মফস্বল সংবাদ

আমাদের এই ছোট্ট শহরে আমার মত যুবক বয়সী ছেলেপেলেদের আড্ডা দেওয়ার জায়গা আসলে তেমন একটা নেই। এই পাড়ার মুখে, ঐ পাড়ার চায়ের দোকানে কিংবা বালিকা স্কুলের রাস্তার উপর কালী মন্দিরের সামনে। এইসব জায়গায় অবশ্য বহু পোলাপাইন আড্ডা দেয় কিন্তু আমারা তেমন একটা জুত পাই না। আরে আড্ডা দিলে দিতে হয় দিল খুলে কিন্তু এইসব জায়গায় কি আর তার জো আছে? পাড়ার মুখে আড্ডা দিলে হাজারটা মুরব্বির সামনে পড়তে হয়। তাদের এই প্রশ্ন, সেই প্রশ্ন আর আমাদের হাজারটা কইফিয়ৎ। চায়ের দোকানের সামনে বসলে নির্ঘাত রংবাজ আর কালী মন্দিরের সামনে দাড়ালে বালিকাদের বাবাদের বিচার বাসায় পৌছাতে সপ্তা’খানেক সময় নিবে। তাই কলেজের পুকুর পাড়ের দক্ষিণ কোণের আম গাছ তলাটাই আমাদের ভরসা।

আমাদের গাছ তলার আড্ডার মধ্যে আজিজ হল মহাজ্ঞানী পাবলিক। দুনিয়ার সব বিষয়ে তার একটা মতামত আছে আর সেই কারণে আজকে যখন সকাল বেলা আমাদের মাথার উপর পেপার নাচাতে নাচাতে বলল- খবর শুনছস? আমরা তখন কেউ ব্যাপারটায় তেমন গা করলাম না। শুধু রেদয়ান বেটা একটু শয়তানী হাসি দিয়ে বলল- হ্যা, ওবামা যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সৈন্য সরায়ে নিতাছে ব্যাপারটা আমাদের জন্য খুব ইন্টারেস্টিং। কিন্তু আজিজ আমাদের অবাক করে দিয়ে বল- আরে ধূর, ওবামা-বুশের কথা রাখ। আরে এইটা তো পুরা কেলেংকারী ঘটনা। আমাদের মধ্যে শওকতের আবার কেলেংকারী ঘটনার দিকে নজর বেশী তাই ব্যাটা হ্যাচকা টান দিয়ে আজিজ কে পাশে বসিয়েই প্রশ্ন করল- কিরে ঘটনা কি? এইবার মহামতি আজিজের উত্তর- আরে ব্যাটারা, শরীফ স্যারের ঘটনা শুনছস? পেপার-টেপারে উঠে তো পুরা ব্যাড়া-ছেড়া অবস্থা।

এইবার আমরা আর পাত্তা না দিয়ে পারি না, সবাই নাড়াচাড়া দিয়ে উঠি। রেদয়ান মুখের সিগারেট সরিয়ে প্রশ্ন করে- কোন শরীফ স্যারের কথা কস? একটু বিরক্ত হয়ে আজিজের পালটা প্রশ্ন- এই শহরে আর কয়টা শরীফ স্যার আছে? আরে ব্যাটা বাঘা শরীফ। রেদয়ান আর আজিজের ক্যাচালে বিরক্ত হয়ে আমি তাড়া দেই- ঐ শালা আজিজের বাচ্চা, ঘটনা কি সেইটাই তাড়াতাড়ি বল। এইবার আজিজ আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বাম হাতের পেপারটা সামনে এগিয়ে দেয়। বাঘা শরীফের কেলেংকারীর খবর পড়ার জন্য আমরা সবাই তখন পেপারের উপর হুমড়ি খেয়ে পরি। রেদয়ানের মাথার উপর দিয়ে মারুফ কিংবা আমার কানের পাশ দিয়ে মাথা বের করে শওকত বাঘা শরীফের কাহিনী পড়ার জন্য চেষ্টা করতে থাকে। এইভাবে হুড়াহুড়ির মাঝে দেশের প্রধান দৈনিকের মফস্বল সংবাদের পাতায় চারকোণা বক্সের খবরটা পড়তে পড়তেই আমরা সবাই শান্ত হয়ে আসি কারণ এতটা অবাক আমরা কেও সম্ভবত অনেকদিন হই নি। অবাক বললে আসলে ভুল বলা হবে আমরা অনেকেই আসলে এই কথা টা বিশ্বাস করে উঠতে পারি নি। তাই রেদয়ান প্রশ্ন করে- এও কি সম্ভব?

