চেতনায় একেশ্বরবাদ, হৃদয়ে বুদ্ধের বাণী – পর্ব ৩

চেতনায় একেশ্বরবাদ, হৃদয়ে বুদ্ধের বাণী – পর্ব ৩
ড. রমিত আজাদ

সম্রাট অশোক এবং মগধ-বাংলার অহিংস ও সাম্যের দর্শন বৌদ্ধ দর্শন:
ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান যুদ্ধপাগল এক সম্রাট ছিলেন অশোক, তাঁর নেশা ছিলো একটিই – বিজয়। ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন চাণক্যের পরামর্শে বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্যের অধিকারী হন অশোকের পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, (বিশ্বজয়ী মহাবীর আলেকজান্ডারের নামজাদা সেনাপতি সেলুকাসের কন্যাকেও বিবাহ করেন তিনি)। তাই উত্তরাধিকার সূত্রেই বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক হন সম্রাট অশোক। স্থবির না থেকে পিতামহের স্থাপিত সাম্রাজ্যকে আরো সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেন অশোক। করেনও তাই। ‘ইতিহাসের লক্ষ-কোটি নৃপতির নামের ভিড়ে অশোক নামটি একাকী একটি নক্ষত্রের মতন জ্বলজ্বল করছে’ – একথা তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু কথা হলো, কেন? তিনি যুদ্ধজয়ী সম্রাট ছিলেন তাই? সেরকম তো আরো কত সম্রাটই ছিলেন! না, বাহুবলের শৌর্য্য উনাকে এতটা খ্যাতি দেয়নি, উনার খ্যাতির মূলে রয়েছে জীবনের এক পর্যায়ে পূর্বপুরুষের দর্শন ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মানবতাবাদী দর্শন বৌদ্ধ দর্শনকে গ্রহন ও তাকে রাজানুকুল্য দেয়া।

আগে কয়েকবার লিখেছি যে, অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ ছিলো আর্য সাম্রাজ্যের বাইরে। আর্যরা এদেরকে খুব সহজে দখলে নিতে পারছিলো না। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন কলিঙ্গ দখলের কিন্তু সফলকাম হননি। তাই এবার পৌত্রের নজর পড়লো কলিঙ্গের দিকে। দুই পক্ষের সৈন্যবাহিনীই শক্তিশালী। কিন্তু মৌর্য সৈন্যরা অনেক বেশি যুদ্ধপটু আর কৌশলী। কলিঙ্গের সৈন্যরা বীর, স্বাধীনচেতা, শত্রু যত শক্তিশালীই হোক না কেন তার কাছে হার মানতে রাজি নয়। তারা বীর-বীক্রমে লড়াই করে গেলো। এরকম পরিস্থিতিতে যা হবার তাই হলো। আহত আর নিহত সৈন্যে ভরে উঠল যুদ্ধক্ষেত্র। রক্তাক্ত হলো সমস্ত প্রান্তর। একসময় কলিঙ্গরাজ নিহত হলেন। পরাজিত হলো কলিঙ্গ, বিজয়ী হলেন অশোক, স্বপ্ন-পূরণ হলো তাঁর।

বিজয়ী মগধ সম্রাট হাতির পিঠে চেপে যেতে যেতে দেখলেন তার দুপাশে ছড়িয়ে রয়েছে কত অসংখ্য মৃতদেহ। কত আহত সৈনিক। কেউ আর্তনাদ করছে, কেউ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে চিৎকার করছে। কেউ সামান্য একটু পানির জন্য ছটফট করছে। আকাশে মাংসের লোভে শকুনের দল ভিড় করছে। যুদ্ধক্ষেত্রের এই বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখে সম্রাট বিষণ্ন হয়ে গেলেন। অনুভব করলেন তার সমস্ত অন্তর ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। ধীরে ধীরে নিজের তাঁবুতে ফিরে দেখলেন, শিবিরের সামনে দিয়ে চলেছে এক তরুণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসী আর যোদ্ধা এই জীবনে দুইজন দুই মেরুর মানুষ। যোদ্ধা অশোক প্রশ্ন করেন সন্ন্যাসীকে, “সন্ন্যাসী তুমি কোথায় যাও?”
সন্ন্যাসী বললেন, “আমি যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈনিকদের সেবা করতে চলেছি।”
মুহূর্তে অনুতাপের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল সম্রাটের হৃদয়। সম্রাটের অন্তরে জ্বলে উঠল নতুন এক প্রজ্ঞার আলোক। তিনি শপথ করলেন আর যুদ্ধ নয়, আর হিংসা নয়, মহামতি বুদ্ধের করুণার আলোয় অহিংসা মন্ত্রে ভরিয়ে দিতে হবে সমগ্র পৃথিবী।

একদিন যিনি ছিলেন উন্মত্ত দানব চণ্ড-অশোক, তিনি এবার হলেন শান্তি আর অহিংসার পূজারী – পিয়দশি (প্রিয়দর্শী) অশোক। জীবনের অবশিষ্ট সময় অহিংস ধম্মই তাঁর পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে।

খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩-২৭২ অব্দে বিন্দুসারের মৃত্যুর পর রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে তাঁর পুত্রদের মধ্যে প্রায় দীর্ঘ চার বছর যুদ্ধের পর অশোক খ্রিস্টপূর্ব ২৬৯-৬৮ অব্দে রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন।
সম্রাট অশোকের সর্বকনিষ্ঠ ভাইয়ের নাম ছিল বীতাশোক। ছেলেবেলা থেকেই বীতাশোক ছিলেন রাজ ঐশ্বর্য সুখভোগ বিষয়ে উদাসীন। অশোক ও তার অন্যান্য ভাইয়েরা সিংহাসনের অধিকার নিয়ে যখন বিবাদ, হানাহানিতে মত্ত বীতাশোক তখন আরও বিষণ্ন হয়ে উঠলেন। সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন মুক্তির আশায়। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী গিরিদত্তের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে বৌদ্ধসঙ্ঘে ভিক্ষু হয়ে গেলেন।

