জন্মদাতা

শালার মেজাজ টা কেমন লাগে , ভার্সিটির বাস টা মিস করলাম । সকালটাই লস দিয়ে শুরু, ফাউ ফাউ দশ টাকা খরচ হয়ে গেল। এদিকে টিউটোরিয়ালে যাই না দেখে স্যার ডাকছে, বেটা আবার কথা বলা শুরু করলে ঘন্টা তিনেকের আগে থামতে পারে না । ওদিকে মিতুর সাথে বারটায় টিএসসিতে দেখা করার কথা, মনে হয় না সম্ভব । ঝামেলা, মিতুও আবার মোবাইল বন্ধ রাখছে । শেষে আবার ফোন কইরা রাগ ভাঙ্গাতে হবে । মোবাইলের কোরবানী, টাকা খরচ , শালা সুন্দরী গালফ্রেন্ড থাকার যে কি সমস্যা । সব খানেই শালার টাকার কারবার ।বাপটাও যে কি হইছে না টাকা দিতেতো চায় না আর দিলেও আগের পাই পয়সার হিসাব চায় , দিতে না পারলে সেই পুরান প্যাচাল – ‘তোর ভাইওতো ভার্সিটিতে পড়ছে , কই ওরতো এত টাকা লাগে নায়’ । আরে বাবা, বাবারে কে বুঝাবে ভার্সিটিতে পড়া মানে বড় ভাইয়ের মত আসা আর যাওয়া না। একটু ইয়ার দোস্ত থাকবে, সুন্দরী গালফ্রেন্ড থাকবে , তাইলেতো খরচ একটু হবেই । টেনশনের কি আছে ? আর কিছু বললেই সেই পুরানো অহংকার , জীবনে এক পয়সা ঘুষ খাই নাই এখনো খাই না, তাই তোমার বন্ধুদের বাবাদের মত তোমার পিছনে এর খরচ করতে পারবো না । আরে বাবা এত সত্ থাইকা কে কোথায় বড়লোক হইছে ? কে বুঝাবে যে সম্মান না টাকাটাই আসল ? দেখতো নাই তোমার কলিগের ছেলে রায়হান ১২০cc হোন্ডা নিয়ে ঘুরে কিভাবে ডিপার্টমেন্টের মাইয়াগো সামনে পার্ট লয় , খালি তোমার ছেলে একটু দশ টাকা বেশী চাইলেই যত দোষ । কি সমস্যা ঘুষ খাইলে ? আগে খাওনাই এখন খাবা । তোমার ছেলের চেহারাটা মাশাল্লাহ যে সুন্দর শুধু একটা বাইক থাকলে দেখতা ডিপার্টমেন্ট কেন পুরা কলাভবনের মাইয়াগো কাইত করে ফেলত । না তা আর ভাববা কেন , ভাবলে তো আর বাড়ী না থাকার আফসোস করতা না । শালা এত কিছুর পরও কিছু করতে পারি না , হাজার হইলেও জন্মদাতা বাপ ।


