বোর-আইনস্টাইন বিতর্ক – পর্ব ১, ২, ৩

বোর-আইনস্টাইন বিতর্ক – পর্ব ১
——————– ড. রমিত আজাদ

সাধারণ মানুষের একটি প্রচলিত ধারণা হলো, বিজ্ঞান সর্বদা ধ্রুব সত্যকে আবিষ্কার করে এবং বিজ্ঞান যা করে তা সর্বজনীন এবং একই বিষয়ে একাধিক সত্যের কথা তারা বলেনা বরং একটিমাত্র সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে। একজন বিজ্ঞানী যা বলেন বা প্রতিষ্ঠিত করেন সকল বিজ্ঞানীই তা মেনে নেয়। বিষয়টি আসলে পুরোপুরি সেরকম নয়। ইতিহাসে বহুবারই দেখা গিয়েছে যে, একজন খ্যাতিমান বিজ্ঞানী যা বলছেন অপর একজন খ্যাতিমান বিজ্ঞানী তা মেনে নিতে চাচ্ছেন না। আবার এই প্রশ্নে বিজ্ঞানীরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছেন। এরকম একটি ঘটনা বোর-আইনস্টাইন বিতর্ক।

ঘটনার সুত্রপাত উনবিংশ শতকের শেষের দিকে। বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাঙ্ক-এর শিক্ষক তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন প্লাঙ্ক যেন ফিজিক্স নিয়ে লেখাপড়া না করেন। কারণ শিক্ষক মনে করতেন যে প্লাঙ্ক অত্যন্ত প্রতিভাবান, তার প্রতিভা ব্যবহার করলে তিনি মানবজাতিকে অনেক কিছু দিতে পারবেন, কিন্তু ফিজিক্স নামক বিজ্ঞানটি সমপুর্ণ হয়ে গিয়েছে, সেখানে নতুন করে আর কিছু দেয়ার নেই।
বিষয়টি আসলে মোটেও সেরকম ছিলোনা। সেই সময়ে ফিজিক্স-এর নিখুঁত গঠনের প্রচেষ্টায়ও দুটি খুঁত ছিলো — ১। কৃষ্ণবস্তু-বিকিরণ ব্যাখ্যার অসুবিধা (নিউটনীয় মেকানিক্স-এর সাথে পরীক্ষালদ্ধ ফলাফলের গরমিল), ২। আলোর গতিজনিত মাইকেলসন-মরলে-এর পরীক্ষার উদ্বেগজনক ফলাফল। এদেরকে তখন বলা হতো ফিজিক্স-এর নির্মেঘ উজ্জ্বল আকাশে দুটি কালো মেঘ।

উল্লেখ্য যে ম্যাক্স প্লাঙ্ক ফিজিক্স নিয়েই পড়ালেখা করেছিলেন এবং এবং ঐ কৃষ্ণবস্তু বিকিরণের প্রথম ব্যাখ্যা তিনিই দিয়েছিলেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্স (Quantum Mechanics) নামক বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠার অগ্রগতির এটিই ছিলো প্রথম পদক্ষেপ। পরবর্তিতে বিজ্ঞানী নীলস বোর শক্তির কোয়ান্টায়নের ধারনার সূচনা করলেন। এভাবেই সুত্রপাত নতুন বিজ্ঞান কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর। জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটনের প্রতিষ্ঠিত ফিজিক্স (যার পরিবর্তিত নাম হলো নিউটনীয় মেকানিক্স না ক্লাসিকাল মেকানিক্স) হতে তা ছিলো একেবারেই ভিন্ন ধারার সেই অর্থে বৈপ্লবিক। আনকোড়া নতুন কোন কিছুকে চট করে গ্রহন করা সবসময়ই কষ্টকর, এক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি।

কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এ কোন অবসারভেবল (observable)-এর মান যেমন কোন কণার অবস্থান অথবা গতিবেগ কেবলমাত্র পরিসংখ্যানিক ভাবে ভবিষ্যদ্বানী করা যায় কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করা যায়না। নীলস বোর মনে করতেন কণিকার এই সম্ভাবনা প্রকৃতি (probabilistic nature) মৌলিক। অন্যদিকে আলোড়ন সৃষ্টিকারি আপেক্ষিক তত্ত্ব (theory of relativity)-এর জনক অপর জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ভিন্নমত পোষণ করতেন। তিনি মনে করতেন, যেহেতু মানগুলো সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করা যাচ্ছেনা, তার মানে কোয়ান্টাম মেকানিক্স নামক বিজ্ঞানটি সম্পুর্ণরূপ ধারন করেনি। এইরূপে বিজ্ঞানটি কিছু বাস্তবতাকে বিবেচনা না করেই কাজ করে যাচ্ছে। এইভাবেই বোর-আইনস্টাইন বিতর্কের শুরু।

