ছোটবেলার ঈদ কিংবা বড় বেলার কম্পু দিন

“আজ ঈদ, মদীনার ঘরে ঘরে আনন্দ”- কোন একটা ছোট ক্লাসের বাংলা বইয়ের এই লাইনটা সম্ভবত আমাদের অনেকের ছোটবেলার ঈদের সবচেয়ে উজ্জ্বল বিজ্ঞাপন। ঈদের আগের সন্ধ্যায় চাঁদ দেখার জন্য ব্যস্ততা, সকাল বেলা গোসল শেষে নামায আর তারপর বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে সালাম আর সেই সাথে সালামীর ভাগ। আর কোরবাণী ঈদের সময় পশু নিয়ে আমারা ছোটদের ছোটাছুটি মাঝেমাঝে বড়দের ব্যস্ততাকেও ছাড়িয়ে যেত নিশ্চিত। এত এত ব্যস্ততার মাঝে তখন বুঝতে পারিনি কিন্তু এখন নিশ্চিত কলোনী কিংবা গ্রামের বাড়িতে করা সেইসব ছোটবেলার ঈদ স্মৃতির দৌড়ে এগিয়ে থাকবে বহুদূর।

আজকাল কেন জানি ঈদের সময় আগের মত খুব ভোরে উঠা হয় না। তাই গতকাল নামাযের মাত্র সাতাশ মিনিট আগে উঠে টের পেলাম এইবার কিছুক্ষণ কলেজের ফলইনের আগে সেই ছুটাছুটি টা না করলে হচ্ছে না তাই পাঞ্জাবী পড়ে যখন ঘড়ির দিকে তাকালাম তখন বুঝতে পারলাম আর মাত্র মিনিট পাঁচেক বাকী আছে। এরপর নামায, কোলাকুলী এবং তারপর অপেক্ষা, কশাই মহাশয়দের জন্য অপেক্ষা। আশেপাশের সবার কোরবানী হয়ে যাচ্ছে হুজুরও রেডী কিন্তু উনাদের দেখা নাই তাই অপেক্ষা। এরপর সব যখন খাপে খাপে মিলল ততক্ষণে পাশের আংকেলের মাংস কাটাও প্রায় অর্ধেক শেষ। আর দেরীটা পুশিয়ে নিতে ছোটাছুটি করতে করতেই বাকী সকাল টা শেষ। হায় ব্যস্ততা, হায় সেই ছোটবেলার সালামী।

ছোটবেলায় আমরা প্রায় ঈদই করতাম গ্রামের বাড়ীতে, সেই সন্দ্বীপ। কিন্তু একবার আমার বাপজানের ছুটি মিলবে না বলে আগেই অফিস থেকে ঘোষণা আসল তাই আমি আর আমার ছোটবোন মন খারাপ করে ঘুরাঘুরি করি আর বড়দের মত চিন্তিত মুখে বাড়িতে গেলে কি কি আনন্দ হতে পারত সেইটা নিয়ে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত থাকি। হয়ত সেই ক্ষুদে বুদ্ধিজীবিদের আলোচনায় রাস্তা খুলে যায়। বাপজানের বস হঠাৎ কি মনে করে সাতদিনের ছুটি মঞ্জুর করে বসে। তারপর? তারপর আরকি ছুট সন্দ্বীপ। তখনও মোবাইল যুগ শুরু হয় নাই তাই বাড়িতে সেই আকস্মিক যাত্রার খবর পৌছানোর কোন উপায় নাই তাই বিনা খবরেই শুরু হয় আমাদের সেই সারপ্রাইজ যাত্রা। টাঙ্গাইল থেকে বাসে ঢাকা, ট্রেনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আর এরপর স্টীমার, নাম তার রাঙ্গাবালী। রাঙ্গাবালী যখন কূলে ভিড়ল তখন আবার আমার আর ছোটবোনের শুরু হয় গভীর চিন্তা, বাড়িতে এইযে কোন খবর না দিয়ে হঠাৎ হাজির হচ্ছি তাতে সবাই কেমন অবাক হবে। স্টীমারে বসে সবাই কেমন অবাক হবে সেটা বুঝার তো আর কোন উপায় নেই তাই আমরা রিক্সা করে রওনা দেই, শেষ বিকেলে সন্দ্বীপের এবড়ো থেবড়ো মাটির রাস্তা দিয়ে আমরা দাদা বাড়ির দিকে রওনা দেই। সেই রিক্সা যখন শেষ পর্যন্ত বাড়ি পৌছে তখন বাড়ির সবাই বেশী অবাক হয়েছিল নাকি আমরা বেশী খুশি হয়েছিলাম সেটা বুঝার আসলে কোন উপায় ছিল না।