…………………………………………………………………

বৃষ্টি নামবে মনে হয় , আকাশটা কাল হয়ে আসছে । এদিকে যে কি হয়েছে গত আধা ঘন্টায় বাসাটা মনে হয় দশ মিটারও আগায় নায় । এই পলিটিক্যাল পার্টি গুলা যে কি , কারো সর্দি হইলেও মুক্তাঙ্গানে সমাবেশ দিয়ে রাস্তায় একটা জ্যাম বাধাবে । ধূর ছাই , জ্যাম ছুটে না কেন? ঐ দিকে টিউশনির লেট হচ্ছে । মনটাও ভাল লাগছে না , বাবাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসলাম । কেন জানি এতদিনেও মায়াটা কাটাতে পারলাম না ,প্রত্যেকবার বাবা কে ট্রেনে তুলে দিলেই চারপাশটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে । কিন্তু সময়তো আর কম হল না , চার বছর ধরে ঢাকা আছি তবু অভ্যস্ত হতে পারলাম না ।প্রথম প্রথম তো কান্না আসত । মনে হত এত বড় শহরে আমি একা ।
ক্লাস সিক্সে থাকার সময় মা মারা গেল কিন্তু বাবা আর বিয়ে করল না । দিদি আর আমাকে মানুষ করতে করতে মানুষটা তার পুরা শ্রম বাজী রাখল । ছোট্ট একটা ডিসপেনসারি , এর আয়ে কোন রকমে হয়ত ভদ্র ভাবে চলা যায় কিন্তু জীবনের আশা গুলোতো আর পুরোন হয় না । না হলে কত ইচ্ছা ছিল বাবার দিদির বিয়েটা ধুমধাম করে দিবে । কিন্তু সেই পুরান নিন্ম মধ্যবিও কাহিনী – শখ আছে তো সাধ্য নাই । এত আয়োজন করতে গেলেতো ডিসপেনসারি বেঁচতে হয় , তাই দিদি দিল না ।তা হলে কি ভাবে চলবে সংসার , দিদি জেদ ধরল ডিসপেনসারিতে হাত দিলে বিয়েই করবে না ।তাই দিদির কাছে গোপন করে অনেক ঋন করল বাবা । দিদি জানল না , জানল শুধু বাবা আর অনেক পরে আমি । তবুও দিদি তো অস্ট্রেলিয়ায় দুলাভাইয়ের সাথে সেটেল করেছে এই যা শান্তি ।এই ঋণের বোঝা টানতে টানতে দোকান টা আর সোজা হয়ে দাড়াতে পারছে না । আমি জানি , বাবার কি প্রাণান্তকর অবস্থা আমার ঢাকার খরচ চালাতে ।আমি চলে যেতে চাই কিন্তু বাবার খুব শখ ছেলে মেডিকেল থেকে একটা ভাল রেজাল্ট নিয়ে বের হবে । আর এই সাধের পিছে রসদ জোগাতে বাবার যে কি কষ্ট হচ্ছে তা চিন্তা করলে এত বড় শহরে আরো অসহায় লাগে । ধূস বৃষ্টি টা দেখি সত্যি সত্যি নেমে পড়ল , এইবার যদি নেতা নামের এই ম্যানিয়াক গুলা একটু রাস্তা ছাড়ে । রাতে যখন শুই তখন শুধু মনে হয় বাবার যে কি অবস্থা । এত ব্লাড প্রেশার তাও কোন দিন রাত এগারটার আগে বাবা দোকান বন্ধ করে না , কে বুঝাবে বাবাকে । বাবার কষ্ট দেখে দুই টা টিউশনি নিয়েছি কিন্তু মরার এই শহর যেন বাবার কষ্ট আরো বাড়াতে জিনিস পএ বই পএ এর দাম বাড়াচ্ছে । সবাই যেন প্রতিজ্ঞা করেছে বাবার সপ্নটা এরা সফল হতে দিবে না। বাবা এখনও টেনশনে আমার জন্য রাতে ঘুমাতে পারে না , মোবাইলের যুগেও আগের মত বড় বড় চিঠি লিখে । চিঠি গুলোতে থাকে শুধু আমাকে নিয়ে তার সপ্নের কথা । টেনশনে বাবা দুই তিন সাপ্তাহ পরপর ঢাকায় ছুট দেয় । হলে অন্যরা হাসে , রফিক তো বলে আংকেল এত দিন বাবা অন্তপ্রাণ ছেলের কথা শুনেছি কিন্তু এবার ছেলে অন্তপ্রাণ বাবার দেখা পেলাম । কিন্তু ওরাতো জানে না বাবাকে প্রতিবার আসা যাওয়ার খরচ বাঁচাতে কত হিসেব কষতে হয় । মাঝে মাঝে যখন সহ্য হয় না তখন জিজ্জেস করি বাবা তোমার এত কষ্টের মনে কি ? প্রতিবার বাবা একটু মুচকি হাসে তারপর বলে , কারণ আমি যে তোর জন্মদাতা বাপ ।


