‘ওম মনিপদ্মে হুম’ – পর্ব ৫

‘ওম মনিপদ্মে হুম’ – পর্ব ৫
———————-ড. রমিত আজাদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর থেকে)

বধু শুয়ে ছিলো পাশে, শিশুটিও ছিলো,
প্রেম ছিলো, আশা ছিলো, জোৎস্নায়
তবে সে দেখিলো কোন ভুত?
ঘুম কেন ভেঙে গেলো তাঁর?

গৃহত্যাগী হলেন রাজপুত্র সিদ্ধার্থ, জীবনের সব মায়া ছেড়ে। বিলাসবহুল প্রাসাদ তাঁকে আর কোন দিন টানতে পারেনি, পথে পথেই কাটিয়ে দিলেন বাকি জীবনটা। শিষ্যদের মধ্যে গৌতম বুদ্ধ মৌখিকভাবে উপদেশ দিতেন। জীবদ্দশায় তিনি বৌদ্ধসঙ্ঘ স্থাপন করেন।
.
বুদ্ধ তাঁর প্রচারিত ধর্মের কোন গ্রন্থ রচনা করেন নি। তাঁর পরিনির্বাণের পর মেধাবী শিষ্যগণ কর্তৃক বৌদ্ধদের ক্রমাগত তিনটি মহাসভায় তাঁর বাণী, মত, আচার ব্যবহার ও দর্শন সংগৃহীত হয়। বুদ্ধের পরিনির্বণের পর তাঁর প্রধান শিষ্যত্রয় (দুই শিষ্য সারিপুত্র ও মৌদ্গলায়ন বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই মারা যান) মহাকাশ্যপ, আনন্দ এবং উপালি প্রথম বর্ষায় রাজগৃহে (রাজগীরে) উপস্থিত হয়ে বুদ্ধের বাণীগুলি সঙ্কলনের জন্য এক মহাসভার (council) আহ্বান করেন। এটাই প্রথম ধর্ম-সঙ্গীতি নামে বিখ্যাত। এ সভায় বিদ্যাবয়োবৃদ্ধ পাঁচশত বুদ্ধশ্রাবক উপস্থিত ছিলেন। মগধরাজ অজাতশত্রু (৪৯৩-৪৬২ খ্রিস্টপূর্ব) এই সভার পৃষ্ঠপোষক এবং মহাকাশ্যপ প্রধান নেতা ছিলেন। বুদ্ধের নিত্যসহচর আনন্দ ধর্মাংশের সংগ্রহে প্রধান নেতা, এবং উপালি বিনয়াংশের সংগ্রহে প্রধান নেতা ছিলেন। দুই শিষ্যের এই সংগ্রহ গ্রন্থ সূত্রপিটক ও বিনয়পিটক নামে প্রসিদ্ধ। অভিধর্ম সূত্রপিটকেরই অন্তর্গত ছিলো। পরে পৃথককৃত হয়ে অভিধর্মপিটক নামে প্রসিদ্ধ হয়। এই তিন পিটককে বলা হয় ত্রিপিটক। ত্রিপিটক থেরাবাদীর শাস্ত্র। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের প্রায় ৫০০ বছর পরে এই ত্রিপিটক লিখিত হয়, এর পূর্বে তা সঙ্ঘের দ্বারা মৌখিকভাবে উপদিষ্ট হতো। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের এই মূল পিটকগুলি বুদ্ধকথিত মগধের পালিভাষায় রচিত হয়। পরবর্তীতে বৌদ্ধধর্ম প্রাদেশিক হতে ক্রমশঃ সার্বভৌমিক হলে সংস্কৃতেও শাস্ত্রগ্রন্থাদি রচিত হয়।
.
বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর তাঁর অনুসারি আচার্যদের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বৌদ্ধধর্মের উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসার ঘটতে থাকলেও এর পরিণাম হিসেবে অনুসারিদের মধ্যে বিভিন্ন আচার-বিচার ও মন্তব্যে ভেদও উৎপন্ন হতে থাকে। কেননা বিভিন্ন মানুষ, জাতি বা সমাজের বদ্ধমূল আচার-বিচার, বিশ্বাস বা সংস্কারগুলি নতুন ধর্মে দীক্ষিত ব্যক্তির কাছ থেকে একেবারে চলে যায় না। ফলে বিভিন্ন সম্প্রদায়গত মতের উদ্ভব ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই কোন নতুন ধর্ম স্বীকার করা মাত্রই মানুষের জীবন বা বিশ্বাসের আমূল পরিবর্তন ঘটে না, বরং নিজের বিশ্বাস বা পরম্পরাগত অভ্যাস নতুন ধর্মেও প্রভাব ফেলে। এ কারণেই বুদ্ধের শিক্ষা গ্রহণকারী নানা প্রকৃতির মানুষ একে নানাভাবে দেখে এবং বিচার-বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করে। এতে করে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক মতভেদও বাড়তে থাকে।
.
প্রথম সঙ্গীতির (মহাসভা) একশ’ বছরের মধ্যেই অনুসারীদের মধ্যে মতভেদ তীব্র হয়ে ওঠলে এ সময় স্থবির যশ বা যজ্ঞ নামক একজন আচার্য (ভিক্ষু শোণবাসী এবং রেবত নামক অন্য কয়েক প্রখ্যাত ভিক্ষুকে সম্মত করে) ৩৮০ মতান্তরে ৩৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বৈশালীতে দ্বিতীয় মহাসভার (সঙ্গীতি) আহ্বান করেন। এই সভার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো সে সময়ে অনেকগুলো বিকশিত সম্প্রদায়ের বিচারপূর্বক সত্য সিদ্ধান্ত প্রতিপাদন করে বিনয় পরিশোধন করা। কিন্তু পারস্পরিক মতভেদের দরুন সেই সভার উদ্দেশ্য সফল হয় নি। মতভেদের তীব্রতার কারণে বৌদ্ধগণ স্থবিরবাদী ও মহাসাঙ্ঘিক নামে দু’টি সম্প্রদায়ে (নিকায়ে) বিভক্ত হয়ে যায়। স্থবিরবাদ হচ্ছে থেরবাদ। স্থবিরবাদীরা বুদ্ধের মানবতায় বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু মহাসাঙ্ঘিকরা বুদ্ধকে অলৌকিক বা অমানব রূপ দিতে তৎপর ছিলেন। ফলে ভিন্নমতাবলম্বী ভিক্ষুগণ এই সঙ্গীতি বর্জন করে কৌশাম্বীতে পৃথক সভার আহ্বান করেন। এভাবে ভিক্ষুসঙ্ঘে এই প্রথম দুই নিকায় বা পক্ষের সৃষ্টি হয়। এরমধ্যে বৈশালীতে সংগৃহিত সূত্র ও বিনয়ের অনুসরণকারিগণ স্থবিরবাদী এবং কৌশাম্বীর সভায় অনুগামিগণ মহাসাঙ্ঘিক নামে অভিহিত হন। মহাসাঙ্ঘিক সম্প্রদায়ের প্রবর্তকরূপে মহাকাশ্যপকে মানা হয়। বুদ্ধ সম্বন্ধীয় বিচারে মহাসাঙ্ঘিকদের চিন্তাধারাই ছিলো মহাযান ধর্মের প্রধান ভিত্তি। পরবর্তীকালে মহাসাঙ্ঘিক সম্প্রদায় হতে মহাযান বৌদ্ধের উদ্ভব হয়। এই সংস্কারমনা মহাযানীরাই রক্ষণশীল স্থবিরবাদীদের হীনযান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। স্থবিরবাদের প্রবর্তক ছিলেন উজ্জয়িনীর নিবাসী মহাকচ্ছপায়ন। এই হচ্ছে দ্বিতীয় ধর্ম সঙ্গীতি।
.
কিন্তু বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মতভেদ ও বিবাদ নিরন্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই ভেদ দূর করতে কালক্রমে পুনরায় ধর্ম ও বিনয়ের সংস্কার প্রয়োজন হলে সম্রাট অশোকের (২৬৯-২৩২ খ্রিস্টপূর্ব) পৃষ্ঠপোষকতায় পাটলিপুত্রের ‘অশোকারামে’ তৃতীয় সভার অধিবেশন আহুত হয়। কিন্তু বিভেদ নিরসনে সফল না হতে পারায় তিনি স্থবিরবাদকে বুদ্ধের মূলশিক্ষার অনুরূপ হিসেবে ঘোষণা করেন। এই তৃতীয় সভার অধ্যক্ষ ছিলেন তাঁর গুরু ৭২ বছরের বৃদ্ধ আচার্য মোগ্গলিপুত্ত তিস্স (মৌদ্গলিপুত্র তিষ্য)। বিভিন্ন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মতভেদ দূর করে সত্য সিদ্ধান্ত নির্ণয় করার উদ্দেশ্যে আচার্য তিষ্য এক হাজার ভিক্ষুকে নির্বাচন করেছিলেন বলে জানা যায়। এই সভায় তিষ্যের অধ্যক্ষতায় বিবাদগ্রস্ত বিষয়ের উপর নয় মাস ধরে আলোচনা চলে। পরিশেষে তিষ্যের রচিত ‘কথাবত্থু’ গ্রন্থটি প্রমাণস্বরূপ সকলে স্বীকার করেন। এটি হচ্ছে তৃতীয় সঙ্গীতি। এই সঙ্গীতিতে সর্বাস্তিবাদী প্রভৃতি এগারোটি নিকায় স্থবির নিকায় হতে পৃথক হয়। অর্থাৎ বুদ্ধের নির্বাণের একশত বছর পরে (৩৮০ খ্রিস্টপূর্ব) বৌদ্ধসঙ্ঘ স্থবিরবাদ এবং মহাসাঙ্ঘিক নামে যে দুটি নিকায়ে বিভাগ হয়েছিলো, পরবর্তী সোয়াশো বছরে তা বিভক্ত হয়ে মহাসাঙ্ঘিকের ছয়টি এবং স্থবিরবাদের বারোটি, মোট আঠারোটি নিকায় হয়। এই বিভাগগুলি এরকম-
.
প্রথম ধাপ:
বৌদ্ধসঙ্ঘ => (১) মহাসাঙ্ঘিক + (২) স্থবিরবাদ
.
দ্বিতীয় ধাপ:
(১) মহাসাঙ্ঘিক => (৩) গোকুলিক + (৪) এক ব্যবহারিক
(২) স্থবিরবাদ => (৫) বৃজিপুত্রক (বাৎসীপুত্রীয়) + (৬) মহীশাসক
.
তৃতীয় ধাপ:
(৩) গোকুলিক => (৭) প্রজ্ঞপ্তিবাদ + (৮) বাহুলিক (বাহুশ্রুতিক) > (৯) চৈত্যবাদী
(৫) বৃজিপুত্রক => (১০) সম্মিতীয় + (১১) ভদ্রয়াণিক + (১২) ধর্মোত্তরী + (১৩) ছন্নাগারিক
(৬) মহীশাসক => (১৪) ধর্মগুপ্তিক + (১৫) সর্বাস্তিবাদ
.
চতুর্থ ধাপ:
(১৫) সর্বাস্তিবাদ > (১৬) কাশ্যপীয় > (১৭) সাংক্রান্তিক > (১৮) সূত্রবাদী (সৌত্রান্তিক)
.
