আমার চারপাশ ০১

০১।
আমার সব কিছুর শুরু একটু দেরীতে, যাকে বলে কিনা লেট ব্লুমার। নাইন টেনে কলেজের ছেলেপেলেরা যখন হাওয়ায় তাদের মন ভাসানো শুরু করেছে তখন ঐটা আমার কাছে বড়দের ব্যাপার, লজ্জার ব্যাপার। প্রত্যেক ছুটি শেষে কলেজের ছেলেপেলেরা যখন তাদের নতুন নতুন পরীদের বর্ণনা দেয় তখন বাকীদের মত আমিও তা শুনি কিন্তু মনে মনে ভাবি পোলাপাইন সব ইচড়ে পাকা। আমাদের ইনটেকের ফার্স্ট ক্যাডেট যখন প্রত্যেক ভ্যাকেশনে তার নতুন নতুন অফার পাওয়ার কাহিনি বলে মনে মনে তখন বলি শালা মেয়েরাও দেখি সব ইচড়ে পাকা। কিন্তু কি আশ্চার্য খেল! ক্লাস ইলাভেনে এক ম্যাডাম কে প্রথম দেখে আমার মনে হল এইবার আমারো ইচড়ে পাকা হবার সময় হয়েছে। কিন্তু ঐযে বললাম লেট ব্লুমার তাই ভুল সময়ে ভুল লোকের জন্য এই অনুভূতি।

০২।
কোথায় জানি পড়েছিলাম বয়ঃসন্ধি কালে ছেলেমেয়েরা দারুন আবেগ প্রবন হয়ে যায়। ছুটি গল্পের ফটিকের মত সবকিছুতেই তাদের দারুন অভিমান। ঐযে বললাম লেট ব্লুমার তাই বড় বয়সেও চারিদিকে দারুন বিষন্ন আমার সময়। যা করি তাতেই যেন কেমন মন খারাপের হাওয়া পাই। বন্ধুর কাছে ফোন করলে যদি বলে দোস্ত ক্লাসে আছি পরে ফোন দে, তখন শুধু শুধুই মনে হয় শালা আর আগের মত পাত্তা দেয় না। পরীক্ষায় বরাবরের মত খারাপ করার পর মনে হয় নাহ এইবার এইসব থেকে ছুটি নিতে হবে, চলে যেতে হবে দূরে কোথাও।
অযথাই মন খারাপ থাকে। তাই বালিকা কে যখন আগে বলা একশ বারের মত হাসতে হাসতে বলি- যাবি নাকি দূরে কোথাও? আমার সাথে? তার উত্তরে বালিকা যখন জোরে জোরে হাসতে হাসতে বলে- দূরে কোথাও যাওয়া যায় কিন্তু তোর মত পাগলের সাথে অবশ্যই না। কেন যেন তখন ১৫/১৬ বছরের বালকদের মত দারুন আবেগ সবকিছু গ্রাস করে নিতে চায়। অযথাই বিষন্নতায় ঘিরে ফেলে চারপাশ।

০৩।
একটা ক্যাডেট কোচিং এ মাঝে মাঝে ক্লাস নেই। টাকা যে খুব একটা বেশী পাওয়া যায় তা বলব না কিন্তু খালি মনে হয় আমার হাতের উপর দিয়েই কিছু ছেলে মেয়ে ক্যাডেট হয়ে যাবে। আর এই অনুভূতির লোভে কোচিংটা ছাড়তে পারি না। তবে মাঝে মাঝে এমন কিছু অভিজ্ঞতা হয় যেগুলোর জন্যও এটা ছাড়তে ইচ্ছে করে না।

