দি নিউ মমিন্সিঙ্গা সার্কাস ….!

ঘুম থেকে উঠে দরজা খোলা মাত্রই দেখলাম প্রচুর ভীড়।বিকেল ৫.৩০ বাজে।আবার কি হল?? ভীড় নীচতলার করিডোর জুড়ে, সিঁড়ির ধাপে ধাপে,দোতলায় গিয়ে তুঙ্গে!! কোমরে তোয়ালে পেঁচিয়ে বের হয়েছিলাম গোসল করার আশা নিয়ে! জুলাই মাসে দিনে অন্তত একবার গোসল না করলে নিজেকে বড় বিবেকহীন মনে হয়। কিন্তু অনুসন্ধিৎসু অন্তঃকরণের কাছে হার মেনে গেলাম! আবার দরজা লাগায়ে হাফ প্যান্ট আর টিশার্ট পরলাম! জুলাই মাসে গোসল রাতেও করা যাবে! মজা গরম গরম না হলে হল?
পকেটে হাত ঢুকিয়ে অকুস্থলে পৌঁছলাম। এদিক সেদিক দলা পাকানো মানুষ! একদলা বিল্ডিং এর বাইরে, বয়স্ক দলা! হোস্টেলের কর্মচারীর দলা! একদলা করিডরে আর সিঁড়িতে , কি হচ্ছে কোন আইডিয়া নেই এঁদের। আমার মত।এরা স্টুডেন্ট।
আরেকদলা মূল দলা।ঘটনা ঘটাচ্ছে এরা। মারমুখী মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে দুই পার্টি।এক পার্টি স্টুডেন্ট, আরেক পার্টি হোস্টেলের ফোর্থক্লাস কর্মচারী,কিছু বহিরাগত । গলার স্বর উচ্চ থেকে উচ্চতর গ্রামে উঠছে, খেলা জমে উঠছে, ইফতারির সময় এগোচ্ছে,চক্রবৃদ্ধি হারে ভীড়ও বাড়ছে!
ঘটনা কি জানার আশায় দু একজনকে জিজ্ঞেস করলাম! যথারীতি কর্তা কারক বহির্ভূত হওয়ায় কোন উত্তর পেলাম না! সবাই গুরুত্বের সহিত নিজের বক্তব্য অধিবেশনে পেশ করার ধান্ধায় ব্যস্ত! বক্তাদের দিকে মনযোগ দিলাম,কিছু যদি উদ্ধার করা যায়!!ঘাড় ঘুরাতে ঘুরাতে ঘাড় ব্যথা হয়ে গেল, এত বক্তা!
ক্লেদ ক্লেশে যা উদ্ধার করা গেল, তা মোটামুটি এরকম :—
—আপনি ডিউটি ফেলে কই গেছিলেন? আপনার কাজ রাতে হোস্টেল গার্ড দেয়া!
—আপনি তা না করে হাওয়া খাইতে গেছেন।
—তখনই মোবাইল চুরি হল,চোর তো দেখতে পাচ্ছি না!
— তাইলে আপনেই নিছেন!
—সেহরি খাইতে গেছি!
—সেহরি খাইতে দুই ঘন্টা লাগে?
—আপনারা যে আমার বাসায় যাইয়া আমার বউয়ের কাছ থেকে মোবাইল কাইড়া আনলেন, কামডা কি ঠিক হইল?
—কানের দুল ধইরাও টান দিছেন!
—হাতের চুড়িও টানাটানি করছেন!
—বউতো আপনার একার,এলাকার সবাই জানল কেমনে কি হইছে?
—আপনি কলেজের কর্মচারী, আপনেরে ডাকছি জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য।
—আপনার বউয়ের মোবাইল না আনলে তো আপনি হাওয়া হইয়া যাইতেন!
—হ্যায় ডিউটি দ্যায় নাই প্রিন্সিপাল এর কাছে যাইন, বিচার দেইন!বউ নিয়া টানুইনক্যারে?
—ছাত্রগোর রুমেও তো টিভি, ফ্রিজ আছে।আউইন লইয়া বারিত যাইগা!!
—অই কি কইলি।কেরা কইলি।সামনে আইসা আবার ক।
—আপনি এলাকার লোকজন নিয়া হোস্টেলে আসছেন কেন?
—হ হ আপনি কি আমাদের থ্রেট দিতে আসছেন!?
—এলাকার লুক কনে দ্যাখলাইন, এইহানে ব্যাহেই আমার বাই! গটনা হুইন্না আইছে!
—অই সব বাইর অ।থ্রেট দিতে আইছে!
—অই পিচ্চিও আপনের ভাই?
—হ্যায় বাই না,বাইস্তা!
—অই ক্যারা থ্রেট দেয়রে!!??? ……