অশোক ঘোষণা করলেন আর যুদ্ধ নয়, এবার হবে ধর্ম বিজয়। ভ্রাতৃত্ব, প্রেম, করুণার মধ্যে দিয়ে অপরকে জয় করতে হবে। শুধুমাত্র নির্দেশ প্রদান করেই নিজের কর্তব্য শেষ করলেন না। এত দিন যে রাজসুখ বিলাস ব্যসনের সাথে পরিচিত ছিলেন তা পরিত্যাগ করে সরল পবিত্র জীবনযাত্রা অবলম্বন করলেন।

তিনি সকল প্রতিবেশী দেশের রাজাদের কাছে দূত পাঠিয়ে ঘোষণা করেছিলেন তিনি তাদের সাথে মৈত্রী, প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চান। সকলে যেন নির্ভয়ে আপন রাজ্য শাসন করেন। এমনকি সম্রাট অশোক তার উত্তরাধিকারীদের কাছেও দেশ জয়ের জন্য যুদ্ধ করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি তাদের উপদেশ দিতেন অস্ত্রের মাধ্যমে নয়, প্রেম করুণা সহৃদয়তার মধ্যে দিয়েই মানুষকে জয় কর। এই জয়কে সম্রাট অশোক বলতেন ধর্ম বিজয়। ইতিপূর্বে একবার বলেছি যে, মহাবীর আলেকজান্ডার নন গৌতম বুদ্ধই প্রথম বিশ্বজয় করেছিলেন। আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাসের সাথে সামরিক-রাজনৈতিক মৈত্রীর সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন অশোকের পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, আর সম্রাট অশোক মহামতি বুদ্ধের মত হৃদয় দিয়ে বিশ্ব-নেতৃবৃন্দের সাথে মৈত্রীর সম্পর্ক স্থাপন করলেন।

দেশের অভ্যান্তরে বৌদ্ধ দর্শন প্রচার:
সম্রাট অশোক বৌদ্ধ দর্শনকে রাজানুকূল্য দিলেন। কোন দর্শন যখন রাজানুকূল্য পায় (ক্ষমতা যোগ দর্শন/ধর্ম) তখন তা অতি দ্রুতই প্রসারিত হয়। সেটাই ঘটতে শুরু করলো।
প্রধানত অশোকেরই প্রচেষ্টায় ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার লাভ করে। তবে তিনি ধর্ম প্রচারের জন্য শুধু যে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচারকদের পাঠাতেন তাই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্তম্ভ পর্বত শিলাখণ্ডের ওপর বিভিন্ন বৌদ্ধ উপদেশ উৎকীর্ণ করে দিতেন যাতে সেই অনুশাসন পাঠ করে প্রজারা তা পালন করতে পারে। শুধু উপদেশ নয়, জনহিতকর কাজেও নামলেন তিনি, অশোকের নির্দেশে বহু পথ নির্মাণ করা হলো। এই সমস্ত পথের দুপাশে প্রধানত বট এবং আম গাছ পোঁতা হতো। যাতে মানুষ ছায়ায় পথ চলতে পারে। ক্ষুধার সময় গাছের ফল খেতে পারে। প্রতি আট ক্রোশ অন্তর অন্তর পথের ধারে কূপ খনন করা হয়েছিল, মানুষের পানির তেষ্টা মেটানোর জন্য। অপরাধীদের জন্য শাস্তির পরিমাণ লাঘব করা করেছিলেন । অশোক মৃত্যু দন্ড রহিত করেন নি। তিনি মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ব্যাক্তিকে তিনদিনের অবকাশ লাভের সুযোগ দিয়েছিলেন ।

নারীদের নৈতিক উন্নতির জন্য অশোক বিশেষ কর্মচারী নিযুক্ত করেন। তা ছাড়া উৎসব অনুষ্ঠান, দিব্যরূপ প্রদর্শন (বিমান দর্শন) প্রভৃতি বিভিন্ন বিনোদনের মাধ্যমেও তিনি ধর্ম প্রচার করেন । তিনি নিজে বিহার যাত্রার পরিবর্তে ধর্মযাত্রা শুরু করেন। ধর্ম যাত্রার অর্থ গৌতম বুদ্ধের স্মৃতিবিজরিত স্থানগুলিতে গিয়ে বুদ্ধের বাণী প্রচার করা । ভেরী ঘোষের পরিবর্তে ধর্মঘোষ ধ্বনিত হয়।

শুধু মানুষ নয়, পশুদের প্রতিও ছিল তার গভীর মমতা। তিনি সমস্ত রাজ্যে পশুহত্যা ও শিকার নিষিদ্ধ করেছিলেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে তিনিই প্রথম পশুদের জন্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন। সর্বজীবের প্রতি করুণার এমন দৃষ্টান্ত জগতে বিরল।