গত দিন চারেক আগে একদিন ক্লাসের সব পড়া ১০মিনিট আগেই শেষ। তাই কিছু করার না পেয়ে প্রশ্ন করলাম বাছারা তোমারা কেন ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হতে চাও। উত্তর গুলোও সব গৎবাধা, দশ বছর আগের আমাদের সময় থেকে খুব একটা চেঞ্জ হয়নি। কেও সেনাবাহিনিতে যেতে চায়, কেও দেশসেবা করতে চায়, কার বাবা-মা চায়, কার বা ভাই বোন কে দেখে ইচ্ছে হয়েছে আবার কেও কেন যে যেতে চায় তা ঠিক করে জানে না। নাহ আমাদের থেকে খুব একটা আগায় নাই সময়।
কিন্তু হঠাৎ এক ছাত্রীর উত্তরে চমকে যাই। মেয়ে বলে কিনা সে বাসার থেকে দূরে থাকতে চায় তাই ক্যাডেট কলেজে যেতে চায়। ঠিক শুনলাম কিনা বুঝার জন্য আবার প্রশ্ন করি- কি জন্য? আবার সেই একি উত্তর। এইবার একটু ভাল করে আবার তাকাই।
মেয়ে আমার পুরান ছাত্রী, আগেও আমার কাছে পড়েছে। তাই পরে আবার জিজ্ঞেস করি কি ব্যাপার তোমার? তখন মেয়ে নানা কাহিনি বলে যায়। শুনার পর আমার খালি প্রতীমের- “ব্রোকেন ফেমিলি বয়” গান্টার কথা মনে পরে যায়।
ড্রিলে আমি কখনই ভাল ছিলাম না তাই ক্লাস সেভেনের প্রথম টার্মে সকাল বিকাল প্রতিবেলা আমার জন্য পাঙ্গা ছিল অবধারিত। রাজ্জাক স্টাফ যখন চিৎকার করে বলত- ঐ রাশেদ কি বাচ্চা ফল আউট, কেয়ামতের ৩১ তারিখ পর্যন্ত ফ্রন্টরোল স্টার্ট। তখন শুরু হয়ে যেত আমার পাঙ্গা। আর সেই টাইম টাই আমি খালি ফ্রন্টরোল দিতাম আর ভাবতাম আর মাত্র ৩০দিন, আর মাত্র ২৯দিন আর মাত্র ২৮দিন। এইভাবে বাসায় যাবার দিন গুনতাম আর ভাবতাম মাত্র এই কয়েক্টা দিন তারপর তো বাসা। সেইখানে তো আর রাজ্জাক স্টাফের কেয়ামতের ৩১ তারিখ নাই। এইভাবেই চলে যেত আমার ড্রিল টাইম।
আমার ছাত্রীর কাছে তার ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার কারন শুনে হঠাৎ মনে হল কি হবে মেয়েটার। ক্যাডেট কলেজে যখনি কোন বিপদে পরেছি তখনি বাসায় যাবার দিন গুনে গুনে নিজেকে সাহস দিতাম, আর বলতাম-আর তো মাত্র কিছু টা দিন, কোন ভাবে পার করতে পারলেই সেখানে অন্তত এই বিপদ আমাকে ছুতে পারবে না। আর সেইখানে এই মেয়েকে কলেজে দিন গুনতে হবে বাসায় যাবার কারন তারপর থেকেই তো তার বিপদের শুরু।
এই মেয়ের কথা মনে হতেই খালি মনে হয় অহেতুক আমার সব বিষন্নতা, নাগরিক জীবনে এতো খালি বিলাস।

৮,১৩৮ বার দেখা হয়েছে

৮১ টি মন্তব্য : “আমার চারপাশ ০১”

  1. নারীঘটিত পোস্টে রটনা / দুর্ঘটনাই প্রাধান্য পায় কিন্তু তুমি অনেক সুন্দর করে সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে ক্যাডেট সত্ত্বায় চলে গেছ.....

    ভাল লাগছে পড়ে :thumbup: :thumbup:

    জবাব দিন
  2. হুমম, কচিকাঁচা পরিবেষ্টিত রাশেদ তাহলে লেট-ব্লুমার? দেরিতে প্রস্ফুটিত হয়েই এই অবস্থা, আরো আগে হলে না জানি কী হতো!

