‘ওম মনিপদ্মে হুম’ – পর্ব ১

‘ওম মনিপদ্মে হুম’ – পর্ব ১
—————- ড. রমিত আজাদ

আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগের কথা। ১০৪২ সালে আমাদেরই বাংলাদেশের এক কৃতি সন্তান দুর্গম পর্বতমালা, কঠোর আবহাওয়া, তুষারের শীতলতা, ইত্যাদি সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ক্লান্তিকর দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পৌঁছালেন হিমালয় দুহিতা তিব্বতে। সাথে সাথে একদল ঘোড়সওয়ার ছুটে এসে তাঁকে অভ্যার্থনা জানালো। সেই ঘোড়সওয়ারদের হাতে তীক্ষ্ণ বর্ষার মাথায় পতপত করে উড়ছে শ্বেত পতাকা, সুরতোলা বাদ্যযন্ত্রে বাজছে স্বাগত বাজনা আর সেই সাথে উচ্চারিত হচ্ছে মহামন্ত্র, ‘ওম মনিপদ্মে হুম’। তিব্বতের গু-জে-এর রাজা স্বয়ং গার্ড অব অনার দিয়ে বরণ করেছিলেন বাংলার এই জ্ঞানতাপসকে, নাম তাঁর শ্রীজ্ঞান অতীশ দিপংকর।

আমাদের বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ (বিক্রমপুর) জেলার বজ্রযোগিনী গ্রামে ৯৮০ খ্রীস্টাব্দে জন্ম শ্রীজ্ঞান অতীশ দিপংকরের। বংশ পরিচয়ে তিনি ছিলেন রাজপুত্র। তাঁর রাজপিতার নাম ছিলো কল্যাণশ্রী আর মাতার নাম ছিলো শ্রী পদ্মপ্রভা/প্রভাবতী। রাজা-রাণীর তিন পুত্রের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন তিনি। পিতামাতা তাঁর নাম রেখেছিলেন আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ। তাঁর অপর দুই ভাইয়ের নাম ছিল পদ্মগর্ভ ও শ্রীগর্ভ। অতীশ খুব অল্প বয়সে বিয়ে করেন। কথিত আছে তার পাঁচ স্ত্রীর গর্ভে মোট ৯টি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তবে পুন্যশ্রী নামে একটি পুত্রের নামই শুধু জানা যায়।

