পাঠকের ডায়েরিঃ একজন শহীদুল জহির এবং জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার গল্প

আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা লেখকদের চিনতে বড় দেরি করে ফেলি। ঘড়ির কাটা ঘুরে, সময় যায় কিন্তু সময়ের স্রোতে আমরা আসল লোকদের চিনতে বড় দেরি করে ফেলি। আমরা শুধু বাজার কাটতি লেখকদের চিনি আর চিনি টিভি নাটকের লেখকদের। তারপরেও আমরা নিজেদের পাঠক বলি। তাই সামান্য কিছু পাঠকগন্ডি পেরিয়ে একজন শহীদুল জহির কিংবা মাহমুদুল হকের সাথে আমাদের পরিচিত হতে অনেক দিন লাগে। কে জানি একবার বলেছিল সত্যিকার লেখকেরা একসময় না একসময় বেরিয়ে আসে তাই মৃত্যুর পরে হলেও তাদের লেখা ডানা মেলে।

শহীদুল জহিরের স্মরণে ছোটপত্রিকা শালুক বিশেষ সংখ্যা বের করেছিল। আজিজের অলিতে গলিতে হাঠতে হাঠতে একদিন সেটা হস্তগত হয়। সেখানে শহীদুল জহিরের উপর লেখা এবং শহীদুল জহিরের লেখা উভয়ের সংমিশ্রণ আছে। এই সংখ্যার শেষে আছে শহীদুল জহিরের একটা নাতিদীর্ঘ উপন্যাস- ” জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার গল্প”।

উপন্যাসের শুরু হয় এক যুবক আবদুল মজিদ আর ছেঁড়া স্যান্ডেল দিয়ে। রায়সা বাজারে যাওয়ার পথে কারকুন বাড়ি লেন থেকে নবাবপুর সড়কে উঠতেই তার স্যান্ডেল ছিড়ে যায়। ছিড়ে যাওয়া স্যান্ডেল, উড়ন্ত উইপোকাদের হত্যাযজ্ঞ এবং ঠিক তখন আবুল খায়েরের ধন্যবাদ জ্ঞাপন এইসব মিলিয়ে উপন্যাসের শুরু। তিনটি আলাদা আলাদা ঘটনা- ছিড়ে যাওয়া স্যান্ডেল, উইপোকাদের হত্যাযজ্ঞ এবং আবুল খায়েরের ধন্যবাদ জ্ঞাপন। আপাত দৃষ্টিতে একটি নিরীহ পরষ্পর সম্পর্কহীন তিনটি ঘটনা দিয়েই উপন্যাসের শুরু কিন্তু উপন্যাসের ঘটনা বিস্তার যত প্রবল হয় ততই পরিষ্কার হয় তাদের অর্ন্তনিহিত সম্পর্ক। এই সম্পর্ক আর পরিষ্কার করতে উঠে আসে লক্ষীবাজারের সেই মহল্লা, মহল্লার লোকজন, বদু মাওলানা, মহল্লার সবচাইতে প্রাচীন মুসলিম পরিবারের প্রধান খাজা আহমেদ আলী, আজিজ পাঠান, আবদুল গণি, মোমেনা এবং আর অনেকে। সেই সাথে আর আসে ৭১। প্রবল তবে অনুচ্চারিত একাত্তর।

উপন্যাসটির শুরু এবং শেষ দু-টোই সময় কে উল্ল্যখ করে। যুবক আবদুল মজিদের স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায় ঊনিশো পঁচাশি সনে এবং উপন্যাসের সমাপ্তি টানা হয় ঊনিশো ছিয়াশি সনে। তবে এই স্বল্প সময়টুকু উপন্যাসের বর্ণনার উপজীব্য নয় বরং উপন্যাসের গল্প চলে একাত্তর কে ঘিরে, একাত্তরে লক্কীবাজারের লোকদের ঘিরে। তাই উপন্যাসে উঠে আসে বদু মাওলানার মহল্লার ছাদে “কাওয়া” উড়ানোর গল্প, মিলিটারি আসার গল্প, ইসমাইল হাজেমের অভিভূত দৃষ্টি কিংবা আবদুল গণির উক্তি- এ্যামনে এইটা শেষ হইল। হ্যা, ঠিক আবদুল গণির কথা মতই তখন অনেক কিছুই এ্যামনেই শেষ হয়ে যায় কারণ সেটা ছিল একাত্তর।