    মেয়েটার কথা জেনে খারাপ লাগল। ক্যাডেট জীবনের 'ভয়াবহতা' সম্পর্কে ধারণা নেই, তাই জানি না ওর জন্য কোনটা বেশি কষ্টকর হবে - বাসা নাকি ক্যাডেট কলেজ। তবে শুভকামনা থাকবে ও যেন জীবনের সব হিসাবনিকাশ ঠিকমত মেলাতে পারে।

    ক্লাস ইলেভেনের ম্যাডাম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই।

    জবাব দিন
  3. রায়হান আবীর (৯৯-০৫)

    দারুন লিখছিস বন্ধু।

    তিন নম্বর নিয়ে বলি। আমার নিজের অবস্থা মোটামুটি মেয়েটার মতোই ছিল। বাসায় থাকতে হবে না এইটা আমার জন্য আমার বিশাল ব্যাপার। কেন? আচ্ছা এইটা না কইলাম।

    তবে কলেজে তোর মতো আমিও দিন গুনতাম। তবে সেটা বাসায় আসবো এইজন্য না। ছুটিতে একটু পোলাপানের সাথে দেখা সাক্ষাত হবে এইজন্য।

    সবচে বড় কথা হলো- এই বছরের আগ পর্যন্ত আমি ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার পর থেকে একনাগারে সাতদিনের বেশী বাসায় স্বাভাবিক ভাবে থাকতে পারি নাই। তবে এখন পারি। বড় হয়ে গেছি বলেই।

    যাই হোক, তোদের জন্য আমার সবসময়ই হিংসা ...

    জবাব দিন
  4. রাব্বি (১৯৯৮-২০০৪)

    সিউল ফাউল করছে, আমি খেলুম না। :(( :((
    না পইরা কম্মেন্ত কইরাও ......

    :frontroll: :frontroll: মাসরুফ ভাই কেয়ামতের ৩১ তারিখ তো আইসা পরল্লো

    (অফ টপিকঃ কুনু বড় ভাই এর doubt নেয়া যায় ?? )

    জবাব দিন
  5. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    চমৎকার এই লেখনীর জন্যেই আমি রাশেদের লেখার একজন 'নিবিড়' ভক্ত পাঠক :hatsoff: :hatsoff:

    এই মেয়ের কথা মনে হতেই খালি মনে হয় অহেতুক আমার সব বিষন্নতা, নাগরিক জীবনে এতো খালি বিলাস।

    উপলব্ধিটা মন ছুয়ে গেলো। বাচ্চা মেয়েটার জন্য সমবেদনা। কলেজে গিয়ে দারুন কিছু বন্ধু পেয়ে কষ্ট কিছুটা হলেও কমুক, এই কামনায়।


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  6. তারেক (৯৪ - ০০)

    রাশেদ হেব্বি লেখা। কি সুন্দর গড়গড়াইয়া লেখ তুমি।
    কোন এক ম্যাডামকে নিয়া আমাদের ব্যাচেও খুব টানাটানি ছিলো, বিশদে বলতে পারতেছি না, ঝামেলা আছে। 🙂 😛


    www.tareqnurulhasan.com

    জবাব দিন
  7. জিহাদ (৯৯-০৫)

    আমিও লেট ব্লুমার। তবে তোর আমার পার্থক্য হইলো আমি এখনো ফোটার অপেক্ষায় আছি।

    মেয়েটার জন্য সিরিয়াসলি খারাপ লাগছে।

    আর লেখাটা খুব সুন্দর হইসে।


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  8. রাজীউর রহমান (১৯৯৯ - ২০০৫)

    লেখা ভাল লাগছে ।

    এক ম্যাডামরে আমিও হালকা পাতলা পছন্দ করতাম কিন্তু ম্যাডাম পোলাপাইনের কাছে কালারড ছিল।

    কি আর করা । আমার কাছেও কালারড হইল।

    জবাব দিন
  9. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    রাশেদ গং : সবাই মিল্লা তো ভালোই জমাইছো।

    রাশেদ, লেখাটা ভালো লাগলো। ম্যাডাম থেকে হবু ক্যাডেট- কোনো কিছু বাদ নাই! তোমার :just: ফ্রেন্ডের খবর কি? (সবাইরে দেখে রাখা বড় ভাইয়ের দায়িত্ব কিনা!!) :-B :-B :-B


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাশেদ (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।