উনিশ ও বিশ শতকে আবিষ্কৃত অশোকের অসংখ্য প্রস্তরলিপির পাঠোদ্ধারের মাধ্যমে শুধু নৃপতি হিসেবে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনই নয়, তাঁর রাজত্বকালের ঘটনাবলী এবং প্রশাসনের প্রকৃতি সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। অশোক তাঁর তেরোতম লিপিতে নিজের জীবন দর্শন, রাজনীতি ও ধর্ম সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। প্রাচীনকালের রাজকীয় চিন্তাধারা ও কর্মকান্ড সম্পর্কে এত সরল ও ব্যাপকভাবে উপস্থাপিত দলিল সম্রাট অশোকের রাজত্বের পূর্বে বা পরে আর পাওয়া যায় না। তিনি তাঁর লিপিসমূহে মানুষের শান্তি ও কল্যাণের উপর যুদ্ধ কী ধরনের প্রভাব ফেলে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কলিঙ্গ যুদ্ধই তাঁকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে, মানব সংঘ, কল্যাণ ও শান্তির ক্ষেত্রে যুদ্ধ কতটা ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি যুক্তি দিয়ে প্রমানও করার প্রয়াস পেয়েছেন যে, ধর্মীয়, নৈতিক ও রাজনীতি এর কোনো প্রেক্ষিতেই যুদ্ধ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
সমাজ এবং ব্যক্তি স্তরে যুদ্ধের ক্ষতিকর প্রভাব প্রত্যক্ষ করে অশোক বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধের ভিত্তিতে যুদ্ধের পথ পরিহার করে শান্তি ও সামাজিক সৌহার্দ্য গড়ে তোলার দায়িত্ব কাঁধে নিতে পারলে মানুষের কল্যাণ সাধন সম্ভব। তিনি তাঁর রাষ্ট্রীয় এবং ধর্মীয় নীতির নতুন ধারণার ব্যাখ্যা দেন ধম্ম -এর উপর ভিত্তি করে, যা ছিল সম্পূর্ণই ধর্ম ও নৈতিকতা সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব চিন্তা। তিনি তাঁর এ ধারণা প্রস্তরখন্ডে এবং স্তম্ভের গায়ে উৎকীর্ণ করে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা এবং সাধারণের কাছে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বর্ণনা দেন, কী করে কলিঙ্গ যুদ্ধ তাঁর চিন্তাধারায় পরিবর্তন এনেছিল এবং শান্তির জগৎ ও সামাজিক সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিল। কলিঙ্গ যুদ্ধ তাঁর মনোজগতে যে পরিবর্তন এনেছিল, তেরোতম প্রস্তরলিপিতে তার বর্ণনা নিম্নরূপ:
‘‘যখন তিনি (অশোক) ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র, রাজা পিয়দসি আট বছর অতিবাহিত করলেন, তখন কলিঙ্গ জয় হল। এতে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার লোক গৃহহীন হয়, এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয় এবং তারও কয়েক গুণ বেশী মানুষ ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপর যখন কলিঙ্গ তাঁর রাজ্যভুক্ত হয়, তখন ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র ঐকান্তিকতার সঙ্গে ‘ধম্ম’ পালন করেন, তাঁর একমাত্র কাম্য হয়, ধম্ম প্রচার। কলিঙ্গ জয়ের পরে ঈশ্বরের প্রিয়জন অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকেন। কারণ, যখন একটি স্বাধীন দেশ বিজিত হয় তখন হত্যা, মৃত্যু এবং নির্বাসিত মানুষগুলি ঈশ্বরের প্রিয়পাত্রের মনকে ভারাক্রান্ত করে। আরো অনুশোচনা হয় যখন সেখানে বসবাসকারী ব্রাহ্মণ, শ্রমন, অন্ধ যে কোনো বর্ণের লোক অথবা যারা তাদের উপরস্থদের প্রতি অনুগত, বাবা মায়ের প্রতি অনুগত, শিক্ষকের প্রতি অনুগত ও ভালো ব্যবহার করে, এবং বন্ধু, সহকারি, আত্মীয়, দাস ও ভৃত্যদের প্রতি সহনুভূতিশীল প্রত্যেকেই তাদের প্রিয়জনের প্রতি হিংস্রতা, হত্যা এবং বিচ্ছিন্নতায় কষ্ট পায়। এমনকি যে ভাগ্যবানেরা যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেয়েছে এবং যাদের ভালোবাসা কমে নি (যুদ্ধের নির্দয় প্রভাবেও) তারাও তাদের বন্ধু, সহকারি, সহকর্মী এবং আত্মীয়দের দুর্ভাগ্য দেখে কষ্ট পায়। সকল মানুষের এ ধরণের কষ্ট পাওয়ার বিষয়টি ঈশ্বরের প্রিয়পাত্রের মনের উপর ভারী বোঝা হয়ে জেঁকে বসে। ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র বিশ্বাস করেন যে, যারা ভুল কাজ করে তাদের যতদূর সম্ভব ক্ষমা করে দেয়া উচিত। ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র বনবাসী অপরাপর গোত্রদের তাঁর সাম্রাজ্যে স্বাগত জানিয়েছেন এবং ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন যে, প্রত্যেক মানবগোষ্ঠীকে নির্বিঘ্নে, স্বনিয়ন্ত্রিত হয়ে মানসিক শান্তিতে এবং ভদ্রভাবে বাস করতে দেয়া উচিত…