প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন মায়ের কাছে। তিন বছর বয়সে সংস্কৃত ভাষায় পড়তে শেখা ও ১০ বছর নাগাদ বৌদ্ধ ও অবৌদ্ধ শাস্ত্রের পার্থক্য বুঝতে পারার বিরল প্রতিভা প্রদর্শন করেন তিনি। মহাবৈয়াকরণ বৌদ্ধ পণ্ডিত জেত্রির পরামর্শ অনুযায়ী তিনি নালন্দায় শাস্ত্র শিক্ষা করতে যান। ১২ বছর বয়সে নালন্দার আচার্য বোধিভদ্র তাঁকে শ্রমণরূপে দীক্ষা দেন, এবং তখন থেকে তাঁর নাম হয় দীপংকর। ১২ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত তিনি বোধিভদ্রের গুরুদেব অবধুতিপাদের নিকট সর্বশাস্ত্রে পান্ডিত্য অর্জন করেন। ১৮ থেকে ২১ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বিক্রমশীলা বিহারের উত্তর দ্বারের দ্বারপন্ডিত নাঙপাদের নিকট তন্ত্র শিক্ষা করেন। এরপর মগধের ওদন্তপুরী বিহারে মহা সাংঘিক আচার্য শীলরক্ষিতের কাছে উপসম্পদা দীক্ষা গ্রহণ করেন। আচার্য শীলরক্ষিতের কাছ থেকে তিনি লাভ করেন শ্রীজ্ঞান উপাধী। ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের জন্য তিনি পশ্চিম ভারতের কৃষ্ণগিরি বিহারে গমন করেন এবং সেখানে প্রখ্যাত পন্ডিত রাহুল গুপ্তের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ শাস্ত্রের আধ্যাত্নিক গুহ্যাবিদ্যায় শিক্ষা গ্রহণ করে ‘গুহ্যজ্ঞানবজ্র’ উপাধিতে ভূষিত হন। বলা হয়ে থাকে যে তিনি চৌষট্টি ধরনের কলা/বিদ্যা শেখেন (যেমন সঙ্গীতকলা, যুক্তিবিদ্যা)। আরও বলা হয়ে থাকে যে তিনি ১৫০ জন আচার্যের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক খ্যাতিমান ছিলেন ধর্মকীর্তি শ্রী ।
১০১২ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীজ্ঞান গিয়েছিলেন সুবর্নদ্বীপে (বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ) সেখানে ধর্মকীর্তির কাছে মহাযান পন্থার ধর্মীয় দর্শন হিসাবে শিক্ষা নেন। দীর্ঘ ১২ বছর বৌদ্ধ দর্শনশাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ের উপর অধ্যয়ন করে তিনি ফিরে এলেন বাংলায়। বাংলায় তখন চলছিলো শক্তিমান পাল রাজাদের শাসনামল। রাজা ন্যায়পাল শ্রীজ্ঞানকে রাজা ধর্মপাল (৭৭০-৭৭০ খ্রীস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠিত ‘বিক্রমশীলা’ বিহারের প্রধান আচার্য (অধ্যক্ষ) হিসাবে নিয়োগ দেন। তিনি রাজশাহীর সোমপুর বিহারেরও প্রধান আচার্য ছিলেন।

বাংলায় উদ্ভুত সাংখ্য দর্শনই পৃথিবীর প্রাচীনতম দর্শন বলে অনেকে মনে করেন (বৈদিক দর্শন সাংখ্য দর্শন-এর পূর্বে হলেও তা পূরাণ মিশ্রিত বলে তাকে নির্ভেজাল দর্শন বলা যাবেনা বলে অনেকে মনে করেন।) কপিল মুনি সৃষ্ট সাংখ্য দর্শনের ধারাবাহিকতায়ই উদ্ভুত বৌদ্ধ দর্শন। এই বৌদ্ধ দর্শন বা ধর্ম বাংলার অন্যতম প্রাচীন ধর্ম। আর্য সাম্রাজ্যের বাইরে উদ্ভুত ও অ-বৈদিক দর্শন বলে আর্যরা এই দর্শনের ঘোরতর বিরোধী ছিলো। তাই প্রথমদিকে এই দর্শন বাংলা ও তার আশেপাশেই চর্চিত ও বিকশিত হয়। ধীরে ধীরে তা প্রসার লাভ করে ও দুর্গম হিমালয় পেরিয়ে তিব্বত, চীন, মঙ্গোলিয়া, কোরিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশে পৌছে যায়।

বাংলার ভূমিপুত্র শৌর্য্যশালী পাল রাজাদের শাসনামলে বৌদ্ধ দর্শন ব্যাপক রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়। পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল বাংলার প্রথম গণভোটে নির্বাচিত একজন রাজা ছিলেন। তিনি ও তার উত্তরপুরুষরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। পাল রাজাদের প্রথম রাজধানী বিক্রমপুরে ছিলো বলে ধারনা করা হয়, এবং পরবর্তিতে তা পাটলিপুত্র ও গৌড়ে স্থানান্তর করা হয়। গৌতম বুদ্ধের দেশের শাসক পালরা বৌদ্ধজাহানে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিলো। পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পাল শাসনামলের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হলেও পাল যুগেই তা রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় উন্নয়নের শিখরে পৌছায়। রাজা গোপালের পুত্র ধর্মপাল (শাসনামল ৭৭০ থেকে ৮১০ পর্যন্ত) নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন, ধর্মপাল বিক্রমপুরেও (বর্তমান মুন্সীগঞ্জ) একটি উল্লেখযোগ্য বৌদ্ধ বিহার নির্মান করেন। এছাড়া পালরা নির্মান করেছিলেন জগদ্দল, ওদন্তপুরা, সোমপুরা ও বিক্রমশিলা বিহার (Jagaddala, Odantapura, Somapura, and Vikramashila)

