চরমপত্রের একদিন

আমি স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি। তাই স্বপ্ন দেখি বিচার হচ্ছে সেইসব ঘাতকদের যারা একটা শিশু জন্মাবার আগেই তাকে চরম আঘাত করেছিল ডিসেম্বরের এই ১৪ তারিখ আটত্রিশ বছর আগে। তাই বিচারের স্বপ্নে আঙ্গুল গুনি, বছর গুনি। আটত্রিশ বছর। হয়ত ক্রমান্বয়ে এই সংখ্যাটার বেড়ে চলা মনে হতাশা বাড়ায়। কিন্তু এইসব হতাশা ঝেড়ে ফেলতে চাই। তাই খুঁজে ফিরি আটত্রিশ বছর আগে সেইসব যুদ্ধ বিজয়ী মানুষ গুলোর মনোবলের ভান্ডার। আশায় থাকি নিশ্চয় একদিন শেষ হবে আমাদের এই বছর গণনা। তাই আশ্রয় নিই চরমপত্রের, পুরান সেই ক্লাসিকের। যুদ্ধ দিনের সেই অমরগাথার। আশা করি যুদ্ধের কালদিন গুলোতে মুক্তিযুদ্ধাদের আশার ভান্ডার এর কিছুটা আমরা অনুভব করতে পারব চরমপত্রের এই ক্লাসিক সংখ্যা থেকে। আর হ্যাটস অফ টু এম আর আকতার মুকুল, যুদ্ধ দিনের এই অমরগাথার রচিয়তা কে।
……………………………………………………………………………………………..
চরমপত্র

……১৯৭১
মেজিক কারবার। ঢাকায় অখন মেজিক কারবার চলতাছে। চাইরমুড়ার থনে গাবুর বাড়ি আর কেচকা মাইর খাইয়া ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়া সোলজারগুলা তেজগাঁও কুর্মিটোলায় আইসা- আ-আ-আ দম ফেলাইতেছে। আর সমানে হিসাবপত্র তৈ্রি হইতাছে। তোমরা কেডা? অ্যাঃ ৭২ জন। কেতাবের মধ্যে তো দেখতাছি লেখা রইছে বৈ্রবে দেড় হাজার পোষ্টিং আছিলো। ব্যাস ব্যাস, আর কইতে হইবে না- বুইজা ফালাইছি। বাকিগুলার বুঝি হেই কারবার হইয়া গেছে। এইডা কি ? তোমরা মাত্র ১১ জন কির লাইগ্যা ? তোমরা কতজন আছিলা ? খাড়াও খাড়াও এই যে পাইছি কালিয়াকইর – ১২৫ জন। তা হইলে ১১৪ জনের ইন্নাল্লিয়াহে ডট ডট ডট রাজেউন হইয়া গেছে। হউক, কোন ক্ষেতি নাই। কামানের খোরাকের লাইগ্যাই এইগুলারে বাঙ্গালমুলুকে আনা হইছিল। আরে এইগুলি কারা? যশুরা কই মাছের মত চেহারা হইছে কির লাইগ্যা। ও-অ-অ তোমরা বুঝি যশোর থাইক্যা ১৫৬ মাইল দৌড়াইয়া ভাগোয়াট হওনের গতিকে এই রকম লেড়লেড়ে হইয়া গেছ। অ্যাঁ- তুমি একা খাড়াইয়া আছো কির লাইগ্যা? কি কইলা- তুমি বুঝি মীরকাদিমের মাল? ও-অ-অ বাকি হগ্গলগুলারে বুঝি বিচ্ছুরা মেরামত করছে? গাং এর পারে পাইয়া আরামসে পানির মইদ্দে চুবানি মারছে।

কেইসডা কি? আমাগো বকসীবাজারের ছক্কু মিয়া কান্দে কির লাইগ্যা? ছক্কু-উ, ও ছক্কু ! কান্দিস না ছক্কু, কান্দিস না। কইছিলাম না, ‘বাঙ্গাল মুলকের কেদো আর প্যাকের মাইন্দে মছুয়াগো মউত তেরা পুকারতা হ্যায়’। নাঃ তখনই কি চোটপাট হ্যান করেগা, ত্যান করেগা; আর অখন। অখন তো মউলবী সাবরা কপিকলের মাইদ্দে পড়ছে। সামনে বিচ্ছু , পিছনে বিচ্ছু, ডাইনে বিচ্ছু , বাঁয়ে বিচ্ছু। অখন খালি মছুয়ারা চিল্লাইতেছে, ‘ইডা হ্যামি কি কুরছুনুরে , হামি ক্যা নানির বাড়িত আচ্ছিনুরে। হামি ইডা কি করনুরে’।