আমাদের সবার মধ্যেই আসলে প্রশ্নটা ঘুরছিল, এও কি সম্ভব? তাই এই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচালে আমরা সবাই নিজেরা নিজেরা প্রশ্ন, পালটা প্রশ্ন করতে থাকি। আমরা প্রশ্ন করতে থাকি কারণ লোকটা আর কেউ নয় বাঘা শরীফ। আমাদের লক্ষীপুর ডিগ্রী কলেজের ৩০ বছরের প্রিন্সিপাল শরীফুর রহমান ওরফে বাঘা শরীফ। গত ত্রিশ বছরে এই কলেজের এমন কোন ছাত্র-ছাত্রী নাই যে কিনা বাঘা শরীফের হুংকার শুনে একবারের জন্যও কেঁপে উঠে নি। এমন একটা ইংরেজী ক্লাস নাই যেখানে কার না কারো দিকে খাতা ছুড়ে মেরে শরীফ স্যার বলে নাই- ঐ ব্যাটা গরু, তোকে রেখে আমার কলেজের সামনের ঐ মাঠে হাল চাষ করলেও অনেক লাভ হত। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে কারণ আমাদের মনে পরে যায় আমাদের বাপ-চাচাদের অনেকেই তার ছাত্র ছিল যারা কিনা এখনো এতদিন পর বাজারে, রাস্তায় বাঘা শরীফ কে দেখলে এক কোণায় সরে গিয়ে আস্তে করে সালাম দেয়। তাই আমরা আরেকবার খবরের কাগজের পাতায় সতর্ক দৃষ্টি দেই, চারকোণা বক্সের ভিতর থাকা খবরের মাঝে কোন ভুল হল কিনা তা বের করার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। ভিতরের কাল অক্ষর গুলো তাদের অস্তিতের সাথে আমাদের জানান দেয় ত্রিশ বছর ধরে এই শহরে কিংবা এই কলেজে বাঘা শরীফের রাজত্ব প্রায় শেষ হয়ে এল। তবু কেন জানি আমরা পরষ্পর কে প্রশ্ন করি- এও কি আসলে সম্ভব?

আমাদের মনে বাঘা শরীফের হুংকার এখন জলজ্যান্ত তাজা বলে আরাফাত হয়ত আমাদের হয়ে আর নিশ্চিত হতে চায়। তাই ব্যাটা আমাদের উদ্দেশ্য করেই হয়ত একটা প্রশ্ন ছুড়ে- আচ্ছা কলেজের নাম দিছে, ঘটনার বিবরণ দিছে কিন্তু কলেজের প্রিন্সিপালের তো নাম দেয় নায়, নাকি দিছে? খবরটা আরেক বার পড়তে পড়তেই রেদয়ান উত্তর দেয়- হু , দেয় নায়। আজিজ উত্তর দেয়- আরে লক্ষীপুর ডিগ্রী কলেজের প্রিন্সিপাল যে একজন আর সেইটা যে বাঘা শরীফ তা কি আর পত্রিকা পাতায় লেখা লাগে? এইটা তো একটা বাচ্চা ছেলেও জানে। এই রকম নানা কথা, পালটা কথার মাঝখানে আমরা আস্তে আস্তে বিশ্বাস করতে শুরু করি- সম্ভব, হয়ত ব্যাপারটা সম্ভব। তবে আমরা কেও সেইটা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চাই না কারণ আমাদের মনে তখনো একটা কথা ঘুরছিল- এও কি সম্ভব?