আঠারোটি নিকায়ের পিটকও (সূত্র, বিনয়, অভিধর্ম) ছিলো, যাদের মধ্যে সূত্র ও বিনয় অনেকটা একরকম ছিলো। অভিধর্ম পিটকে শুধু মতভেদই নয়, এমনকি তাদের গ্রন্থও ছিলো ভিন্ন ভিন্ন। এই ভিন্ন ভিন্ন অভিধর্ম পিটক গ্রন্থগুলোতে একে অন্যের মতবাদকে খণ্ডন করেছেন। সম্রাট অশোক নিজে স্থবিরবাদী হওয়ায় তাঁর সময়কাল পর্যন্ত এই নিকায় রাজপৃষ্টপোষকতা পেলেও অশোকের পরবর্তীকালে ভারতবর্ষ হতে ক্রমশ অন্য বৌদ্ধশাখা কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে স্থবিরবাদী ভিক্ষুগণ শ্রীলঙ্কায় আশ্রয় নেয়। ২৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অশোকের পুত্র মহেন্দ্রর চেষ্টায় শ্রীলঙ্কায় স্থবিরবাদ প্রচারিত হয়। সেখান হতে ব্রহ্ম, শ্যাম প্রভৃতি দেশে তা বিস্তৃত হয়।
.
স্থবিরবাদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বাস্তিবাদ হচ্ছে সর্বপ্রধান। এই সম্প্রদায় তত্ত্বের অনিত্যতায় অবিশ্বাস করে সকল কিছুকে নিত্য বলে স্বীকার করেন। অশোক প্রভৃতি কর্তৃক সর্বাস্তিবাদিরা অনাদৃত হলেও একসময় উত্তর ভারতে সর্বাস্তিবাদেরই প্রাধান্য সৃষ্টি হয়। এই সর্বাস্তিবাদীর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কুষাণবংশীয় রাজা কণিষ্ক (৭৮-১৪৪ খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর সময়ে এই সম্প্রদায় মধ্য এশিয়া ও চীনদেশে প্রসারিত হয়। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বসুমিত্রের নেতৃত্বে এবং পার্শ্ব, অশ্বঘোষ প্রমুখ বৌদ্ধ আচার্যের সহায়তায় জলন্ধরে কুণ্ডলবন বিহারে পাঁচশত ভিক্ষুর সমন্বয়ে চতুর্থ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়। এটাই ছিলো বৌদ্ধধর্মের অন্তিম সঙ্গীতি। এ সভায় বসুমিত্র ছিলেন সভাপতি এবং অশ্বঘোষকে পাটলিপুত্র থেকে এনে উপসভাপতি করা হয়েছিলো। এই মহাসভায় একত্রিত আচার্যগণ বৌদ্ধধর্মের সিদ্ধান্তগুলিকে স্পষ্ট করতে এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মতভেদ দূর করতে বৌদ্ধ ত্রিপিটকের ভাষ্যরূপে ‘মহাবিভাষা’ নামে বিশাল গ্রন্থ প্রণয়ন করা হয়। সর্বাস্তিবাদীর অভিধর্ম পিটকের অন্তর্গত জ্ঞানপ্রস্থানের অভিধর্মের এই ব্যাখ্যাগ্রন্থ মহাবিভাষা সংস্কৃত ভাষায় লিখিত হয়। পূর্বে যে আঠারোটি নিকায়ে সঙ্ঘ বিভক্ত হয়েছিলো, তা লুপ্ত হয়ে এ সময়ে মোটামুটি চারটি মাত্র সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিলো। আর্যসর্বাস্তিবাদী, আর্যসম্মিতীয়, আর্যমহাসাঙ্ঘিক এবং আর্যস্থবির। পূর্বোক্ত আর্যসর্বাস্তিবাদী ও আর্যসম্মিতীয় সম্প্রদায় তত্ত্বনির্ণয়ে ভগবান্ বুদ্ধের বচন এবং এর বিবরণভূত অভিধর্মবিভাষাকে প্রমাণরূপে অবলম্বন করতেন বলে তাদেরকে একত্রে বৈভাষিক এবং পরবর্তী দুই সম্প্রদায় আর্যমহাসাঙ্ঘিক ও আর্যস্থবিরগণ কেবল সূত্রান্ত অর্থাৎ বুদ্ধের বচনকেই মাত্র প্রমাণরূপে অবলম্বন করায় তাদেরকে একত্রে সৌত্রান্তিক বলা হয়। বৈভাষিক ও সৌত্রান্তিক এই দুই দার্শনিক সম্প্রদায় হীনযান বৌদ্ধধর্মের অন্তর্গত।
.
রাজা কণিষ্কের সময়ে অর্থাৎ খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে বৌদ্ধগ্রন্থে সংস্কৃত ভাষা সমাদৃত হয় এবং মহাযান নামক ধর্মসম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয়। পরবর্তীতে চীন, কোরিয়া, জাপান ও তিব্বতে এর ব্যাপক প্রসার ঘটে। এই মহাযান সম্প্রদায়ের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে বৌদ্ধধর্ম প্রধানত মহাযান ও হীনযান এই দুটি সম্প্রদায়ে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায়। সংস্কারপন্থী এবং কৃচ্ছ্রতাসাধনের বিরোধী উদার মহাযানী বৌদ্ধগণই পূর্ববর্তী রক্ষণশীল বৌদ্ধগণকে হীনযান আখ্যা দেয়। হীনযানীদের থেরবাদীও (স্থবিরবাদী) বলা হয়। হীনযানীরা বুদ্ধের মূল অনুশাসনকে অনুসরণ করার পক্ষপাতী। এই অনুশাসনে ভোগবিরতি, ইন্দ্রিয় সংযম ও চিত্তশুদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এর তাৎপর্য হচ্ছে নৈতিক জীবনে কঠোরতা বা কৃচ্ছ্রতাসাধন। হীনযানীরা পুরুষকারের পক্ষপাতী। তাদের মতে নির্বাণ বা অর্হৎ-এর অবস্থালাভ নিজের চেষ্টাতেই সম্ভব। ভিক্ষুজীবন বা সন্ন্যাস নির্বাণলাভের উপযোগী। বৈভাষিক ও সৌত্রান্তিক শাখায় বিভক্ত এই হীনযানীদেরকে সর্বাস্তিবাদীও বলা হয়। দার্শনিক বিবেচনায় এরা বস্তুবাদী।
.
অন্যদিকে মহাযানীরা সংস্কারপন্থী এবং কৃচ্ছ্রতাসাধনের বিরোধী। এই মতে কেবল নিজের মুক্তিকামনা স্বার্থপরতা মাত্র। সর্বমুক্তি হলো ধর্মসাধনার উদ্দেশ্য। নির্বাণ লাভের জন্য ভিক্ষু-জীবন অপরিহার্য নয়। কারণ গৃহস্থরাও নির্বাণ লাভ করতে সক্ষম। তাঁদের মতে বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রে মনে করা হয়েছে যে, শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধত্ব লাভ করার বহু পূর্ব থেকে জন্ম জন্মান্তর ধরে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করে পুণ্য অর্জন করেছিলেন। তাঁর সেই অবস্থাগুলিকে বোধিসত্ত্ব অবস্থা বলা হয়। এই অবস্থায় বোধিমার্গে একবার আরূঢ় হতে পারলে ভিক্ষু ধীরে ধীরে বুদ্ধত্বের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। তাই মহাযানপন্থীরা এই বোধিসত্ত্ব অবস্থাকে কাম্য মনে করেন। যে অবস্থায় মানুষ পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করতে পারে সেই অবস্থা হলো মহাযানীদের আদর্শ। এই অবস্থা দু’ভাবে স্থায়ী করা সম্ভব। পূর্ববর্তী মহাযানী আচার্যরা মনে করেন, করুণ, মৈত্রী প্রভৃতি বিশেষ গুণরূপ পারমিতার (বদান্যতা, ধার্মিক আচরণ, সহনশীলতা, আত্মিক শক্তি, ধ্যান ও স্বজ্ঞা- এই ছয়প্রকার পারমিতাকে ‘পরম জ্ঞান’ বা প্রজ্ঞা অর্জনের পথে একেকটি পদক্ষেপ বলে গণ্য করা হয়।) চর্চা করে এই অবস্থা স্থায়ী করা যায়। দার্শনিক দৃষ্টির তারতম্য অনুসারে মহাযানীরা দুটি শাখায় বিভক্ত- মাধ্যমিক বা শূন্যবাদী ও যোগাচার বা বিজ্ঞানবাদী। দ্বিতীয় খ্রীষ্টাব্দের আচার্য নাগার্জুন ও আর্যদেব মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের আচার্য এবং চতুর্থ খ্রীষ্টাব্দের আচার্য অসঙ্গ ও বসুবন্ধু হচ্ছেন যোগাচার সম্প্রদায়ের প্রবক্তা। তবে মহাযানীদের দর্শন হচ্ছে ভাববাদী দর্শন।
.
পরবর্তী কোন কোন আচার্যরা মনে করেন যে, মন্ত্রশক্তি নিয়োগেও এই কাম্য অবস্থানকে স্থায়ী করা যায়। অষ্টম-নবম শতকে এই তান্ত্রিক বৌদ্ধ মতাবলম্বীদের উদ্ভব হয়। এই মতকে মন্ত্রযান বা তন্ত্রযান বলা হয়। আধ্যাত্মিক দৃষ্টির তারতম্য অনুসারে এর তিনটি শাখা হচ্ছে- বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। তান্ত্রিক বৌদ্ধ হতে দশম শতাব্দীতে আবির্ভূত বজ্রযান সম্প্রদায়টি দার্শনিক দিক দিয়ে যোগাচার ও মাধ্যমিক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মিশ্রিত রূপ। নেপালের বর্তমান বৌদ্ধধর্ম প্রধানত বজ্রযান। এই ধর্মে একটি বিরাট পূজাপদ্ধতিকে স্থান দেয়া হয়েছে। দেবদেবীর সংখ্যাও অনেক। বোধিচিত্তকে বজ্র নামে আখ্যায়িত করা হয়। লৌকিক অর্থে বোধিচিত্ত হচ্ছে শুক্র এবং পারমার্থিক অর্থে চিত্তের সেই অবস্থা যা হতে বুদ্ধত্ব লাভ করা যায়।
.
যাঁরা দশভূমিক সিদ্ধির জন্য যোগাভ্যাসকে একান্ত আবশ্যক মনে করেন তাঁদেরকে যোগাচারী বলা হয়। যোগাচারীদের মতে শিষ্যগণ যোগ এবং আচার অবলম্বন করবেন। অপ্রাপ্ত ও অজ্ঞাত বিষয়কে জানার জন্য যে প্রশ্ন (অনুসন্ধান) তা হচ্ছে যোগ এবং গুরুর উপদিষ্ট তত্ত্বকে গ্রহণ ও স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে আচার। যোগ ও আচার এই দু’টি গ্রহণ করায় যোগাচার নামে খ্যাত। তাঁরা স্বয়ং বেদ্য জ্ঞানকে স্বীকার করায় বিজ্ঞানবাদী নামেও পরিচিত হয়েছেন।