অশোকের রাজত্বকাল বেশ কয়েকটি বৌদ্ধসংঘ পুনর্গঠনের কারণে উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দে সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সহায়তায় পাটলীপুত্রে তৃতীয় বৌদ্ধ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। অশোকের শাসনামলেই প্রধান প্রধান বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলোর সংকলনের কাজ শেষ হয়। তিনি বৌদ্ধধর্মের থেরাবাদী সম্প্রদায়কে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন এবং সংঘকে ভিন্নমতাবলম্বীদের সেখান থেকে বহিষ্কার করার নির্দেশ দেন। এ সম্মেলন থেকেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, ধর্মান্তরের মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মকে এশিয়ার প্রত্যেক অংশে এমনকি এশিয়ার বাইরেও কার্যকর করে তোলার। অশোক তাঁর লিপিতে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের নামোল্লেখ করেছেন যাদের সঙ্গে তিনি কূটনৈতিক এবং অন্যান্যদের সঙ্গে ধর্মপ্রচারক বিনিময় করেন। সাধারণত স্থানীয় ভাষায় অশোকের লিপি উৎকীর্ণ করা হতো। ব্রাহ্মী লিপিতে প্রাকৃত ভাষা অশোকের লিপির প্রধান মাধ্যম হলেও সব ভাষাভাষি মানুষের কাছে বৌদ্ধ ধর্মকে পরিচিত করে তুলতে তাঁর লিপিতে স্থানীয় মানুষের উপযোগী দক্ষিণ ভারতীয় এবং হেলেনীয় ভাষারও ব্যবহার করা হতো।

অশোক বৌদ্ধ হলেও অন্য কোনো ধর্মের প্রতি তার কোনো বিদ্বেষ ছিল না (তবে এই নিয়ে বিতর্কও আছে)। সকলেই যে যার ধর্ম পালন করত। একটি শিলালিপিতে তিনি লিখেছেন, নিজের ধর্মের প্রতি প্রশংসা ও অন্যের ধর্মের নিন্দা করা উচিত নয়। পরস্পরের ধর্মমত শুনে তার সারবস্তু, মূল সত্যকে গ্রহণ করা উচিত।

সমসাময়িক বৈদিক, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মীয় বিশ্বাসের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলির প্রতিক্রিয়া হিসেবে ধম্ম-এর ধারণার সৃষ্টি হয়। একটি নতুন ভাবাদর্শ সৃষ্টির লক্ষ্যে অশোক প্রচলিত বিশ্বাস ও চিন্তা থেকে তাঁর মূল্যবোধ গ্রহণ করেন এবং ধম্ম-এর সঙ্গে এর সংশ্লেষ ঘটান। ফলে অশোকের বিশাল সাম্রাজ্যে বহুবিধ ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক এবং সামাজিক ব্যবস্থার সংমিশ্রণ ঘটে এবং তাঁর রাজ্যে মিশ্র জনগণ প্রত্যেকেই তাদের স্ব স্ব অবস্থানে নিরাপদ ছিলেন। ধম্ম-এর মূলনীতিই এমন ছিল যে, প্রত্যেক ধর্ম, বর্ণ এবং মতাবলম্বীদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ধম্ম-এর মূল বাণী ছিল ‘সহনশীলতা’। অশোকের মতে প্রত্যেক মানুষ এবং তাদের বিশ্বাস ও ভাবধারার মাঝে সহনশীলতার ধারণা সম্প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন। অশোকের দৃষ্টিতে সহনশীলতা হলো দাস ও ভৃত্যের প্রতি দয়া প্রদর্শন, শিক্ষকের প্রতি সম্মান দেখানো, বাবা-মায়ের প্রতি আনুগত্য, বন্ধু সহকর্মী এবং আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি উদারতা প্রদর্শন, ব্রাহ্মণ এবং শ্রমণদের সম্মান করা এবং তাদের অর্থ সাহায্য দান এবং সকল প্রাণীর প্রতি সদয় থাকা। অশোক তাঁর দ্বাদশ প্রস্তরলিপিতে ঘোষণা করেছেন যে, কেবল নিজের জন্যই নয়, একজন মানুষের জীবনের প্রধান দায়িত্ব হলো সকল ধর্মের কল্যাণ ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করা।

সম্রাট অশোক তাঁর রাজত্বের ত্রয়োদশ বছরে পঞ্চম প্রস্তরলিপির মাধ্যমে ধম্ম-এর আদর্শের প্রচারণা শুরু করেন। এ লিপিতে অশোক বন্দীদের প্রতি দয়া প্রদর্শনের জন্য রাজকর্মচারীদের নির্দেশ দেন। যে সকল বন্দীর সন্তান-সন্ততি আছে, যারা বৃদ্ধ, দুর্বল এবং অসুস্থ তাদের তিনি মুক্ত করে দেন। তিনি তাঁর একাধিক লিপিতে মানবজাতির কল্যাণের ও সুখ শান্তি প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন এবং সে লক্ষ্যে পৌঁছাবার উপায় তিনি তাঁর ষষ্ঠ প্রস্তর লিপিতে বর্ণনা করেন। তাঁর ধম্ম-এর চিন্তার মূলে ছিল প্রত্যেক ধর্ম এবং ধর্মাচরণের প্রতি সহনশীলতা ও ভালোবাসা। তিনি তাঁর দ্বিতীয় লিপির মাধ্যমে শুধু মানুষ, পশু এবং পাখির প্রতি দয়া প্রদর্শন নয়, বরং উদ্ভিদ জগতের প্রতিও সহনশীল হওয়ার নির্দেশনা দেন। তিনি ফলদায়ক বৃক্ষ, ঔষধি লতাগুল্ম, এবং জ্বালানির জন্য বৃক্ষ রোপনের এবং উদ্ভিদকূলের স্বাভাবিক বর্ধণ ব্যাহত না করার নির্দেশ দেন।

একটি শিলালিপিতে অশোক বলছেন “সব মানুষ আমার সন্তান। আমি তাদের পিতার মত। প্রত্যেক পিতা যেমন তার সন্তানের মঙ্গল ও খুশি চান তেমন আমিও চাই জগতের প্রত্যেকটি মানুষ যেন সবসময় আনন্দে থাকে।”