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোসলে গেলাম! পৃথিবীর বুকে এই একমাত্র যায়গা,যেখানে হোস্টেলে ছেলেদের বহুকষ্ট করে জমানো টিউশনির টাকায় কেনা,বাবা মায়ের পুরস্কার হিসেবে দেয়া, প্রেমিকার স্পর্শ লেগে থাকা শখের মোবাইল, ল্যাপটপ ইত্যাদি চুরি হলে এলাকাবাসী চোরের পক্ষ নিয়ে দলবেঁধে স্টুডেন্টদের দিকে তেড়ে আসে!!! হম্বিতম্বি করে চোর “উদ্ধার ” করে নিয়ে যায়!!! যাওয়ার সময় গালভর গালাগাল দিয়ে যায় “সব ফহিন্নির ফুতেরা পড়তে আইছে।আমগোর এলাকাত হুস্টেল,আমগোর হুস্টেলত থাহস ; পুলাপান মুবাইল্ডাই ত নিছে! তাইবইলা মারবি!?? দয়ামায়া নাই???….. ”
পাচ বছর ধরে একই দৃশ্য দেখছি। নিয়মের কোন ব্যত্যয় নাই!!কে যেন বলেছেন শখের দাম লাখ টাকা! তাই বোধহয় ইমোশনটাও একটু বেশি! ফার্স্ট সেকেন্ড ইয়ারে আমিও গলা ফাটাতাম! এখন গায়ে লাগে না! আর কটা দিন!!!!
গোসল শেষ করে হেডফোনে clutch এর binge &purge ফুল ভল্যুমে ছেড়ে ডক্টরস ক্লাবের দিকে রওনা হলাম! গায়ক গলা ফাটায়ে গাচ্ছে “come on m….f…..r, come on m…..f….r!” ভেতরের ক্রোধ ভেতরেই বিস্ফোরিত হচ্ছে। শত্রুকে হেডফোনে বন্দী করে প্রবল আক্রোশে গালাগাল দিয়ে পাশবিক সুখানুভূতি হচ্ছে!!
বেশিদূর এগোতে পারলাম না। জটলা।একজন বিপ্লবী কর্মচারী গলার রগ ফুলিয়ে চেঁচাচ্ছেন “সব বিল্ডিংয়ের গেইটো তালা মারুইন ।মেইন গেইটোও তালা মারুইন ।ছাত্রগোর ছার আইসা বিচার করব তারপরে তালা খুলা হইব! ”
সাথে সাথে আরেকটা প্রতিপক্ষ কন্ঠ ততোধিক জোরে “অই সব বাইরঅঅঅঅঅঅঅঅঅ….” জটলা কেটে এগুতে এগুতে বললাম ইফতারির সময় হয়ে গেছে।মাহবুব ভাই,আমাদের ক্যান্টিন চালাতেন,বলে উঠলেন “আপনেরেই খুঁজতাছি মনে মনে। কিছু একটা করেন।ছাত্রগোরে বুজান। ”
“তৃপ্তি ” ডাইনিংয়ের “মাস্টারশেফ ” ইদ্রিস ভাই বলে উঠলেন “এইযে নেতা সাব আসছেন! হ্যায় কি কয় হুনি …”
আমি হতভম্ভ!!! কি হচ্ছে!!! গলা খাকরি দিয়ে বললাম “মাহবুব ভাই,আপনারা যান।এলাকার লোকজন নিয়ে যান।বাসায় গিয়ে ইফতারের ব্যাবস্থা করেন।আমি ছেলেদের সাথে কথা বলছি! যানতো।।”
ছেলেদের একজন বলল “ভাইয়া,গার্ড মামার সাথে একটু কথা বলব! ”
মাহবুব ভাইরা ছোটগল্পের মত; চলে গিয়েও গেলেন না,মাসুদ ভাইয়ের দোকানের সামনে অবস্থান নিলেন।
গার্ড মামা রয়ে গেলেন।গলার স্বর বিনীত। ছেলেদের জেরা শুরু হল!
