একজন শেখ আহমেদ জালাল এবং মুক্তিযুদ্ধের এক তথ্য ভান্ডার

একটা দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গূরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তাদের স্বাধীনতার ইতিহাস। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এই ইতিহাস সংরক্ষণের দ্বায়িত্ব সাধারণত প্রত্যেক রাষ্ট্রেই নেয় সরকার কিন্তু আমাদের দেশ যেন এক উলটো রাজার দেশ। তাই এদেশের পাঠ্য বইয়ে স্বাধীনতার ইতিহাস পরিবর্তন হয় প্রতি পাঁচ বছর পর পর, জাতীয় পতাকা উড়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের গাড়িতে। প্রায়া আড়াইশ বছর আগে স্বাধীন হওয়া যুক্তরাষ্ট্র যেখানে তাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লিখতে ব্যবহৃত কলম পর্যন্ত সংরক্ষণ করে তখন চল্লিশ বছর আগে স্বাধীন হওয়া আমাদের জাতীয় আর্কাইভ থেকে অযত্নে, অবহেলায় নষ্ট হয়ে যায় মুজিব নগর সরকারের গূ্রুত্বপূর্ণ দলিল। আর তাই জাতীয় ইতিহাস সংরক্ষণে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার জন্য এগিয়ে আসতে হয় একজন শেখ আহমেদ জালাল, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কিংবা এ প্রজন্মের কয়েকজন তরুণ কে।

শেখ আহমেদ জালাল, পেশাগত জীবনে যিনি ছিলেন একজন কূটনৈতিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি অবস্থান করছিলেন জাপানে। সেখানে থেকেই তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মুজিব নগর সরকারের হয়ে জাপানী জনগণের মধ্যে প্রচারণার কাজে অংশ নেন। যেহেতু তখনো জাপানী সরকার বাংলাদেশ কে স্বীকৃ্তি দেয় নি তাই ঝুকির মাঝে থেকেও তিনি নানা ভাবে এই কাজে অংশ নিয়েছিলেন। তবে এত কিছুর মাঝেও তিনি তথ্য সংরক্ষণের একটা কাজ চালিয়ে গেছেন যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে সত্যিকারে এক গূরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের উপর নানা গূরুত্বপূর্ণ দলিল সংগ্রহে রাখতে শুরু করেন।এর মধ্যে যেমন আছে পাকিস্তানি সরকারের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দূতাবাসের সাথে চালাচালি হওয়া চিঠির অনুলিপি তেমনি আছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকার বাংলাদেশের উপর ততকালীন ক্লিপিং। এভাবেই তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে গড়ে উঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ৩১ খন্ডের এক বিশাল সংগ্রহ।এই কাজটা কতটা দূরহ ছিল তা অনুমান করার জন্য শুধু একটা তথ্যই যথেষ্ঠ, সেটা হল তখন তিনি দেশ থেকে এতদূরে থেকেও দেশে প্রকাশিত পত্রিকার কাটিং সংগ্রহ করেছেন যা এখন সত্যিকার ভাবে এক দূর্লভ বস্তু। তার ইচ্ছে ছিল এইসব সংগ্রহের উপর ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধের উপর গবেষণামূলক কাজ করা কিন্তু ২০০৩ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যবরণ করায় তার সে ইচ্ছা আর পূরণ হয় নি। তবে তার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তার সমস্ত সংগ্রহ তার পরিবার দান করে দেয় মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের কাছে।

শেখ আহমেদ জালালের সংগ্রহ গুলো সংরক্ষণের জন্য মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর ছিল অত্যন্ত উপযুক্ত একটা প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের ইতিহাস সংরক্ষণের ব্যর্থতা এড়িয়ে নতুন প্রজন্ম কে সঠিক ইতিহাস শিক্ষা দিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কিছু ব্যক্তির নিজস্ব উদ্যোগে গড়ে উঠে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। কিন্তু মনে রাখতে হবে এর নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা এই প্রতিষ্ঠানের আছে অর্থের সংকট, স্থানের সংকট। এইসব নানাবিধ কারণে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তার সংগ্রহশালার সব উপকরণ প্রদর্শনীর জন্য উন্মুক্ত করে দিতে পারে না। শেখ আহমেদ জালালের এই ব্যক্তিগত তথ্য ভান্ডারও ছিল এই অংশে। আর এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে শেখ আহমেদ জালালের তথ্য ভান্ডার উন্মুক্ত করে দিতে এগিয়ে আসে একদল তরুণ, যাদের প্রায় সবাই কোন না কোন ভাবে বাংলা ব্লগোস্ফিয়ারের সাথে জড়িত।