বিদেশে ধর্ম/দর্শন প্রচারঃ
শুধু ভারতবর্ষ নয়, বাইরে আরও বহু দেশে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য লোক পাঠালেন অশোক। তিনি চেয়েছিলেন তার অহিংসা ও প্রেমের বাণী সকল মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে।

সম্রাট অশোকের বিশ্বরাষ্ট্রের ধারণা বিশ্লেষণে পন্ডিতগণ সমসাময়িক বৌদ্ধধর্মীয় চক্রবর্তিন বা বিশ্বজনিন সম্রাটের ধারণার উপর গুরুত্ব দেন। সম্রাট হবেন পাপমুক্ত এবং করুণার প্রতীক। সমসাময়িক জৈন ধর্মীয় দিগ্বিজয়ী ধারণার সঙ্গে এ বিশ্বজনীন রাজার ধারণার মিল রয়েছে। কিন্তু অশোক তাঁর প্রস্তরলিপিতে কখনোই নিজেকে চক্রবর্তী বা দিগ্বিজয়ী হিসেবে দাবি করেন নি।

ভারতের বাইরেও যাতে ধর্মের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে, তার জন্য তিনি রাজ্যবিজয় নীতির পরিবর্তে ধর্মবিজয় নীতি গ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন দিকে বৌদ্ধ প্রচারক প্রেরন করেন । মহাবংশ অনুসারে ব্রহ্মদেশে, পশ্চিম এশিয়া, তুরষ্কে মিশর, ম্যাসিডন ও গ্রীসে ধর্মপ্রচার করেছিলেন। সিংহলে তাঁর পুত্র মহেন্দ্র কন্যা সংঘমিত্রাকে প্রেরণ করেছিলেন। ঐতিহাসিক সান্ডার্স এর মতে – অশোকের ধর্ম প্রচার করে এশিয়া, ইউরোপে ও আফ্রিকা মহাদেশে কুসংস্কারাচ্ছন্ন অধীবাসীদের মধ্যে কৃষ্টিমুলক প্রভাব বিস্তার সমর্থ হয়েছেন।

অশোকের কিছু শিলালিপি গ্রীক ও আরামাইক ভাষায় লেখা আছে। বৌদ্ধ সাহিত্যে আরো জানা যায়, অশোক গ্রীক রাজ্যগুলোতে মানুষ ও পশুর জন্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুতরাং অশোকের এই জনহিতকর ও মানবিক কার্যাবলীর গ্রীকদের স্পর্শকাতর মনের উপর যথেষ্ঠ প্রভাব বিস্তার লাভ করেছিল। সিলঁবা লেভির রচনায় জানা যায়- অশোকের মৃত্যুর অল্পকালেন মধ্যে অনেক গ্রীক বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেছিলেন। সুতরাং এটি অশোকের ধর্ম প্রচারের ফলশ্রুতি তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

পরিশেষে বলা যায় যে, অশোক বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে একজন কিংবদন্তী। যার অবদানে বিশ্বে এক তৃতীয়াংশ মানুষ আজ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং অশোকের সময় থেকেই বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্বধর্মে পরিণত হয়েছে।

ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি শাসনকার্যঃ
ধর্মচরণে অধিক মনোযোগী হলেও রাজ্যশাসনের ব্যাপারে সামান্যতম দুর্বলতা দেখাননি। পিতা-পিতামহের মতো তিনিও ছিলেন সুদক্ষ প্রশাসক। সুবিশাল ছিল তার রাজ্যসীমা। তিনি শাসনকাজের ভার উপযুক্ত ব্যক্তিদের হাতেই দিতেন এবং প্রয়োজনমতো তাদের নির্দেশ দিতেন।
সম্রাট অশোক তার সমস্ত জীবন প্রজাদের সুখ কল্যাণে তাদের আত্মিক উন্নতির জন্য ব্যয় করেছিলেন। তবুও তার অন্তরে দ্বিধা ছিল। একজন সম্রাট হিসেবে তিনি কি তার যথার্থ কর্তব্য পালন করছেন? একদিন গুরুকে প্রশ্ন করলেন, গুরুদেব, সর্বশ্রেষ্ঠ দান কী?
বৌদ্ধ সন্ন্যাসী উত্তর দিলেন, সর্বশ্রেষ্ঠ দান ধর্মদান। একমাত্র ধর্মের পবিত্র আলোতেই মানুষের অন্তর আলোকিত হয়ে উঠতে পারে। তুমি সেই ধর্মদান কর।
গুরুর আদেশ নতমস্তকে গ্রহণ করলেন অশোক। তারই অনুপ্রেরণায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল বৌদ্ধ ধর্মের সুমহান বাণী। কিন্তু যেখানে বৌদ্ধ ধর্মের কোনো আলো গিয়ে পৌঁছায়নি, কে যাবে সেই দাক্ষিণাত্যে, সুদূর সিংহলে? অবশেষে অশোকের পুত্র মহিন্দ ও কন্যা সংঘমিত্রা সিংহলে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন।

বাংলায় সম্রাট অশোকের শাসন:
অশোক পাটলীপুত্র (বর্তমান পাটনা বা এর কাছাকাছি কোনো স্থান) হতে তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করতেন। অশোকের সময়ে পুন্ড্রবর্ধন (বর্তমান উত্তরবঙ্গের বগুড়া) মৌর্য সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ বা প্রশাসনিক বিভাগ ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, রাজকীয় তহবিল এবং ধম্ম প্রচারের ব্যয় নির্বাহের অর্থের প্রধান উৎস ছিল গঙ্গা উপত্যকা ও বাংলা থেকে সংগৃহীত রাজস্ব।

