আমার চারপাশ০২- গত বর্ষার সুবাস

০।
আমি হইলাম ম্যাংগো জনতা তাই আমার অনভূতি গুলো চড়া সুরে বাধা নয় কখনই। আন্ধার রাতের জ্যোৎস্না আমাকে মাতাল করে দেয় না কিংবা বৃষ্টির শব্দে আমার হাত দিয়ে মুড়মুড়িয়ে কবিতা ঝরে না। কিন্তু তারপরেও একটা কথা থেকে যায় কারণ স্মৃতি বলে একটা জিনিস রয়ে যায়।

০১।
বৃষ্টি নামটা আমার ব্যাপক পছন্দ তাই বলে বৃষ্টিতে ভিজা কিন্তু আমি একদম পছন্দ করি না। কিন্তু একেই বলে ভাগ্যের ফের। প্রতি বর্ষায় অন্তত ২০/২৫ এমন সময় আসবে যে আমাকে ভিজতেই হবে। দেখা গেল বাসার থেকে বের হবার সময় মেঘের কোন সগ্নী সাথী আশেপাশে নেই কিন্তু যেই মাত্র জায়গামত আসছি মানে এমন জায়গায় যেখানে এই অভাগার আশ্রয় নেবার স্থান নেই, তখনি ঠিক আগমন ঘটবে তার। এইসব দেখে নিজের ভাগ্যের উপর মেজাজ খারাপ করে খালি ভাবি শালা এই জীবনে যদি বৃষ্টি নামের কেও আসত…………

০২।
ছাত্র হিসেবে আমি ছিলাম ব্যাপক, প্রতিবারই কয়েক নাম্বারের জন্য ফেলের সদর দরজা আমাকে ছুতে পারত না। তাই প্রতিবার ভ্যাকেশনের থেকে আসার সময় আব্বু আম্মু করুন স্বরে আমাকে বলত- প্লীজ বাবা, এইবার কলেজে গিয়ে অন্তত একটু পড়াশুনা করিস। আমিও তখন ততোধিক করুন সুরে কথা দিতাম এইবার হবেই, কিছু একটা তো হবেই।

কিন্তু কথায় বলে মানুষের স্মৃতি নাকি ব্যাপক দূর্বল, তাই কলেজে আসার কয়েকদিনের ভিতরে সেই করুণ স্বর বা সুর সবি মনের গহীনে হারিয়ে যেত। তারই ফলস্রুতিতে একবার যখন টার্ম ফাইনালের রেজাল্টে ক্লাসে শেষ ৬ জনের ভিতর স্থান নিলাম ঠিক তখনি কেন যেন সেই করুন স্বর এর কথা মনে পড়ে গেল। তাই হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঠিক এইরকম একটা সময়ে কিছুই ভাললাগে না, মন একাএকা থাকতে চায়। কিন্তু উপায় নেই গেমসের বাঁশি তখন বেজে গেছে। হাউস বেয়ারা মোবারাক ভাই চিৎকার করছে- এই ক্লাস টুয়েল্ভ বাইর হও, তাড়াতাড়ি বাইর হও।

ঠিক এই সময়ে বৃষ্টি নামল, ঝুমঝুম করে, ফকফকা রোদের মাঝে। এমন বৃষ্টি যা কিনা মোবারক ভাইয়ের হাজার চিৎকারেও ক্লাস টুয়েলেভ কে নীচে নামাতে পারবে না কিংবা স্টাফদের হাজার বাঁশিতেও যেখানে গেমস হবার কোন সম্ভাবনা নেই। আর ঠিক তখনি কেন যেন মনটা ভাল হয়ে গেল, বড় তুচ্ছ ভাবে বৃষ্টির কারণে।

আর এখন পিছনে ফিরে দেখলে মনে হয় তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে মন ভাল করার দিন গুলি বুঝি ফেলে এসেছি গত জন্মের ওপারে।

০৩।
আমি কখন গল্প লেখার চেষ্টা করিনা বরং বলার চেষ্টা করি। এটা আমি প্রথম শিখেছিলাম হয়ত আমার দাদীর কাছ থেকে। আমি এখনো চোখ বন্ধ করলে দৃশ্যটা যেন দেখতে পাই। এক বৃদ্ধ কথা বলে যাচ্ছে আপন মনে, মাঝেমাঝে হাত দিয়ে মুখের কোণায় জমে থাকা পানের রস মুছছে। আর তার পায়ের কাছে বসে আছে একটা কম বয়েসী রোগা-পাতলা বালক। সেই বালক চোখ বড় করে শুনছে কথা, কোন গল্প অবশ্য তা নয় যেমনটা বাকীরা শুনেছিল তাদের দাদা-দাদীর কাছে। তাও বালক শুনত কারণ সেই বৃদ্ধ কথার পিঠি কথা সাজিয়ে বকে যেত পারত অবিরাম। সেই রকম কিছু কথা বালকের মনে রয়ে গেল অক্ষত অনেক বছর পরেও।

