কোন জ্ঞান বিজ্ঞান? সেই জ্ঞান পাঠ করা এতো জরুরী কেন?

কোন জ্ঞান বিজ্ঞান? সেই জ্ঞান পাঠ করা এতো জরুরী কেন?
——————————————————————————— ড. রমিত আজাদ

প্রাচীন পৃথিবীর বিখ্যাত এক জ্ঞানী মানুষ — এরিস্টোটল তাঁর নাম— তিনি বলেছিলেন যে, “বিশুদ্ধ চিন্তা থেকে তত্ত্ব তৈরী করা যায়”, অর্থাৎ যা কিছু বলেছিলেন তা কেবল যুক্তিতর্কের সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এইভাবে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, উপর থেকে দুটি বস্তু ছেড়ে দিলে ভারী বস্তুটি সর্বদা হালকা বস্তুর চেয়ে আগে মাটিতে পড়বে। তিনি আরও বলেছিলেন, “স্থির অবস্থাই যে কোন কায়ার স্বাভাবিক অবস্থা”, এই বিবেচনায় চলন্ত কোন বাহনে অবস্থিত অন্যান্য কায়াগুলোর সেখান থেকে ছিটকে পড়ার কথা। তিনি আরো বলেছিলেন, “ডেমোক্রিটাসের এ্যাটমিজম সঠিক নয়, এ্যাটম বলে কিছু নাই”। তিনি আরো বলেছিলেন যে, “নারীদের দন্তের সংখ্যা পুরুষদের দন্তের সংখ্যা অপেক্ষা কম।” যদিও এরিস্টোটল দুই দুইবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন, তারপরেও তিনি সম্ভবত একবারও স্ত্রীদের দন্তের সংখ্যা গণনা করে নিজের মতামতের সত্যতা যাচাই করেননি। ৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এরিস্টোটল, কেটে যায় প্রায় ১৩০০ বছর। আর এই সুদীর্ঘকাল টিকে থাকে এরিস্টোটলের এই মতবাদগুলো।

পরবর্তিতে এরিস্টোটল-এর উপরোক্ত সবগুলো মতবাদই ভুল প্রমাণিত হয়। আর এর পিছনে অবদান রেখেছিলেন বিশ্বখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী আল হাইয়াম ( আবু আলী আল-হাসান ইবনে আল-হাতেম (Abū ʿAlī al-Ḥasan ibn al-Ḥasan ibn al-Haytham))। তিনি ছিলেন আরবী ভাষায় রচিত কিতাব-আল-মানাজির (Kitāb al-Manāzir, Book of Optics) নামক একটি গ্রন্থের লেখক। যুগান্তকারী গ্রন্থ কিতাব-আল-মানাজির, রচনা করা হয়েছে ১০১১ থেকে ১০২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময় ধরে। পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাব সৃষ্টিকারী গ্রন্থ হিসেবে আইজাক নিউটনের Philosophiae Naturalis Principia Mathematica এর সমান্তরালে উচ্চারিত হয় এর নাম। গ্রন্থটিতে তিনি আলোকসংক্রান্ত অনেক যুগান্তকারী তত্ত্ব দেন এবং প্রাচীন ভ্রান্ত ধারণার নিরসন করেন, তাই তাঁকে বলা হয় আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের জনক (father of modern optics)।

বর্তমান ইরাকের বসরা নগরীতে ৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন ইবনে আল-হাতেম। কেউ তাঁকে বলেন আল-বসরী ‘বসরা থেকে আগত ব্যক্তি’, কেউ বা বলেন আল-মিসরী ‘মিসর থেকে আগত ব্যক্তি’। আর পশ্চিমে তাঁকে বলা হয় আল হাজেন, তাঁর নাম আল-হাসানের লাতিনীয় অনুবাদের কারণে ঘটেছিল এমনটি। তিনি লিখে গেছেন ২০০’র উপর গ্রন্থ এবং অভিসন্দর্ভ, নানা বিষয়ের উপর। জ্যামিতিতে বীজগণিত প্রয়োগের প্রচলন তিনিই প্রথম করেন, এর ফলে সূচনা হয় নতুন গাণিতিক ধারা: বিশ্লেষণধর্মী জ্যামিতি (analytical geometry), রেনে ডেকার্তের জ্যামিতিক বিশ্লেষণ এবং নিউটনের ক্যালকুলাসে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় ছয়-সাত শতাব্দী পর।