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে মহাস্থানে প্রাপ্ত ব্রাহ্মী শিলালিপি থেকে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, মৌর্য আমলে পুড্রবর্ধন বর্তমান মহাস্থান একটি প্রসিদ্ধ শাসনকেন্দ্র ছিল এবং এখানে একজন ‘মহামাত্র’ বা প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক যুগের প্রথম সূচনা হয় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের (খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক) শাসনামল থেকে। তিনিই প্রথম তৎকালীন ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চল জয় করে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পন্ডিতদের ধারণা সমগ্র বাংলাদেশ তখন মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল (আহমেদ, নাজিমউদ্দিন; মহাস্থান, ময়নামতি ও পাহাড়পুর, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃঃ ৬)। মহাস্থানে প্রাপ্ত ব্রাহ্মী-শিলালিপিখানি মৌর্যসম্রাট অশোক কর্তৃক প্রজ্ঞাপ্ত বলে স্থিরকৃত হয়েছে। এ লিপিতে ছবগ্গীয় বা ষড়বর্গীয় থেরবাদী ভিক্ষুদের উল্লেখ রয়েছে।

হিউয়েন সাঙ তাঁর ভ্রমণ-কাহিনীতে আরো উল্লেখ করেছেন যে, তিনি পুড্রবর্ধন (উত্তরবঙ্গ), সমতট (পূর্ববঙ্গ), তাম্রলিপ্তি (দক্ষিণ বা দক্ষিণ পশ্চিম বঙ্গ) ও কর্ণসুবর্ণ (পশ্চিমবঙ্গ) পরিদর্শনকালে অশোক কর্তৃক নির্মিত বহু স্তূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম-দ্বিতীয় শতকে রচিত দিব্যাবদান গ্রন্থে জানা যায় যে, মধ্যদেশের পূর্বসীমা পুড্রবর্ধন নগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল (Law, B.C; Geography of Early Buddhism, Delhi 1973, pp.1-2)|

বৈদিকদের বিরূপতা:
কিন্তু সেকালের বৈদিক ব্রাহ্মণরা তার এই বৌদ্ধ ধর্মপ্রীতিকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। আর্য রাজার অনার্য দর্শন বৌদ্ধ গ্রহন করা তাদের পক্ষে ভালোভাবে দেখার কথাও না। তাই তার সভাসদদের মধ্যে যারা ব্রহ্মণ্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন তাদের মধ্যে প্রচন্ড অসন্তোষ ছিলো। উপরন্তু তার এক রানি তিষ্যরক্ষিতা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম বিরোধী। তিষ্যরক্ষিতা ব্রাহ্মণদের সাথে গোপন ষড়যন্ত্র করতে আরম্ভ করলেন। প্রথমে অশোক কোনো কিছুই জানতেন না। কিন্তু কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচর তার কাছে সমস্ত সংবাদ প্রকাশ করে দিল। অশোকের রাজত্বকালে শেষ অনুশাসনগুলোর একটি রাজাদেশ প্রচারিত হয়েছিলো আগের মত রাজার নামে নয় বরং রাণীর নামে।

এদিকে রাষ্ট্রের ক্ষমতাও কার্যত অশোকের পৌত্র সম্পাতি (সম্প্রতি)-র হাতে চলে যায়। রক্ষণশীল ব্রাহ্মণরা সম্পাতিকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রচুর অর্থদান করছেন ও ধর্মকাজে রাজকোষ শূণ্য করে ফেলছেন। তখন সম্পাতি এই অর্থ বরাদ্ধ অনেক কমিয়ে দেন।

প্রচণ্ড মর্মাহত হলেন অশোক। যে আদর্শকে এত দিন তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে প্রচার করেছেন আজ নিজের স্ত্রী তার বিরোধিতা করছে। মনের দুঃখে রাজ্যপাট ত্যাগ করে বৌদ্ধবিহারে গিয়ে আশ্রয় নিলেন।

সম্রাটের শেষ জীবন:
সম্রাট অশোকের অনেক স্ত্রী ও সন্তান ছিলো। প্রধান মহিষী ছিলেন অসন্ধিমিত্রা।
অশোকের শেষ দিনগুলিতে তার নাতি সম্পতিই সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। অশোক কেবল কাগজে-কলমেই রাজা হয়ে রইলেন।যেহেতু সম্পতি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি খুব একটা অনুরক্ত ছিলেন না, তাই অশোকের আমলে ধর্মপ্রচারের জন্য প্রজাদের কল্যাণের জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হতো, সম্পতি সেই ব্যয় কমিয়ে দিলেন। অশোকের তখন আর তেমন কিছুই করার ছিলোনা।

একদিন যিনি ছিলেন সমগ্র ভারতের সম্রাট, আজ তিনি রিক্ত। বুঝতে পারলেন পৃথিবীতে তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে, এবার বিদায় নিতে হবে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই বেদনাহত চিত্তে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন নৃপতি মহামতি অশোক।

সম্রাট অশোকের গুপ্ত সংঘ:
সম্রাট অশোককে নিয়ে একটি মিথ প্রচলিত আছে – তিনি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নেয়ার পরপরই গঠন করলেন ৯ সদস্যের একটি দল (Ashoka’s Secret Society of Nine Men)- পৃথিবীর ইতিহাসের সবচাইতে গোপন। যাদের দায়িত্ব ছিলো জ্ঞান সংগ্রহ করে তা সংরক্ষণ করা। তাও এমন সব জ্ঞান যা সাধারণ মানুষের কাছে বা ভুল মানুষের হাতে গেলে তা হতে পারে মানবসভ্যতার জন্য হুমকি। নয়জনে লিখলেন নয়টি বই। যাতে কুক্ষিগত করা হলো কিছু বিদ্যা।