.
অন্যদিকে মাধ্যমিক বা শূন্যবাদীরা আর কিছু জানার নেই বলে যোগকে গ্রহণ করেন না। এই মতে সর্ব ক্ষণিক, সর্ব দুঃখ, সর্ব স্বলক্ষণ ও সর্ব শূন্য- এই চারটি বুদ্ধোপদিষ্ট তত্ত্বের ভাবনা দ্বারা সর্বশূন্যত্বরূপ পরিনির্বাণ লাভ হয়। তাতে মাধ্যমিকগণ কৃতার্থ, তাঁদের আর কিছু করণীয় বা কোন উপদেশ গ্রহণীয় থাকতে পারে না, এরূপ মনে করেন। তাঁরা বৌদ্ধ গন্ধ স্পর্শ প্রভৃতি বাহ্যবস্তু এবং রূপবিজ্ঞান প্রভৃতি চৈত্তবস্তু থাকা সত্ত্বেও ঐগুলিকে অস্বীকার করতে সচেষ্ট হয়ে সর্বশূন্য এরূপ প্রচার করায় শূন্যবাদী নামে পরিচিত। তাঁদের দর্শনে ভাব ও অভাব এই অন্ত (কোটি) রহিত বলে সর্ব স্বভাবের অনুৎপত্তিরূপ শূন্যতা হচ্ছে মধ্যমপ্রতিপৎ। সেই মধ্যম মার্গকে অবলম্বন করে নিজের মত প্রচার করায় তাঁদেরকে মাধ্যমিক বা শূন্যবাদী বলা হয়।
.
তবে বৌদ্ধধর্মের মূলসূত্রগুলির বা বুদ্ধের বাণীর তত্ত্বনির্দেশ করতে গিয়ে কালক্রমে যেসব নানান দার্শনিক মতের সৃষ্টি হয়েছিলো, সেসব বিভিন্ন মতাবলম্বী সম্প্রদায়ের মধ্যে শেষপর্যন্ত চারটি সম্প্রদায় তাঁদের নিজেদের বিশিষ্ট আধ্যাত্মদৃষ্টি বা দর্শনের জন্য বৌদ্ধসঙ্ঘে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো এবং বহুদিন ধরে তাঁরা প্রভাব বিস্তার করেছিলো। এই চারটি সম্প্রদায় হচ্ছে শূন্যবাদ বা মাধ্যমিক সম্প্রদায়, বিজ্ঞানবাদ বা যোগাচার সম্প্রদায়, বাহ্যানুমেয়বাদ বা সৌত্রান্তিক সম্প্রদায় এবং বাহ্যপ্রত্যবাদ বা বৈভাষিক সম্প্রদায়। ব্যবহারিক সংজ্ঞায় মাধ্যমিক ও যোগাচারকে মহাযান এবং সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিককে হীনযান বলা যায়। দার্শনিক ভিন্নতা মেনেও প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধসঙ্ঘের ভিতরে এই মহাযান ও হীনযান সম্প্রদায়কে পরস্পর বিরোধী দল বলা সঙ্গত হবে না এজন্যে যে, উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রভেদ থাকলেও তা অতি সূক্ষ্ম এবং এরা পরস্পর নিকট সম্পর্কযুক্ত। শেষপর্যন্ত উভয়ই বৌদ্ধদর্শনেরই অনুসারী।
.
তবু যেহেতু বৌদ্ধ সম্প্রদায় হীনযান ও মহাযানে স্পষ্টতই দ্বিধাবিভক্ত, তাই এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্যসূচক কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
.
হীনযান ও মহাযানের পার্থক্য:
প্রথমেই জেনে রাখা আবশ্যক যে, বৌদ্ধসম্প্রদায়ের এই দুটি বিভাগ বৌদ্ধধর্মের প্রসার অনুসারে হয় নি। মূলত বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের ক্রমোন্নতির পর্যায় অনুসারে তা উন্নীত হয়েছে। বুদ্ধের নির্বাণের চার-পাঁচশত বছর পর তাঁর অনুসারি খ্যতনামা আচার্যগণই তা সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁদের মতে, প্রাচীন বৌদ্ধগণ বুদ্ধোপদিষ্ট ধর্মমতের গূঢ় তাৎপর্য বুঝতে না পেরে কেবল বাহ্য আচারের পরিশীলন করেন। সেজন্যে তাঁরা এই প্রাচীন বৌদ্ধদের হীনযান আখ্যা দেন। এবং নতুন বৌদ্ধরা সংস্কারপন্থী এবং কৃচ্ছ্রতাসাধনের বিরোধী উদার বলে তাদেরকে মহাযান আখ্যা দেন। স্বাভাবিকভাবেই এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য কিছু পার্থক্য হলো-
.
০১. প্রথমতঃ হীনযান ও মহাযান এই দুই সম্প্রদায়ের চরম লক্ষ্যেই বিরোধ রয়েছে। হীনযানের চরম লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাণের মাধ্যমে অর্হৎপদ লাভ। অন্যদিকে মহাযানের চরম লক্ষ্য হচ্ছে বোধিসত্ত্ব প্রাপ্তি। হীনযান মতানুযায়ী অর্হন্মুনি কেবল নিজ মুক্তির জন্য যত্নশীল হন, আর মহাযান সম্প্রদায় সকল জীবের মুক্তির জন্য যত্নশীল হওয়াকে জীবনের লক্ষ্য মনে করেন। অর্থাৎ সংসারের সকল দুঃখভারাক্রান্ত প্রাণীর মুক্তি না হওয়াতক মহাযানীরা সচেষ্ট হন। সুতরাং বলা যায়, হীনযানীরা অন্তর্মূখী অর্থাৎ তাদের চরম লক্ষ্য হলো ব্যক্তিক বা বৈয়ক্তিক মুক্তি (individual liberation), আর মহাযানীরা বহির্মুখী অর্থাৎ সার্বভৌম মুক্তিকে (universal liberation) স্বীকার করেন।
.
০২. হীনযানে নিরীশ্বরবাদ স্বীকৃত। বুদ্ধের ‘আত্মদীপো ভব’ এই বচনে গুরুত্ব দিয়ে মুক্তির জন্য জীবকেই স্বয়ং যত্নশীল হতে হয়। কিন্তু মহাযানে ঈশ্বর স্বীকৃত এবং বুদ্ধকে ঈশ্বর মনে করে ‘দশভূমি’র উপর বুদ্ধের মূর্তি স্থাপন করে তাঁর পূজার্চনা করা হয়। তাঁদের মতে বুদ্ধ হচ্ছেন স্বয়ং কল্যাণময়, সমস্ত সংসার তাঁর কল্যাণপাত্র। অর্থাৎ হীনযানে বুদ্ধকে মানুষ হিসেবে ভাবা হয়েছে, আর মহাযানে তাঁকে ঈশ্বররূপে প্রতিষ্ঠিত করে তাঁর উপাসনা স্বীকৃত হয়েছে।
.
০৩. হীনযানে ভিক্ষুজীবন ও সন্ন্যাসের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, এবং এই মতানুযায়ী মানুষ সংসার পরিত্যাগ করে নির্বাণের জন্য যত্নশীল হবে। কিন্তু মহাযানমতে নির্বাণলাভের জন্য সংসার ত্যাগের আবশ্যকতা নেই, সংসারে থেকেই মানুষ নির্বাণ লাভে সমর্থ হতে পারে।
.
০৪. হীনযানে নির্বাণ হচ্ছে অভাবাত্মক, অর্থাৎ নির্বাণের মাধ্যমে ভবতৃষ্ণা লুপ্ত হয় বলে দুঃখেরও নিবৃত্তি ঘটে। কিন্তু মহাযানে নির্বাণ হচ্ছে ভাবাত্মক। তাঁদের মতে নির্বাণপ্রাপ্ত ব্যক্তির দুঃখ নাশ হয় না, কিন্তু আনন্দ লাভ হয়।
.
০৫. হীনযানে ‘তন্হা’ বা তৃষ্ণা নিবারণকে নির্বাণের সেতু বলা হয়েছে। এই তৃষ্ণানিবারণের দ্বারা যে ভাব লাভ করা যায় তা হলো তৃষ্ণাশূন্যভাব বা শূন্যতা। কিন্তু মহাযানে এই নিবৃত্তি মার্গ অপেক্ষা কার্য মার্গকে প্রবল মনে করা হয়। এই মতে জ্ঞানই মূলশক্তি এবং তা অর্জনের উপায়স্বরূপ ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’ উন্নতির চরম সীমায় পৌঁছালে বোধিলাভ ঘটে।
.
০৬. হীনযানমতে অর্হৎপদ প্রাপ্তির লক্ষ্যে বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙ্ঘ এই ত্রিরত্ন বা ত্রিশরণ এবং শীলতাকে মূল অবলম্বন হিসেবে স্বীকার করা হয়। বোধিসত্ত্বোৎপাদ, পাপদেশন, পুণ্যানুমোদনা, ষট্পারমিতা (বিশুদ্ধতা) এগুলি অবলম্বনের মাধ্যমে নির্বাণ লাভ করা যায়। অন্যদিকে মহাযানমতে সার্বভৌম মুক্তির লক্ষ্যে বোধিসত্ত্বকেই মুখ্য উপায় বলে সমাদর করা হয়। আর এই বোধিসত্ত্বের প্রধান গুণ বা ধর্ম হচ্ছে করুণা যাকে প্রজ্ঞার মতো স্বীকার করা হয়েছে।
.
০৭. হীনযানে আত্মা স্বীকৃত নয়। কিন্তু মহাযানে ভিন্নভাবে আত্মার সত্তা স্বীকার করা হয়। মহাযান মতে ব্যক্তিক বা বৈয়ক্তিক আত্মা মিথ্যা হলেও পারমার্থিক আত্মা (মহাত্মা) মিথ্যা নয় এবং মহাত্মা মানুষের মধ্যে বিদ্যমান থাকে।
.
০৮. হীনযানে স্বাবলম্বন সন্ন্যাসের আদর্শ অত্যন্ত কঠিন পথ। অন্যদিকে মহাযানে ঈশ্বরাত্মা বোধিসত্ত্বকে আদর্শরূপে স্বীকার করে নির্বাণলাভের পথ সুগম করা হয়েছে। এজন্যেই হীনযানকে সঙ্কীর্ণপথ এবং মহাযানকে প্রশস্ত পথ বলা হয়েছে।
.
০৯. হীনযানে বিশ্বতত্ত্বের কোন দার্শনিক বিচার করা হয় নি, যা মহাযানে বহুল পরিমাণে রয়েছে। হীনযানে ভূমিচতুষ্টয়, কিন্তু মহাযানে দশভূমি আলোচিত হয়েছে।
.
১০. সর্বোপরি সম্প্রদায় হিসেবে পরিবর্তনের ঘোর বিরোধী হীনযানীরা প্রকৃতপক্ষে গোড়া বৌদ্ধ। অন্যদিকে মহাযানীরা উদার ও প্রগতিশীল বলে অশ্বঘোষ, নাগার্জুন, অসঙ্গ প্রমুখ মহাযানী পণ্ডিতগণ নানান দার্শনিকতাপ্রসূত গভীর প্রশ্নের সমাধান করেছেন।

