অতি প্রাচীন দ্বন্দ্ব ও বাংলার বীরত্বগাঁথা

 

অতি প্রাচীন দ্বন্দ্ব ও বাংলার বীরত্বগাঁথা ১:
—————————–ডঃ রমিত আজাদ

হযরত নূহ (আঃ)-এর প্রোপৌত্র বঙ্গ-এর নামানুসারেই আমাদের দেশের নাম বঙ্গ হয়েছে বলে একটি সূত্রমতে পাওয়া যায়। সেই বঙ্গ-এরই বংশধর আমরা। আরেকটি সূত্রমতে বঙ্গ শব্দের অর্থ সূর্য-দেবতা। রাজা বঙ্গ-ই ছিলেন বঙ্গ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা, তাই তাঁর নামানুসারেই দেশের নাম হয় বঙ্গ। আজ থেকে বিশ হাজার বছর পূর্বের প্রস্তর যুগের নিদর্শন বাংলায় পাওয়া গিয়েছে। প্রায় চারহাজার বছরের পুরনো তাম্রযুগের ধ্বংসাবশেষ বাংলায় পাওয়া গিয়েছে । আমাদের ভূমির মূল বসতি স্থাপনকারীরা অনার্য ছিলেন। আমাদের আদি পূর্বপুরুষরা অস্ট্রিক বা অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষায় (ইদানিংকার কোল, ভীল, সান্তাল, শাবারা ইত্যাদি-র সাথে মিল থাকতে পারে) কথা বলতেন বলে ধারনা করা হয়।

আর্য সাম্রাজ্যের বাহিরে অবস্থিত এই দেশের মানুষ (জাতি)-কে, আর্য কর্তৃক রচিত গ্রন্থ ঋগবেদে ‘শত্রু” আখ্যা দেয়া হয়েছে (Dasa is a term that initially had the connotation of “enemy,” as relating to tribes identified as the enemies of the Indo-Aryan tribes in the Rig Veda) ঋগবেদে দস্যু শব্দটিও ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থ এই দাড়ালো যে, আর্যরা আমাদের শত্রু জ্ঞান করতো।

মহাভারতে (৬।৯) অঙ্গ, বঙ্গ ও কলিঙ্গ রাজ্য তিনটাকে ভারতবর্ষ বা প্রাচীন ভারতের নিকটবর্তী রাজ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১২ বছর তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে অর্জুন বঙ্গ ও কলিঙ্গের সকল পবিত্র স্থানে এসেছিলেন। মহাভারতের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, পান্ডব ও কৌরবদের যুদ্ধ কুরুক্ষেত্রে বঙ্গ-বাসীরা দুর্যোধনের পক্ষে (পান্ডবদের বিপক্ষে) অংশ নিয়েছিলো। Vangas sided with Duryodhana in the Kurukshetra War (8:17) along with the Kalingas. They are mentioned as part of the Kaurava army at (7:158). Many foremost of combatants skilled in elephant-fight, belonging to the Easterners। বঙ্গ-এর হস্তিবাহিনী ছিলো দুর্ধর্ষ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দশ হাজার সৈন্যের এক পর্বতসম বাহিনী নিয়ে বঙ্গ বীরেরা দুর্যোধনের পিছনে অবস্থান নিয়েছিলো। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় বঙ্গের রাজা ছিলেন ভগদত্ত।

খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে বাংলার বেশিরভাগ এলাকাই শক্তিশালী রাজ্য মগধের অংশ ছিল । মগধের কথা রামায়ণ এবং মহাভারতে পাওয়া যায়। গৌতম বুদ্ধের (খ্রীষ্টপূর্ব ৫৬৩ থেকে ৪৮০ পর্যন্ত) সময়ে এটি ছিল ভারতের চারটি প্রধান রাজ্যের মধ্যে একটি । মগধের ক্ষমতা বাড়ে বিম্বিসারের (রাজত্বকাল ৫৪৪-৪৯১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) এবং তার ছেলে অজাতশত্রুর (রাজত্বকাল ৪৯১-৪৬০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) আমলে । বিহার এবং বাংলার অধিকাংশ জায়গাই মগধের ভিতরে ছিল তবে বাইরেও অনেক জায়গা ছিলো। গৌতম বুদ্ধ-এর ভাষা ছিলো মগধি প্রাকৃত (মগধি প্রাকৃত ও পালি ভাষা খুব কাছাকাছি)। তিনি আর্য ছিলেন কি অনার্য ছিলেন এই নিয়েও প্রচুর বিতর্ক রয়েছে (Johannes Bronkhorst’s book “Greater Magadha” was a very fine example of a revisionist history. It argued that the Aryan culture had not penetrated to Buddha’s region of birth and life (Magadha) and hence did not have a caste system and a very insignificant population of Brahmins)। তবে তাঁর প্রচারিত দর্শন যে অবৈদিক (heterodox) ছিলো এতে কোন সন্দেহ নেই।