প্রথম পাল রাজা গোপাল নির্মান করেছিলেন ওদন্তপুরা বিহার। রাজা ধর্মপাল ইতিহাসখ্যাত বিক্রমশিলা বিহার (অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়) ও দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম বিহার সোমপুরা (পাহাড়পুর, নওগাঁ, বাংলাদেশ) নির্মান করেন। ধর্মপাল পঞ্চাশটিরও অধিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মান করেছিলেন। ধর্মপাল-এর পুত্র দেবপাল নালন্দার সবচাইতে উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

পাল শাসনামলের উল্লেখযোগ্য দর্শন গ্রন্থ গৌড়পাদ রচিত আগামা শাস্ত্র (Agama Shastra), শ্রীধর ভট্ট রচিত ন্যায়া কুন্ডালি (Nyaya Kundali), ভট্ট ভবদেব রচিত কর্মানুষ্ঠান পদ্ধতি, ইত্যাদি। চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর রচিত কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম চক্রপাণি রচিত চিকিৎসা সংগ্রহ, আয়ুর্বেদ দিপিকা, ভানুমতি, শব্দ চন্দ্রিকা এবং দ্রাভিয়া গুনশাস্ত্র; সুরেশ্বর রচিত শব্দ-প্রদীপ, বৃক্ষায়ুরবেদ এবং লোহপদ্ধতি; ভঙ্গসেনা রচিত চিকিৎসা সংগ্রহ, গদধারা বিদ্যা (Gadadhara Vaidya) রচিত শুশ্রুষা; জিমুতভাহানা (Jimutavahana) রচিত দয়াভগ, ভয়াভোহারা মাতৃকা (Vyavohara Matrika) এবং কলাবিবেক (Kalaviveka )। প্রাচীন বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ;-ও পাল শাসনামলে রচিত। পাল রাজাদের সুদীর্ঘ চারশত বছরের ইতিহাসে ধর্ম, দর্শন, শিক্ষা, সাহিত্য, ললিতকলা, চিকিৎসা, ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্র ছিলো গৌরবান্বিত।
শৌর্যপূর্ণ পাল শাসকরা গুণীদের মর্যাদা দিতে জানতেন। রাজা ধর্মপাল বৌদ্ধ দার্শনিক হরিভদ্রকে তাঁর গুরু মেনেছিলেন। বীরদেব, বজ্রদত্ত সহ অনেক পন্ডিত ব্যক্তিই পাল শাসনামলে বিকশিত হয়েছিলেন। একাদশ শতাব্দীর এমন একজন পন্ডিত ব্যাক্তির নাম অতীশ দিপংকর।