আতকা আমাগো ছক্কু মিয়া কইলো, ‘ভাইসাব , আমার বুকটা ফাইট্যা খালি কান্দন আইতাছে। ডাইনা মুরা চাইয়া দেহেন ওইগুলা কি খাড়াইয়া রইছে। কি লজ্জা, কি লজ্জা’! মাথাডা এ্যঙ্গেল কইরা তেরচি নজর মারতে দেহি কি! শও কয়েক মছুয়া অক্করে চাইউয়ার বাপ মানে কিনা দিগম্বর সাধু হইয়া খাড়াইয়া রইছে। বিগ্রেডিয়ার বশীর তগো জিগাইলো ‘তুম লোগকো কাপড়া কেধার গিয়া’? জবাব আইলো যশোরে শার্ট, মাগুরায় গেঞ্জি, গোয়ালন্দে ফুলপ্যান্ট আর আরিচায় আন্ডারওয়্যার থুইয়া বাকি রাস্তা খালি চিল্লাইতে চিল্লাইতে আইছি- ‘ হ্যায় ইয়াহিয়া ইয়ে তুমনে কেয়া কিয়া- হামলোগ তো অভি ন্যাঙ্গা মছুয়া বন গিয়া’?

আতকা ঠাস ঠাস কইরা আওয়াজ হইলো- ডরাইয়েন না ডরাইয়েন না। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী চুলে ভর্তি সিনা চাবড়াইতে শুরু করছে- ‘পদ্মা নদীর কুলে আমার নানা মরেছে, পদ্মা নদীর কুলে আমার দাদা মরেছে, গাবুর বাড়ির চোটে আমার কাম সেরেছে’। ব্যাস মওলবী রাও ফরমান আলী, ঠেটা মালেক্যা ভাগোয়াট হওনের গতিকে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্টের কাছে খবর পাডাইলো , ‘ হে প্রভু , তোমার দিলে যদি আমাগো লাইগ্যা কোনরকম মহব্বত থাক্যা থাকে , তা হইলে তুরনদ আমাগো ক্যইয়া দাও কিভাবে ক্যইয়া দাও কিভাবে বিচ্ছু আর হিন্দুস্তানী ফোর্সের পা ধরলে আমার লেড়লেড়া আর ধ্বজভংগ মার্কা সোলজারগো জানটা বাঁচানো সম্ভব হইবে’।

এই খবর না পাইয়া জেনারেল পিঁয়াজি আর সেনাপতি ইয়াহিয়া কি রাগ? ছদর ইয়াহিয়া লগে লগে উথান্টের কাছে টেলিগ্রাম করলেকা, ‘ভাই উ থান্ট, ফরমাইন্যার মাথা খারাপ হওয়নের গতিকেই এইরকম কারবার করছে। গের চিডিডারে চাপিস কইরা ফালাও। এই দিকে আমি আর শাহনেওয়াজ ভুট্টোর ডাউটগুল পোলা পোংটা সরদার জুলফিকার আলী ভুট্টোররে মিছা কথার ওয়াল্ড রেকর্ড করনের লাইগ্যা জাতিসংঘে পাডাইতেছি। একটুক নজরে রাইকখো’। বেডার আবার সাদা চামড়ার কসবীগো লগে এথি-ওথি কারবার করনের খুবই খায়েশ রইছে।

কইছে কিরে ভাই , আল্লাদের আর সময় নাই। সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের হবু ফরিন মিনিস্টার জুলফিকার আলী ভুট্টো ব্রাকেটে শপথ লওনের টাইম হয় নাইক্যা। ব্রাকেট শেষ জাতসংঘে যাইয়া পয়লা রিপার্টারগো লগে টু-উ-উ মারত মানে কিনা লুকোচুরি খেলা খেলতাছিল। তারপর জাতিসংঘে আতকা কান ধইরা উঠ-বস-উঠ-বস কইরা ভুট্টো সাবে চিল্লাইতে শুরু করলো, আর লাইফে এইরকম কাম করুম না। বাঙ্গাল মুলুকে আমরা গেঞ্জাম কইরা খুবই ভুল করছি। আমরা মাফ চাইতাছি, তোওবা করতাছি, কানডলা খাইতাছি- আমাগো এইবারের মত ক্ষমা কইরা দেন।

কিন্তু ভুট্টো সাব বহুত লেট কইরা ফালাইছেন। এইসব বোগাচ কথাবার্তায় আর কাম চলবো না। ঠাস ঠাস কি হইলো? কি হইলো? সোভিয়েট রাশিয়া জাতিসংঘে ভেটো মাইরা হগ্গল মিচকি শয়তানরে চিত কইরা ফালাইছে। কইছে, ফাইজলামির আর জায়গা পাও না? এইদিকে সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের পরানের পরান জানের জান চাচা নিক্সন কড়া কিসিমের টিরিক্স করনের লাইগ্যা সপ্তম নৌবহররে সিঙ্গাপুরে আনছে। লগে লগে সোভিয়েট রাশিয়া হিসাব কইরা কাম করনের লাইগ্যা হোয়াইট হাউসের এ্যাডভাইসিং করছে। প্রেসিডেন্ট নিকলাই ক্রেম্লিন থাইক্যা কইছে পাক-ভারত উপমহাদেশের বাইরে কেউ নাক না গলাইলেই ভালো হয়। ব্যাস, আমেরিকার সপ্তম নৌবহররে সিঙ্গাপুরে আইসা নিল ডাউন হইয়া রইল।

