আজম খান

চুপ,চুপ,চুপ, অনামিকা চুপঃ

তখন সম্ভবত সেভেন বা এইটে পড়ি, বাসায় টিভি চ্যানেল বলতে সেই আদি অকৃ্ত্রিম বিটিভি। ডিশের স্বাদ পেতে তখনো অনেক দেরি তাই পড়াশোনা বাদে বাসায় থাকার সময়টাতে বাংলা সিনেমা, নাটক, বির্তক, খবর সব দেখি। এমনকী মাঝে মাঝে জনি প্রিন্ট শাড়ির এ্যাড দেখার জন্যও বসে থাকি। সেই সময় একদিন হঠাৎ বিটিভি ছাড়তেই দেখি এক টিঙটিঙে বুড়ো গান গাইছে- চুপ, চুপ,চুপ, অনামিকা চুপ। বুঝা যাচ্ছে গলা খুব একটা ভাল অবস্থায় নেই। কে এই বুড়ো আর কোথায় তার অনামিকা সেটা বোঝার আগেই শেষ হয়ে গেল গানটা। এরপর আরেকদিন রাতের ইংরেজী সংবাদের পর গানটা আবার শুরু হল- চুপ,চুপ,চুপ, অনামিকা চুপ। তবে এইবার আমি একা না আমার সাথে আমার পিতাজানও উপস্থিত। টিভির পর্দায় গায়ক কে দেখে এবং গান শুনে তিনি কিঞ্চিৎ উত্তেজিত এবং সম্পূর্ণ নষ্টালজিক হয়ে গেলেন। পিতাজানের উত্তেজনা দেখে আমি গায়কের গলার অবস্থা নিয়ে কিঞ্চিৎ সন্দেহ প্রকাশের চেষ্টা করলাম কিন্তু পিতাজান ধমক দিয়ে বললেন- চুপ কর, তোরা আজম খানের আসল গলা শুনস নাই। অসুখে অসুখে সেই আগের গলা নাই। এই প্রথম আমি জানলাম এই টিঙটিঙে গায়কের নাম আজম খান যার গান স্বাধীনতার পর আর হাজার যুবকের মত আমার পিতাজানকেও নাড়া দিয়েছিল। আর সেই প্রথম টের পেয়েছিলাম আজম খান আজও অনেক কে নষ্টালজিক করে দিতে পারে।

এত সুন্দর দুনিয়াঃ

আজম খানের শুরু কোথা থেকে? জন্মমৃত্যুর হিসেবে আজিমপুর কলোনি, ১৯৫০। স্কুল, কলেজ আর বেড়ে উঠা আজিমপুরেই কিন্তু জীবনের স্বর্ণযুগটা কাটিয়েছেন কমলাপুর। আর গানের গানের জগতে শুরু ধরলে ৬৯ এর গণঅভ্যুথানের সময় “ক্রান্তি” শিল্পী গোষ্ঠীর সাথে। স্বাধীনতার পর চারদিকে যখন নতুন করে সব কিছু শুরু করবার জোয়ার তখন শুরু করলেন পপ মিউজিক। চার বন্ধু মিলে শুরু হল ব্যান্ড দল “উচ্চারণ”। টিভির পর্দায় প্রথম আসলেন ১৯৭২ সালে। “এত সুন্দর দুনিয়া” আর “চার কলেমা সাক্ষী দিবে” গান নিয়ে। এরপর আবার ১৯৭৪ সাল। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সপ্তডিঙ্গা অনুষ্ঠানে “ওরে সালেকা, ওরে মালেকা” দিয়ে আবার সাড়া ফেললেন চারিদিকে। তারপর একে একে “আলাল ও দুলাল” “অভিমানী” “আসিআসি” কিংবা “বাংলাদেশ”।