তবে এ উপন্যাসে বর্তমান সময়ের অনুপস্থিতি থাকলেও সত্যিই কি তা অনুচ্চারিত থাকে? হয়ত থাকে না। তাইতো আবুল খায়ের ধন্যবাদ জানায়, মজিদের সন্তানের নাম হয় মোমেনা কিংবা বদু মাওলানা শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে- “বইনরে ভুলো নাইকা?” বর্তমান উপন্যাসে বিস্তারিত না আসলেও হারায় না কারণ অতীতের উপরর ভর করেই বর্তমান দাঁড়ায়।

এই উপন্যাসের একটা চমৎকার জিনিস হচ্ছে লেখক এখানে রাজনীতি কে সুক্ষ ব্যাঙ্গ করতে ছাড়েন না। তাইতো আমরা দেখি বদু মাওলানা আর আজিজ পাঠান একদিন বন্ধু হয়ে যায়। আজিজ পাঠান আবদুল মজিদ কে জানায় রাজনীতিতে চিরস্থায়ী বন্ধু বা শত্রু বলে কিছু নেই কিংবা বদু মাওলানা একদিন মহল্লার লোকদের জানায় মানীর মান শুধু আরেকজন মানীই রাখতে জানে। হয়ত এই সবের সবই সত্য তাই মহল্লায় আবার বদু মাওলানা আবার তার স্কার্ফ গলায় ঝুলিয়ে হেটে বেড়ায়। কিন্তু কেউ কিছু বলে না কারণ সবাই এখানে দর্শক, শুধুই দর্শক।

এই উপন্যাসের আরেকটা দারুণ জিনিস হচ্ছে তার বর্ণনারীতি। কারণ এই উপন্যাসের বেশির ভাগই বর্ণনা করা হয় সামষ্টিক দৃষ্টি থেকে। তাই অনেক সময় কথক হয়ে উঠে লক্ষীবাজার মহল্লার লোকজন। তারাই সামষ্টিক ভাবে জানান দেয় মহল্লায় মিলিটারি আগমনের, মৃত্যুর কিংবা শোকের। আর এই রীতির মজা হচ্ছে সামষ্টিক বাস্তবতা কে এখানে তুলে আনা যায় সহজেই।

মুক্তিযুদ্ধের উপর আমাদের রচিত বেশির ভাগ সাহিত্যের উপর পাঠক হিসেবে আমার মত এদের বেশির ভাগেই আবেগের যত ব্যবহার আছে সাহিত্যিক সুক্ষতার ততই অনুপস্থিতি। একটা যুদ্ধ মানেই অস্ত্র নয়, রক্ত নয়, হত্যা নয়। এদের সাথেই থাকে মানুষ, তার হিংসা,লোভ,ক্রোধ,ভালবাসা,মায়া নিয়ে। এই যুদ্ধের কত গল্পই তো আমরা শোনাতে পারি। কিন্তু সবাই আবেগের জায়গা থেকে বের হয়ে এসে সঠিক গল্প শোনাতে পারে না, সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু শহীদুল জহির পেরেছিলেন। আর পেরেছিলেন বলেই হাসান আজিজুল হক এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর মত শক্তিমান লেখকেরা “জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা” কে শক্তিশালী উপন্যাস বলতে বাধ্য হন।

২,৯৫৩ বার দেখা হয়েছে

২৬ টি মন্তব্য : “পাঠকের ডায়েরিঃ একজন শহীদুল জহির এবং জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার গল্প”

      • আন্দালিব (৯৬-০২)

        এইবারের বইমেলায় আমার লক্ষ্যই ছিলো শহীদুল জহির। গতবার ছিলো কায়েস আহমেদ। ঠিক করেছি বাংলা ভাষার তথাকথিত 'জনপ্রিয়' লেখকদের লেখা আর পড়বো না। বেছে বেছে, খুঁজে খুঁজে মনমতো লেখক বের করবো, স্টলে দাঁড়িয়ে বই পড়ে ভালো লাগলেই খালি সেইটা কিনবো।

        তো, শহীদুল জহির কিনে আমি ঠকি নাই। আমার অনেক উপকারই করেছেন উনি। যেভাবে হাসান আজিজুল হক উপকার করেন পাঠকের। বা অনেকের কাছে কায়েস আহমেদও উপকারী হতে পারেন, ঠিক সেভাবে।

        শহীদুল জহির পাঠ বা আলোচনার সমস্যা হলো তাঁকে ঘিরে তৈরি হওয়া অনুভূতিগুলোর বৈচিত্র্যতা, বিভিন্নতা এবং সেই বিভিন্নতাকে প্রকাশে পাঠকের অক্ষমতা! এর থেকে কোন নিস্তার নাই। তাই তোমার মতো সাহস করে লিখতে পারি নাই ঠিক কেমন লেগেছে।