—আপনার সাথে খারাপ ব্যাবহার করছি?
—না।
—আপনার বউয়ের কানের দুল ধইরা টান দিছি!?
—না।
—চুড়ি?
—না।
—এইগুলা বলবেন, আমরা ভিডিও করে রেখে দিব!
—আচ্ছা।
আমি মিনমিন করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করতেই,
—এই চুপ চুপ,ভাইয়া কথা বলবেন।
উভয়পক্ষের ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন দেখে মনে হল না কেউ কোন কথা শুনতে চাচ্ছে!! সবাই অলরেডি বিরক্ত হওয়া শুরু করেছে! জনতা অ্যাকশন চায়।একটু মিন মিন করে চলে আসার আয়োজন করলাম। আসার পথে ছেলেদের বললাম
—এগুলা করে লাভ নাই।অনেক করছি আমরা।সবাই মিলে যাও প্রিন্সিপালের কাছে,বিচার চাইতে না।
—হ হ প্রিন্সিপালের অফিস ভাংমু চল!
—আরে ভাংচুর করে লাভ কি? যাইয়া লাইট,ফ্যান,ফ্রিজ,পিসি যা পাও খুইলা নিয়া বেইচা দাও।নতুন একটা সেট কিন! প্রিন্সিপাল কর্মচারীদের কিছু কইব না,তোমারাও প্রিন্সিপালরে কিছু কইবা না।কর্মচারীদের অবহেলায় তোমাদের যা লস হইব,তোমরা প্রিন্সিপালের কাছ থেকে নগদে ক্ষতিপূরণ নিয়ে নিবা! বিচার চেয়ে লাভ নাই।বিচারই নাই,আবার লাভ!
বলতে বলতে কানে আবার হেডফোন তুলে দিয়ে হাটা দিলাম।কথায় কথা বাড়ে।তাড়াতাড়ি কেটে পড়তে হবে! পেছনে ভীড় আবার পুঞ্জীভূত হচ্ছে।মাসুদ ভাইয়ের দোকানের সামনেও বিচলিত নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে! হিসেব শেষ হয় নি, হিসেব শেষ হয় না কখনও!!
clutch এর আর্তনাদ থেমে গেছে! মৌসুমি ভৌমিক আশা নিয়ে গাচ্ছেন “তাই স্বপ্ন দেখব বলে.. আমি দুহাত পেতেছি…।” আলো কমে এসেছে, চারিদিক শান্ত হয়ে আসছে।আমার হাটার গতি দ্রুততর হল,ইফতারির দেরি হয়ে যাচ্ছে।দেরি হলে ইফতারি পাওয়া যাবে,কিন্তু বসার যায়গা পাওয়া যাবে না!

১,৩৯২ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “দি নিউ মমিন্সিঙ্গা সার্কাস ….!”

  1. নাফিস (২০০৪-১০)

    ভালো লিখেছেন ভাই ! :thumbup:
    ময়মনসিংহ শহরে আমি দুখানা মোবাইল ফোন বিসর্জন দিয়েছি। খাটি ঠ্যাক যারে বলে আরকি।এর মাঝে একটা আবার প্রথম সেল ফোন.. নাসিরাবাদ কলেজের সামনে দিনে দুপুরে গলায় ছুরি ধরে নিয়ে যায়., ক্লাস টেনে পড়ি তখন ! পীড়াদায়ক স্মৃতি। 🙁

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মামুনুর রশীদ খান(২০০১—২০০৭)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।