আলবার্ট আইনস্টাইন, বরিস পাদোলস্কি এবং নাথান রোজেন ১৯৩৫ সালে একটি পরীক্ষার প্রস্তাব করেন, তাদের নামের আদ্যোক্ষরের সমন্বয়ে পরীক্ষাটির নাম হয় ইপিআর (EPR)। এই পরীক্ষার আরেক নাম থট এক্সপেরিমেন্ট (thought experiment)। যুক্তিটি এমন ছিলো যে, কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর আইনসমূহ অনুযায়ী -একত্রে থাকা দুটি কণিকার একটি বিচ্ছিন্ন করে যদি বহু আলোকবর্ষ দূরে নিয়ে যাওয়া হয় তখন একটিকে কোনভাবে বিক্ষিপ্ত করলে অন্যটিও বিক্ষিপ্ত হবে। কণিকাজোড়ার একটির ধর্ম পরিমাপ করলে অন্যটির ধর্ম তাৎক্ষণিকভাবে পরিমাপ করা সম্ভব হয়ে ওঠে। কণিকাজোড়ার একটিতে পরিমাপ শুরু করলে তার যমজ কণিকাটি সাথে সাথেই তা অনুভব করতে শুরু করে এবং সেই অনুযায়ী সে ভৌত অবস্থাও গ্রহন করে। ফিজিক্সে এই বিষয়টিকে এনটেঙ্গলমেন্ট (Entanglement) বলা হয়।

আইনস্টাইনের সৃষ্ট আপেক্ষিকতা অনুযায়ী আলোর গতির চাইতে অধিকতর গতি সম্পন্ন কোন গতি এই মহাবিশ্বে হতে পারেনা। অথচ এনটেঙ্গেলমেন্ট এর বিরোধিতা করে দূরক্রিয়া (action at a distance)-কে সমর্থন করছে। যা আইনস্টাইনের কাছে মোটেও গ্রহনযোগ্য ছিলোনা। তিনি এই সিদ্ধান্ত করলেন যে, ‘যদি উভয় কণিকাদ্বয়ের একই ধর্ম থাকে তাহলে তা এই কারণে যে, এই বৈশিষ্ট্য তারা ধারন করেছিলো যখন তারা একই সাথে ছিলো, এবং সেই বৈশিষ্ট্যই তারা বজায় রেখেছে যখন তারা পৃথক হলো। আইনস্টাইনের এই নিষ্পত্তি কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর পূর্ণতা দেয়ার পথে ছিলো, কিন্তু অবিলম্বেই তা নীলস বোর কর্তৃক তর্কবাণে বিদ্ধ হলো।

এখানে ইন্টেরেস্টং বিষয় হলো এই যে, নিউটনীয় মেকানিক্স দীর্ঘ আড়াইশত বছর পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করেছিলো। এবং তা মানবজাতির জীবনে সূচনা করেছিলো একটি নতুন যুগের যুক্তিনিশ্চয়তাবাদ-এর যুগ। এমন অনুভুত হতে শুরু করেছিলো যে প্রকৃতি জগতের কোন রহস্যই আর রহস্য নয় সবকিছুই নিউটনীয় মেকানিক্স ব্যাখ্যা করতে সমর্থ। মানবজাতির জন্য যা ছিলো অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে উদ্ভুত দুটি নতুন সমস্যা (যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে) ব্যাখ্যা করতে নিউটনীয় মেকানিক্স ব্যার্থ হলো। ক্ষুদ্র কণিকার যে জগতের সাথে মানবজাতির পরিচয় ঘটলো তা ও আলোর গতির মতো অতি দ্রুত গতিসম্পন্ন কায়ার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করায় নিউটনীয় মেকানিক্স-এর সীমাবদ্ধতা প্রকাশ পেলো। যা ছিলো সেই সময়ের বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের জন্য চরম সংকট। অবশেষে দুটো বিষয়েরই ব্যাখ্যা পাওয়া গেলো এবং মানব জাতি উপহার পেলো নতুন দুটি বিজ্ঞান কোয়ান্টাম মেকানিক্স (ক্ষুদ্র কণিকার জগতের ব্যাখ্যা) ও রিলেটিভিস্টিক মেকানিক্স (আলোর গতির মতো অতি দ্রুত গতিসম্পন্ন কায়ার ব্যাখ্যা)। অথচ আশ্চর্য্য এই যে এই দুই বিজ্ঞানের জনকরাই প্রকৃতি জগতের ব্যাখ্যা নিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হলেন।