১। প্রপাগান্ডা ও সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার – এই গ্রন্থ হলো সেট অফ মেসেজ, যার মাধ্যমে বৃহৎ মানবগোষ্ঠির উপর প্রভাব বিস্তার করা যায়।
২। ফিজিওলজি- এই গ্রন্থ জীবের যান্ত্রিক, ভৌত ও বায়োলজিকাল ফাংশনগুলো অধ্যায়ন করে।
৩। মাইক্রোবায়োলজি – এই মিথ অনুযায়ী পবিত্র গঙ্গা নদীর পানি এক জাতীয় জীবাণুর দ্বারা বিশুদ্ধ করা হয়েছে। হিমালয়ের একটি গোপন ঘাঁটিতে বসে তা করা হয়েছিলো। তাই গঙ্গার পানিতে স্নান করে অনেকেই আরোগ্য লাভ করেছে।
৪। আলকেমি – ধাতুর রূপান্তর সম্পর্কে এখানে বলা হয়েছে। মিথ অনুযায়ী ভারতবর্ষের উপাসনালয়গুলোতে প্রচুর পরিমানে স্বর্ন রয়েছে। উপমহাদেশের স্বল্প পরিমান প্রাকৃতিক খনি থেকে এতো স্বর্ণ পাওয়া যাওয়ার কথা নয়।
৫ কমিউনিকেশন – এই গ্রন্থে মহাজাগতিক যোগাযোগের কথা বলা হয়েছে।
৬। গ্র্যাভিটেশন – বিমান শাস্ত্র: এই গ্রন্থে বিমান নির্মানের কৌশল সম্পর্কে বলা হয়েছে।
৭। কসমোলজি – এই গ্রন্থে স্থান-কালের মধ্য দিয়ে প্রচন্ড দ্রুত গতিতে ভ্রমণ, টাইম-ট্রাভেল ও আন্তঃবিশ্বজগতে ভ্রমণ সম্পর্কে বলা হয়েছে।
৮। লাইট – এই গ্রন্থে আলোর গতিবেগ নিয়ন্ত্রণপূর্বক তাকে অস্ত্র হিসাবে লক্ষ্যবস্তুতে ব্যবহার করা।
৯। সোশিওলোজি -এই গ্রন্থে সমাজবিকাশের বিভিন্ন আইন-কানুন ও সামাজিক অবক্ষয়ের বিষয়ে বলা আছে।

(চলবে)

১,৮৬২ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “চেতনায় একেশ্বরবাদ, হৃদয়ে বুদ্ধের বাণী – পর্ব ৩”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "সন্ন্যাসী আর যোদ্ধা এই জীবনে দুইজন দুই মেরুর মানুষ" - পৃথিবীটা গোল, তাই কখনো কখনো আবার তারা এক হয়ে যায়।
    "মানব সভ্যতার ইতিহাসে তিনিই প্রথম পশুদের জন্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন। সর্বজীবের প্রতি করুণার এমন দৃষ্টান্ত জগতে বিরল।"- এ তথ্যটা আগে অজানা ছিলো। ধন্যবাদ এ তথ্যের জন্য।
    "তিনি যুক্তি দিয়ে প্রমানও করার প্রয়াস পেয়েছেন যে, ধর্মীয়, নৈতিক ও রাজনীতি এর কোনো প্রেক্ষিতেই যুদ্ধ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।" - এটাও এই প্রথম জানলাম।
    "অশোকের মতে প্রত্যেক মানুষ এবং তাদের বিশ্বাস ও ভাবধারার মাঝে সহনশীলতার ধারণা সম্প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন। অশোকের দৃষ্টিতে সহনশীলতা হলো দাস ও ভৃত্যের প্রতি দয়া প্রদর্শন, শিক্ষকের প্রতি সম্মান দেখানো, বাবা-মায়ের প্রতি আনুগত্য, বন্ধু সহকর্মী এবং আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি উদারতা প্রদর্শন, ব্রাহ্মণ এবং শ্রমণদের সম্মান করা এবং তাদের অর্থ সাহায্য দান এবং সকল প্রাণীর প্রতি সদয় থাকা। অশোক তাঁর দ্বাদশ প্রস্তরলিপিতে ঘোষণা করেছেন যে, কেবল নিজের জন্যই নয়, একজন মানুষের জীবনের প্রধান দায়িত্ব হলো সকল ধর্মের কল্যাণ ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করা।" - চমৎকার উপলব্ধি।

