল তখন বোনেরা রান্নাবাটি খেলা নিয়ে সিরিয়াস হল।আর ভাইয়েরা গোমড়া মুখে বই নিয়ে এসে বসে থাকত। আমি অফার করলাম আমারে “বানায়ে দিলে” আর পড়তে হবে না।খুব খুশি তারা।
পরের ছুটিতে ভায়েরা আমার সব প্রফেশনাল হয়ে গেল। বই নিয়ে পড়তে আসছে। আমিও উপুড় হয়ে পিঠ পেতে শুয়ে আছি। সাড়াশব্দ নাই।কিছুক্ষণ পরে—
—আমি অংক পারি না!
— আমি ইংরেজি পারি না!
— বিজ্ঞান বুঝায়ে দাও।
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম —
— আচ্ছা ঠিক আছে আধা ঘন্টা ৫ টাকা। এবার কিলায়ে দে।
বইপত্র একপাশে ঠেলে তারা বলল —
— আচ্ছা পড়ালেখা একটু পরে করলেও চলব!
পরেরবার রেট ৫ টাকা ঠেকে ১০ টাকায় উঠল।বাড়ির সবাই নাকি তাদের “আধাঘণ্টা ৫ টাকা পার্টি ” নামে ডাকে!!
ছুটি যায় তারা একটু একটু বড় হয়।এখন শুধু টাকায় কাজ হয় না।এটা ওটা খাওয়াতে হয়,মোবাইল ভর্তি গেমস নিয়ে যেতে হয়!!সারাজীবন এগুলা করতে পারলে ভাল হত।

খুব ছোট থাকতে তারা “তুই ” বলে ডাকত, একটু বড় হয়ে “তুমি “, এখন “আপনি ” বলে ডাকে।বয়স বাড়ছে! তাদেরও,আমারও।কিন্তু বড় হওয়াতো হল না! ইচ্ছেও করে না! সময় কি একটু একটু করে ব্যাবধান তৈরি করছে? সময়ের কাজই তো এইগুলা করা! সময়ের কাজ সময় করবে ভাইয়েদের কাজ ভাইয়েরা। সময়ের কাছে হেরে যাবার জন্য তো ভাইকে ভাই ডাকি নি!

৯৪৪ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “ওরা আছে! ওরা থাক!!”

  1. সামিউল(২০০৪-১০)
    সময়ের কাছে হেরে যাবার জন্য তো ভাইকে ভাই ডাকি নি!

    কোপা পুরাই।

    ইশ, আমারে "বানায়ে দেয়ার" মত কেউ নাই... 🙁


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সামি(২০০৪-১০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।