দর্শনশাস্ত্রে নিশ্চয়তাবাদ (determinism) বলে একটি দর্শন আছে তা এই বলে যে, ‘আমাদের জগৎ সম্পুর্ণভাবে নির্ধারনীয়, মানে জগতে যাই ঘটে তা কোন না কোন পুর্বতন ঘটনার দ্বারা প্রভাবিত, অন্যরকম কিছু হওয়া সম্ভব না। এইভাবে প্রতিটি ঘটনাই (event) নির্ধারন যোগ্য। বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তাবাদের অনুমিতিগুলোকে প্রথম সুস্পষ্টভাবে প্রস্তাব করার কৃতিত্ব ল্যাপ্লাসের। তিনি বলেন, ‘যদি কোনো নির্দিষ্ট সময়ে সমগ্র মহাবিশ্বের অবস্থা দেওয়া থাকে, তাহলে প্রাকৃতিক নিয়মসমূহের একটা পরিপূর্ণ সেট অতীত ও ভবিষ্যত সব কিছুই নির্ধারণ করবে। এর ফলে অলৌকিক কিছু ঘটার সম্ভাবনা নাকচ হয়ে যায়।’ এটাই বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তাবাদ। উদাহরণঃ সূর্য ও গ্রহগুলির যেকোন একসময়কার দ্রুতি যদি জানা থাকে তবে নিউটনের গতিসূত্রগুলো ব্যবহার করে তাদের পরবর্তি যেকোন সময়কার দ্রুতি ও অবস্থান জানা যাবে। লাপ্লাস আরো কিছুদূর অগ্রসর হয়ে বলেছিলেন যে, ‘মানবিক আচরণ সম্পর্কেও এই ধরনের বিধি রয়েছে।’

অপরপক্ষে অনিশ্চয়তাবাদ (Indeterminism/Uncertainty) নামক দর্শনটি বলে

ঘটনাসমূহ পুর্বতন ঘটনাগুলি দ্বারা নির্ধারিত নয়। এটা নির্ধারনবাদ-এর উল্টাটা এবং তা সুযোগ (chance)-এর সাথে সম্পর্কিত। এটা আবার ইচ্ছার স্বাধীনতা নামক উচ্চমাত্রার দর্শনের সাথে সম্পর্কিত।

এই দুই দর্শনের পক্ষ নিয়ে দুই বিজ্ঞান ও দুই দল বিজ্ঞানী শক্ত বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন।

(চলবে)
বোর-আইনস্টাইন বিতর্ক – পর্ব ২
——————– ড. রমিত আজাদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর থেকে)
Pre-revolutionary debate:
পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে আইনস্টাইন-ই প্রথম বলেছিলেন যে, ম্যাক্স প্লাঙ্কের আবিষ্কারের ফলে ফিজিক্স-কে নতুন করে লেখার প্রয়োজন পড়বে। এরই জের ধরে ১৯০৫ সালে তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে আলোর কেবল তরঙ্গ ধর্ম নয় পাশাপাশি কণিকা ধর্মও রয়েছে। অর্থাৎ আলো ‘কণিকার স্রোত’। (উল্লেখ্য যে কথাটি প্রথম বলেছিলেন মুসলিম বিজ্ঞানী আল হাইয়াম (Al Hazen, ১১ শতক), পরবর্তিতে স্যার আইজাক নিউটনও একই মত প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তার কিছুকাল পরে হুইগেনস, ইয়াং ও আরও কিছু বিজ্ঞানী পরীক্ষার দ্বারা প্রমান করেছিলেন যে আলো এক প্রকার তরঙ্গ। এতে আল হাইয়ামের কথা ছাইচাপা পড়ে যায়)। আইনস্টাইন সেই সময়ের একটি বড় সমস্যা photo-electric effect নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করার পর আলোর কণিকা ধর্ম প্রমাণিত হয়। এ’ যেন ছাই থেকে ফিনিক্স বেরিয়ে আসার মত। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, বৈপ্লবিক তত্ত্ব আপেক্ষিকতার জনক বলে পরিচিত হলেও বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন নোবেল পুরষ্কারটি পেয়েছিলেন তুলনামুলক ছোট কাজ photo-electric effect-এর উপর।

আলোর কণিকার একটি শ্রুতিমধুর নাম দেয়া হয়েছে ফোটন (photon)। এই ফোটন ধারণার বিরূদ্ধে যে কয়জন বিজ্ঞানী সোচ্চার ছিলেন বোর তাদের মধ্যে একজন। ১৯২৫ সালের আগে তিনি এই ধারণাকে আলিঙ্গন করতে পারেননি। ফোটন ধারনাটি আইনস্টাইন সাবলীলভাবে নিয়েছিলেন এই কারণে যে তা হখো ভৌত বাস্তবতা (physical reality) (যদিও একইসাথে তা বিভ্রান্তিকরও ছিলো), কেবলই সংখ্যা নয়। পক্ষান্তরে বোর এই কারণে ফোটন ধারনাকে অপছন্দ করতেন যে, তা mathematical solution-এর choice-কে যথেচ্ছ (arbitrary) করছে। অনেকগুলো সমীকরণ-এর মধ্যে যেকোন একটি সমীকরণ বিজ্ঞানী-কে পছন্দ করে নিতে হবে এটা তাঁর ভালো লাগেনি।