আলাল ও দুলাল

ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে ইন্ডিয়ান চ্যানেল গুলোর দেখাদেখি টিভিতে আসল ক্লোজ আপ ওয়ান বাংলাদেশ। সেখানে ব্যান্ড পর্বে এক প্রতিযোগী গাইল রেনেসা ব্যান্ডের এক গান- আলাল ও দুলাল… চাংখার পুলে প্যাডেল মেরে এখনো কী তোরা হারাস দূরে। রেনেসা ব্যান্ডকে এমনিতেই ভাল পাই। তাদের এই গান আগে শোনা ছিল না তাই এটা সেই প্রতিযোগীর মুখে শুনে ভালই লাগল। পরের দিন এক বন্ধুকে আলাল ও দুলাল গানের কথা বলতে সে বলে- আরে ব্যাটা এটা তো আজম খানের গান। কিন্তু আমি ডাউট দিই। এটা কেমনে সম্ভব। প্রতিযোগী গান গাওয়ার সময় তো লেখা উঠল মূল গান রেনেসা। সে সময় তো আর ঘরে নেট নাই যে খোজার জন্য গুগল সাহেবের সাহায্য নিব তাই দুই জনের তর্ক চলতে থাকল টানা কয়েকদিন। বন্ধু নানা প্রমাণ হাজির করে কিন্তু আমি যে নিজের চোখে লেখা দেখলাম তাকে অবিশ্বাস করি কেমনে? এর পর গান নিয়ে ভাল আইডিয়া আছে এমন আরেকজন সমাধান করল এই তর্কের, আজম খান আর রেনেসা দুই জনেরই গান আছে আলাল ও দুলাল কে নিয়ে। এর পরের প্রশ্নের উত্তর অবশ্য সে দিতে পারে নাই। কেন আলাল আর দুলাল কে নিয়ে এই দুই বিখ্যাত ব্যাক্তি/দল গান লিখতে গেল? এর উত্তর অবশ্য আমি পেলাম আর পরে টিভিতে এক সাক্ষাতকার অনুষ্ঠানে।

রেনেসার নকীব খান এক চ্যানেলে সাক্ষাতাকার ভিত্তিক এক অনুষ্ঠানে আমার ধোয়াশা পরিষ্কার করলেন। সত্তরের দশকের আজম খানের সেই তালমাতাল করা গান “আলাল আর দুলাল” তাদেরো নাড়া দিয়েছিল সেই সময়। তার বিশ বছর পর তারা ঠিক করলেন এই গানে একটা সিকুয়েল করবেন। আজম খানের গানে আলাল আর দুলাল কে তাদের বাবা হাজী চান খুজে বেড়ায় চাংখার পুলে প্যাডেল মেরে। রেনেসা তাদের গানে প্রশ্ন করল এত বছর পর আলাল আর দুলাল যখন বড় হয়ে গেছে তখনো কী তারা চাংখার পুলে প্যাডেল মেরে ঘুরে বেড়ায়, তারা কি এখনো দূরে হারায়? সম্ভবত এইভাবেই তৈরি হল প্রথম কোন বাংলা গানের সিকুয়েল তাও অন্য আরেক ব্যান্ডের হাতে। এইখানেও আজম খান ইতিহাস তৈরি করে গেলেন তার আলাল আর দুলাল কে সাথে নিয়ে।

বাংলাদেশ

আসিফ কে গায়ক হিসেবে যে আমি খুব উচ্চ মানের মনে করি তা না তবে এই লোকটার মুখে একবার গান শুনে আমি বলতে বাধ্য হলাম লোকটার গলা দারুণ। তখন আমরা কলেজে। কলেজের রিউনিয়নে গান গাইতে আসল আসিফ। প্রথমে তার পবন দাস বাউলের দিল কী দয়া হয় না গান এবং পরে আজম খানের বাংলাদেশ গানটা শুনে তার গলা সম্পর্কে ধারণা পাল্টাতে বাধ্য হলাম। সেই প্রথম আসিফের মাধ্যমেই আজম খানের বাংলাদেশ গানের সাথে পরিচয়। আসিফ যখন হায়রে হায় বাংলাদেশ বলে টানটা দিল কলেজ অডিটরিয়ামে তখন কেন যেন রেল লাইনের ধারের ঐ ছেলেটার জন্য আমার বুকও হা হা করে উঠল। সেই গানটা গাওয়ার পর আসিফ যখন আজম খান সম্পর্কে বলছিল তখন প্রথম জানলাম আজম খান শুধু একজন গায়ক নন সাথে মুক্তিযোদ্ধাও।