নতুন কি কাজটি করেছিলেন আল হাইয়াম যা পাল্টে দিলো পৃথিবীকে?
ইতিহাসের সময়রেখা ধরে এগুলে আমরা দেখি পৃথিবীর বহু প্রান্তে বহু মানুষ প্রকৃতির উপর গবেষণা করে গেছেন, কোনোরূপ নিয়মতান্ত্রিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন না করেই। প্রথম দিককার এরূপ কিছু মানুষ ছিলেন প্রাচীন গ্রিকরা। এরিস্টোটলের মতো পণ্ডিতগণ প্রাকৃতিক স্বতঃসিদ্ধ ঘটনা (phenomena) পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, কিন্তু তাঁরা তাঁদের ধ্যান-ধারণাকে সুশৃঙ্খল গবেষণার মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখেননি (যেমন করে তিনি তার স্ত্রীদের দন্ত গণনা করে দেখেননি)। তাঁরা ছিলেন উত্তম পর্যবেক্ষক কিন্তু দুর্বল পরীক্ষক। তাঁরা চেয়েছিলেন যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে তাঁদের ফলাফলকে সমর্থন করতে। এর ফলে প্রায়ই তাঁরা ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন, যা ধরা পড়ে শত শত বছর পর, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে।

ইবনে আল-হাতেমের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের পেছনে কাজ করেছে মূলত তাঁর ইসলাম ধর্মীয় বিশ্বাস এবং তাঁর অনুসন্ধিৎসু, সন্দেহবাদী মন। পবিত্র কোরআন শরীফ পাঠ করে তিনি জেনেছিলেন যে, মানুষ ত্রুটিপূর্ণ, কেবলমাত্র স্রষ্টা-ই নিখুঁত। প্রকৃতির ব্যাপারে সত্য আবিষ্কার করতে, তিনি বলতেন, প্রকৃতিকেই তার নিজের হয়ে কথা বলতে দিতে হবে। টলেমির উপর সংশয় পোষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন,
“একজন সত্য-সন্ধানী তিনি নন যিনি প্রাচীন মানুষের লেখা পড়েন, এবং নিজের প্রবৃত্তির দ্বারা পরিচালিত হয়ে সেগুলির উপর বিশ্বাস স্থাপন করেন, বরং তিনিই সত্য-সন্ধানী যিনি সেগুলির উপর নিজের বিশ্বাসকে সন্দেহ করেন এবং সেখান থেকে যা আহরণ করেন তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন—তিনি এমন একজন মানুষ যিনি যুক্তি ও নিরীক্ষার আশ্রয় নেন।” অর্থাৎ জ্ঞানের কথা যাই বলেন আর তাই বলেন, পরীক্ষার দ্বারা যতক্ষণ না তা প্রমাণিত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে বিজ্ঞান বলা যাবেনা। আর যখন জ্ঞানের কথাটি যথাযথ পদ্ধতির মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত হবে কেবলমাত্র তখনই তাকে বিজ্ঞানের মর্যাদা দেয়া হবে।

‘আলো এবং বর্ণ বায়ুতে মিশ্রিত হয় না’ এ হাইপোথিসিসকে পরীক্ষা করতে গিয়ে আল-হাতেম পৃথিবীর প্রথম ক্যামেরা, অবস্কিউরা (Obscura) উদ্ভাবন করেন, পর্যবেক্ষণ করেন আলো সূক্ষ্ম ছিদ্রের ভেতর দিয়ে গমন করার পর কী ঘটে, এবং ফলাফল লিপিবদ্ধ করেন। এমনিভাবে আরো ডজন ডজন ‘সত্যিকারের গবেষণালব্ধ ফলাফল’ কিতাব-আল-মানাজিরে তিনি লিপিবদ্ধ করেন।