নীলস বোর ১৯১৩ সালে Bohr model of the hydrogen atom, যেটা পরমাণুর বর্ণালী (atomic spectrum) ব্যাখ্যায় quantum-কে ব্যবহার করছে। আইনস্টাইন প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কিন্তু অতি দ্রুতই তিনি মত পরিবর্তন করেন ও তা মেনে নেন।

The quantum revolution:
Quantum Mechanics নামক বিষয়টি একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তা হয়েছিলো ধাপে ধাপে। বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে এসে কোয়ান্টাম বিপ্লব সাধিত হয়। এবং তা হয়েছিলো বোর ও আইনস্টাইন দুজনার দিকনির্দেশনা অনুযায়ীই। এই পর্যায়ে বোর ও আইনস্টাইন আরেক দফা বিতর্কে অবতীর্ণ হলেন।
১৯২৫ সাল। সুইজারল্যান্ডের এরোজায় আলপাইন হোটেলে অবকাশ যাপন করছিলেন এক প্রেমিক পুরুষ। নাম অরভিন শ্রোডিঞ্জার। পুরো নাম অরভিন রুডলফ জোসেফ আলেক্সান্ডার শ্রোডিঞ্জার।

১৮৮৭ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় জন্ম শ্রোডিঞ্জারের। ধর্ম আর দর্শনে বেশ দখল ছিল তাঁর। তবে এসবের মাঝেও প্রেমিক পুরুষ পরিচয়টি শ্রোডিঞ্জারের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়ে উঠে। বয়স তখন ৩৮। ঘরে বিবাহিত বউ থাকলেও হোটেলের কামরায় তখন এক তরুণ বয়সের প্রেমিকা। এমনি এক রাতের কথা। প্রেমিকার সাথে রঙিন সময় কাটাচ্ছিলেন সেই রাতে। ঠিক এইসময়টাতে তাঁর মাথায় ধরা পড়ে গেল পরমাণু জগতের এক রঙিন ছবি। মাথায় ছিল অভিজাত বংশোদ্ভুত ফরাসী বিজ্ঞানী ডে ব্রুগলির তরঙ্গায়িত পরমাণু জগৎ। ব্রুগলির তরঙ্গ যেখানে নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেক্ট্রনকে পরিচালনা করে যাচ্ছে নিরন্তর সেখানে শ্রোডিঞ্জার যোগ করলেন নতুন আরেক মাত্রা। এতদিনের কণা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ইলেক্ট্রনকেই রূপায়ন করলেন শক্তি তরঙ্গ হিসেবে। শক্তি তরঙ্গটি এত দ্রুত উঠানামা করছে বলেই আমাদের কাছে তা ইলেক্ট্রন মেঘের মত প্রতীয়মান হচ্ছে। কত সুন্দর অথচ সরল একটি ধারণা! সনাতনীয়, তরঙ্গপ্রেমী আইনস্টাইনীয় দল ভারী হল আরো। শ্রোডিঞ্জার এখানেই থেমে থাকেন নি। সেই শক্তি তরঙ্গকে ব্যাখা করতে পারে এমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সমীকরণও তিনি উপহার দিলেন বিশ্ববাসীকে। আর শ্রোডিঞ্জারের এই তরঙ্গ সমীকরণের সবচেয়ে বিষ্ময় হল এর তরঙ্গ অপেক্ষক (function)। শ্রোডিঞ্জারের ভাষায় যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে পুরো পরমাণু জগতকে। সনাতনীয়রা তাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। যোগ দিলেন অন্যন্যরাও। অবশেষে যে পরমাণুর একটি সহজ, সুন্দর ছবি দৃশ্যমান হল তাঁদের সামনে ! আর কঠিন কঠিন গণিতের মার প্যাঁচ থেকে ব্যাখ্যাযোগ্য সুন্দর ছবি কারই না অপছন্দ!