……………………………………………………………

সেই সকাল থেকে এখানে বসে আছি , শুনেছিলাম আমেরিকানরা নাকি কাজ কর্মে চটপটে । সব কাজ নাকি দ্রুত ক রে কিন্তু এখনতো ম নে হয় সব ভুয়া , এ্যাম্বেসীর ভিতর যদি এরা ২০জনের সাক্ষাতকার নিতে চার ঘন্টা লাগায় তাহলে ৬৫ নাম্বার হিসে বে ম নে হয় আজ আর আমার স ম্ভব না । এদিকে এই ঢ্যাঙ্গা বাঙ্গালী ব্যাটা দেখি আবার আসছে , কি বিরক্তিকর । স কাল থেকে এই নিয়ে তিন বার আস ল । প্রত্যেকবার তার একই কাজ, জ্বী আপনার নাম কি, বাবার নাম , মায়ের নাম, পেশা ? আরে বাবা এক প্রশ্ন এত বার ক রার কি আছে ? প্রত্যেকবার জিজ্ঞেস ক রলে কি বাপ মায়ের নাম চেঞ্জ হয়ে যাবে ?অর্থহীন কাজ কর্মে দেখি সবাই ওস্তাদ ।এ্যাম্বেসীর এরক ম কাজ কর্ম দেখে ম নে হয় আমার পাশের বৃ্দ্ধ ভদ্রলোক ম নে হয় কিছুটা বিরক্ত হয়ে উঠলেন । তাই স ময় কাটানোর জন্য কিছুক্ষন উশখুশ ক রে শেষ পর্যন্ত এদের কাজ ক র্মের ভড়ং নিয়ে আমার সাথে আলাপ শুরু করলেন। অবশ্য কিছুক্ষন এর মধ্যে আলাপটা একতরফা হয়ে উঠল , উনি বক্তা আমি শ্রোতা । এ্যাম্বেসীর কাজ কর্ম থেকে আমাদের আলাপ দেশের আবহাওয়া, আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট এর মত গুরুগ্মভীর বিষয় পেরিয়ে উনার সন্তানদের উপর স্থির হল। পৃথিবীর তাবত বৃদ্ধলোকের মত উনিও সন্তানদের গল্প বলতে ভালবাসেন ।আমার পাশের এই বৃ্দ্ধ ভদ্রলোক রির্টায়ার্ড সরকারি অফিসার, সন্তানরা বিদেশে সেটেলেড, বৌ মারা গেছে প্রায় ৫ বছর । এ ভদ্রলোকের এ রকম নানা ছোট খাট তথ্য আর উনার সুন্দর গল্প বলার ক্ষমতা আমাকে আরো কৌ্তুহলী করে তুলল ।আর আমার কৌ্তুহল আর হয়তবা বৃ্দধ মানুষের অতীত প্রিয়তা আমার সামনে অতীত বর্তমান মিলিয়ে এক ঘটনার পর্দা তুলে ধরল ।এই বৃ্দধ ভদ্রলোকের সব সন্তানরা বিদেশে থাকলেও এমন কি উনার গ্রীন কার্ড নামক এক আরাধ্য বস্তুটি থাকলেও বছরের দশ মাস দেশেই থাকেন । এমন নয় যে আমরা যেমন গল্প উপন্যাস কিংবা টিভির জনপ্রিয় কোন সিরিয়ালের মত বা আমাদের অতি পরিচিত কোন প্রতিবেশীর মত উনার সন্তানরা উনাকে বোঝা মনে করে একে ওন্যের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করে অথবা উনি আমেরিকা গিয়ে সাবেকি মানুষদের মত মানিয়ে নিতে পারেন না । উনার ক্ষেেএ বরং উলটা সত্যি । উনার ছেলেরা উনাকে শ্রদ্ধা করে , বউরা সম্মান , আমেরিকান কালচার নিয়ে উনার বক্তব্য ওখানে থাকতে গেলে তো একটু মানিয়ে চলতে হবে । আমি উনার এই বক্তব্য শুনে একটু বিভ্রান্ত হয়ে যাই , জিজ্ঞেস করি তাহলে আপনি এই বৃ্দধ বয়সে কেন এই দেশে সন্তন , নাতী নাতনী দের সান্নিধ্য ছেড়ে একাকী ছন্নছাড়া জীবন যাপন করছেন ? আমার এই প্রশ্নের জবাবে উনার ঠোটের কোণায় যে এক হাসি ফুটে উঠল তা বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই । আর এই বর্ণনাতীত হাসি আমাকে আরো বিভ্রান্ত করে দিল । আর আমার এই বিভ্রান্ত অবস্থা থেকে বাচাতে এই বৃ্দধ ভদ্রলোক তার ভাষায় যে কাহিনি তুলে ধরলেন তা অনেকটা এরকম –