    জবাব দিন
  2. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "তাঁর ধম্ম-এর চিন্তার মূলে ছিল প্রত্যেক ধর্ম এবং ধর্মাচরণের প্রতি সহনশীলতা ও ভালোবাসা। তিনি তাঁর দ্বিতীয় লিপির মাধ্যমে শুধু মানুষ, পশু এবং পাখির প্রতি দয়া প্রদর্শন নয়, বরং উদ্ভিদ জগতের প্রতিও সহনশীল হওয়ার নির্দেশনা দেন। তিনি ফলদায়ক বৃক্ষ, ঔষধি লতাগুল্ম, এবং জ্বালানির জন্য বৃক্ষ রোপনের এবং উদ্ভিদকূলের স্বাভাবিক বর্ধণ ব্যাহত না করার নির্দেশ দেন।" - অত্যন্ত সহৃদয়তার পরিচায়ক।
    "সম্রাট হবেন পাপমুক্ত এবং করুণার প্রতীক" - আহা! কতইনা সৌভাগ্যের কথা এমন সম্রাট বা শাসক পাওয়া!
    "তিনি শাসনকাজের ভার উপযুক্ত ব্যক্তিদের হাতেই দিতেন এবং প্রয়োজনমতো তাদের নির্দেশ দিতেন।' - এটা করতে পারাটাই একজন শাসকের সবচেয়ে বড় গুণ বলে আমি মনে করি।
    Ashoka’s Secret Society of Nine Men সম্পর্কিত তথ্যাবলী বড়ই চমৎকার লাগলো।
    কিন্তু এতকিছু পড়ার পর ভাবছি, সম্প্রতি মিয়ানমারে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা আরাকানি ও রোহিংগা মুসলিমদের উপর যে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা কি তাদের ধর্মীয় দীক্ষা থেকে সরে আসার কারণে?

    জবাব দিন
    • ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

      খুব সুন্দর মন্তব্য করেছেন খায়রুল ভাই। আপনার মন্তব্য বরাবরই অনুপ্রেরণাদায়ক।

      "সম্প্রতি মিয়ানমারে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা আরাকানি ও রোহিংগা মুসলিমদের উপর যে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছে," - বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করতে হবে। আমি সে সময় একটা কবিতা লিখেছিলাম। 'ভাসছে মানুষ, ভাসছে মানবতা' http://www.somewhereinblog.net/blog/ramit/29620568 ।

      প্রথমে নিজেদের সমালোচনা দিয়েই শুরু করি - আক্রান্ত-বিপদগ্রস্ত, ভীত-সন্ত্রস্ত রোহিঙ্গারা যখন ছুটে এলো বাংলাদেশের সীমান্তে তাদেরই মুসলিম ভাইয়ের সাহায্য পাওয়ার জন্য, টলটলায়মান নৌকায় দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে সাহায্য প্রার্থনা করলো, তখন আমরা কেমন দূরদূর করে ওদের তাড়িয়ে দিয়েছিলাম, মনে পড়ে। অথচ এই আমরাই ১৯৭১ পরিমরি করে ছুটে গিয়েছিলাম ভারতে, সেখানকার জনগণ আমাদের ফিরিয়ে দেয়নি। আর আমরা কি করলাম রোহিঙ্গাদের সাথে? কোথায় আমাদের মানবতা?

      দ্বিতীয়ত, বর্তমান পৃথিবীর তাবৎ শয়তানীর মূলে হয় বৃটিশরা নয় ইহুদীরা। ইতিহাসের বিচারে আরাকান আমাদেরই অংশ ছিলো। আমি যতদূর জানি, ১৯৪৭ সালে, বিভাগের সময় আরাকানীরা পূর্ব বাংলায় যোগ দিতে চেয়েছিলো কিন্তু বৃটিশরা ইচ্ছাপূর্বক সেটা হতে দেয়নি। যেমনটি তারা করেছিলো কাস্মীরের সাথে, যেমনটা করেছিলো কুর্দীস্থানের সাথে। কাস্মীর সমস্যাটি তৈরী করেছিলো ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখতে, তেমনি রোহিঙ্গা সমস্যাটি তৈরী করেছিলো বাংলাদেশ-বার্মার মধ্যে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখতে। এই ডাবল গেম ইংরেজদের অতি পুরাতন পলিসি।

      এরপর আসা যাক বৌদ্ধ দর্শনের অহিংসা প্রসঙ্গে - বৌদ্ধ ধর্ম শান্তির ধর্ম এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে বৌদ্ধরা শান্তিপ্রিয় থাকতে পেরেছে কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন। আমি বাংলার পাল শাসনামক নিয়ে গর্ববোধ করি। তখন আমাদের বাঙালীদের সাম্রাজ্যের সীমারেখা বিস্তৃত ছিলো সুদুর আফগানিস্তান পর্যন্ত। কথা হলো এত বিশাল সাম্রাজ্য কি আর শান্তিপূর্ণভাবে এসেছিলো? পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা গোপালের পিতামহ একজন দার্শনিক ছিলেন, কিন্তু পিতা ছিলেন একজন দক্ষ সেনাপতি, রাজা গোপালও ছিলেন অকুতভয় সেনানায়ক। তারপর তার ছেলে ধর্মপাল-ও দক্ষ যোদ্ধা এবং পৌত্র দেবপাল-তো ছিলেন কিংবদন্তি সমরনায়ক। আর এত বিশাল সাম্রাজ্য চারশত বছর টিকিয়ে রাখা (যা কিনা মোগল ডাইনাস্টির চাইতেও দ্বিগুন সময় ও উপমহাদেশের দীর্ঘতম ডাইনাস্টি) কখনোই সম্ভব হতো না যদি তার শক্তিশালী সসস্ত্রবাহিনী না থাকতো। এভাবে দেখবেন, বৌদ্ধ সন্যাসীরা অহিংসার বাণী প্রচার করলেও, বৌদ্ধ শাসকরা কখনোই এ্যাবসোলুট অহিংসা প্রদর্শন করেনি। একই চিত্র দেখবেন চীনে, জাপানে, কোরিয়ায় ইত্যাদি। এমনকি বৌদ্ধরা নিজেদের মধ্যেও মারামারি-যুদ্ধ বিগ্রহ করেছে, যেমন চীন-জাপান, চীন-ভিয়েতনাম, বার্মা-থাইল্যান্ড, চীন-মঙ্গোলিয়া, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
      দর্শনের পাশাপাশি বাস্তবতাও রয়েছে।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।