আমাদের দ্বীপে তখনো রিক্সা আসেনি, হক সাহেব হয়ত তখনো প্রধানমন্ত্রী হননি কিংবা আমাদের দ্বীপের পাড়ে তখনো ভীড়েনা আলাউদ্দীন নামের কোন স্টীমার। সেই সব দিনের কোন এক বর্ষার কালে ঝুমঝুম বৃষ্টির মাঝে যখন চারিদিকে যতদূর দেখা যায় চারাচর শুধু পানি আর পানি। ঠিক সেই সময় আমাদের দ্বীপের কোন গ্রামের ভিতর এক তরুণী অপেক্ষায় ছিল, অপেক্ষায় ছিল একদল মানুষের বা ঠিক করে বললে একটা নির্দিষ্ট মানুষের। যে বা যারা তাকে নিয়ে যাবে অন্য গ্রামে তার নতুন ঠিকানায়। যা কিনা পরের সত্তর বছরের জন্য তার স্থায়ী ঠিকানা হয়ে থাকবে। যে দিনের কথা সেই তরুণী তার উত্তরসূরী কে বলবে ঝুলে যাওয়া চামড়ার উপর থেকে পানের রস মুছতে মুছতে।

আমি যেন অনেক বছর আগে শুনা সেই গল্পের দৃশ্য দেখতে পাই, দেখতে পাই ভীষন বর্ষার মাঝে ১৫/২০ জনের একটা দল চলছে ছাতা মাথায়, শুনতে পাই হাটু পানির ভিতর মানুষের পা ফেলার শব্দ, ঝপঝপ-ঝপাঝপ। যেমনটা গল্পটা বলার সময় শুনতে পেতেন সেই বৃ্দ্ধ।

আমি মাঝেমাঝে ভাবি, কিভাবে আমার বৃদ্ধা দাদী দেখতে পেত বহু বছর আগের সেই বর্ষা, শুনতে পেত ঝুপঝুপ শব্দে হাটু পানি ভেঙ্গে আসা সেই মানুষ গুলোর আওয়াজ। আমিও কি একটা সময় অনুভব করতে পারব আমাকে ভালবেসে বৃষ্টি দিনে ছোয়া মানুষটার স্পর্শ কিংবা বিগত জীবনে ফেলে আসা সকল বর্ষার সুবাস।

২,৬৬৭ বার দেখা হয়েছে

৮৭ টি মন্তব্য : “আমার চারপাশ০২- গত বর্ষার সুবাস”

  1. মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

    তুমি ছাত্র হিসাবে যতটা ব্যাপক লেখক হিসাবে তার চেয়ে বেশি ব্যাপক।
    ঈস্‌ !! সেই বৃষ্টির প্রতীক্ষার দিনগুলি মনে পড়ে গেলো। এখনও সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বৃষ্টির শব্দ শুনলে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। শেষটা অসাধারন লেগেছে।

    বিঃ দ্রঃ প্রথম লাইনে ব্যাপক শব্দটি ২ বার ২ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।

    জবাব দিন
  2. এখন পিছনে ফিরে দেখলে মনে হয় তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে মন ভাল করার দিন গুলি বুঝি ফেলে এসেছি গত জন্মের ওপারে।

    দোস, আমার সবসময় এরকম মনে হয় রে !!
    মন তাই বেশিরভাগ সময়তেই খারাপ থাকে 🙁 🙁

    জটিল লিখছিস, হৃদয় ছুঁয়ে গেল।

    জবাব দিন
    • রাশেদ (৯৯-০৫)
      দোস, আমার সবসময় এরকম মনে হয় রে !!

      খুব খ্রাপ কথা। মাঝে মাঝে এমন মনে হওয়া ভাল কিন্তু সব সময় হওয়া ভাল না। এইটারে কয় নাগরিক বিষন্নতা x-(
      এর থেকে বাচতে হলে জানতে হবে তাই আমার চারপাশ০১ পইড়া আস 🙂


      মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

      জবাব দিন
  3. তানভীর (৯৪-০০)

    রাশেদ, খুব সুন্দর করে লিখেছ। :thumbup:

    এইসব দেখে নিজের ভাগ্যের উপর মেজাজ খারাপ করে খালি ভাবি শালা এই জীবনে যদি বৃষ্টি নামের কেও আসত

    আহারে! আমার জীবনেও যদি আসত...... :dreamy:

    আর এখন পিছনে ফিরে দেখলে মনে হয় তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে মন ভাল করার দিন গুলি বুঝি ফেলে এসেছি গত জন্মের ওপারে।

    একদম সত্য কথা। এখন অনুভূতিগুলো অনেক ভোঁতা হয়ে গেছে।

    আমিও কি একটা সময় অনুভব করতে পারব আমাকে ভালবেসে বৃষ্টি দিনে ছোয়া মানুষটার স্পর্শ কিংবা বিগত জীবনে ফেলে আসা সকল বর্ষার সুবাস।

    দোয়া করি, অনেক বড় হও। 😛

    জবাব দিন
  4. রকিব (০১-০৭)

    বরাবরের মতই অসাধারণ লাগলো। অনুভূতি প্রকাশের ভঙ্গিটা অসামান্য ভাই। কোন একটা বিচিত্র কারনে প্রথম প্যারাটা মাথায় ঢুকে গিয়েছে।
    আবার বলছি, ভালো লাগলো :boss: ।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  5. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    রাশেদ ভালো লাগলো লেখাটা।
    তোমার লেখা দেইখ্যা ভাবতেসি বর্ষা বাদল আর বৃষ্টি এই তিনজনরে নিয়া একটা ত্রিভুজ প্রেমের গল্প লিইখ্যা ফেলি। কী কও??? 🙂 🙂 🙂

    জবাব দিন
  6. সাজিদ (২০০২-২০০৮)

    বাইরে ব্রিস্টি (রিকার কেমনে লেখে ফোনেটিকে?) হইতেসে, তাও আবার যেমন তেমন না পুরা ঝর, ভিজতে আমারো ভাল লাগেনা কিন্তু ভিজে আসলাম, মজা লাগসে..... লেখা ব্যাপক হইসে :boss: :boss:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।