সামহয়্যারইন ব্লগের আদি প্রস্তর যুগ থেকেই আমরা দেখে এসেছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কে আঘাত করার প্রচেষ্টা। এইসব ক্ষেত্রে ছাগুদের প্রধান অস্ত্র ছিল তথ্য বিকৃ্তি। এইসব তথ্য বিকৃতি ঠেকাতে বাংলা ব্লগোস্ফিয়ারে নানা সময় নানা ভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এইরকম একটা প্রচেষ্টা ছিল “তথ্য সংরক্ষণ প্রকল্প প্রস্তাব” আর এই পোস্টের ভিত্তিতেই উইকিপিডিয়ার রাগিব ভাই প্রস্তাব করেন- “উইকিযুদ্ধ“। এই উইকিযুদ্ধ প্রস্তাবের ভিত্তিতেই একদল সেচ্ছাসেবক তরুণ যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সাথে। আর তখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের একজন ট্রাস্টি মফিদুল হক প্রস্তাব করেন উইকিযুদ্ধের যোদ্ধারা শেখ আহমেদ জালালের সংগ্রহীত তথ্য ভান্ডারের সংরক্ষণের জন্য একে ডিজিটালাইজেশন করতে পারেন এবং এর মাধ্যমে স্থান, অর্থ ইত্যাদি সংকট কে পাশ কাটিয়ে অতি সহজে এই তথ্য ভান্ডার সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে পারেন। আর এভাবেই শুরু হয় একদল ব্লগারের এই তথ্য ভান্ডার কে রক্ষার এক দারুণ প্রচেষ্টা। এই তথ্য ভান্ডারের অধিকাংশ উপকরণ ছিল কালের পরিক্রমায় জীর্ণ তাই সঠিক ভাবে একে ডিজিটালাইজেশন ছিল সত্যিই দূরহ। এর পরেও প্রায় এক বছরের স্বেচ্ছা শ্রম দিয়ে উইকিযোদ্ধারা দশ খন্ডের ডিজিটালাইজেশন সম্পন্ন করেন। প্রস্তুতকৃ্ত এই দশ খন্ডের ভিত্তিতেই এই মাসের ১২ তারিখ মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘর তাদের ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত করে “শেখ আহমেদ জালাল কালেকশন”।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন আমরা বিজয়ের আনন্দে ধরে নিয়ে্ছিলাম যুদ্ধ শেষ ঠিক তখন পরাজিত রাজাকার, আল-বদরেরা শুরু করেছিল নতুন এক যুদ্ধ তবে তা অতি সংগোপনে, নিঃশব্দে। এই যুদ্ধে তারা মূল মন্ত্র হিসেবে নিয়েছিল গোয়েবলসের সেই বিখ্যাত উক্তিকে- একটা মিথ্যা কে বার বার বল, একদিন সেটা সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। তাই তারা গত ৪০ বছর ধরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কে আঘাত করতে বার বার মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে, নতুন প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ধোয়াশা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। এই ধোয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে অনেক সময় আমরা নিজেরাই নিজেদের আঘাত করেছি, নিজেদের দূর্বল করেছি। কিন্তু এখন সময় হয়েছে ঘুরে দাড়াবার। এই ঘুড়ে দাড়ানোর পথে আমি গোয়েবলসের সেই বিখ্যাত উক্তিটি কে একটু ঘুরিয়ে বলতে চাই- সত্য কে উচুঁ করে ধর, বার বার বল। মিথ্যা পরাজিত হবেই। তাই আসুন এই বিজয় দিবসে আমরা সত্য কে আবার সামনে নিয়ে আসি, আমাদের ফেসবুকের স্ট্যাটাসে শেখ আহমেদ জালালের আর্কাইভের লিংক শেয়ার করি। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চেতনার পরাজয় হবেই।

উইকিযোদ্ধাদের একাংশ

১। এই কার্যক্রম সম্পর্কে আর বিস্তারিত আছে এখানে
২। শেখ আহমেদ জালাল কালেকশনের লিংক ( http://archives.liberationwarmuseum.org/sa-jalal-collection/volume-1)

৩,৫২৮ বার দেখা হয়েছে

৩০ টি মন্তব্য : “একজন শেখ আহমেদ জালাল এবং মুক্তিযুদ্ধের এক তথ্য ভান্ডার”

  1. রাশেদ (৯৯-০৫)

    উপরের ছবিটা আর্কাইভ প্রকাশের দিন উইকিযোদ্ধাদের একাংশের। বার বার চেষ্টা করেও ছবির নিচে ক্যাপশন দিতে পারছি না তাই মন্তব্যে দিলাম।


    মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

    জবাব দিন
  2. সাবিহা জিতু (১৯৯৩-১৯৯৯)

    তথ্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, রেশাদ। যে উদ্যেগের কথা জানালি সেটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীও। তার অর্থ হচ্ছে সদিচ্ছা এখনো আমাদের কারো কারো ভিতর আছে যেখানে আমরা চাইলে অনেক সীমাবদ্ধতা পেরুতে পারি।


    You cannot hangout with negative people and expect a positive life.