তবে আমাদের হয়ে উত্তর টা আসলে শওকত দেয়। শওকত সোজা সাপ্টা উত্তর দেয়- কেন সম্ভব নয়? হাজার হইলেও শরীফুর রহমান ওরফে বাঘা শরীফ একটা মানুষ। সেও আমাদের মত ভুল করতে পারে। আরে কত হাজার হাজার বড় বড় লোকের এই বয়সে এসেও এইসব ভুল করছে সেই খানে বাঘা শরীফের ব্যাপারটা অসম্ভব কিছু না। শওকতের কথার কোন উত্তর আমরা না দিলেও আমরা ওর কথাট ফেলতে পারি না। কারণ দেশের বড় বড় কবি সাহিত্যিকরা যেইখানে এই ভুল করছে সেইখানে শরীফ স্যারের পক্ষেও এই ভুল করা সম্ভব। আর শওকতের কথা তো আর ফেলে দেয়া যায় না, হাজার হলেও শালা এই সব গসিপের খবর ভালই রাখে। তাই আমরা একটু অবাক হয়ে চারকোণা বক্সের ভিতর বড় কাল হরফে লেখা ” কলেজের প্রিন্সিপাল কর্তৃক ছাত্রীর শ্লীলতাহানীর চেষ্টা” খবরের দিকে একটু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি।

আমাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই হঠাৎ করে ঢং ঢং করে কলেজের ঘন্টা আমাদের জানান দেয় বেলা এগারটা বাজে। আমরা সবাই নাড়াচাড়া দিয়ে উঠি, হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পাশের বই খাতা গুলো গুছানোর চেষ্টা করি কারণ এখন ইংরেজী ক্লাস, বাঘা শরীফের ক্লাস। পত্রিকার খবরও আমাদের মনে ক্লাস নিয়ে সন্দেহ জাগায় না কারণ হয়ত গত পরশু বাঘা শরীফের দেওয়া হুংকার আমাদের মনে এখনো জ্বলজ্যান্ত। তাই আমরা পুকুর পাড়ের পাশ দিয়ে হাটতে হাটতে কলেজ বিল্ডিঙ্গের ১১৬ নাম্বার রুমের দিকে এগিয়ে যাই। ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে আমরা আমাদের হাটা আর দ্রুত করি কারণ সোয়া এগারটা বাজলেই বাঘা শরীফ হুংকার দিয়ে বলবে- এই ক্লাসের সব দরজা বন্ধ করে দাও, এখন আর ক্লাসে কেও ঢুকবে না। তবে এগারটা দশে ক্লাসের সামনে এসে আমরা বুঝতে পারি আজ আর সাধারণ দশটা দিনের মত নয় কারণ কেও ক্লাসে শান্ত হয়ে বসার চেষ্টা করছে না, আজমল কে কে গোলমাল করছে সেইটা টুকে রাখার চেষ্টা করছে না। ছোট ছোট দলে দলে ভাল হয়ে ছেলে মেয়েরা আলোচনা করছে। কয়েক জনের হাতের মুঠোতে থাকা পত্রিকা আমাদের নজর এড়ায় না। আমরা বুঝতে পারি পত্রিকার খবরটা শুধু আমারা না আর অনেকের নজরে এসেছে। তাই বাকী সবার মত আমরাও অপেক্ষা করতে থাকি কখন বাঘা শরীফ আসে।

কিন্তু অপেক্ষা করতে করতেই আমরা বুঝে যাই আজকের দিনটা সম্ভবত গত ত্রিশ বছরের মধ্যে লক্ষীপুর ডিগ্রী কলেজে অন্যতম ব্যতিক্রম দিন। তাই শওকত কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে- আরে দূর, ক্লাস হইব না। আরে ব্যাটা এই রকম একটা নিউজের পর বাঘা শরীফের বাপেরও সাধ্য নাই পোলাপাইনের সামনা সামনি দাঁড়ায়। আর তাই অন্য সবার মত আমরাও বের হয়ে আসি ইতস্তত ভংগীতে, যেন ঠিক কী করা উচিত তা বুঝে উঠতে পারছি না। ইতস্তত হাঠতে হাঠতেই আমরা পাঁচ-ছয় জন পৌছে যাই শরীফের টঙ্গের দোকানের সামনে।