এ্যাঃ এ্যাঃ এইদিকার কারবার হুনছেন নি? হারাধনের একটা ছেলে কাদে ভেউ ভেউ, হেইটা গেলো গাথার মইদ্দে রইলো না আর কেউ। জেনারেল পিঁয়াজি সরাবন তহুরা দিয়া গোসল কইরা ঢাকার হোটেল ইন্টারকণ্টিনেণ্টালের মাইদ্দে হান্দাইয়া এখনো চ্যাঁ চ্যাঁ করতাছে, আমার ফোর্স ছেরাবেরা হইলে কিহইবো, আমি পাইট করুম, পাইট করুম। আমাগো মেরহামত মিয়া আতকা চিল্লাইয়া উঠলো- এইডা কি। এইডা কি। জেনারেল পিঁয়াজির ফুলপ্যান্টে দুই রকম রং দেখতাছি কির লাইগ্যা? সামনের দিকে খাকি রং, পিছনের মুড়া বাসন্তী রং, কেইসডা কি? অনেক থিংক করলে বোঝন যায় এর মাজমাডা। হেইর লাইগ্যা কইছিলাম……

(রচনায়- এম,আর, আকতার মুকুল)

২,৮২৩ বার দেখা হয়েছে

২২ টি মন্তব্য : “চরমপত্রের একদিন”

  1. আন্দালিব (৯৬-০২)

    চরমপত্র একটা বারুদের মতো নেশা ধরায়ে দেয়। এখনও পড়লে রক্ত গরম হয়ে ওঠে।

    তবে এইটাও খুব আশ্চর্য লাগে যে সেই সময়টা যাঁরা জীবনে ধারণ করে আছেন তাঁরা কী করে সবকিছু এমন ভ্রষ্ট হয়ে যেতে দিলেন?!! 🙁

    জবাব দিন
    • রাশেদ (৯৯-০৫)

      আমার মতে এই চরমপত্র ছিল আমাদের যুদ্ধের সময় অন্যতম বড় মনস্তাত্তিক হাতিয়ার। একই সাথে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা আর হানাদার কবলিত এলাকার সাধারণ মানুষের যোদ্ধাদের উপর আস্থা বজায় রাখার জন্য স্বল্প উপকরণ দিয়ে এরথেকে আর ভাল প্রচারণামূলক অনুষ্ঠান সম্ভবত আর সম্ভব হত না। তাই রক্ত গরম করতে এটা বাধ্য।


      মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

      জবাব দিন
  2. হাসনাইন (৯৯-০৫)
    বিগ্রেডিয়ার বশীর তগো জিগাইলো ‘তুম লোগকো কাপড়া কেধার গিয়া’? জবাব আইলো যশোরে শার্ট, মাগুরায় গেঞ্জি, গোয়ালন্দে ফুলপ্যান্ট আর আরিচায় আন্ডারওয়্যার থুইয়া বাকি রাস্তা খালি চিল্লাইতে চিল্লাইতে আইছি- ‘ হ্যায় ইয়াহিয়া ইয়ে তুমনে কেয়া কিয়া- হামলোগ তো অভি ন্যাঙ্গা মছুয়া বন গিয়া’?

    :salute:

    জবাব দিন
  3. রাজীউর রহমান (১৯৯৯ - ২০০৫)
    জেনারেল পিঁয়াজির ফুলপ্যান্টে দুই রকম রং দেখতাছি কির লাইগ্যা? সামনের দিকে খাকি রং, পিছনের মুড়া বাসন্তী রং, কেইসডা কি?

    সেইরকম । :salute: :salute:

    জবাব দিন
  4. চরম পত্র আসলেই চরম। রক্ত গরম করে দেয়। যুদ্ধে যাইতে মন চায়।

    আমার একটা চিন্তা আছে। আমি মনে করি যুদ্ধ এখনো শেষ হয় নাই। এই দেশ থেকে সব রাজাকার ঝেঁটিয়ে বিদায় করা, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন ও যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদান, ফাকিস্তান যাতে তাদের করা গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায় সেজন্য কুটনৈতিক তৎপরতা, দুর্নীতি নির্মূলে অংশগ্রহণ, দেশের নাম উজ্জ্বল করার জন্য যে কোন কাজ/ক্ষেত্রে অবদান রাখা, সবই মুক্তিযুদ্ধের পর্যায়ে পড়ে। নতুন প্রজন্মের জন্য এটাই মুক্তিযুদ্ধ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহমেদ (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।