যাই হোক শ্রোডিঞ্জারের এই দিনগুলি নিয়ে এক বিখ্যাত পদার্থবিদের উক্তি-
“এই সময়টাতে শ্রোডিঞ্জারের জীবনে কেবল দুটো জিনিসই ছিলো। এক নারীর সান্নিধ্য। দুই পরমাণুর রহস্য উদঘাটন। আমাদের ভাগ্য ভালো শ্রোডিঞ্জার দুটোই একসাথে করতে পেরেছিলেন”।
আইনস্টাইনের শক (shock)-এর শুরু হয়েছিলো যখন ১৯২৫ সালে ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ পরমাণুর ব্যাখ্যায় কিছু ম্যাট্রিক্স সমীকরণ উপস্থাপন করেন। এর ফলে নিউটনীয় স্থান-কাল (space-time)-এর ধারনা উঠে যায়, অথচ স্থান-কাল ভৌত বাস্তবতা (physical reality)। ঘটনাটি ছিলো এরকম –
১৯২৫ সালের কথা। জার্মানীর উত্তর সমুদ্র পাড়ের এক নির্জন দ্বীপ হেজল্যান্ড। দ্বীপের বেলাভূমিতে হাটছিলেন এক পরিব্রাজক। অ্যাথলেটদের মত পাহাড়ে পাহাড়ে চড়ে বেড়ানো যার অভ্যাস। পরিব্রাজকের নাম ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ। তিনি ছিলেন বোরের অন্যতম শিষ্য। শ্রোডিঞ্জারের এই তরঙ্গ জগতের নতুন ছবিকে ধরে নিয়েছিলেন নিজের ব্যাক্তিগত জীবনের প্রতিদ্বন্দী হিসেবে। তাঁর বিশ্বাস ছিলো বোরের অদ্ভুত কোয়ান্টাম লাফেই মিলবে পরমাণুর রহস্যের সমাধান। পরমাণু নিশ্চয়ই এত সরল আর সাধারণ নয় যে এই সনাতনীয় তরঙ্গ পটভূমিতে এর ব্যাখ্যা মিলবে! তাঁর ধারণা ছিল পরমাণু আসলেই কোনো একক, অনন্যসাধারণ কিছু যাকে এই সাধারণ তরঙ্গ, কক্ষপথ কিংবা বহুতল ভবন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। একে ধরতে হলে চাই একেবারে নতুন কিছু, নতুন কোনো গণিত কিংবা নতুন কোনো চিন্তাভাবনা। তাই বাদ দিতে হবে এতদিনের সব পুরোনো ধারণার। অবসান ঘটাতে হবে সনাতনীয় বিজ্ঞান সংস্কৃতির।

পরমাণুর গণিত যে একটু ভিন্নতর হবে সেটা হাইজেনবার্গ আঁচ করতে পেরেছিলেন গণিতের খুব সাধারণ একটা ধর্ম দেখেই। দুটি অংকের গুণন ধর্ম। যেমন ২ এর সাথে ৩ গুণ করলে ফল যা হবে ৩ এর সাথে ২ গুণ করলেও নিশ্চয়ই একই ফল হবে। কিন্তু হাইজেনবার্গ অবাক হয়ে দেখলেন কোনো এক মুহুর্তে একট ইলেকট্রনের অবস্থান এবং ঐ মুহুর্তে তার গতিবেগ এই দুই রাশির বেলায় গণিতের এই বিনিময় ধর্ম আর খাটে না। ক্রম পাল্টালেই ফল আসে একেবারে ভিন্ন। হেজল্যান্ডের বালুকাবেলায় হাঁটতে হাঁটতে পরমাণুর অসাধারণ এই দিকটা আবিষ্কারের পর সে রাতে আর ঘুমান নি তিনি। সমুদ্রের পাড় ছেড়ে একটা পাহাড়ের চুড়ায় উঠে যান তিনি। সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত সেখানে কাটান। পরবর্তী জীবনে হাইজেনবার্গ এ রাতের নাম দেন ‘হেজল্যান্ডের রাত’। তিনি লিখেছেন –

‘সেদিন ক্যালকুলেশন করতে করতে রাত তিনটে বেজে যায়। ফাইনাল হিসেবটা হাতে পেয়ে এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম যে রাতে আর ঘুমাতে পারি নি। হোটেল ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম এক পাহাড়ের চূড়ায় আর অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন ভোর হবে!’

হাইজেনবার্গ তখন গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে হাইড্রোজেনের বর্ণালীরেখা নিয়ে কাজ করছিলেন। জুনের ৭ তারিখে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিনি এই দ্বীপে আসেন। আর দ্বীপে বসে এ আবিষ্কারের পর জুনের ৯ তারিখে গটিনজেনে ফিরে তিনি সহকর্মী ম্যাক্স বর্নকে তার লেখা পেপারটি দিয়ে আবার ছুটিতে চলে যান। পেপারের সাথে লেখা ছিল –

‘একটা মাথা নষ্ট করা পেপার পাঠালাম আপনাকে। আপনি পড়ে দেখবেন। পেপারটা ছাপানোর সাহস পাচ্ছি না। তাই আপনাকে পাঠালাম। আপনার পরামর্শ কামনা করছি।‘