শরীফের দোকানের সামনেই আমরা ব্যাপারটার আসল উত্তাপ টের পাই। কারণ দোকানের কোণায় মিঠু ভাই হাত পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে ভাষণের স্টাইলে কথা বলে যাচ্ছে। আর মিঠু ভাই এইভাবে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ভাষণের স্টাইলে কথা বলা মানেই বিপদের লক্ষণ, গন্ডগোলের আলামত। কলেজের অনেকেই তাকে ঘিরে কথা শুনার চেষ্টা করতে থাকে এমন কী আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে নিরীহ ভালছেলে মাইনুদ্দীন কে পর্যন্ত দেখা যায় ভীড়ের মাঝে মাথা ঢুকিয়ে মিঠু ভাইয়ের কথা শুনায় ব্যস্ত। আজিজ সব দেখে বলে- ব্যাপার তো সুবিধার মনে হচ্ছে না। শওকত মাথা নাড়তে নাড়তে বলে- আরে ব্যাটা, মিঠু ভাই কি এই সুযোগ ছাড়ব? সারা বাজারের মধ্যে স্যার যে থাপ্পড় টা মারছিল সেইটার শোধ নেওয়ার এমন সুযোগ মিঠু ভাই সারা জীবনে আর কই পাইব। এইবার আমরাও বুঝতে পারি গত আট বছর ধরে আমাদের কলেজের ছাত্র মিঠু ভাই এইবার কলেজে মাথা তুলে দাঁড়াবে, যেই বাঘা শরীফ ছাড়া এই শহরে সে কাউরে ভয় পায় না সেই বাঘা শরীফের কলেজেই ব্যাটা মাথা তুলে দাঁড়াবে।

আমরা তাই আর এই ঝামেলার মাঝে দাড়াই না, সিগারেট টানতে টানতে আস্তে দূরে সরে আসি। দূর থেকে দাড়িয়ে মিঠু ভাই আর সাঙ্গপাঙ্গ সাথে পোলাপাইনের মতিগতি বুঝার চেষ্টা করি। ঠিক এইসময় শওকত প্রশ্ন টা করে, আচমকা। বলে- আচ্ছা পেপারে তো স্যারের কথা কইল কিন্তু মাইয়া টার নাম তো কইল না? এইবার হঠাৎ করে ব্যাপারটা আমাদেরও চোখে পরে, আসলেই পত্রিকায় মেয়েটার নাম ঠিকানা বলা নাই। মহাজ্ঞানী আজিজ আবার তার মতামত জানায়- আরে এখন পেপার গুলা এইসব কেসে ভিক্টিমের নাম সহজে দেয় না, নারী অধিকার বইলা একটা কথা আছে না? নারী অধিকার থাকুক কিংবা নাই থাকুক মনে মনে আমরা সবাই নামটা খুজতে ব্যস্ত হয় পরি। কে হতে পারে মেয়েটা?

আমাদের মধ্যে শওকত প্রথম মুখ খুলে আবার- আরে স্যার যেহেতু তার এত বছরের সুনাম নষ্ট করার ঝুঁকি নিছে তাইলে মেয়ে নিশ্চয় দারুণ সুন্দরী। ব্যাপারটায় অবশ্য আমাদেরও কোন সন্দেহ ছিল না কিন্তু আমরা ভাবতে থাকি কে হতে পারে কলেজের সেই সুন্দরী? আমাদের যুথি? শেফালী কিংবা সি সেকশনের শিমলা? ভাবতে ভাবতে আমরা কোন কুল-কিনারা করতে পারি না তাই তর্ক চলে কে হতে পারে সেই সুন্দরী। আমাদের তর্কের মাঝেই এতক্ষণ চুপ মেরে থাকা রেদয়ান যেন হঠাৎ ফুঁসে উঠে, বলে- কি সব বালছাল আলোচনা লাগাইছস? একটা মানুষ এত বছর তোদের পড়াইল, তোদের বাপ চাচাদের পড়াইল তারে নিয়া এইসব কথা বলতে তোদের লজ্জা লাগে না। এইখানে লজ্জার কি আছে তা বুঝতে না পেরে আমরা অবাক হয় রেদয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমরা তাকিয়ে থাকতে থাকতেই রেদয়ান মুখের সিগারেট টা দূরে ছুড়ে দিয়ে বই খাতা নিয়ে উঠে পরে ধুপধাপ। আমরা ডাকলেও শালা কিছুই শুনে না বরং বাসায় কাজের ছুতোয় চলে যায় দ্রুত।