দার্শনিক এরিস্টটলের শিষ্য আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সেনাবাহিনী ৩২৬ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মগধের নন্দ সাম্রাজ্যের সীমানার দিকে অগ্রসর হয়। রাজ্যপিপাসু আলেকজান্ডার জানতেন যে দক্ষিণ এশিয়ার একেবারে পূর্বদিকে এক মহাপরাক্রমশালী জাতি আছে যার হস্তিবাহিনী ভয়াবহ। এই জাতি ইতিমধ্যেই দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম শক্তিশালী সমুদ্রভ্রমণকারী জাতি হিসাবে সুখ্যাতি অর্জন করেছে। সমুদ্রপথে দূরবর্তি জাভা, সুমাত্রা, শাম ইত্যাদি দেশের সাথে তারা বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করেছে। মহাভামসা ইতিহাস গ্রন্থ অনুযায়ী এই দেশের (বঙ্গদেশ) রাজপুত্র বিজয় সিংহ (খ্রীষ্টপূর্ব ৫৪৪) লঙ্কা জয় করে তার নাম সিংহল দেন। এছাড়া তারা মালয় দ্বীপপুঞ্জ ও শামদেশেও তাদের নিজস্ব উপনিবেশ স্থাপন করে। যুদ্ধনেশাগ্রস্ত আলেকজান্ডার-কে এই রাজ্য জয়ের নেশায় পয়ে বসলো। তিনি হুকুম দিলেন তাঁর বাহিনীকে পুর্বমুখে ঐ দেশের দিকে অগ্রসর হতে। কিন্তু এতটা পথ জয়ী হয়ে আসা আলেকজান্ড্রীয় সেনাবাহিনী এবার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই তারা অজুহাত দেখাতে থাকে যে তারা রণক্লান্ত এবং আর সামনে তারা যেতে চায়না। আলেকজান্ডার অনড় হয়ে বসলে তার বাহিনী বিয়াসের কাছে বিদ্রোহ ঘোষনা করে এবং আরও পূর্বদিকে যেতে অস্বীকার করে। গ্রীক পরিব্রাজক মেগাস্থানিস তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইন্ডিকা’-য় উল্লেখ করেছেন, এই জাতির নাম গঙ্গাঋদ্ধি (Gangaridae)। যার অর্থ “Wealth of the Ganges”। দিওদোরাস সিকুলাস (Diodorus Siculus) উল্লেখ করেছেন, ভারত উপমহাদেশের সবচাইতে শক্তিশালী জাতি ছিলো গঙ্গাঋদ্ধি জাতি, এর রাজা বিশ হাজার অশ্ব, চার হাজার হস্তি, দুই হাজার রথ ও দুই লক্ষ পদাতিক সৈন্যের এক শৌর্যপূর্ণ বাহিনী নিয়ে আলেকজান্ডারের মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হন। আলেকজান্ডার তখন তাঁর সহকারী কইনাস (Coenus) এর সাথে দেখা করার পরে ঠিক করেন ফিরে যাওয়াই ভাল। গ্রীক পলিম্যাথ টলেমী (৯০-১৬৮ খ্রীষ্টাব্দ) লিখেছেন গঙ্গারিডী জাতি গঙ্গা নদীর মোহনার পাঁচটি মুখের পুরোটাতেই রাজত্ব করতো। অর্থাৎ সেই রাজ্যের অবস্থান যেখানে ছিলো সেটাই আজকের বাংলা। গঙ্গারিডী রাজ্য বাংলারই প্রাচীন রূপ, গঙ্গাঋদ্ধি জাতি আমাদেরই পূর্বপুরুষগণ।

পরবর্তিকালে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসনামলে মগধ রাজ্য (বাংলা সহ) মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। তারও পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত হয় শক্তিশালী গুপ্ত সাম্রাজ্য যা মগধেই গড়ে ওঠে। বাংলার স্বাধীন রাজা ছিলেন শশাঙ্ক-এর রাজত্বকাল ছিলো ৬০৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত । তিনি সম্ভবত হর্ষবর্ধন-এর ভগিনী রাজ্যশ্রী কে অপহরন করে ছিলেল ।এইজন্য হর্ষবর্ধন-এর সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হয় ।তাঁর শক্তি বৃদ্ধি হতে দেখে কামরুপ রাজ ভাস্করবর্মন তাঁর শত্রু হর্ষবর্ধন-এর সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন । ৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দে শশাঙ্ক-এর মৃত্যুর পর তাঁর রাজ্যের পতন ঘটে ও বাংলাতে এক অরাজক অবস্থার সৃস্টি হয় যাকে বাংলায় মাৎস্যন্যায় বলা হয় ।

৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দে গৌড় রাজ শশাঙ্ক-এর মৃত্যুর পর বাংলার ইতিহাসে একঘোরতর নৈরাজ্যের সৃস্টি হয় যা প্রায় দেড়শো বছর তা স্থায়ী হয় । এই যুগকে বলা হতো মৎস্যন্যায়-এর যুগ, মানে মাছের মধ্যে আইন হলো বড় মাছ ছোট মাছদের খাবে অর্থাৎ দুর্বল সবলের দ্বারা অত্যাচারিত হবে। এই সময় বাংলাতে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের সৃস্টি হয় আত্মকলহ,গৃহযুদ্ধ,গুপ্তহ্ত্যা,অত্যাচার প্রভৃতি চরমে ওঠে । বাংলার সাধারণ দরিদ্র মানুষদের দুর্দশার শেষ ছিল না । স্থায়ী প্রশাসন না থাকাতে বাহুবলই ছিল শেষ কথা।

মাৎস্যন্যায়ের সময় বাংলার বিশৃঙ্খলা দমনের জন্য বাংলার মানুষ ঠিক করলেন এভাবে আর চলেনা! সৎ, মেধাবী, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক কাউকে সিংহাসনে বসাতে হবে। অবশেষে আয়োজন করা হয় নির্বাচনের। এটিই ছিলো আমাদের ইতিহাসের প্রথম গণনির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমে গোপাল নামক একজন কে বাংলার রাজা হিসেবে গ্রহন করা হয়। তিনি সাধারণ কেউ ছিলেন না। তার পিতা ছিলেন একজন বীর যোদ্ধা ও পিতামহ ছিলেন একজন পন্ডিত দার্শনিক। গোপালই হলেন পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা । জ্ঞানী, সৎ, মেধাবী, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক কাউকে সিংহাসনে বসালে যে দেশ ঐশ্বর্যশালী হয়ে ওঠে এটি ছিলো একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পাল বংশের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই রাজা ছিলেন ধর্মপাল (রাজত্বকাল ৭৭৫-৮১০ খ্রীষ্টাব্দ) এবং দেবপাল (রাজত্বকাল ৮১০-৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ) । দেবপালের রাজত্বকালে উপমহাদেশের এক বিশাল অংশ বাঙালীদের করতলগত হয়।
 

 
(আমরা বীরের জাতি)

(চলবে)

 

 

 

 

 

৯৭৯ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “অতি প্রাচীন দ্বন্দ্ব ও বাংলার বীরত্বগাঁথা”

  1. অরূপ (৮১-৮৭)

    \\ হযরত নূহ (আঃ)-এর প্রোপৌত্র বঙ্গ-এর নামানুসারেই আমাদের দেশের নাম বঙ্গ হয়েছে বলে একটি সূত্রমতে পাওয়া যায়// .... এটা কোন সুত্রমতে???
    প্রপৌত্র কি গ্রেট গ্র্যান্ডসান??

    সম্পুর্ন লেখাটা পড়ব আশা রাখি ... (সম্পাদিত)


    নিজে কানা পথ চেনে না
    পরকে ডাকে বার বার

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ভালো লাগল পড়ে।
    ঐতিহাসিক জিনিস যেহেতু লেখার শেষপর্বে টীকা গুলো কাইন্ডলি দিয়ে দিয়েন ভাইয়া।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  3. ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

    ধন্যবাদ খায়রুল ভাই।
    গঙ্গারিডি জাতি সম্পর্কে ছোটবেলায় আমাদের পাঠ্যপুস্তকেই পড়েছিলাম। বাংলা এ্যকাডেমী থেকে প্রকাশিত একটা বই আছে, 'গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ'। যতদূর জানি, বিজয় সিংহের বিষয়টাও একসময় পাঠ্যপুস্তকে ছিলো পরবর্তিতে তুলে দেয়া হলো কেন জানিনা।
    অন্যান্য তথ্যও যথাসম্ভব যেষ্টা করেছি যাচাই করে দেয়ার। ইন্টারনেটের কল্যাণে আজকাল অনেক কিছুই হাতের মুঠোয় এসে গেছে, আর একাধিক ভাষা জানা থাকায় আমারও কিছুটা সুবিধা রয়েছে।

    জবাব দিন
  4. ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

    আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ,
    লংকা করিয়া জয়,
    সিংহল নামে রেখে গেছে,
    নিজ শৌর্যের পরিচয়।

    (বঙ্গের বীর সন্তান নামক একটি ইতিহাসের বইয়ে এই কবিতাটি উদ্ধৃত আছে)

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।