আর গবেষণালব্ধ ফলাফলের উপর জোর দিয়ে এভাবেই ইবনে আল-হাতেম জ্ঞান-বিজ্ঞানে নতুন এক “অনুসন্ধানের” দ্বার খুলে দেন এবং ইতিহাসে সত্যিকারের প্রথম বিজ্ঞানীর স্থান অলংকৃত করেন।

সত্য ও জ্ঞান অনুসন্ধানে ইবনে আল-হাতেমের উক্তিঃ “আমি নিরন্তর জ্ঞান ও সত্য খুঁজে বেড়িয়েছি, এবং আমার উপলব্ধি হলো, স্রষ্টার দ্যুতি ও নৈকট্যলাভের জন্য জ্ঞান ও সত্যানুসন্ধানের চেয়ে উত্তম কোনো পথ নেই।“

আমি ফিজিক্সের অধ্যাপক পাশাপাশি আমাকে ব্যবসায় প্রশাসনে অধ্যায়নরত ছাত্র-ছাত্রীদেরকেও বিজ্ঞান পড়াতে হয়। প্রায়শঃই আমাকে এই প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হতে হয় যে, “বিজনেস স্টুডেন্টদের বিজ্ঞান পড়ানোর মানে কি? কি কাজে লাগবে তাদের এই বিজ্ঞান পড়া?” সেমিস্টারের শুরুতে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেও বিজ্ঞান শিক্ষায় অনীহা লক্ষ্য করি। অবশ্য সেমিস্টারের শেষে তারা সকলেই সন্তষ্টি প্রকাশ করে ও বলে, “এই সাবজেক্টটি না পড়লে জীবন অপূর্ণ থেকে যেত”।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বিদ্যালয়ে তো বটেই, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও অ-বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীদের কিছু পরিমানে বিজ্ঞান পড়া উচিৎ এবং বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীদের কিছু পরিমানে আর্টস পড়া উচিৎ। তা না হলে শিক্ষিত মানুষ হিসাবে পূর্ণতা পাওয়া যায়না।