হাসতে হাসতে শওকত আবার মুখ খুলে- আরে বুঝস নাই এত দরদ কেন? আমরা মাথা নাড়াই কারণ সত্যি আমরা ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারি নাই। হাসতে হাসতেই শওকত উত্তর দেয়- শালারা ভুইলা গেলি, শরীফ স্যারের ক্লাস টেনে পড়া ছোট মাইয়াটারে রেদয়ানের বাচ্চা লাইক করে। এইবার একটু উচ্চস্বরে হাসি দিয়ে আমরাও বুঝিয়ে দেই ব্যাপারটা আমাদের কাছে ক্লিয়ার, পুরা ক্লিয়ার।

রেদয়ানের ব্যাপারটা আমাদের কাছে ক্লিয়ার হলেও ক্লিয়ার হয় না মেয়েটার নাম। আর সেইটা নিয়ে উত্তেজিত তর্ক বিতর্কের মাঝেই একসময় টের পাই সূর্য ঠিক আমাদের মাথার উপর আর ঠিক তখন আমাদের শরীর আমাদের জানান দেয় ক্ষুধার কথা। তাই বিকেলের সেশনের জন্য এই তর্ক অসমাপ্ত রেখেই আমরা উঠে পরি।

কিন্তু বিকেল বেলা আর আমাদের সেই অসমাপ্ত তর্ক আবার নতুন করে শুরু করা হয় না। কারণ বাড়ি থেকে আসার সময় আমরা সবাই টের পাই আমাদের ছোট্ট এই মফস্বল শহর উত্তেজনায় কাপছে। সম্ভবত শহরের মানুষের এই নিস্তরঙ্গ জীবনে অনেকদিন এমন কোন বিনোদন আসেনি। তাই বাজার থেকে চায়ের দোকান কিংবা বয়েজ স্কুলের খেলার মাঠ সবখানেই শুধু একটাই প্রশ্ন- কিভাবে এইটা সম্ভব? অবশ্য এর সম্ভাব্যতা নিয়ে নানা রকম যুক্তি আসতে থাকে অনেকের কাছ থেকেই। অনেকেই যে এই ব্যাপারটা আগেই টের পেয়েছিল এমন খবরও শহরের বাতাসে ঘুরে বেড়াতে থাকে। আসলে সেইদিনের সেই বিকেল বেলা আমাদের শহর টা হয়ে যায় গুজবের শহর।

কিন্তু আমাদের শহরেই অনেকে এইটা বিশ্বাস করতে পারে না। তাই তারা ছুটে যায় আমাদের শহরে দেশের প্রধান দৈনিকের স্থানীয় সংবাদ দাতার কাছে। কিন্তু সেইখানেও তারা হতাশ হয় কারণ তারা আবিষ্কার করে সেই রিপোর্টার আজ সকালেই হঠাৎ জরুরী কাজে ঢাকায় চলে গেছে। কিন্তু এইবার আর শহরের মানুষের অবিশ্বাস করার কিছু থাকে না, তারা বুঝতে পারে নিশ্চয়ই এক সময়ের নিজের স্যার এর উপর এমন একটা খবর ছাপা হবার পর সাংবাদিক আমিনুল ইসলামের এই শহরে দারুণ লজ্জা লাগছিল। সারা শহর বুঝে যায় দেশের প্রধান দৈনিকের স্থানীয় সংবাদ দাতা আমিনুল ইসলাম শুধু অত্যন্ত সৎ নয় বরং সাথে সাথে তার একসময়ের শিক্ষা গুরুর প্রতি দারুন শ্রদ্ধাশীলও ছিল। সাংবাদিক আমিনুল ইসলামের এই কর্তব্য নিষ্টা আর সেই সাথে গুরু ভক্তি আমাদের ছুয়ে যায়। আমাদের সেই বিকেল বেলা এই গুজবের শহরে আমিনুল ইসলাম হঠাৎ হয়ে উঠেন এক নায়ক যার হাতে পতন হয় আমাদের শহরের এক কিংবদন্তীর।