কোরবানীর সময় দুপুরের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে আর তেমন কাজ থাকে না তাই এরপর একে একে বন্ধুদের ফোন করা শুরু করলাম। সবার সাথে কথা বলতে বলতেই যেটা বুঝলাম আড্ডা জমানোর জন্য কেউ তেমন ব্যস্ত নয়। কারণ কার আছে বালিকা আর কোন ব্যাটা মহা আলসে। তাই কি আর করা আজকাল অন্যতম বড় বন্ধু কম্পুর সামনে বসে থাকি পুরা বিকেল জুড়ে। ব্লগ পড়ি, মানুষের ফেসবুকে ঘুরাঘুরি করি, গুতা দিই আর গুতা খাই এবং সময় পার করি। ভাগ্যিস সন্ধ্যার সময় আজিজে আড্ডা দিই এমন একদল বড় ভাইয়ের আড্ডা দেওয়ার ইচ্ছে হয় তাই রক্ষা। শেষ পর্যন্ত দুই তিন ঘন্টা আড্ডা দিয়ে যখন বাসায় আসলাম তখন খাওয়া দাওয়া শেষে আবার সেই পুরাতন বন্ধু কম্পু। তারপর আবার আমরা সেই দুই বন্ধু, কম্পু আর আমি আর অন্যদিনের মত গভীর রাত পর্যন্ত আমাদের যৌথ ভ্রমণ।

ছোটবেলায় একবার কোন এক ঈদের আগের রাতে নয়টার সময় বলা হল আজ সারা দেশে এখনও পর্যন্ত চাঁদ দেখা যায় নি তাই আগামী কালও রোজা। সেইটা শুনে আমার ছোটবোনের সেকি কান্না, তার একটা মাত্র কথা কাল কে তার ঈদ চাই ই চাই। সে কোন কথা শুনতে নারাজ। কালকে সে নতুন জামা আর জুতা পড়বেই পড়বে তাই তার আগামীকাল ঈদ চাই। মা বুঝায় তো বাপজান বুঝায়, একটু পরে ধমকও দেয় দেয় কিন্তু পিচ্চির কান্না তাতে আর বাড়ে। তার একটাই কথা কালকে ঈদ চাই, আল্লাহ কে বল ঈদ দিতে। পিচ্চির কান্নায় হয়ত কিছু হয় তাই বিটিভির রাত দশটার ইংরেজী সংবাদে হঠাৎ বলা হয় দেশের কোন এক প্রত্যন্ত অন্ব্ঞলে চাঁদ দেখা গেছে তাই আগামী কাল ঈদ। আমরা অবাক হই আর পিচ্চি খুশী হয়, বেজায় খুশী।

আজকালকার ঈদে কেন জানি আগের মত সেই মজাটা পাই না, বয়সের দোষ না আমার দোষ সেইটা বুঝতে পারছি না। হয়ত বয়সের দোষ তাই সালামী নাই, অহেতুক ছোটাছুটি নাই, বাড়ি গেলে কি কি আনন্দ হতে পারত সেটা নিয়ে পিচ্চি আর আমার কোন আলোচনা নাই। হয়ত আমার দোষ বাকীদের মত তাই বালিকা নাই। আর শেষ পর্যন্ত তাই ঈদের পরের দিন সকাল বেলা আছি আমরা তিন জন- আমি, কম্পু আর ব্লগিং।

৩,৫৩০ বার দেখা হয়েছে

৬৪ টি মন্তব্য : “ছোটবেলার ঈদ কিংবা বড় বেলার কম্পু দিন”

  1. মিশেল (৯৪-০০)

    দেশে থাকতে আমার ঈদটা অবশ্য খারাপ যেত না। এক এক করে সবকটার বাসায়ে যেতাম। যেটার বাসায়ে যেতাম সেটাকে নিয়ে বের হয়ে যেতাম আরেকটার বাসায়ে। এভাবে চলতে থাকত। শেষে সব একসাথে হয়ে বিকাল কিংবা সন্ধ্যার দিকে যেতাম শান্তর বাসায়ে। ডিনারটা হত সেখানে। আন্টির হাতের রান্না না খেলে ঈদটাই পুরা হত না। বালিকাদের জন্য সময় দেয়া হত পরেরদিন।