(https://horoppa.wordpress.com/2011/11/10/4676-philosophers-the-schools-of-buddhism/)

(তথ্যসূত্র: রণদীপম বসু)

বজ্রযান:
পূর্বেই বলা হয়েছে যে বজ্রযান মহাযানেরই একটি শাখা। তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের মন্ত্রযানের সঙ্গে মহাসুখবাদের সংযোগের ফলে উদ্ভূত এ মতবাদ বাংলার সমতট অঞ্চলে বিশেষ প্রসার লাভ করেছিল। বজ্রযানমতে নির্বাণের পর শূন্য, বিজ্ঞান ও মহাসুখ লাভ হয়। শূন্যতার পরম জ্ঞানই নির্বাণ। এই জ্ঞানকে বলে নৈরাত্মা। নৈরাত্মার মধ্যে আত্মা লয়প্রাপ্ত হয়। বোধিচিত্ত যখন নৈরাত্মার আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে নৈরাত্মাতেই লীন হয়, তখন উৎপন্ন হয় মহাসুখ। চিত্তের যে পরমানন্দ ভাব, যে এককেন্দ্রিক ধ্যান, তা-ই বোধিচিত্ত। বোধিচিত্তই বজ্র। কঠোর যোগের দ্বারা ইন্দ্রিয় দমিত হলে চিত্ত বজ্রের ন্যায় দৃঢ় হয়। এ অবস্থায় সাধক বোধিজ্ঞান লাভ করেন। বজ্রকে আশ্রয় করে যে যানে বা পথে নির্বাণ লাভ হয়, তা-ই বজ্রযান।
বজ্রযানে গুরু অপরিহার্য। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের গুরু জেতারি ছিলেন বজ্রযানের অন্যতম গুরু। তিনি এ বিষয়ে বহু গ্রন্থও রচনা করেন। সপ্তম শতাব্দীর বৌদ্ধপন্ডিত শান্তিদেবও বজ্রযান বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। বাঙালি তান্ত্রিক আচার্য শান্তরক্ষিতও বজ্রযান বিষয়ে তিনখানি তন্ত্রগ্রন্থ রচনা করেন।
বজ্রযানমতে এই ভৌতিক দেহ পঞ্চস্কন্ধ দ্বারা গঠিত। সাধকের দেহস্থ এই পঞ্চস্কন্ধের মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশি সক্রিয়, সে অনুযায়ী তার কুল নির্ণীত হয়। এই কুল দ্বারা সাধকের প্রাথমিক পরিচয় ছাড়াও অন্তর্নিহিত যোগশক্তির প্রভাব সম্পর্কেও জানা যায়। কুলগুলি হচ্ছে ডোম্বী, নটী, রজকী, চন্ডালী ও ব্রাহ্মণী। এই পঞ্চকুল আবার পাঁচটি শক্তি বা প্রজ্ঞার রূপ বিশেষ। বৈষ্ণব পদকর্তা চন্ডীদাসের রজকী বজ্রযান মতে তাঁর কুলেরই সূচক। বজ্রযানে সাধনমার্গ নানা দেব-দেবী, মন্ত্র, পূজা ও আচার-অনুষ্ঠানে আকীর্ণ।
বর্তমান বাংলাদেশে বজ্রযানী বৌদ্ধ মতাদর্শের বিদ্যমানতা নেই। বাংলাদেশী বৌদ্ধদের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন থাকলেও এবং ভিক্ষুসংঘের মধ্যেও চিন্তার মতানৈক্যগত বিভিন্ন নিকায় থাকলেও প্রত্যেক নিকায় ও সংস্থা থেরবাদের অনুসারী। তাদের মধ্যে স্থান ও পাত্রভেদেও কোনোরূপ তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মাচরণের সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হয় না। [সুমন কান্তি বড়ুয়া]

অষ্টম শতকে বাংলা ও বিহারে (মগধে) মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম পরিবর্তিত হয়ে ‘বজ্রযান’ নামে একটি মতবাদ গড়ে ওঠে। বিহারের বিক্রমশীলা মঠটি ছিল বজ্রযানী বৌদ্ধদের অন্যতম সাধনমার্গ। একাদশ শতকে এই মঠের বজ্রপন্থিগন তিব্বতে ধর্ম প্রচার করতে গিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে বাংলার অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অন্যতম। বাংলার পাল রাজারা বজ্রযানী মতবাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
এবার বাংলায় বজ্রযান মতের উদ্ভব সম্বন্ধে আলোচনা করব।
বৌদ্ধধর্মকে বাংলার আর্যপূর্ব লোকায়ত ভাবধারা প্রভাবিত করেছিল। শিকড়টি প্রাচীন সভ্যতায় নিহিত বলেই বাংলার লোকায়ত ভাবধারায় রয়েছে নারীপ্রাধান্য। এ কারণে বাংলাকে আজও আমরা বলি “মাতৃতান্ত্রিক বাংলা।” আমরা দেশকে মাতা বলি নদীকে মাতা বলি, ইত্যাদি।