আমাদের শহরে সেই বিকেল বেলা হাজারো গুজবের মাঝে নায়ক হয়ে উঠেন আরেক জন, মিঠু ভাই। আমরা জানতে পারি সেই বিকেল বেলা মিঠু ভাই তার ছেলেপেলেদের নিয়ে মিছিল করে কলেজের প্রিন্সিপালের রূমের তালা লাগিয়ে দিয়েছেন। আমরা অবাক বিস্ময়ে সেই খবর শুনি কারণ সম্ভবত গত ত্রিশ বছরে কলেজের করিডোরে এই প্রথম কেও মিছিল করার সাহস দেখায়। আমরা আর অবাক হয়ে শুনি মিঠু ভাই আগামীকাল সকালে মিছিল নিয়ে বাঘা শরীফের বাসার সামনে যাবেন, বিচার চাইবেন। বিচার চাইবেন আমাদের শহরের সেই নাম না জানা মেয়েটার জন্য। এত এত সব খবরের মাঝে গুজবে ভারী হয়ে আসা আমাদের শহরের বাতাস উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলেও শহরের সেই উত্তেজনার রেশ কাটে না। কারণ সবাই অপেক্ষায় থাকে পরের দিন সকালের যেই দিন প্রথম বারের মত এই শহরে কেউ বাঘা শরীফের সামনা সামনি দাড়িয়ে তার বিচার চাইবে। আমরাও অপেক্ষায় থাকি তামাশা দেখার।

কিন্তু আমাদের হতাশ হতে হয়। তাই সারা রাত অপেক্ষায় থাকার পরেও আমাদের আর সকাল বেলা তামাশা দেখা হয় না। আমরা শুনতে পারি মিঠু ভাই আর তার মিছিল পৌছানোর আগেই বাঘা শরীফের বাসায় তালা পরেছিল। আমরা জানতে পারি আজ সকালেই বাঘা শরীফ আর তার পরিবার এই শহর ছেড়ে চলে গেছে। আমরা বুঝতে পারি এত সবের পরেও এই শহরে শরীফুর রহমানের কিছু শুভাকাঙ্খী রয়ে গেছে আর তাই গত রাতেই বাঘা শরীফ শহর ছাড়তে পেরেছে নিঃশব্দে, পলাতকের মত।

কিন্তু এত কিছুর পরেও হয়ত একজন উপর থেকে মুচকি হাসছিলেন তাই সংবাদ পত্রের গাড়ি ঢাকা থেকে সকাল নয়টায় শহরে পৌছানোর দশ মিনিটের মাঝে সমস্ত পেপার নিঃশেষ হয়ে যায়। অনেক চেষ্টার পর পাওয়া একটা পেপারে বাকী সবার মত আমরাও আতিঁপাঁতি করে খুজতে থাকি সেই সংবাদ। বাকী আর অনেকের মত পত্রিকার পাতার পর পাতা উল্টাতে উল্টাতে আমাদের উত্তেজনা থিতু হয়ে আসে, আমরা বুঝতে পারি আজকে আর আর মফস্বল সংবাদের পাতায় দারুন উত্তেজনাকর কোন খবর নেই। তাই হতাশ হয়ে আমরা সিগারেট ধরাতেই আজিজ পেপার হাতে চিৎকার দিয়ে উঠে- সর্বনাশ। আর সর্বনাশের কারণ খুজতে আজিজের মাথার পাশ দিয়ে পত্রিকার পাতায় নজর দিতেই আমরা দেখতে পাই সংশোধনী সংবাদ- গত কালের ” কলেজের প্রিন্সিপাল কর্তৃক ছাত্রীর শ্লীলতাহানীর চেষ্টা” খবরে লক্ষীপুরের জায়গায় ফরিদপুর ডিগ্রী কলেজ পড়তে হবে।

৩,৭৩১ বার দেখা হয়েছে

৩৭ টি মন্তব্য : “মফস্বল সংবাদ”