    জবাব দিন
  2. জিহাদ (৯৯-০৫)
    তারপর আবার আমরা সেই দুই বন্ধু, কম্পু আর আমি আর অন্যদিনের মত গভীর রাত পর্যন্ত আমাদের যৌথ ভ্রমণ

    প্রথম ধাক্কায় তো অন্য কিছু পড়ে ফেলসিলাম। 😀

    ব্যাপার নাহ। আমার অবস্থাও কালকে সেম সেম ছিল। তবে কম্পুর সামনে সারাদিন বসার টাইম পাইনাই। কোপা শামসু অবসরে। তাই নিজেরেই ফিল্ডে নামতে হইসিল :grr:

    আর আজকে সকাল থেকে - "সর্বাঙ্গে ব্যাথা, অষুধ দেবো কোথা" টাইপ সিচুয়েশনের ভিতর দিয়ে যাইতেসি 🙁

    তোর বোন এখন কত পিচ্চি? 😀


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  3. আহমেদ

    কিরে রাশেদ... লেখাটা তো ভাল হইসে অনেক... :boss: একদিন সময় কইরা আমারে খাওয়ায় দিস। আর তুই যখন ফোন দিসস, কসম কইলাম -তখন আমি গরু কাটায় ব্যস্ত আসিলাম... বালিকা বা আইলসামি কোনোটাই ছিল না!!

    জবাব দিন
  4. রকিব (০১-০৭)

    আহা আগে কি সুন্দর ঈদ করতাম !! 😕 😕
    রাশুদা, কুবের মাঝির মেয়ের সাথে ঈদের দিন বিকাল বেলা নৌকায় চইড়া যে ঘোরাঘুরি করলেন, ঐটা লেখেন নাই ক্যান!!!! :grr: :grr:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  5. মান্নান (১৯৯৩-১৯৯৯)

    ঈদের দিন উইকডে থাকায় কিছু করা হয়নি।
    তবে আজ একজনের মৃত্যুবার্ষিকীতে বহুদিন পর মহাঝাল গরুর মাংস খেলাম না হলে কুরবানীর ঈদ গরুর মাংসের স্বাদ ছাড়াই কাটত 🙁

    জবাব দিন
  6. দিন গুলি মো্র সোনার খাঁচাই রইল না,,,,
    লেখাটা পড়ে খুব ই ভাল লাগল ভাইআ,আবার একটু মন খারাপ হল।
    আসলেই ঈদ এর দিনের জন্য এখন আর কোনো প্রতিক্ষা থাকে না,কেমন পানসে হয়ে গেছে সব।
    একটা সময় ছিল যখন ঈদ এর তিনটা দিন শেষেও গ্রামের বাড়ি ছেড়ে আস্ তে মন চাইত না,আর একটা দিন বেশি থাকার জন্য কান্নাকাটি করতাম কত।কিন্তু আব্বু আম্মুর অফিস থাকার কারনে আর বেশি থাকা হত না।বাড়ি ছেড়ে এসে বাড়ির পিছনের পুকুর আর সামনের আম গাছ টার জন্য সে কি ভীষণ মন খারাপ লাগত।দিন গুনতে থাকতাম,কখন আবার ঈদ আসবে। 🙁
    কিন্তু এখন চিত্র ভিন্ন।সবাই খুব ব্যস্ত।আমরা ভাইবোনেরা সবাই দুরে থাকি।এখন শুধু দাদুর মন রক্ষার জন্য ঈদ এর দিন সকালে বাড়িতে যাওয়া,দিন শেষ না হতেই আবার ফিরে আসার জন্য অস্থিরতা,একটা দিন বাড়িতে থাকা যেন অসম্ভব মনে হয়।
    অনেক বছর পর এইবার কুরবানির ঈদ এ আমরা পুরো পরিবার একসাথে হলাম।একটু হলেও সেই পুরান আমেজ টা যেন আবার ফিরে পেলাম।একটু সময়ের জন্য হলেই জরাজীর্ণ বাড়িটাই প্রান ফিরে এল।সুন্দর সময় গুলো খুব দ্রুত কেটে যায়,তাই ঈদ এর দিন টা যেন এক পলকেই শেষ হয়ে গেল,সন্ধ্যা হওয়ার আগেই আবার সবাই ব্যস্ত শহরের উদ্দেশ্যে রাওনা দিলো,পিছনে পরে থাকল সেই জরাজীর্ণ বাড়িটি,প্রিয় পুকুরটি,আর প্রায় ম্রিত আম গাছটি।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মিশেল (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।