কথিত আছে যে তিব্বতের রাজা লংদর্মা (Langdarma) দীর্ঘ সত্তর বছর বৌদ্ধ ধর্ম/দর্শন-কে অবদমন করে এবং বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের নির্যাতন করে। তারপর গুজ রাজ্যের দ্বিতীয় রাজা ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস’-ওদ নাগ-ত্শো-লো-ত্সা-বা-ত্শুল-খ্রিম্স-র্গ্যাল-বা সহ কয়েক জন ভিক্ষুর হাতে প্রচুর স্বর্ণ উপঢৌকন দিয়ে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিব্বত ভ্রমনের আমন্ত্রন জানালে দীপঙ্কর সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। এতে নিরাশ না হয়ে ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস’-ওদ সীমান্ত অঞ্চলে সোনা সংগ্রহের জন্য গেলে কারাখানী খানাতের শাসক তাঁকে বন্দী করেন ও প্রচুর সোনা মুক্তিপণ হিসেবে দাবী করেন। ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস’-ওদ তাঁর পুত্র ল্হা-লামা-ব্যাং-ছুব-ওদকে মুক্তিপণ দিতে বারণ করেন এবং ঐ অর্থ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিব্বতে আনানোর জন্য ব্যয় করতে বলেন। ল্হা-লামা-ব্যাং-ছুব-ওদ গুজরাজ্যের রাজা হয়ে গুং-থং-পা নামে এক বৌদ্ধ উপাসককে ও আরো কয়েক জন অনুগামীকে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিব্বতে আনানোর দায়িত্ব দেন। এরা নেপালের পথে বিক্রমশীলা বিহারে উপস্থিত হন এবং দীপঙ্করের সাথে সাক্ষাৎ করে সমস্ত সোনা নিবেদন করে ভূতপূর্ব রাজা ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস’-ওদের বন্দী হওয়ার কাহিনী ও তাঁর শেষ ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করলে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অভিভূত হন। তাঁরা মহাজ্ঞানী অতীশ দীপংকর-কে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান তিব্বতে এসে ক্ষয়িষ্ণু বৌদ্ধ দর্শনকে পুনর্জাগরিত করতে। আঠারো মাস পরে ১০৪০ খৃস্টাব্দে বিহারের সমস্ত দায়িত্বভার লাঘব করে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিব্বত যাত্রার জন্য প্রস্তুত হন।

দীপংকর রচিত ‘ বোধি পথ প্রদীপ’ গ্রন্থটি বৌদ্ধধর্ম প্রচারে খুবই সহায়ক ছিলো। এরপর ৬২ বছর বয়স্ক জ্ঞান তাপস দীপংকর সকল পথকষ্ট অগ্রাহ্য করে তিব্বতের পতনোম্মুখ বৌদ্ধ দর্শনকে পুনুরোদ্ধার করার পবিত্র লক্ষ্যে পৌছান গু-জে-তে। আর সেখানে পৌছেই শুনতে পান তাঁরই সমর্থিত মহামন্ত্র ‘ওম মনিপদ্মে হুম’।

কি এই মহামন্ত্র? কি তার গুঢ় অর্থ? বাঙালী জ্ঞানতাপসের এই মন্ত্র আজও কেন ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় তিব্বতের আকাশে-বাতাসে? পরবর্তিতে এইসব নিয়ে আলোচনা করবো।

(ধর্মবিশ্বাসে আমি একজন মুসলমান হলেও আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের আদি ধর্ম বৌদ্ধ দর্শনের প্রতি আমার গভীর আগ্রহ রয়েছে। সময় ও সুযোগ পেলে তা জানার চেষ্টা করি। আশা করি পাঠকরা আমার লেখাটির গঠনমূলক সমালোচনা করবেন আমার লেখায় কোন তথ্যবিভ্রাট থাকলেও জানাবেন।)

তথ্যসূত্র: ১। ইন্টারনেটে প্রাপ্ত বিভিন্ন আর্টিকেল (পরবর্তিতে বিস্তারিত উল্লেখ করবো)

১,২৭১ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “‘ওম মনিপদ্মে হুম’ – পর্ব ১”

    • ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

      অনেক ধন্যবাদ খায়রুল ভাই। তৃতীয় পর্বটি পোস্ট করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ব্লগের নিয়মানুযায়ী প্রথম পাতায় এক লেখকের দুইটার বেশি লেখা রাখা যাবেনা। তাই সেটি পোস্ট নিচ্ছেনা। যাহোক ড্রাফট করা আছে, কয়েকদিন পরে পোস্ট করে দেব। ওখানে অতীশ দীপংকরের জীবনি শেষ হবে। তার পরের পর্বে 'ওম মনি পদ্মে হুম' মহামন্ত্রটির উপর কিছু লিখবো আশা করি। সেখানে অর্থ লিখবো।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।