আজম খান ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে যাওয়ার আগে বাবা কে জানাতে গিয়েছিলেন যুদ্ধ যাত্রার কথা। বাবা বলেছিলেন- যুদ্ধে যাচ্ছিস ভাল কথা, কিন্তু দেশ স্বাধীন না করে ফিরতে পারবি না। ছেলে কথা রেখেছিল। ট্রেনিং নিয়েছেন দুই নম্বর সেক্টরে মেলাঘরে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন খালেদ মোশারফ। সহযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন শহীদ রুমি যার হাতেই প্রথম অস্ত্রের হাতেখড়ি। যুদ্ধ করলেন কুমিল্লার সালদা, ঢাকার যাত্রাবাড়ি, গুলশান এলাকায়। ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সেকশন কমান্ডার। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তার শ্রবণশক্তি। যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল একাত্তরেই কিন্তু সব স্বপ্ন হয়ত পূরণ হয় নি হয়তো তাই তার কন্ঠে হাহাকার হয়ে বেজে উঠে- হায়রে হায় বাংলাদেশ।

আসি আসি বলে তুমি আর এলে না

গতকাল সকালে যখন প্রথম শুনলাম আজম খান মারা গেছেন তখন বাসায় ছিলাম, খবরটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য টিভির চ্যানেল গুলোর নিউজ স্ক্রল দেখতে দেখতে বাংলাভিশনে দেখলাম আজম খানের এক পুরানো সাক্ষাতকার অনুষ্ঠান দেখানো হচ্ছে। অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা অপি করিম আজম খানের গান, তার গানের নানা ইতিহাস নিয়ে কথা বলছিলেন। আজম খানও বলছিলেন তার বিভিন্ন গানের পিছনের ইতিহাস। আজম খানের তখন উত্থান কাল চলছে, সেই সময় এক বালিকা তার প্রেমে পরেছিল এবং পৃথিবীর অধিকাংশ প্রেম কাহিনীর মত এটাও একটা ব্যার্থ কাহিনী। আর ঠিক সেই সময় তৈরি হয় তার বিখ্যাত গান আসি আসি বলে তুমি আর এলে না। কথাটা শুনতে শুনতেই ভাবছিলাম হয়ত প্রত্যেকটা গানের পিছনেই এমন গল্প লুকানো থাকে। আমরা সেই গল্প গুলো না জেনেই হয়ত হেডফোনে গান শুনি, মাথা দুলাই আর গল্প গুলো চাপা পড়ে গানের আড়ালে।

চার কলেমা সাক্ষী দিবে

বেশি দিন আগের কথা না আমরা ক্লাস ফোর ফাইভে থাকতেই ব্যান্ডের গান বা পপ গান মানে একদল আজেবাজে ছেলের অসংস্কৃত চিৎকার। এখন অবস্থা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে না গেলেও অনেক ভাল। এইসব দেখে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না প্রায় চল্লিশ বছর আগে আজম খানেরা যখন শুরু করেছিলেন তখন অবস্থা কতটা প্রতিকূল ছিল। সেই প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শুরু করেছিলেন বলেই হয়ত আজ ব্যান্ডের একটা শক্ত ধারা বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে। আর কিছু না হোক শুধু এই জন্য হলেও ইতিহাসে আজম খান সারা জীবন থেকে যাবেন গুরু হিসেবে।

অভিমানী

স্বাধীনতার সময়কার এবং তার পরের অনেক কিংবদন্তী চলে যাচ্ছেন আস্তে আস্তে। অনেক সময় আজম খানের মত অর্থাভাবে পূর্ণ চিকিতসা না করাতে পেরে। আমাদের রাষ্ট্রে হয়ত জীবিতদের থেকে মৃতদের সম্মান বেশি তাই একমাত্র মৃত্যুর পর সম্মান জানায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিরোধীদলীয় নেত্রী। আমরা পেপারে, ব্লগে এলিজি লিখি। হয়ত তার অনেক গল্প, কীর্তি আগামী কিছুদিন আমাদের আড্ডায় চায়ের কাপের সাথে অবস্থান করে নিবে। এইসব আড্ডায় হয়ত প্রশ্ন উঠবে তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি কোনটা। এই প্রশ্নের উত্তরে আমি গতকাল এক ব্লগে সবজান্তা ভাইয়ের করা মন্তব্যই খালি আবার বলতে পারি- গান তো অনেকেই গাইতে পারে কিন্তু যুদ্ধ করে কতজন?