কাজেই মাতৃতান্ত্রিক বাংলা অনিবার্যভাবেই মহাযানী বৌদ্ধধর্মকে প্রভাবিত করেছিল। মহাযানীপন্থার অন্যতমা দেবী ছিলেনপ্রজ্ঞাপারমিতা। তখন একবার বলেছি যে মহাযানীরা বুদ্ধত্ব লাভে আগ্রহী এবং বোধিসত্ত্ব মতবাদে বিশ্বাসী। বোধিসত্ত হচ্ছেন তিনি যিনি বারবার জন্মগ্রহন করেন এবং অপরের পাপ ও দুঃখভার গ্রহন করে তাদের আর্তি দূর করেন। মহাযানীপন্থায় কয়েক জন বোধিসত্ত্ব রয়েছেন। এঁদের মধ্যে অবলোকিতেশ্বর, মঞ্জুশ্রী এবং বজ্রপানি প্রধান। প্রজ্ঞাপারমিতা কে বোধিসত্ত্বেরই গুণাবালীর মূর্ত রূপ বলে মনে করা হত। বোধিসত্ত্বদের স্ত্রী কল্পনা করা হয়েছিল। এই দেবীই ছিলেন দেবতাদের প্রকৃত শক্তি। দেবতাকে মনে করা হত সদূর এবং অজ্ঞেয় এবং দেবীকে সক্রিয় মনে করা হত। এই ধারণার পিছনে, সাংখ্যদর্শনের প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হয়। সাংখ্যদর্শনের প্রবক্তা কপিল ছিলেন প্রাচীন বাংলার একজন দার্শনিক। কপিলের একটি বিখ্যাত উক্তি হল: ‘প্রকৃতি ত্রিগুণাত্বক চঞ্চলা, পুরুষ অপ্রধান।’ সে যাই হোক। মহাযানীরা বিশ্বাস করতেন যে: দেবতাকে পেতে হলে দেবীর সাহায্য নিতে হয়। সৃষ্টিকে ভাবা হত যৌনমিলনের প্রতীক। কাজেই কোনও কোনও মহাযানী সম্প্রদায়ে যৌনমিলন ধর্মীয় আচারে পরিণত হয়েছিল।
এই যৌনবোধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মরমী অতীন্দ্রিয়বাদ । হীনযানীরা বিশ্বাস করতেন মুক্তির উপায় হল ধ্যান এবং আত্মসংযম। পক্ষান্তরে, মহযানীরা মনে করতেন মুক্তি অর্জনে প্রয়োজন স্বয়ং বুদ্ধ এবং বোধিসত্ত্বর দাক্ষিণ্য। এভাবে উদ্ভব হয়বজ্রযানী মতবাদ। বজ্রযানীরা বিশ্বাস করতেন যে মোহিনী শক্তি আয়ত্ব করে মুক্তি লাভ করা সম্ভব। এই শক্তিকে ‘বজ্র’ বলা হত। বজ্র নারীরই অন্যতম শক্তি। এ জন্য বৌদ্ধধর্মের নতুন শাখার নাম হয়েছিল বজ্রযান। তাহলে বজ্রযানের উদ্ভবস্থল হিসেবে কি আমরা বাংলাদেশের বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামটিকে চিহ্নিত করতে পারি? যে গ্রামে দশম শতকে অতীশ দীপঙ্করের জন্ম হয়েছিল? ইদানিং বিক্রমপুরী বিহার আবিস্কৃত হয়েছে:

মুন্সীগঞ্জ সদরের রঘুরামপুরে হাজার বছেরর পুরেনা বৌদ্ধ বিহারের সন্ধান মিলেছে। আবিস্কৃত বৌদ্ধ বিহারটি মুন্সীগঞ্জ তথা বিক্রমপুর অঞ্চলের হাজার বছর আগের প্রাক-প্রাচীন সভ্যতার প্রথম বৌদ্ধ বিহার। আবিস্কৃত এ বৌদ্ধ বিহারটির নাম তৎসময় কালের বিক্রমপুরী বৌদ্ধ বিহার বলে ধারনা করা হচ্ছে। জেলা সদরের বজ্রযোগিনীর রঘুরামপুরে গত ২৩শে মার্চ ২০১৩ (শনিবার) এক সংবাদ সম্মেলনে এ পুরাকীর্তি তথা বৌদ্ধ বিহার আবিস্কৃত হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষনা করা হয়েছে । মাটির নীচে চাঁপা পড়ে থাকা আবিস্কৃত বৌদ্ধ বিহারটি ১২’শ থেকে ১৩’শ বছর আগের ঐতিহাসিক নিদর্শন বলে জানা যায়। এছাড়া প্রত্নতত্ম খননের মধ্য দিয়ে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার বজ্রযোগিনী ও রামপালে মাটির নীচে চাঁপা পড়া ৩ মিটার গভীর পর্যন্ত প্রাক-প্রাচীন সভ্যতার মানব বসতির চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেছে। সংস্কৃতি মন্ত্রনালয় এ প্রকল্প কাজের অর্থায়ন ও সহযোগিতা করছে। বেলা ১২ টার দিকে বজ্রযোগিনীর রঘুরামপুরে আবিস্কৃত বৌদ্ধ বিহারের পাদদেশে বিক্রমপুর অঞ্চলে প্রত্নতাত্তিক খনন ও গবেষনা প্রকল্প আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য রাখেন খনন ও গবেষনা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক নূহ-উল-আলম লেনিন। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন- প্রত্নতত্ম খনন কাজের গবেষনা পরিচালক ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড, সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। যেভাবে আবিস্কৃত হয় : ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে খনন শুরুর প্রথম বছরেই বজ্রযোগিনীর রঘুরামপুরে ইট-নির্মিত দেয়ালাংশ আবিস্কৃত হয়। রঘুরামপুরে প্রত্নতত্ম খননের তৃতীয় সেশনে ইট-নির্মিত স্থাপত্যের ১০০ মিটার উত্তরে গর্ত পরিস্কার করতে প্রথম বারের মতো ক্ষতিগ্রস্ত ইটের দু’টি দেয়ালের চিহ্ন বেরিয়ে আসে। এ দেয়ালকে উদ্দেশ্য করে ৮০ মিটার গুন ৬০ মিটার জায়গা নিয়ে ২ গুন ২ বর্গমিটারে ১২’শ গ্রিডে ভাগ করে শুরু হয় বৌদ্ধ বিহার আবিস্কারের উৎখনন। দ্বিতীয় বছরের উৎখননের মধ্য দিয়ে পাওয়া যায় উত্তর-দক্ষিন প্রলম্বিত ২ দশমিক ৫ মিটার প্রসস্থ দু’টি ইটের প্রাচীর দেয়ালের অংশ বিশেষ। মাঝে মাঝে ২ মিটার প্রসস্থ ভিক্ষুক বিভাজন দেয়ালের অংশ বিশেষও শনাক্ত করা গিয়েছিল ওই বছর। তৃতীয় বছরের উৎখননে ৫ টি ভিক্ষু কক্ষের অস্তিত্ব খুজে পাওয়ার মধ্য দিয়ে বিক্রমপুর অঞ্চলের প্রথম এ বৌদ্ধ বিহারের আবিস্কার নিশ্চিত হন খননকারীরা। কথিত আছে অতীশ দীপঙ্করের সময় (৯৮২-১০৫৪ খ্রি.) বিক্রমপুরের বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রে নেপাল, তিব্বত, চীন, থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশ থেকে প্রায় ৮০০০ শিক্ষার্থী ও ১০০ জন শিক্ষক এসে ছিলেন। বলা হয়, অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন ঐ শিক্ষাকেন্দ্রের অধ্যক্ষ।

কিন্তু, বাংলায় কারা প্রথম বজ্রযানের ধারণা conceive করেছিলেন?
মধ্যযুগের বাংলায় বৌদ্ধসমাজে স্থবিরবাদ নামে একটি দার্শনিক মতের উদ্ভব হয়েছিল । স্থবিরবাদীরা মনে করতেন: যে কেউ নিরাসক্তি এবং মানসিক অনুশীলনের উচ্চ স্তরে পৌঁছলে অতিপ্রাকৃতিক শক্তির অধিকারী হতে পারে। বুদ্ধ যাদুবিদ্যা চর্চার নিন্দা করতেন। অথচ বাংলার স্থবিরবাদীগণ যাদুবিদ্যা চর্চা করতেন। পাশাপাশি প্রত্যেক বৌদ্ধই যে মঠের সংযত জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন, তা কিন্তু নয়। অনুমান করায় যায়, এই প্রতিষ্ঠানবিরোধীরাই বজ্রযানের ধারণা প্রথম conceive করেছিলেন ।
এর আগে একবার বলেছিলাম যে: পাল রাজারা বজ্রযানী মতবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। পাল রাজারা বাংলায় বজ্রযানী মতবাদের একটি বিধিবদ্ধ রূপ দিয়েছিলেন। পাল যুগের বাংলায় বজ্রযানীদের প্রভূত সম্মান ছিল।
বজ্রযানীদের প্রধানা দেবী হলেন তারা। ইনি ছিলেন বুদ্ধ এবং বোধিসত্ত্বদের স্ত্রী। মাতঙ্গী পিশাচী ডাকিনী যোগীনি -প্রমূখ তুচ্ছ দেবীও বজ্রযানীদের আরাধ্য ছিল। বজ্রযানীগণ বিশ্বাস করতেন দেবদেবীদের করূণা ভিক্ষা করে লাভ নেই। এদের বাধ্য করতে হবে। যে গ্রন্থে এ কাজ করার উপায় তাদের বলা হত ‘তন্ত্র’। যে কারণে বজ্রযান কে বলা হয় তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম। মন্ত্র এবং যন্ত্র -এ দুই হল বজ্রযানের সাধনার উপকরণ। যন্ত্র হল মোহিনী প্রতীক, যা সঠিক ভাবে আঁকতে হয়। (মোহিনী প্রতীক হল religious symbolism. যা মার্কিন লেখক ড্যান ব্রাউন আধুনিক পাঠকে কাছে পরিচিত করেছেন । )
বজ্রযানের প্রধান মন্ত্র হল:

ওম মনিপদ্মে হূম:

পূর্বে একবার উল্লেখ করেছি যে: বিহারের বিক্রমশীলা বিহারটি ছিল বজ্রযানী বৌদ্ধদের অন্যতম কেন্দ্র। একাদশ এই মঠের বজ্রযানী বৌদ্ধরা তিব্বতে ধর্ম প্রচার করতে গিয়েছিলেন । তিব্বতে আজও অসংখ্যবার ‘ওম মনিপদ্মে হূম’ জপ করা হয়। -এই মন্ত্রটি বুদ্ধ এবং প্রজ্ঞাপারমিতার এবং বোধিসত্ত্ব এবং তারা দেবীর যৌনমিলনের প্রতীক। তবে বজ্রযান কেবলি যৌন সাধনপন্থ নয়, বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের একটি রহস্যময় রূপ।
এভাবে বজ্রযান হয়ে উঠেছিল যৌনঅতীন্দ্রিয়বাদী …
তবে বজ্রযানে ধ্যানের গুরুত্বকে অবহেলা করা হয়নি। বজ্রযানীর উদ্দেশ্য ছিল যৌনচর্চার মাধ্যমে দেবীর কৃপা লাভ করে অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা অর্জন। যা একটি ধর্মীয় আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা থেকে ভারতবর্ষের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। বজ্রযানী সাধকদের বলা হত সিদ্ধ অথবা সিদ্ধাচার্য। এঁদের সংখ্যা ছিল ৮৪। পূর্বে মহাযানপন্থার বইপুস্তক লেখা হয়েছিল সংস্কৃত ভাষায় । বজ্রযানী সিদ্ধাচার্যগণ লিখতেন বাংলায় । তাদের ভাবনার সঙ্কলনই- চর্যাচর্যবিনিশ্চয় বা চর্যাপদ। চর্যাপদই বাংলা ভাষার আদিরূপ।

চর্যাপদের কবি বা সিদ্ধাচার্য চর্যাপদ রচনা করেছিলেন। সাধারণত বজ্রযানী ও সহজযানী আচার্যগণই সিদ্ধাচার্য নামে অভিহিত হতেন। তিব্বতি ও ভারতীয় কিংবদন্তীতে এঁরাই ‘চৌরাশি সিদ্ধা’ নামে পরিচিত। তবে এই ৮৪ জন সিদ্ধাচার্য আসলে কারা ছিলেন তা সঠিক জানা যায় না।

চর্যার কবিরা ছিলেন পূর্ব ভারত ও নেপাল রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসী। কেউ পূর্ববঙ্গ, কেউ উত্তরবঙ্গ, কেউ বা রাঢ়ের অধিবাসী ছিলেন। কেউ কেউ বিহার, কেউ ওড়িশা, কেউ বা আবার অসম বা কামরূপের বাসিন্দাও ছিলেন। এঁরা ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, ক্ষত্রিয়, বণিক এমনকি অন্ত্যজ শ্রেণী থেকেও এসেছিলেন। কেউ কেউ রাজবংশজাতও ছিলেন। এঁরা পূর্বাশ্রমের পিতৃপ্রদত্ত নাম ত্যাগ করেছিলেন বলে নাম দেখে এঁদের জাতি স্থির করা যায় না। এঁরা হিন্দুধর্মের সনাতন শাস্ত্রবিধান মানতেন না বলে এঁদের বেদবিরোধী ও নাস্তিক আখ্যা দেওয়া হয়। সাধনার নামে গোপনে কেউ কেউ যৌনাচারও করতেন বলে আধুনিক গবেষকগণ মত প্রকাশ করেন।

আবিষ্কৃত পুঁথিটিতে ৫০টি চর্যায় মোট ২৪ জন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন: লুই, কুক্কুরী, বিরুআ, গুণ্ডরী, চাটিল, ভুসুকু, কাহ্ন, কাম্বলাম্বর, ডোম্বী, শান্তি, মহিত্তা, বীণা, সরহ, শবর, আজদেব, ঢেণ্ঢণ, দারিক, ভাদে, তাড়ক, কঙ্কণ, জঅনন্দি, ধাম, তান্তী পা, লাড়ীডোম্বী। এঁদের মধ্যে লাড়ীডোম্বীর পদটি পাওয়া যায়নি। ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক পদগুলি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুঁথিতে না থাকলেও ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচী আবিষ্কৃত তিব্বতি অনুবাদে এগুলির রচয়িতার নাম উল্লিখিত হয়েছে যথাক্রমে কাহ্ন, তান্তী পা ও কুক্কুরী। এই নামগুলির অধিকাংশই তাঁদের ছদ্মনাম এবং ভনিতার শেষে তাঁরা নামের সঙ্গে ‘পা’ (< পদ) শব্দটি সম্ভ্রমবাচক অর্থে ব্যবহার করতেন। কবিদের নাম শেষে পা দেওয়ার কারণঃ পদ > পাদ > পা পাদ > পদ > পা পদ রচনা করেন যিনি তাদেরকে পদকর্তা বলা হত যার অর্থ সিদ্ধাচার্য / সাধক [এরা বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মের সাধক ছিলেন] ২ টি কারণে নামশেষে পা দেওয়া হতঃ ১. পদ রচনা করতেন ২. সম্মান / গৌরবসূচক কারনে

সাধারণভাবে লুইপাদকেই আদি সিদ্ধাচার্য মনে করা হয়। তাঞ্জর বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ছিলেন বাঙালি। তিনি মগধের বাসিন্দা ছিলেন ও রাঢ় ও ময়ূরভঞ্জে আজও তাঁর নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। চর্যার টীকায় তাঁর অন্য নাম লূয়ীপাদ বা লূয়ীচরণ। ১ ও ২৯ সংখ্যক পদদুটি তাঁর রচিত।

চর্যার পুঁথিতে সর্বাধিক সংখ্যক পদের রচয়িতা কাহ্ন বা কাহ্নপাদ। তিনি কৃষ্ণাচার্য, কৃষ্ণপাদ ও কৃষ্ণবজ্র নামেও পরিচিত। পুঁথিতে তাঁর মোট ১১টি পদ (পদ- ৭, ৯, ১১, ১২, ১৮, ১৯, ২৪, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫) পাওয়া যায়। ইনি ওড়িশার এক ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন বলে জানা যায়। শৌরসেনী অপভ্রংশ ও মাগধী অপভ্রংশজাত বাংলায় তিনি পদ রচনা করতেন ভুসুকুপাদ বাঙালি ছিলেন বলে অনেকের অনুমান। কেউ কেউ তাঁকে চর্যাগানের শান্তিপাদের সঙ্গে অভিন্ন মনে করেন। চর্যার পুঁথিতে তাঁর আটটি পদ (পদ- ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩, ৪৯) আছে। এছাড়া সরহপাদ চারটি (পদ- ২২, ৩২, ৩৮, ৩৯), কুক্কুরীপাদ তিনটি(পদ- ২, ২০, ৪৮) এবং শান্তিপাদ (পদ- ১৫ ও ২৬) ও শবরপাদ দুইটি পদ (পদ- ২৮ ও ৫০) রচনা করেন। একটি করে পদ রচনা করেন বিরুআ (পদ ৩), গুণ্ডরী (পদ ৪), চাটিল (পদ ৫), কম্বলাম্বরপাদ (পদ ৮), ডোম্বীপাদ (পদ ১৪), মহিণ্ডা (পদ ১৬), বীণাপাদ (পদ ১৭), আজদেব (পদ ৩১), ঢেণ্ঢণ (পদ ৩৩), দারিক (পদ ৩৪), ভদ্রপাদ (পদ ৩৫), তাড়ক (পদ ৩৭), কঙ্কণ (পদ ৪৪), জঅনন্দি (পদ ৪৬), ধাম (পদ ৪৭) ও তান্তী পা (পদ ২৫, মূল বিলুপ্ত)। নাড়ীডোম্বীপাদের পদটি পাওয়া যায় না।

সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে অনেকের জন্মস্থান এই বাংলার বিভিন্ন জনপদে । চর্যাপদ বা চর্যাগীতি রচয়িতা সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে লুইপাদ (পশ্চিমবঙ্গ), কাহ্নুপাদ (পশ্চিমবঙ্গ), জালন্ধরীপাদ (চট্টগ্রাম), ধর্মপাদ (বিক্রমপুর), বিরুপাপাদ (কুমিল্লা), ডোম্বীপাদ (কুমিল্লা), চাটিলপাদ (চট্টগ্রাম), তিলোপাদ (চট্টগ্রাম), নারোপাদ (চট্টগ্রাম), গোরক্ষপাদ (কুমিল্লা), চৌরঙ্গীপাদ (কুমিল্লা), মীননাথ (বরিশাল), সহ অনেকেই ছিলেন বাঙালি । কুমিল্লার শালবন বিহারকে আজো এখানকার স্থানীয় লোকেরা বলে হাড়িপা সিদ্ধার বাড়ি । অনেকে বলে গোরক্ষ সিদ্ধার বাড়ি, আবার কেউ বলে চৌরঙ্গী সিদ্ধার বাড়ি । এই সিদ্ধাচার্যরাই বাংলাদেশে অবস্থিত সোমপুরী, শালবন, বিক্রমপুরী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিত হিসেবে জ্ঞানচর্চায় নিবেদিত ছিলেন বলে জানা যায় ।

একজন অন্যতম বজ্রযানী হলেন লুই পা (লুই পাদ)। লুই পা কে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের আদি কবি। বজ্রযানী কবিরা রাগ-রাগিণীর মাধ্যমে সুরে সুরে সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মীয়তত্ত্ব পৌঁছে দিতেন।
বাংলায় সংগীতের মাধ্যমে দর্শন চর্চার সেই শুরু …
যা বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়ে আজও অব্যাহত রয়েছে।
আবহমান বাংলার এই এক চিরন্তন বৈশিষ্ট্য …
ধর্মমতের বিবর্তন অনিবার্য। বজ্রযান থেকে উদ্ভব হয়েছিল সহজযানের। বজ্রযানীরা রহস্যময় সব আচার অনুষ্ঠান ও ব্রত পালন করত। সহজযানীরা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা অস্বীকার করেছিল। সহজযান আসলে বজ্রযান এরই সূক্ষ্মতর রূপ। সহজযানে আচার অনুষ্ঠান নেই, দেবদেবী নেই। সহজযানীরা বলতেন,কাঠ- মাটি -পাথরের তৈরি দেবদেবীর কাছে মাথা নোয়ানো বৃথা। তাঁদের কাছে বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানের একেবারেই মূল্য ছিল না। চর্যার একটি পদে এই মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে-

এস জপহোমে মন্ডল কম্মে
অনুদিন আচ্ছসি বাহিউ ধম্মে।
তো বিনু তরুণি নিরন্তর ণেহে
বোধি কি লব ভই প্রণ বি দেঁহে।

এই জপ -হোম-মন্ডল কর্ম নিয়ে সব সময় বাহ্যধর্মে লিপ্ত আছিস। তোর নিরন্তর স্নেহ বিনা, হে তরুণি, এই দেহে কি বোধি লাভ হয়?