এবার যে আলোচনাটিতে আসবো সেটি হলো বিজ্ঞান শিক্ষা ব্যাক্তি মানুষের কি উন্নয়ন সাধন করে, এর কি ধনাত্মক প্রভাব পড়ে সমাজ জীবনে।
১। এই বিশ্বসংসারে মানবজাতির আগমনহেতু জীবনের উদ্দেশ্য মুলত দুটি ১। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ-কষ্টগুলোকে দূর করা (আরাম-আয়েশ বৃদ্ধি করা), ২। সৃষ্টির রহস্য উদঘাটন করা (মানব জীবনের অর্থ খোঁজা) এই দুইটি উদ্দেশ্য সাধনে বিজ্ঞান আমাদের সহায়তা করে।
২। বিজ্ঞান পাঠ করলে বোঝা যায় যে এই জগত-সংসার সুশৃংখল ও এখানে রয়েছে কঠোর আইনের শাসন – এই অর্থে তা সুপরিকল্পিত।
৩। বিজ্ঞান শিক্ষা এই জগৎ-সংসারকে বোঝা (understanding)-কে প্রসারিত করে।
৪। বিজ্ঞান শিক্ষা যে কোন ঘটনা ও বিষয়কে যৌক্তিকভাবে (rational) ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা শিখায়।
৫। বিজ্ঞান শিক্ষা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায়, যার ব্যবহারিক প্রয়োগ রয়েছে সর্বত্র।
৬। বিজ্ঞান শিক্ষা মার্কেটিং স্ফুর্তি ও সত্যের মধ্যে পার্থক্য করণপূর্বক কোন পণ্যটি ক্রয় করা যথাযথ ও অর্থপূর্ণ হবে তা শেখায়।
৭। বিজ্ঞান শিক্ষা যেকোন বিষয়ের গবেষকদের বলিষ্ঠ গবেষণা করতে সহায়তা করে।
৮। আমাদের দেশে একটি সমস্যা প্রকট, তা হলো যে কোন স্তরের আলোচক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তথ্য, উপাত্ত ও যুক্তির ভিত্তিতে আলোচনা না করে, ফাঁকা কিছু ভাবাবেগের ভিত্তিতে আলোচনা করে থাকে। বিজ্ঞান শিক্ষা তথ্য, উপাত্ত ও যুক্তির ভিত্তিতে আলোচনা করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা শেখায়।
৯। বিজ্ঞান শিক্ষা চিন্তার পরিসর ও উপায়সমুহকে বিস্তৃত করে।
১০। যে কোন বিষয় বিশ্লেষণে গণিত ও গণনার গুরুত্বকে বুঝতে সাহায্য করে।
১১। এই যুগ বিজ্ঞানের যুগ এই যুগে থেকে বিজ্ঞান না জানাটাই অপূর্ণতা ও নির্বুদ্ধিতা, যে কোন ব্যাক্তিরই বিজ্ঞানের নূন্যতম জ্ঞান থাকা জরুরী।
১২। বিজ্ঞান শেখায় যথাযথতা ও অভ্রান্ততা (accuracy)।
১৩। বিজ্ঞান শেখায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে আলোচনা না করে স্পেসিফিক অবজেক্টে ফোকাস করতে।
১৪। যেকোন জটিল পরিস্থিতিতে গ্রন্থিমোচন করে খুব সহজেই সমাধান খুঁজে বের করতে বিজ্ঞান শিক্ষা অপরিহার্য্য।
১৫। বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যাক্তির সাংখ্যিক দক্ষতা (numeric skills) বাণিজ্যিক কর্মকান্ডে সুক্ষবুদ্ধি প্রয়োগে আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়।
১৬। বিজ্ঞান মানেই নতুন কিছুকে আবিষ্কার করা, তাই বিজ্ঞান শিক্ষা নতুন আবিষ্কারের ঝোঁক সৃষ্টি করে।
১৭। কোন একটি কিছুর দিকে দেখা ও তার সম্বন্ধে ভাবার চাইতে এক্সাইটিং কিছু নাই। বিজ্ঞানই এটা শেখায়।
১৮। বিজ্ঞান রহস্যকে ভালোবাসা ও তাকে উদঘাটন করা শেখায়।
১৯। যিনি বিজ্ঞান জানেন না তিনি কেবল কলা ও ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়েই আলোচনা করতে সক্ষম, আর যিনি বিজ্ঞান জানেন তিনি সর্ববিষয়েই আলোচনা করতে সক্ষম। এই ‘অলরাউন্ডার’ মানুষ বিজ্ঞানের অবদান।
২০। বিজ্ঞান আমাদের শেখায়, কি করে প্রশ্ন করতে হয়, অন্বেষণ করতে হয়, বিবরণ পেশ করতে হয় ও কমুনিকেইট করতে হয়। এইগুলো সেইসব দক্ষতা যেকোন প্রকার কর্মস্থলেই যার ব্যবহারিক প্রয়োগ রয়েছে।