তথ্যসূত্রঃ

১। উইকিপিডিয়ায় আজম খানের উপর ভুক্তি
২। আমি যুদ্ধ শেষ করতে পারিনিঃ আজম খান

৩। আজম খানের মুক্তিযুদ্ধ

২,৩৯৩ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “আজম খান”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    আজম খানের জীবনযাপনের ধারা আমাদের কে যদি অনুপ্রানিত করতো!
    বাংলা পপ গানের পথিকৃত, মুক্তিযোদ্ধা, সেলিব্রেটি, এ সব পরিচয় সরিয়ে সে জীপনযাপন করেছে একদম সাধারন মানুষ হিসেবে... কোন অহংকার , অহমিকা তো ছিলই না, কোন কিছু প্রাপ্তির আশাও সে করেনি। আর আমরা একটুতেই 'আমি কি হনু রে' ভাব দেখানো শুরু করি আর এই পোড়ার দেশে থেকে আমাদের কিছুই হলো না, দেশ আমাদের কিছুই দিল না এধরনের চিন্তায় রাত দিন পার করি।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. আহমদ (৮৮-৯৪)

    আমরা কলেজে থাকতে আজম খানের গান বেশ হিট ছিল। বিশেষ করে "সালেকা মালেকা"। "বাংলাদেশ" গানটার তুলনা হয় না। "অভিমানী" গানটাও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।


    চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

    জবাব দিন
  3. সাইফুল (৯২-৯৮)

    আরেকটু লিখতে রাশেদ! ভাল লাগছিল পড়তে।

    গুরু যেখানে থাকতেন তার অনেক কাছাকাছি আমাদের বাসা ছিল এক সময়ে। এত সাধারণ জীবনযাপন করতেন, কেউ না দেখলে বিশ্বাস করবেনা।

    দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, দেশের তরুণদেরকে স্বপ্ন দেখতে শিখেয়েছেন, সারা জীবন দেশকে ভালবেসে গেছেন, আর আমরা তার ঠিকমত চিকিৎসা দিতে পারলাম না, আমরা যে আসলে কি, মাঝে মাঝে এই প্রশ্ন আসে মনে।

    গুরু তুমি থাকবে আমাদের মনে আজীবন। ::salute::

    জবাব দিন
  4. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    আজম খানের গান ভালো লাগে। তাঁর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টিও অনেক বড়।
    সব কিছু ছাড়ি্য়ে তার যে দিকটা আমার ভালো লাগে সেটা হলো তার সাদাসিদে জীবন আচরি। অথচ আজকের যুগে একটু পাবলিক প্রিরতা পেয়ে সেলিব্রেটি হলেও ধরাকে সরা জ্ঞান করে অনেকে। অনেকে আবার মুক্তি যুদ্ধ না করেও সার্রটিফিকেট পাওয়ার ইউস করে। তার মাঝেই খ্যাতির প্রতি নির্মোহ চিরতরুণ গুরুর জীবন আমাদের কাছে শিক্ষণীয়। তিনি শুধু একজন গায়ক কিংবা মুক্তিযোদ্ধা নন একজন অনেক বড় মাপের মানুষ।
    গুরু তোমাকে সালাম।
    যতদিন বাংলা ভাষা টিকে থাকবে তোমার নাম উচ্চারিত হবে সবার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে।

    জবাব দিন
  5. লিরা'৯৯

    ভাল লাগল :thumbup:


    বারে বারে বাঁধ ভাঙিয়া বন্যা ছুটেছে
    দারুণ দিনে দিকে দিকে কান্না উঠেছে
    ওগো রুদ্র, দুঃখে সুখে এই কথাটি বাজল বুকে
    তোমার প্রেমে আঘাত আছে, নাইকো অবহেলা
    নয় নয় নয়, এ মধুর খেলা
    তোমায় আমায় সারা জীবন
    সকাল সন্ধ্যা-বেলা ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কামরুলতপু (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।