সহজযানীরা বিশ্বাস করতেন জপ কি প্রার্থণা করে মুক্তি অর্জন সম্ভব না। পরমজ্ঞান সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা-স্বয়ং গৌতম বুদ্ধও জানতেন না। তাঁদের মতে সবার পক্ষেই বুদ্ধত্ব লাভ সম্ভব। এবং এই বুদ্ধত্বের অধিষ্ঠান দেহের মধ্যে। তাঁদের মতে দেহবাদ বা কায়সাধনই একমাত্র সত্য। সহজযানীদের মতে শূন্যতা প্রকৃতি। এবং করুণা পুরুষ। এই ধারণাও, আমার মনে হয়, কপিল প্রবর্তিত সাংখ্যদর্শনের প্রভাব। সে যাই হোক। এই শূন্যতা ও করুণার মিলনে অর্থাৎ নারী ও পুরুষের মিলনে বোধিচিত্তের যে পরমানন্দ অবস্থা হয় তাই মহাসুখ। এই মহাসুখই একমাত্র সত্য। সহজযানের লক্ষ ছিল মহাসুখ। সহজযানীরা মৃত্যুর পর মুক্তিলাভে বিশ্বাস করতেন না। শত বছরের ব্যবধানে গড়ে ওঠা সহজযান এবং বাউল দর্শনের মধ্যে পার্থক্য তো থাকবেই …এটাই স্বাভাবিক। তবে বাউলদের মতো সহজযানীরাও ছিলেন দেহবাদী। কেননা, সহজযানীরা বিশ্বাস করতেন: রস-রসায়নের সাহায্যে কায়সিদ্ধি লাভ করে জড় দেহকেই সিদ্ধদেহ এবং সিদ্ধদেহকে দিব্যদেহে রূপান্তরিত সম্ভব। (ভাষা এখানে বদলে যাচ্ছে, কেননা বিষয়টি দর্শনের অন্তর্গত) …সে যাই হোক। সহজযানীরা অচিন্ত্যযোগী। এর মানে -জন্ম -মরণ সংসার কীভাবে হয়, তাঁরা জানেন না। জন্ম যেমন মরণও তেমনি। জীবিত ও মৃতে বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই। সহজযানের আদর্শ হল সাম্য ভাবনা এবং আকাশের মত শূন্যচিত্ত। শরীরের মধ্যেই অশরীরীর গুপ্ত লীলা। সুতরাং বনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, ঘরে থাকারও প্রয়োজন নেই। আগম, বেদ, পুরাণ। সবই বৃথা। সহজের রূপ নিস্কলুষ এবং নিস্তরঙ্গ। তার মধ্যে পাপপুণ্যের প্রবেশ নেই। সহজে মন নিশ্চল করে, যে সাম্য ভাবনা লাভ করেছে, সেই একমাত্র সিদ্ধ। তার জরা মরণ থাকে না । শূন্য নিরঞ্জনই মহাসুখ। সেখানে পাপ নেই,পূণ্য নেই।
সহজযানে গুরুর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ন। গুরুকে বলা হত ‘বজ্রগুরু।’

এক কথায় সহজযানের উদ্দেশ্য হল কঠোর সাধনায় মুক্তি কামনার পরিবর্তে সদগুরুর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন পরিচালনার মাধ্যমে পরম সুখ লাভ করা। এটি চিত্তের এমন এক অবস্থা , যেখানে সুখ ভিন্ন অন্য কোনও বিষয়ের অস্তিত্ব থাকে না।
মধ্যযগের মরমী কবি সাধক বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস থেকে আরম্ভ করে কবীর,দাদু, তুলসীদাস -এঁরা প্রত্যেকেই চিন্তার দিক থেকে বাংলার সহজযানীদের উত্তরসূরী ছিলেন। কেননা, সহজযানের মূলকথা ছিল- ‘যা মানুষের মধ্যে শাশ্বত স্বরূপের উপলব্দি আনে, যার মাধ্যমে জগতের প্রাণিকুল ও বস্তুনিচয়কে অনুভব করার দর্শনই বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মমতের অন্তর্নিহিত সত্য।’ (বাংলাপেডিয়া; আজহারুল ইসলাম এবং সমবারু মহন্ত )
মধ্যযুগের বাংলার লোকায়ত বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বাংলায় বৌদ্ধধর্ম এমন রূপ পরিগ্রহ করেছিল যে, লৌকিক হিন্দু ধর্ম থেকে তা খুব একটা ভিন্নতর ছিল না। এই পরিবর্তনকেই বৌদ্ধধর্মের বজ্রযান ও তন্ত্রযান ও সহজযান ও কালচক্রযানের রূপান্তর বলে আখ্যাত করা হয়েছে। ’ এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক আবদুল মমিন চৌধুরী লিখেছেন,‘বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের এই লোকজ সংস্কৃতি হয়তো বা বাংলার আর্য-উত্তরাধিকারের কারণে ঘটেছিল বলে বলা যেতে পারে এবং এর থেকেই সৃষ্টি নিয়েছিল মানবতাবাদ, কিছুটা বিকৃত হয়তো বা।’ ( প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি;পৃষ্ঠা, ৮১) যে মানবতা বাদ কে ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় দেখেছেন ‘মধ্যপর্বে হাতে আদিপর্বের শ্রেষ্ঠতম; মহতত্তম উত্তরাধিকার’ হিসেবে।
(ইমরান যুবায়ের-এর ব্লগ)

এবার আসি ‘ওম মনিপদ্মে হুম’ মহামন্ত্রটির সম্ভাব্য কিছু ব্যাখ্যায়।
পূর্বে একবার উল্লেখ করেছি যে এর অর্থ অনেকে মনে করেন যে ‘আহা মনিই প্রকৃত পদ্ম’! কিন্ত এটারই বা অর্থ কি? পদ্মফুল বিশুদ্ধতার প্রতীক। সুতরাং ‘প্রকৃত পদ্ম’ মানে ‘প্রকৃত বিশুদ্ধতা’ হতে পারে। তাহলে ‘মনি’ শব্দটি কি অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে?
বলা হয় যে, এই মন্ত্রের মধ্যেই বুদ্ধের শিক্ষা রয়েছে।

বৌদ্ধ দর্শন অনুযায়ী প্রতিটি মানুষের মধ্যেই বুদ্ধ প্রকৃতি আছে। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই বিশুদ্ধতার বীজ রয়েছে, এটার উন্নয়ন সাধন করে বুদ্ধত্বে রূপান্তরিত করতে হবে। আমাদের সাধারণ দেহ, বাক্য ও মন বিশুদ্ধ হয়ে রূপান্তরিত হবে বুদ্ধের পবিত্র দেহে, বাক্যে ও মনে (প্রতিকীভাবে ‘আউম’ দ্বারা উপস্থাপিত হয়)।

এইভাবে ছয়টি পদাংশ (syllables), ‘ওম মনিপদ্মে হুম’ মানে, সেই পথটির অনুশীলন করে যা কিনা পদ্ধতি (method) ও প্রজ্ঞা (wisdom)-র অবিভাজ্য সংযুক্তি, আমরা আমাদের অশুদ্ধ দেহ, বাক্য, এবং মনকে রূপান্তর করতে পারি একজন বুদ্ধের মহিমান্বিত দেহ, বাক্য, এবং মন-এ।

ওম শব্দের অর্থ – ‘ওম’ প্রভু (ইশ্বর)-র নাম। লেখা হয় আ-উ-ম, উপস্থাপিত হয় ব্রহ্মা (সৃষ্টি), বিষ্ণু (ধারণ) এবং শিব (ধ্বংস) তিনটি রূপে; অথবা বৌদ্ধরা তাকে একে সম্পর্কিত করে বুদ্ধের পবিত্র দেহ, পবিত্র বাক্য ও পবিত্র মন-এ।
স্বামী শীভানন্দ বলেছেন, ওম (আউম) হলো সব। ‘ওম’ হলো ইশ্বর ও ব্রহ্মার নাম ও প্রতীক। ওম হলো সত্যিকারের নাম। ওম মানবের ত্রিগুণিত অভিজ্ঞতাকে কভার করে। ওম হলো বাহ্যিক জগৎসমূহ। ওম থেকে জ্ঞান-মহাবিশ্ব অভিক্ষিপ্ত হয়েছে। মহাবিশ্ব টিকে আছে ‘ওম’-এর উপর আবার বিলিনও হবে ‘ওম’-এ।