২১। বিজ্ঞান মানেই প্রতিদিনই নতুন কিছু শেখা, প্রতিদিনই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহন করা।
২২। সদ্য আবিস্কৃত কোন কিছুর দিকে তাকিয়ে যখন ভাবি যে, ‘এই জগতে আমিই প্রথম এটা জানলাম’ এর চাইতে এক্সাইটিং আর কিছু হতে পারেনা। এটাই বিজ্ঞানের অবদান।
২৩। এই কারণেই বিজ্ঞান পড়বো যে, তা আমাদের শেখায় কিভাবে পদ্ধতিগতভাবে অন্বেষণ করা যায়, সমালোচনার দৃষ্টিকোন থেকে ফলাফল বিশ্লেষণ করতে শেখায়, এবং সকল কেন দিয়ে শুরু সকল প্রশ্নের জবাব দিয়ে উপসংহার টানে।
২৪। ‘ট্রাভেল ওয়াইডেনস আউটলুক’ বলে একটি কথা আছে, বিজ্ঞান এই বিশাল রহস্যময় জগতে প্রতিনিয়ত পরিভ্রমণ করে জগত-সংসার সম্পর্কে আউটলুক প্রসারিত করে।
২৫। অপরাধ জগতে অপরাধী সনাক্ত ও অপরাধ-রহস্য উদঘাটন বিষয়টির সাথে যারা জড়িত তারা জানেন যে বিজ্ঞান (হাতের ছাপ, ডিএনএ টেস্ট, ময়না তদন্ত)-এর ব্যবহার কত দ্রুততা ও দক্ষতার সাথে অপরাধী সনাক্ত ও অপরাধ-রহস্য উদঘাটন-এ সহায়তা করে।
২৬। A fool’s brain digests philosophy into folly, science into superstition, and art into pedantry. Hence University education.” – George Bernard Shaw জর্জ বার্নার্ড শ
২৭। বিজ্ঞান পড়লে বোঝা যায় যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্যাদিগুলো আসলে কি এবং তারা কিভাবে কাজ (function) করে। তাহলে চুল পরিস্কারের কাজে ব্যবহৃত শ্যাম্পু অথবা মাথা ব্যাথা উপশমের টেবলেট, আমার কাছে আর কোন রহস্যই নয়।
২৮। বিজ্ঞানের কোন দেশ নাই, কারণ বিজ্ঞান বিশ্বমানবের, এবং তা সেই মশাল যা পৃথিবীকে আলোকিত করে। বিজ্ঞান হলো জাতির সর্বচ্চো নরত্বারোপ, কারণ সেই জাতির স্থানই সর্বাগ্রে, যেই জাতি চিন্তা ও বুদ্ধিমত্তায় সব চাইতে বেশি অবদান রাখতে পেরেছে।
“Science knows no country, because knowledge belongs to humanity, and is the torch which illuminates the world. Science is the highest personification of the nation because that nation will remain the first which carries the furthest the works of thought and intelligence.” —Louis Pasteur
২৯। বিজ্ঞান বিভিন্ন ঘটনা ও বিষয়ের মধ্যে লজিকাল কানেকশনগুলোকে (logical connections ) বুঝতে এবং সুসঙ্গত (coherent) চিত্র পেতে সাহায্য করে।
৩০। বিশ্বব্যাপি ক্ষিপ্রগতি পরিবর্তন মুলতঃ বিজ্ঞানের উন্নয়নেরই ফসল। সুতরাং বিজ্ঞান শিক্ষা এই ত্বরিত পরিবর্তনগুলোকে মানিয়ে নিতে সহায়তা করবে।
“The rapid changes in our world are mainly due to the progress of science. So studying science would give us an important advantage in adapting to these changes.”
৩১। “সব চাইতে সুন্দর অনুভূতি যা আমাদের হয় তাহলো সেই রহস্যময়তা – সেই মৌলিক ভাবাবেগ যা দাঁড়িয়ে আছে প্রকৃত কলা ও প্রকৃত বিজ্ঞানে।” – আলবার্ট আইনস্টাইন।
“The most beautiful experience we can have is the mysterious – the fundamental emotion which stands at the cradle of true art and true science.” — Albert Einstein. Quote taken from ‘Living Philosophies’, 1931
৩২। যেহেতু আধুনিক যুগে চাকুরী অনেক প্রযুক্তিগত (technical) হয়ে গিয়েছে তাই বিজ্ঞানশিক্ষা একজন চাকুরীপ্রার্থীকে ও চাকুরীজীবিকে অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থানে রাখে।
“As jobs become more technical, having a scientific understanding puts you in a favourable position for future life choices.”
৩৩। বিজ্ঞানের মূল শাখাগুলো যথা রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান আমাদের চারপাশের জগতটির ভিত্তি রচনা করছে। তাই বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে আমরা জানতে পারবো এই জগতটিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে কি করে নিরাপদ করা যায় ও রক্ষা করা যায়।
“Chemistry, Biology and Physics form the basis of the world around us. By studying science, we can learn how to make the most of our world and hopefully how to protect it for the future generations to come.”
৩৪। ষষ্ঠ শতক থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিজ্ঞান অতীব গুরুত্বপূর্ণ (vital) ভূমিকা পালন করে আসছে, শিল্প বিপ্লব থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ বিপ্লব হয়ে আজকের কম্পিউটার বিপ্লব পর্যন্ত বিজ্ঞান বারংবার ব্যবসার ধারাই পাল্টে দিয়েছে ও তার উন্নয়ন লম্ফনে মূল ভূমিকা রেখেছে, তাই ব্যবসায়ীদের জন্যে বিজ্ঞানশিক্ষা অপরিহার্য্য।