ম্যাক্স বর্ন তখন গণিতের নবতম শাখা ম্যাট্রিক্স নিয়ে কাজ করছিলেন। তখন পর্যন্ত গণিতের এই শাখাটি শুধুমাত্র বিশুদ্ধ গণিতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পদার্থবিদরা তাদের খুব কম কাজেই ব্যবহার করেছেন একে। ১৯১২ সালে ইলেকট্রোডাইনামিক্সের এক পেপারে পদার্থবিদ Gustav Mie সর্বপ্রথম ম্যাট্রিক্স ব্যবহার করেন। ১৯২১ সালে ক্রিস্টালের ল্যাটিস তত্ত্বে বর্ন ম্যাট্রিক্স ব্যবহার করেন। হাইজেনবার্গের পেপারটি দেখার সময় বর্নের মনে হলো সাধারণ স্কেলার সূচকের জন্য ab ≠ ba এই ব্যাপারটি একমাত্র ম্যাট্রক্স গুণনের ক্ষেত্রেই সম্ভব। নিজের সহকর্মী প্যাসকেল জর্দানকে নিয়ে তিনি হাইজেনবার্গের সমীকরণে থাকা ক্লাসিক্যাল ফুরিয়ার সূচকগুলোকে রূপ দিলেন ম্যাট্রিক্স এ। হাইজেনবার্গের সমীকরণে যেখানে কণার অবস্থান এবং ভরবেগ নামক দুটি ক্লাসিক্যাল উপাদান ছিল সেখানে ম্যাক্স বর্ন প্রতিটা উপাদানের জায়গায় নিয়ে আসেন কিছু ফুরিয়ার সহগের সমষ্টি। যাদের আবার প্রাথমিক ও শেষ অবস্থা নামে দুটো অবস্থা থাকে। আর এভাবেই জন্ম নেয় কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নতুন এক অধ্যায়। ম্যাট্রিক্স মেকানিক্স!
এদিকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের দুই মহারথি পাউলি এবং বোর তো মহাখুশি। অবশেষে পরমাণুকে ব্যাখ্যা করার মতো গণিতের সন্ধান মিললো যে! আর তাই আবারো শ্রোডিঞ্জারের সরল সহজ তরঙ্গায়িত পরমাণুর ছবিকে আবার আঘাত করলেন বিপ্লবীরা। হাইজেনবার্গ তো বলেই ফেললেন –

‘শ্রোডিঞ্জারের সমীকরণের ফিজিক্যাল অংশের দিকে যখন আমি তাকাই তখন এটা আমার কাছে পুরোটাই ভুয়া মনে হয়। আসলে এটা পুরোটাই একটা রাবিশ জিনিস!’

অন্যদিকে আইনস্টাইন এবং সনাতনীয়রাও হাইজেনবার্গের এই ম্যাট্রিক্স মেকানিক্সকে এক হাত নিলেন। পরমাণু মাত্রই কিছু সংখ্যা এটা তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারলেন না। আমরা, আমাদের বিশ্বজগৎ সবকিছুই তো পরমাণু দ্বারা গঠিত। আর পরমাণু যদি কিছু সংখ্যার সমাহার হয়ে থাকে তবে কি আমরা সবাই সংখ্যা দিয়ে তৈরি!

(এই পর্যায়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি প্রকৃতি জগৎ শুধুই কিছু সংখ্যা? উল্লেখ্য, গ্রীক দার্শনিক ও গণিতবিদ পিথাগোরাস এরকমই কিছু বলেছিলেন যে, চতুর্পাশ্বে যা কিছু আছে সবই সংখ্যা, এমনকি তিনি আত্মাকেও সংখ্যা বলেছিলেন)। আইনস্টাইন দ্বিতীয় শক পেলেন ১৯২৬ সালে যখন ম্যাক্স বর্ণ প্রস্তাব করলেন যে, ‘মেকানিক্স-কে বুঝতে হবে সম্ভাবনা (probability) দিয়ে, কারণ-ঘটন ব্যাখ্যা দিয়ে নয়’। এই interpretation আইনস্টাইন প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯২৬ সালে তিনি ম্যাক্স বর্ন-কে একটি চিহিতে লেখেন, “আমি যে কোন মূল্যেই বিশ্বাস করি যে, মহান ঈশ্বর ছক্কা ছুঁড়ে পাশা খেলেন না।”

চূড়ান্তভাবে ১৯২৭ সালে, হাইজেনবার্গ ও বোর্ণ সলভে কনফারেন্স-এ ডিক্লেয়ার করলেন, বিপ্লব সমাপ্ত হয়েছে, আর কিছুর প্রয়োজন নেই। এটা ছিলো শেষ পর্যায় যেখানে আইনস্টাইন-এর skepticism পরিণত হলো আতঙ্কে। তিনি বিশ্বাস করলেন যে অনেক কিছুই করা হয়েছে, কিন্তু মেকানিক্স-এর রিজন (reason) বোঝা এখনো বাকী আছে।

বিপ্লবকে সমাপ্ত মনে করতে আইনস্টাইন রাজী ছিলেন না এই কারণে যে, তিনি যেইসব কারণসমূহ দেখতে চাচ্ছিলেন যার ফল হিসাবে এইসব আপাত যদৃচ্ছ (random) পরিসংখ্যানিক মেথডগুলো উদ্ভুত হয়। তিনি মূলতঃ এই জাতীয় একটি মডেল দেখতে চাচ্ছিলেন। স্থান-কালে কোন একটি কণিকার অবস্থান পুরোপুরি জানা যাবেনা, কিন্তু ‘অনিশ্চয়তাবাদ’-এর যদৃচ্ছতা (randomness) ও non-deterministic mechanism -কে তিনি গ্রহন করতে পারলেন না। আইনস্টাইন নিজে একজন পরিসংখ্যানিক চিন্তাবিদ ছিলেন, কিন্তু তিনি এটা মানতে রাজী ছিলেন না যে, আর কিছুই আবিষ্কার বা clarify করার বাকী নেই। ঋদিকে বোর-এর কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে, যেসব বিষয় দ্বারা আইনস্টাইন বিচলিত ছিলেন, তার কোনটিই বোরকে স্পর্শ করছিলো না। তিনি বরং এই বিরোধিতা থেকে রেহাই পেয়ে তার নিজস্ব শান্তির জন্য প্রস্তাব করেন principle of complimentarity। এই নীতি পর্যবেক্ষিত কায়ার উপর পর্যবেক্ষকের ভূমিকার কথা বলে। (রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার লাইন মনে পড়লো – ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ, চূণী হয়ে উঠলো রাঙা’)।