    জবাব দিন
  3. তানভীর (০২-০৮)

    লেখার জন্য :thumbup:
    ৭১ কারো দয়ার দান নয়... দেশটা আমাদের -- সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবো আমরাই... রক্ত দিয়ে বিজয় কিনেছি পরাধীনতার প্যাঁকেট মোড়ানো স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য না... একাত্তর-এর স্বাধীনতা বিরোধী থেকে শুরু করে এখনকার সার্বভৌমত্ব বিরোধী পর্যন্ত সব রাজাকার এবং দালাল'দের (পাক এবং ভারতীয়) বিচার চাই..

    জবাব দিন
  4. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    যারা এইকাজে নিরলস শ্রম দিয়ে এই শ্রমঘন কাজটা শেষ করেছেন তাদের সবাইকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম। এই কাজ বড়-ছোট সবার মাঝে একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাক এই কামনা করি, অনুপ্রেরনার উৎস হয়ে উঠুক সবার।

    আর যারা গলাবাজি নিয়ে ব্যস্ত, তারাও বুঝতে শিখুক, "কাজ" কিভাবে করতে হয়। আমি এই কাজে সম্পৃক্ত হতে পারিনি, এটা আমার দূর্ভাগ্য।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  5. রাব্বী (৯২-৯৮)

    খুব ভাল একটা কাজ হয়েছে, রাশেদ। যারা এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিল সবাইকে সাধুবাদ। কাজটি আসলেই খুব বড় মাপের হয়েছে। লেখাটাও যথারীতি দারুন হয়েছে।

    সচলের এই সংক্রান্ত পোষ্টটা মনযোগ দিয়ে পড়িনি। এই পোষ্টের নামটা দেখে এবং তারপর ভিতরে লেখা দেখে বুঝতে পারলাম যে শেখ আহমেদ জালাল সিলভিয়া আপার বাবা। সিলভিয়া আপারা আসলে এসব ডকুমেন্ট ডিজিটালাইজ এবং উন্মুক্ত করা হচ্ছে তা জানতেন না। উনি তোমার লেখা পড়েছেন, বিষয়টি জেনেছেন। তোমাকে এবং সবাইকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এই পোষ্টে হয়তো পরে উনি কমেন্ট করবেন।


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন
      • রাব্বী (৯২-৯৮)

        ফয়েজ ভাই, অস্পষ্টতা আমার লেখার কারণে হয়েছে। সিসিবি'র রকিব আর মইন ছাড়া মনেহয় ওনাকে কেউ চেনে না। সিলভিয়া আপার পুরো নাম সিলভিয়া জালাল। শেখ আহমেদ জালালের বড় মেয়ে। উনি কানাডিয়ান সিডাতে চাকরি করেন। আর ওনার হাসবেন্ড নাসিম ভাই এসসিসি'র এক্স-ক্যাডেট। ওনার বাবা মারা যাবার পর উনি এবং ওনার ভাই বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী সব ভলিউমগুলো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে দিয়েছিলেন। সেটার এখন একটা যথাযথ সংরক্ষন এবং ব্যবহার হচ্ছে।


        আমার বন্ধুয়া বিহনে

        জবাব দিন
  6. Amar bangla font kaaj korche na, tai ei bhabey likhchi, sorry.
    Amar naam Faisal Jalal. I am very proud to be the son of Sheikh Ahmed Jalal. Amar abbar iccha chilo tar collection shobai portay parbey ebong poray shiktey parbey 1971 er bepare. Apnara jara Abbur bepar likheychen ebong support diyechen, apnader shobai kay onek dhonnobad. We are very humbled by your support. Liberation War Museum is a very important institution of the nation and I am happy to have been able to support it this way.
    Abbu amader kay shikhiyechilen how to give back to the nation and I hope we all continue to do this.
    Faisal

    জবাব দিন
    • রাশেদ (৯৯-০৫)

      খুব ভাল লাগল আপনার মন্তব্য পেয়ে। আপনার বাবা যে অবদান রেখে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে আশা করি আমাদের এই প্রজন্ম তার থেকে বুঝতে পারবে স্বদিচ্ছা থাকলে অনেক সীমাবদ্ধতাই অতিক্রম করা সম্ভব 🙂


      মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

      জবাব দিন
  7. নঈম (৮৭-৯৩)

    অসাধারণ কাজ। ধন্যবাদ সংশ্লিষ্ট সবাইকে। করার আছে অনেক কিছু। আপাততঃ ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিঙ্কটি শেয়ার করলাম। খুব শীঘ্রই সকল পর্যায়ে শেয়ার করবো, ইনশাআল্লাহ। আমাদের মতো নগণ্যরা আর কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারি, তা জানতে চাই।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাব্বী (১৯৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।