৩৫। অনেকেই ভাবে যে বুদ্ধিমত্তা খ্যাতিমান বিজ্ঞানী তৈরী করে, না তারা ভুল বলে, সচ্চরিত্রই খ্যাতিমান বিজ্ঞানী তৈরী করে। – আইনস্টাইন।
Most people say that it is the intellect which makes a great scientist. They are wrong: it is character. —A. Einstein
৩৬। আমরা এমন একটি পৃথিবীতে বসবাস করছি যা চমৎকারভাবে বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল, অথচ এখানে খুব কম লোকই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখে। – কার্ল সেগান।
We live in a society exquisitely dependent on science and technology, in which hardly anyone knows anything about science and technology. – Carl Sagan
৩৭। পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাহায্য আমরা আমাদের চারপাশের বিশ্বজগতটাকে উদঘাটন করি, আর এই অভিযানের নামই বিজ্ঞান। – এডউইন হাবেল।
Equipped with his five senses, man explores the universe around him and calls the adventure Science. -Edwin Powell Hubble
৩৮। আজকের বিজ্ঞান, আগামী দিনের প্রযুক্তি। – এডওয়ার্ড টেলর।
The science of today is the technology of tomorrow. -Edward Teller
৩৯। বিজ্ঞান একটি সমস্যার সমাধান করে আরো দশটি প্রশ্নের জন্ম দেয়। – জর্জ বার্নার্ড শ
Science never solves a problem without creating ten more. -George Bernard Shaw
৪০। বিজ্ঞান যতনা জ্ঞানের সমাহার, তার চাইতে বেশি হলো চিন্তনের উপায়। – কার্ল সেগান
Science is a way of thinking much more than it is a body of knowledge. -Carl Sagan
৪১। বিজ্ঞান হলো গুছানো জ্ঞান, আর প্রজ্ঞা হলো গুছানো জীবন। – ইমানুয়েল কান্ট।
Science is organized knowledge. Wisdom is organized life. -Immanuel Kant
৪২। বর্তমান জীবনের সবচাইতে দুঃখজনক দিক হলো বিজ্ঞান অতি দ্রুত জ্ঞান অর্জন করছে, কিন্তু সমাজ অত দ্রুত প্রজ্ঞা অর্জন করতে পারছে না। – আইজাক আজিমোভ।
The saddest aspect of life right now is that science gathers knowledge faster than society gathers wisdom. – Isaac Asimov
৪৩। বিজ্ঞানের উন্নয়নের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করার চাইতে বড় সম্মান আর কোন কিছুতে হতে পারেনা। – আইজাক নিউটন।
To me there has never been a higher source of earthly honor or distinction than that connected with advances in science. -Isaac Newton
৪৪। আমাদের বিজ্ঞানগত ক্ষমতা আমাদের আধ্যাত্মিকতাকে পরাজিত করেছে। আমরা মিসাইলকে পথনির্দেশনা দিয়েছি আর মানব-কে করেছি পথভ্রষ্ট। – মার্টিন লুথার কিং।
Our scientific power has outrun our spiritual power. We have guided missiles and misguided men. — Martin Luther King, Jr.
৪৫। ‘বিজ্ঞান মানে হলো উপলদ্ধি’। – প্লেটো
Science is nothing but perception. – Plato
৪৬। Your theory is crazy, but it’s not crazy enough to be true. – Niels Bohr
৪৭। বিজ্ঞান মানুষকে বন্ধন মুক্ত করবে, অভিকর্ষ-এর বন্ধন, যা আমাদেরকে এই গ্রহটির সাথে আটকে রেখেছে। – ওয়ার্নার ব্রাউন
It will free man from the remaining chains, the chains of gravity which still tie him to this planet. – Wernher von Braun
৪৮। মাইক্রোস্কোপ ও টেলিস্কোপ-এর জন্য প্রকৃতি তার সবচাইতে সুন্দর কবিতাগুলোর কিছু লিখেছে। – থিওডর রোযাক
Nature composes some of her loveliest poems for the microscope and the telescope. ~Theodore Roszak,
৪৯। বিজ্ঞানের প্রতিটি নতুন মহান অগ্রগতি, কল্পনার একটি নতুন স্পর্ধা থেকে উদ্ভুত। – জন ডেউএই
Every great advance in science has issued from a new audacity of imagination. — John Dewey
৫০। এটা বিজ্ঞানেরই কৃতিত্ব যে তা মানবমনের উপর প্রভাব বিস্তার করে মানবজাতিকে তার নিজের ও প্রকৃতির সম্মুখে নিরাপত্তার অভাব দূর করেছে। – আলবার্ট আইনস্টাইন
It stands to the everlasting credit of science that by acting on the human mind it has overcome man’s insecurity before himself and before nature. – Albert Einstein।