‘আ’ শারীরিক সমতল প্রতিনিধিত্ব করে. ‘উ’ মানসিক এবং নাক্ষত্রিক (astral ) সমতল, বুদ্ধিমান আত্মার জগৎ, সকল স্বর্গ। ‘এম’ গভীর ঘুমের দশা-কে প্রতিনিধিত্ব করে, এমনকি সকল কিছু যা কিনা জাগ্রত অবস্থায়ও অজানা, এবং সেইসবকিছু যা কিনা আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধির নাগালেরও বাইরে। এইভাবে ‘ওম’ই সব আমাদের জীবন, চিন্তন ও বুদ্ধিমত্তার ভিত্তি। সমগ্র বিশ্বজগৎ ‘ওম’ থেকে উদ্ভুত, ‘ওম’-এ অবস্থিত এবং ‘ওম’-এই বিলীন হবে।

‘মনি’ শব্দের অর্থ রত্ন। বিশুদ্ধ রত্ন হলো ভালোবাসা ও দয়া (compassion) এবং তা জ্ঞানদীপ্ত হওয়ার বাসনাকে প্রতীকী রূপ দান করে। ‘মনি’ হলো ‘মায়া’। ‘বাসনা’, ‘সংসার’ ও ‘নির্বান’-এর উদ্ভব।

‘পদ্মে’ মানে কমল যা কিনা প্রজ্ঞার প্রতীক। একটি পদ্মফুল যেমন পংক থেকে ওঠে তেমনি প্রজ্ঞাকে মানব অবস্থা থেকে স্বর্গীয় গুন অর্জন করা পর্যন্ত পৌছাতে হবে। সকল প্রজ্ঞার মূল প্রজ্ঞা হলো ‘নীরবতা ও শূণ্যতার প্রজ্ঞা’। ‘পদ্মে’ মানে শূণ্যতা (emptiness)।

‘হুম’ প্রজ্ঞা ও আধ্যাত্মিক পদ্ধতির সংযুক্তি ঘটায়। এটা অবিভাজ্যতা, স্থবিরতা, যাকে আন্দোলিত (disturb) করা যায়না। এটা জ্ঞানদীপনের মনন (সপরিট)-কে উপস্থাপন করে। ‘হুম’ যন্ত্রণাকে ধ্বংস করে।
‘মনি’ মানে উদ্ভব, ‘পদ্মে’ মানে শূণ্যতা, ‘হুম’ এই দুয়ের সমন্বয় সাধন করে (বা মিলন ঘটায়)। ‘মনি’ হলো অজ্ঞান/বিভ্রম (illusion), ‘পদ্মে’ হলো আলো, ‘হুম’ এই দুয়ের সংযুক্তি ঘটায়।

আমার মত:
‘মনি’ শব্দের অর্থ যেহেতু রত্ন, এবং বিশুদ্ধ রত্ন হলো ভালোবাসা ও দয়া (compassion) এবং তা জ্ঞানদীপ্ত হওয়ার বাসনাকে প্রতীকী রূপ দান করে। আবার ‘পদ্ম’ বিশুদ্ধতার প্রতীক। তাই ‘ওম মনিপদ্মে হুম’ মহামন্ত্রটির অর্থ আমি নিম্নরূপ মনে করি

‘ওম মনিপদ্মে হুম’ – জ্ঞানদীপনই প্রকৃত বিশুদ্ধতা।

(আমার মতে)

তথ্যসূত্র:
১। ইমন যুবায়েরের বাংলা ব্লগ (সামু)
২। ইন্টারনেটে প্রাপ্ড় বিভিন্ন আর্টিকেল
৩। https://horoppa.wordpress.com/2011/11/10/4676-philosophers-the-schools-of-buddhism/
৪। ( https://horoppa.wordpress.com/2011/11/10/4685-buddhism-madhyamik-shunyabad/ )
৫। Wikipedia.org

১,৭৮৮ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “‘ওম মনিপদ্মে হুম’ – পর্ব ৫”

  1. মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

    ধর্মচর্চা আমাকে তেমন টানে না। তবু বৌদ্ধধর্মের বহুবিধ দান ভুলি কি করে? বিশেষ করে উল্লেখ করতেই হয় চর্যাপদের কথা। আপনিও তাই বলেছেন। এছাড়া, ভারতীয় ভাস্কর্য ও চিত্রকলার বিকাশে বৌদ্ধধর্মের বিরাট অবদান আছে।

    ইউরোপীয় পন্ডিতরা বৌদ্ধধর্মকে যেভাবে ভাগ করেছেন তাকে আমার বালখিল্যতা বলে মনে হয়েছে। আর যাই হোক ধর্মকে ভুভাগের মত করে ভাগ করা চলে না। বরং হীনযান ও মহাযান এই বিভাগ যা কিনা বৌদ্ধদর্শনের ক্রমোন্নতির পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত, আমার তাকেই অধিকতর যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছে।

    এইসব বিষয়ে শ্রী প্রবোধচন্দ্র বাগচীর কিছু রচনা আছে। আপনার কাজে লাগলেও লাগতে পারে।


    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

    জবাব দিন
    • ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

      মোস্তফা ভাই, অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
      হ্যাঁ বৌদ্ধ ধর্মের অনেক প্রভাব আমাদের বাংলার সংস্কৃতি ও চিন্তাধারায়। হওয়ারই কথা, এটি তো এই মাটিরই দর্শন।
      ইউরোপীয় পন্ডিতদের বিষয়টা ভালো জানিনা। তবে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা যেসব ভাগ-বিভাগ করেছে তা সবই তাদের স্বার্থে। যেমন আমাদের দেশের ইতিহাসকে তারা ভাগ করেছে নিম্নরূপ: বৌদ্ধ শাসন (পাল যুগ), হিন্দু শাসন (সেন যুগ), মুসলিম শাসন (সুলতান ও নবাবী আমল) ও বৃটিশ শাসনামল। এখন কথা হলো, প্রথম তিনটি যদি বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলিম শাসনামল হয় তাহলে পরেরটি খ্রীষ্টান (বা প্রোটেস্টান্ট) শাসনামল হবেনা কেন?

      শ্রী প্রবোধচন্দ্র বাগচীর রচনা আমি পড়িনি। তথ্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি পড়ে দেখবো।

      জবাব দিন
      • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

        মোটাদাগে ইউরোপীয় পণ্ডিতদের দোষ না দিয়ে বরং ইংল্যান্ডের পণ্ডিত রিস ডেভিসের কথা উল্লেখ করলে যথাযথ হতো। আপনার লেখার কল্যাণে আমরা তো জানি, বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীন সাহিত্য নানা ভাষায় পাওয়া গেছে। সিংহল ছাড়াও ব্রহ্ম, শ্যাম ও কম্বুজে - পালি ভাষায়, নেপালে - সংস্কৃত ও অপভ্রুংশ ভাষায়, পাওয়া গেছে তুর্কীস্থানের মরুভূমিতে - সংস্কৃত, প্রাকৃত ও নানাস্থানীয় ভাষায়। এই সমগ্র দিকটাকে বিবেচনায় না এনে তিনি কি করলেন? শুধুমাত্র সিংহল থেকে পালি পুঁথি সংগ্রহ করে, পালিতে লেখা বৌদ্ধ সাহিত্যকে ভিত্তি করে বৌদ্ধ ধর্মের আলোচনা আরম্ভ করলেন। তাতে ফল হলো একপেশে। তারা এই বিশ্বাসে স্থিতধী হলেন যে, বৌদ্ধসাহিত্য প্রথম পালি ভাষায় লেখা হয়। পালি ভাষা কোশল ও মগধের প্রাচীন ভাষা। তাঁরা বৌদ্ধধর্মকে দুটো সম্প্রদায়ে ভাগ করলেন, Northern ও Southern Buddhism. অথচ সামগ্রিক দিকটি বিবেচনায় নিলে এমনটি হতো না। তুলনামূলক আলোচনায় অপেক্ষাকৃত গলদমুক্ত ফলাফল পাওয়া যেত।


        দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

        জবাব দিন
        • ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

          জ্বী, সুন্দর ও যথাযথ বলেছেন।
          একটা কথা বলি, বর্তমানে সারা পৃথিবী জুড়ে একটি নীরব/সরব বিপ্লব চলছে - কমপিউটার-ইন্টারনেট বিপ্লব। তথ্য পাওয়া ও দেয়া এখন আর আগের মতো কঠিন নয়। তাই অনেক অজানা-অর্ধজানা-ভুলজানা বিষয়গুলো সম্পর্কে মানবজাতি জানতে শুরু করেছে। আমার স্ত্রী একদিন বলছিলেন, "ভালো হয়েছে, ইন্টারনেট এসেছে। এখন আর এক জাতি সম্পর্কে আরেক জাতির ভুল ধারনা থাকবে না। নতুন এই প্রযুক্তির কল্যাণে নিউ জেনারেশন খুব কাছ থেকে একে অপরের সাথে আলাপচারিতা করতে পারছে, একে অপরেকে জানতে ও বুঝতে পারছে।" আশা করি এভাবে চলতে চলতে একসময় তথ্যবিভ্রাট দূর হবে ও সকল ভুলবোঝাবুঝির নিষ্পত্তি ঘটবে।

          জবাব দিন
    • ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

      জ্বী খায়রুল ভাই, কিছুটা শ্রম দিতে হয়েছে। আমার নিজের আগ্রহেই কাজটা করেছি। আমাদের সোনালী ইতিহাসের অনেক উজ্জ্বল দিক অনুল্লেখিত রয়ে গেছে, পাঠ্য পুস্তকেও তার দেখা মেলেনা। সেই কারণেই রয়ে গেছে বাতাসে প্রচলিত অনেক ভুল ধারণা। এমনটা গ্রহন যোগ্য নয়। পৃথিবীর প্রাচীনতম দর্শনের জনক জাতি, এতটা হীনমন্যতায় ভুগবে কেন। আমাদের জাতির অন্তর্নিহিত শক্তি অপরিসীম, এই শক্তিকে বাইরে বের করে নিয়ে আসতে হবে।

      কষ্ট করে পড়ার ও মন্তব্যে করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।