  1. রকিব (০১-০৭)

    প্রিয় গল্পকারের গল্প; আপনি একটা জিনিস অসাধারণ ভাবে করতে পারেন, কী ভাবে যেন একটা বুননে পুরো গল্পটা দাঁড় করিয়ে ফেলেন। কবে যে আমরাও 🙁 !!!
    অফটপিকঃ লেখাটা আগে পড়েছি বলে মনে হলো!!! 😛


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. রুম্মান (১৯৯৩-৯৯)

    বুইড়া আংগুল উপরের দিক 🙂


    আমার কি সমস্ত কিছুই হলো ভুল
    ভুল কথা, ভুল সম্মোধন
    ভুল পথ, ভুল বাড়ি, ভুল ঘোরাফেরা
    সারাটা জীবন ভুল চিঠি লেখা হলো শুধু,
    ভুল দরজায় হলো ব্যর্থ করাঘাত
    আমার কেবল হলো সমস্ত জীবন শুধু ভুল বই পড়া ।

    জবাব দিন
  3. টুম্পা (অতিথি)

    একদম এক দমে পুরোটা পড়লাম! দারুণ সাবলীল লেখনী আর শুরুতেই একটা ঔৎসক্য জাগিয়ে দেয়া...সব মিলিয়ে অসাধারণ একটা ছোটগল্প!
    তবে ছোট্ট একটা ডাউট থেকে গেছে, বাঘা শরীফ অপরাধী না হয়েও শহর ছেড়ে কেন চলে যাবে? আর কেউ না জানুক, সে নিজে তো জানতো সে কিছু করেনি!

    জবাব দিন
  4. সামিয়া (৯৯-০৫)

    চমৎকার টুইস্টটা দিয়ে আরও চমৎকার ভাবে কিছু সত্য তুলে আনছ... ওরা জানে ওদের শিক্ষকের পক্ষে এই ঘটনা কিছুটা অসম্ভবই, তারপরেও...ত্রিশ বছরের বিশ্বাস ভেঙ্গে গেল মিথ্যে কলমের খোঁচায়। ভুলেরও সুযোগ নেয় সুযোগসন্ধানী মানুষ, অন্যরা দেখেও কিছু বলছে না... যেমন মিঠু ভাই।
    আবার কেউ যদি প্রতিবাদ করে, তাহলে তার সাথে কোন রকম একটা সম্পর্ক খুজে বের করা...যেমন রেদোয়ানের প্রতিবাদকে ঢেকে দেয়া হয়েছে তার সম্পর্কের সুতো খুজে বের করে। মধ্যবিত্ত মানসিকতায় আমরা যেদিকে ট্রেন্ড সেদিকে ঝুঁকতে বেশ পছন্দ করি।

    সকলেই জানে পেপারে সত্য মিথ্যা মিশায় ছাপায়, তাও মানুষ পেপারের কথাই বিশ্বাস করে। আসলে ঘটনা হারিয়ে যায় চাপিয়ে দেয়া সত্যর আড়ালে। কেন? সমাজবিজ্ঞানীরা হয়ত বলতে পারবেন।

    ঘটনা, পরিপ্রেক্ষিত খুবই চমৎকার। মুগ্ধ। তবে ভাষাটা মাঝে মাঝে হেলে পড়েছে, কোন কোন জায়গায় চুইংগাম হয়ে গেছে।

    তবে এন্ড অফ দা ডে, এইটা একটা সুন্দর আর বাস্তব গল্প। 🙂

    জবাব দিন
  5. তানভীর (৯৪-০০)

    তোমার এই গল্পটা ভালো লেগেছে রাশেদ। খুব সুন্দর করে লিখেছ।

    অন্য কোথাও প্রকাশিত হওয়া পুরনো লেখা এখানে দেখলে খারাপ লাগে। হয়ত এখানে সবার সাথে গল্পটা শেয়ার করার জন্য দিয়েছ, বা অনেকদিন কিছু লেখা হচ্ছে না বলে পুরনো গল্পই শেয়ার করেছ, তারপরও খারাপ লাগাটা লুকিয়ে রাখতে পারলাম না।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : শিরীন (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।