Khayyám, who stitched the tents of science,
Has fallen in grief’s furnace and been suddenly burned,
The shears of Fate have cut the tent ropes of his life,
And the broker of Hope has sold him for nothing!
— Omar Khayyám

(চলবে)

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
১। সামুর ব্লগার ম্যাভেরিক
২। ইন্টারনেটে প্রাপ্ত বিভিন্ন আর্টিকেল

৩,৬৭২ বার দেখা হয়েছে

২৭ টি মন্তব্য : “কোন জ্ঞান বিজ্ঞান? সেই জ্ঞান পাঠ করা এতো জরুরী কেন?”

  1. সাইদুল (৭৬-৮২)

    যদিও এরিস্টোটল দুই দুইবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন, তারপরেও তিনি সম্ভবত একবারও স্ত্রীদের দন্তের সংখ্যা গণনা করে নিজের মতামতের সত্যতা যাচাই করেননি

    প্রমানিত হয়, এরিস্টেটল আমাদের মতই সাধারণ মানুষ ছিলেন, দুঃসাহসী ছিলেন না।

    চমৎকার হচ্ছে লেখাটা


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
  2. মাহবুব (৭৮-৮৪)

    সেই ছোট বেলায় আবদুল্লাহ আর মূতী শরফদ্দিনের "এসো বিজ্ঞানের রাজ্যে" পড়েছিলাম। এরপর আর তেমন কোন লেখা চখে পড়েনি। বিজ্ঞান, অংক- এসবের বই গুলি বেশ খটমটে, নীরস। ওসব বিষয়ের উপর আগ্রহ বাড়ায় না, বরং উলটো। লেখা লেখির এই জায়গাটায় বেশ শুন্যতা আছে। আশা করি রমিত সেটা পূরন করবে।

    জবাব দিন
  3. ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

    অনেক ধন্যবাদ মোস্তাফিজ।
    হ্যাঁ আমিও ডঃ আব্দুল্লাহআল মূতী শরফুদ্দীনের লেখার একান্ত ভক্ত ছিলাম। ঐ লেখাগুলো পড়েই বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। সেখান থেকেই অনুপ্রেরণা পাই বিজ্ঞান বিষয়ে লেখার। ড. আব্দুল্লাহআল মূতী-কে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
    বিজ্ঞান ও দর্শনের সম্পর্ক গভীর, তাই দুটোর দিকেই সমান নজর দেয়ার চেষ্টা করছি।