বোর-আইনস্টাইন বিতর্ক – পর্ব ৩
——————– ড. রমিত আজাদ

Post-revolution: First stage
আগেই উল্লেখ করেছি যে কোয়ান্টাম মেকানিক্স বিষয়ে আলবার্ট আইনস্টাইন সময়ের সাথে সাথে লক্ষণীয়ভাবে তার মত পাল্টেছেন।। প্রথম ধাপে তিনি কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তাবাদ প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে Principle of intederminacy-কে লঙ্ঘন করা যায়। এই ক্ষেত্রে তিনি Thought experiment নামক কিছু পরীক্ষণ প্রস্তাব করেন। এইসব পরীক্ষণে অবস্থান ও বেগ-এর মত Incompitable variable-গুলোর নিখুঁত মান নির্ণয় নিশ্চিত করবে। অথবা একই জিনিসের একই সাথে তরঙ্গ ও কণিকা ধর্ম থাকার বিষয়টির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা উদঘাটন করবে।

পঞ্চম সলভে কনফারেন্সের সময় আইনস্টাইন প্রথমবারের মতো প্রবলভাবে orthodox ধারনাকে আক্রমণ করে বসলেন। ১৯২৭ সালের কনফারেন্সটি ছিলো ইলেকট্রন ও ফোটনের উপর। আইনস্টাইন দেখালেন যে, কিভাবে শক্তির নিত্যতার আইন ও ভরবেগের নিত্যতার আইন ব্যবহারের সুযোগ গ্রহণ করে কণিকার অবস্থা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যেতে পারে। এটা প্রয়োগ করা যায় ব্যাতিচার (interference)-এ আছে এমন কণিকার ক্ষেত্রে যার সম্পর্কে তথ্য Principle of indeterminancy বা complimentarity কোনটি দ্বারাই পাওয়া সম্ভব নয়।

উল্লেখ্য যে যেকোন পরীক্ষা করতে গেলেই প্রয়োজন যন্ত্রপাতির। এমন যন্ত্রপাতি যা নিঁখুতভাবে মাপজোঁক করতে পারবে। আলোর ব্যতিচার সম্পর্কিত একটি পরীক্ষণে আইনস্টাইন যা প্রস্তাব করেছিলেন সেই অনুযায়ী Principle of indeterminancy অমান্য হয়। নীলস বোর সেখানে আইনস্টাইন প্রস্তাবিত যন্ত্রটির ত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে Perfect করার প্রস্তাব দেন।
The principle of indeterminancy applied to time and energy:
এ’ পর্যন্ত অনিশ্চয়তার নীতিটি শুধু দুটি ভৌত রাশির ক্ষেত্রেই বলা হয়েছিলো – অবস্থান ও বেগ (বা ভরবেগ)। এরপর শ্রোডিঙ্গের-এর প্রস্তাবিত কণিকার তরঙ্গ ধর্ম অনুযায়ী এই অনিশ্চয়তার নীতি আরো দুটি রাশির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা বোঝা গেলো। রাশি দুটি হলো – সময় (time) ও শক্তি (energy)। ১৯৩০ সালে সলভে কংগ্রেসে আইনস্টাইন উপরোল্লিখিত এই অনিশ্চয়তার নীতির সমালোচনা করেন। তদানুযায়ী তিনি একটি থট এক্সপেরিমেন্ট প্রস্তাব করেন। এখানে পরীক্ষণের উদ্দেশ্যে একটি বাক্সকে ব্যবহার করার প্রস্তাব করা হয় যেখানে থাকবে electromagnetic radiation ও একটি ঘড়ি। এই বাক্সের নাম দেয়া হয়েছিলো Einstein’s box । সেই সময়ের মতো আইনস্টাইনের কথাই সঠিক মনে কয়েছিলো আর বোর পেয়েছিলেন শক।

নীলস বোর শক পেয়েছিলেন এই কারণে যে, তাঁর মন বলছিলো আইনস্টাইন-এর ঋএই থট এক্সপেরিমেন্টটি সঠিক নয়, কিন্তু এর কোন সমাধানও তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পুরো সন্ধ্যা তিনি ভীষণ ক্ষুদ্ধ ছিলেন। তিনি বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের সাথে কথা বলছিলেন, এবং তাদের বোঝানোর চেষটা করছিলেন যে আইনস্টাইনের কথা সঠিক হলে এটাই হবে ফিজিক্সের পরিসমাপ্তি। আবার এই প্যারাডক্সের কোন সমাধানও তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