তোমাকে আমি যে একটু আগে বললাম আমার পাঁচ সন্তন কথাটি কিন্তু আংশিক সত্যি । হ্যা বুঝতে পারছি আংশিক সত্যি কথাটি তোমাকে আরো বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে । কিন্তু আসল সত্য হল আমার সন্তানদের মাঝে চার জন জীবিত আর একজন মৃত । তবে কি জানো , মা বাবারা আসলে অনেক সময় তাদের সন্তানদের এই চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারে না । আমার ওয়াইফের কথাই ধর না , ওতো মামুনের এই চলে যাওয়াটা কখনো মেনে নিতে পারেনি । শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা অনেকটা মানসিক অসু্খের মত দাড়াল । ওর খালি এক কথা মামুন নিশ্চয় কোথাও বেড়াতে গিয়েছে বরাবরের মত নিশ্চয় চলে আসবে । হায় , পাহাড়ের মত অটল এই বিশ্বাস ভাঙ্গবে সেই সাধ্য বুঝি পৃথিবী্র কোন বাসিন্দার নাই । আর এই বিশ্বাস ওর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত অটুট ছিল । আর আমি ? আমি ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে সময়ের সাথে মেনে নিলেও ছেলেটার একটা কথা ভুলতে পারলাম না । তোমার তো জানার কথা না , তাই শোন । মামুন , আমার এই ছেলেটা অন্ধকার সবসময় খুব ভয় পেত ।। অনেক কাল আগে ছেলেটা যখন খুব ছোট তখন একদিন অন্ধকারে ওর ভাই বোনেরা ওকে ভয় দেখিয়েছিল । বেচারা , কতই আর তখন বয়স নয় কি দশ । ভয়ে যে ওর কান্না শুরু হয়েছে তা আর যেন থামতেই চায় না । শেষ পর্যন্ত বাকী সবাই কে ধমক দিতে ওর কান্না একটু থামল । ওর এই কাহিনি ওর ভাই বোনেরা এখনও গল্পের সময় বলে । কিন্তু কি জানো , ওর একটা কথা সবাই ভুলে গেছে । আমার কিন্তু ঠিক মনে আছে , বুড়ো হচ্ছি , স্মৃতিতে ধূলো পড়ছে কিন্তু কি জানো ঐ একটা স্মৃতি এখনো স্পষ্ট । সেদিন মামুন আমাকে বলেছিল বাবা তুমি প্রমিজ কর আমাকে অন্ধকারে একা ফেলে বেশী ক্ষণ দূরে থাকবে না । আমি সেদিনের করা ঐ প্রতিজ্ঞার কথা আজো ভুলতে পারিনি । হ্যা, হয়ত বাকী সবার মত তুমি বলবে এতদিন আগে করা এই প্রতিজ্ঞার সাথে এই মৃত্যুর কি কোন সম্পর্ক আছে ? কিন্তু আমি বলতে পারি আমার সন্তান এর সাথে আমার করা এই প্রতিজ্ঞা আমি কোন দিন ভাঙ্গতে পারব না , হাজার হলেও আমি ওর জন্মদাতা ।

৪৭ টি মন্তব্য : “জন্মদাতা”

  1. হাসনাইন (৯৯-০৫)

    ভাল লাগছে... :clap: :clap:
    নিজেরে কল্পনা করে লেখাটা মজার, গল্পের মাধ্যমে যে কাউকে ধারণ করা যায়। 😉
    মনে হচ্ছে তুই লেখার সময় টেনে টাইপ করে গেছিস, তাই না?? ব্রেক কম নিছিস। :thumbup:

    জবাব দিন
  2. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    কলেজে আসার আগে দিয়ে এবং কলেজে যোগদানের পরপর সময়ের স্মৃতি নিয়ে লিখতে যেয়ে আব্বার কথাই ঘুরে ফিরে মাথায় আসছে। তোমার এই লেখাটার একটা প্রভাব নিশ্চিতভাবে কাজ করছে।

    খুব ভালো হইছে :clap: :clap: ।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  3. তানভীর (৯৪-০০)

    ভাইরে! কি লিখলা তুমি? অসাধারণ!

    আরে, এইটা দেখি আমার হাউসের ছোট ভাই। :hug: :hug: :hug:
    তোমাদের কথা আমার একদমই মনে নাই। 🙁 🙁 🙁

    তোমার লেখা পড়ে চোখে পানি চলে আসল। পাঁচ তারা।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জুনায়েদ কবীর(৯৫-০১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।