    জবাব দিন
  4. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    রমিত ভাই,

    আপনার এই লেখাটা মিস করেছিলাম।

    বেশ উৎসাহ উদ্দীপক একটা লেখা। সকলের মধ্যে বিজ্ঞানের ইতিহাসে আগ্রহ জাগাবে নিঃসন্দেহে।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  5. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)
    ‘আলো এবং বর্ণ বায়ুতে মিশ্রিত হয় না’ এ হাইপোথিসিসকে পরীক্ষা করতে গিয়ে আল-হাতেম পৃথিবীর প্রথম ক্যামেরা, অবস্কিউরা (Obscura) উদ্ভাবন করেন, পর্যবেক্ষণ করেন আলো সূক্ষ্ম ছিদ্রের ভেতর দিয়ে গমন করার পর কী ঘটে, এবং ফলাফল লিপিবদ্ধ করেন।

    The lines above are picked up from here:
    http://www.somewhereinblog.net/blog/rajib128/29685904

    জবাব দিন
  6. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)
    ইবনে আল-হাতেমের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের পেছনে কাজ করেছে মূলত তাঁর ইসলাম ধর্মীয় বিশ্বাস এবং তাঁর অনুসন্ধিৎসু, সন্দেহবাদী মন। পবিত্র কোরআন শরীফ পাঠ করে তিনি জেনেছিলেন যে, মানুষ ত্রুটিপূর্ণ, কেবলমাত্র স্রষ্টা-ই নিখুঁত। প্রকৃতির ব্যাপারে সত্য আবিষ্কার করতে, তিনি বলতেন, প্রকৃতিকেই তার নিজের হয়ে কথা বলতে দিতে হবে। টলেমির উপর সংশয় পোষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন,
    “একজন সত্য-সন্ধানী তিনি নন যিনি প্রাচীন মানুষের লেখা পড়েন, এবং নিজের প্রবৃত্তির দ্বারা পরিচালিত হয়ে সেগুলির উপর বিশ্বাস স্থাপন করেন, বরং তিনিই সত্য-সন্ধানী যিনি সেগুলির উপর নিজের বিশ্বাসকে সন্দেহ করেন এবং সেখান থেকে যা আহরণ করেন তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন—তিনি এমন একজন মানুষ যিনি যুক্তি ও নিরীক্ষার আশ্রয় নেন।” অর্থাৎ জ্ঞানের কথা যাই বলেন আর তাই বলেন, পরীক্ষার দ্বারা যতক্ষণ না তা প্রমাণিত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে বিজ্ঞান বলা যাবেনা। আর যখন জ্ঞানের কথাটি যথাযথ পদ্ধতির মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত হবে কেবলমাত্র তখনই তাকে বিজ্ঞানের মর্যাদা দেয়া হবে।

    ‘আলো এবং বর্ণ বায়ুতে মিশ্রিত হয় না’ এ হাইপোথিসিসকে পরীক্ষা করতে গিয়ে আল-হাতেম পৃথিবীর প্রথম ক্যামেরা, অবস্কিউরা (Obscura) উদ্ভাবন করেন, পর্যবেক্ষণ করেন আলো সূক্ষ্ম ছিদ্রের ভেতর দিয়ে গমন করার পর কী ঘটে, এবং ফলাফল লিপিবদ্ধ করেন। এমনিভাবে আরো ডজন ডজন ‘সত্যিকারের গবেষণালব্ধ ফলাফল’ কিতাব-আল-মানাজিরে তিনি লিপিবদ্ধ করেন।

    আর গবেষণালব্ধ ফলাফলের উপর জোর দিয়ে এভাবেই ইবনে আল-হাতেম জ্ঞান-বিজ্ঞানে নতুন এক “অনুসন্ধানের” দ্বার খুলে দেন এবং ইতিহাসে সত্যিকারের প্রথম বিজ্ঞানীর স্থান অলংকৃত করেন।

    in fact this whole piece is taken from here:

    https://www.facebook.com/bejoymobilepoint/posts/494771523936793

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।