ঠিক উল্টোভাবে পরবর্তী সকাল ছিলো বোর-এর বিজয়ের সকাল। সারা রাত চিন্তা-ভাবনা করে বোর অবশেষে সমাধান খুঁজে পেলেন। তিনি আরেকবার দেখালেন যে আলবার্ট আইনস্টাইনের কৌশলী যুক্তি (subtle argument) কোন মিমাংসা নয়। তবে এই সিদ্ধান্তে আসতে বোর-কে আইনস্টাইনেরই প্রতিষ্ঠিত দুটি নীতি ব্যবহার করতে হয়েছিলো। General Theory of Relativity-তে আইনস্টাইন প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন principle of equivalence of gravitational এবং rest mass।

বোর দেখালেন যে আইনস্টাইনের এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে gravitational field-এ, কিন্তু এই পরীক্ষণে শক্তি ও সময় নির্ণয়ের যে পদ্ধতি তিনি প্রস্তাব করেছেন, তারই প্রতিষ্ঠিত principle of equivalence অনুযায়ী সেখানে সময় নির্ণয় করলে শক্তি নির্ণয় করা সম্ভব না আর শক্তি নির্ণয় করলে সময় নির্ণয় করা সম্ভব না। ফলে সময় ও শক্তি জোড়ার অনিশ্চয়তা রয়েই গেলো।।

Post-revolution: Second stage
বিপ্লব পরবর্তী দ্বিতীয় দফায় বোর-এর সাথে আইনস্টাইন-এর বিতর্ক হয় এই নিয়ে যে ব্যবহারিকভাবে হয়তো incompatible quantity-গুলোর মান একই সাথে (simultaneously) নির্ণয় করা সম্ভব নয়, কিন্তু বাস্তবে তাদের যথাযথ মান (precise value) নাই একথা বলা যাবে না। আলবার্ট আইনস্টাইন ম্যাক্স বোর্ণ-এর সম্ভাবনামূলক ব্যাখ্যা (probabilistic interpretation) মেনে নেননি। তিনি বলেছিলেন, quantum probability জ্ঞানতাত্ত্বিক (epistemic) সত্তাতাত্ত্বিক (ontological) নয়। আইনস্টাইন কোয়ান্টাম থিওরী-র মহত্ত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন কিন্তু বলেছিলেন, ‘তা পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরেনা’। এভাবে আইনস্টাইন-এর চিন্তাধারা hiddenvariable-এর উপর নতুন কিছু গবেষণার পথকে উম্মুক্ত করে। এমন একটি হলো Bohm interpretation – যা ছিলো একটি পূর্ণাঙ্গ কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর ইমারত তৈরীর প্রচেষ্টা। John Stewart Bell দেখিয়েছিলেন যে কোয়ান্টাম মেকানিক্স যদি অসম্পূর=ণ হয় তাহলে তা locally করা সম্ভব না। ১৯৬৪ সালে বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছিলো Bell’s equality- তে।
(চলবে)

১,৪৪৫ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “বোর-আইনস্টাইন বিতর্ক – পর্ব ১, ২, ৩”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    লেখাটা প্রকাশিত হবার পরপরই পড়ে নিয়েছিলাম রমিত ভাই -- বলা চলে গোগ্রাসে গিলে নিয়েছিলাম।
    দুঃখিত এত দেরিতে মন্তব্য করার জন্য। বিজ্ঞানের ভাষার এত ঝরঝরে বাংলা কমই পড়েছি।
    পরবর্তী পর্ব কি আসছে?

    জবাব দিন
    • ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

      অনেক ধন্যবাদ নূপুর। আমিও নানা ব্যস্ততায় টাইমলি কমেন্ট পড়তে পারিনা, লেখা শেষ করতেও সময় লাগে। দেরীতে ধন্যবাদ দিলাম বলে দুঃখিত। চেষ্টা করবো দু'একদিনের মধ্যেই বাকীটা শেষ করতে।
      এদিকে গতকাল দেশের এক খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবি-কে প্রশ্ন করে জানলাম তিনি সক্রেটিসের এ্যাপলোজী পড়েননি। দু-একজন রাজনীতিবিদ-কে প্রশ্ন করেও তাই জেনেছিলাম। ঐ বইটাও শেষ করতে হবে।

      জবাব দিন
  2. মাহমুদুল হাসান আরমান

    ইন্টারেস্টিং। বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলোর সহজবোধ্য বিশ্লেষণ। গতকাল পড়লাম। মূলত খুজতেছিলাম টেলিপ্যাথি, এনটেঙ্গেলমেন্ট থিওরি। সেটা খুজতে গিয়ে এটা পেলাম।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।