        "আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু" বইটা কি পড়েছো? সেটা নিয়েও একটা লেখা লিখতে পারো। এই রিভিউটা একটু সংক্ষিপ্ত লাগলেও উদ্যোগটাকে সাধুবাদ জানাই! : 😀

        জবাব দিন
        • রাশেদ (৯৯-০৫)

          আমি অনেক আগে থেকেই নাম দেখ বই কিনা ছেড়ে দিয়েছি 😀 নাহ আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু পড়া হয় নায়। সেহেরীর একটু আগ লিখা শুরু করছিলাম, দেখলাম সেহেরির সময় শেষ হয়ে আসছে তাই তাড়াতাড়ি লেখাই শেষ করে ফেললাম 🙂


          মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

          জবাব দিন
        • আন্দালিব ভাই,

          "এইবারের বইমেলায় আমার লক্ষ্যই ছিলো শহীদুল জহির। গতবার ছিলো কায়েস আহমেদ। ঠিক করেছি বাংলা ভাষার তথাকথিত ‘জনপ্রিয়’ লেখকদের লেখা........"

          ভালো লেগেছে। আমিও পড়ার প্রতি আগ্রহ অনুভব করছি ইদানিং আমার সহধর্মীনির সাহচর্যে থেকে। আপনার কাছে আমার অনুরোধ কায়েস আহমেদ সম্মন্দ্ধে আমাকে জানতে সাহায্য করুন। আমাকে কিছু রেফারেন্স দিন। আমার ইমেইল : mahbubnbl@gmail.com অথবা mahbubnbl@yahoo.com

          ধন্যবাদ
          মীর মাহবুব

          জবাব দিন
  1. রাজীউর রহমান (১৯৯৯ - ২০০৫)

    শহীদুল জহিরের বৈশিষ্টপূর্ণ একঘেয়ে বর্ণনারীতি, ... পড়তে পড়তে মনে হয় জমে যাই। এই উপন্যাসটি বহুমাত্রিক । পুরান ঢাকার মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়গুলো সম্পর্কে আগে পড়িই নি। যুদ্ধের ভহাবহতা কিভাবে মানুষের হৃদয়ে আচড় কাটে সেই দিকটি তিনি অসাধারন নৈপূন্যে তুলে এনেছেন।

    আর আমার কাছে রাজনীতি কে ব্যাঙ্গ করার ব্যাপারটি মোটেই সুক্ষ লাগে নি, বেশ তীব্রই বোধ হয়েছে। একেবারে সাধারন জনতার অসহায়ত্বকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন।

    পাঠপুনঃদর্শন ভাল লেগেছে।

    আরিফুল হোসেন তুহিন (মকক ৯৯-০৫) কে বিশেষ ধন্যবাদ যে আমাকে শহীদুল জহির পড়তে সুপারিশ করেছিল।

    জবাব দিন
    • রাশেদ (৯৯-০৫)

      হুম, রায়সা বাজার, লক্ষীবাজার, ভূতের গলি, ভজহরি স্ট্রিট এইসবই শহীদুল জহিরের রচনায় বারবার এসেছে। আর সুক্ষ বললাম কারণ রাজনীতি কে ব্যাঙ্গ করার জন্য বইয়ে কয়েকটা বাক্যের আঁচড়ই যথেষ্ট। আরিফুল হোসেন তুহিন বলায় প্রথমে চিনি নাই পরে বুঝলাম এইটা খালি তুহিন দ্যা হাসের বাচ্চা 🙂


      মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

      জবাব দিন
      • আমিন (১৯৯৬-২০০২)

        না এইটা হাঁসের বাচ্চা না। এইটা হইলো হোসেন.........।
        তোমার এই পোস্ট টা আগেই দেখছিলাম। এই উপন্যাস অর্ধেক পড়ছি। পুরাটা পড়া হয় নাই সময়ের অভাবে। আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু উপন্যাসটাও দারুণ। অবশ্য ঐটারে ঠিক উপন্যাস না বলে বড় গল্প বলতে হয়। আর আরো কিছু ছোট গল্পও পড়লাম জহির সাহেবের। বর্ণনা ভঙ্গির মায়াবিত্বের জন্য একসেপশনাল মনে হইছে....।

        জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    ছোট গল্প পড়েছি তাও মনে নেই,
    উপন্যাস পাইনি হাতের কাছে।
    মনে ছিলো ধীরে ধীরে আবিষ্কার করবো।

    জানতামইনা মারা গেছেন তিনি।
    খুব খারাপ লাগছে।
    ইলিয়াসের প্রয়াণের পর অনেকদিন
    মন দিয়ে বাংলাদেশের গদ্য পড়িনি।
    এবার পড়তে হবে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জিহাদ (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।