সক্রেটিসের এ্যাপোলজি – পর্ব ১০
মূল বক্তৃতাঃ মহাজ্ঞানী সক্রেটিস
লিখেছেনঃ প্লেটো
অনুবাদঃ ডঃ রমিত আজাদ (Dr. Ramit Azad)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর থেকে)
বিচারের জুরি সক্রেটিসকে দোষী সাব্যস্ত করলো
খুব সামান্য ভোটের ব্যবধানে মহাজ্ঞানী সক্রেটিসকে দোষী সাব্যস্ত করা হলো। ৫০০ জন বিচারকদের মধ্যে সক্রেটিসের বিরুদ্ধে জুরি ছিলেন ২৮০ জন, পক্ষে ছিলেন ২২০ জন। তারপর সেই সময়কার রীতি অনুযায়ী তাঁকে দ্বিতীয়বার বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ দেয়া হলো। এথেনীয় জুরিসপ্রুডেন্স (jurisprudence) রীতি অনুযায়ী অভিযোক্তারা একটি দন্ড প্রদান করে, এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি তার চাইতে কম শাস্তি প্রার্থনা করে বিতর্কে অবতীর্ন হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, অভিযুক্তকে যদি মৃত্যুদন্ড দেয়া হতো, তাহলে এটাই প্রচলিত ছিলো যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডের স্থলে নির্বাসন প্রার্থনা করতো। অর্থাৎ প্রতিটি মামলায়ই দেয় দন্ডাজ্ঞার চাইতে কম শাস্তি প্রার্থনা করা হতো। মহাজ্ঞানী সক্রেটিসকে দ্বিতীয় বক্তৃতাটি দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিলো যেন তিনি তাঁকে প্রদত্ত মৃত্যুদন্ডের চাইতে কম শাস্তি প্রার্থনা করতে পারেন। কিন্তু মহাজ্ঞানী সক্রেটিস এইমর্মে বিতর্ক করেছিলেন যে, তিনি একটি মহান দায়িত্ব পালন করে এথেন্স রাষ্ট্রের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন, যা হলো এথেন্সের স্বতন্ত্র নাগরিকদের ব্যক্তিগতভাবে সমালোচনা করা, সুতরাং যথাযথ শাস্তি হবে এই যে, তিনি যেন বাকী জীবন এই মহান দায়িত্ব পালন নির্বিঘ্নে করতে পারেন সেই উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাঁর জন্য ভাতার ব্যবস্থা করা। এতে সিনেটররা ক্ষুদ্ধ হয়, ও তারা সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ডাদেশই বহাল রাখে। মহাজ্ঞানী সক্রেটিস তাঁর দ্বিতীয় বক্তৃতায় যা বলেছিলেন তা নিম্নরূপঃ
দণ্ডাদেশ পাওয়ার পর সক্রেটিসের প্রস্তাব
দণ্ডাজ্ঞার ভোটের ফলাফলে আমি ক্ষুণ্ণ নই, কেন নই এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে, হে বিচারকগণ! ফলাফল এমন হবে তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমি বলতে গেলে আশ্চর্য্যই হয়েছি যে, পক্ষে ও বিপক্ষে ভোটের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি; কারণ আমি ভেবেছিলাম যে আমার বিরূদ্ধে ভোট অনেক বেশি পড়বে; এখন দেখছি যদি ত্রিশটি ভোট অন্যদিকে পড়তো তাহলেই আমি বেকসুর খালাস পেয়ে যেতাম।এবং আমি বলতে পারি যে মিলেটাসের হাত থেকে ছাড়া পেয়েছি, শুধু তাই নয়, আমি আরো বলতে পারি যে, এখন এটা সকলের কাছেই স্পষ্ট, যদি এনিটাস ও লাইকন, মিলেটাসের সাহায্যে এখানে না আসতো তাহলে আইন অনুযায়ী ভোটের পঞ্চম অংশ না পাওয়ার অপরাধে তার এক হাজার দ্রাহ্মা জরিমানা হতো।
এখন, তিনি আমার শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদন্ড প্রস্তাব দিয়েছেন। ঠিকআছে, এবার আমার পক্ষ থেকে আমি কি প্রস্তাব রাখতে পারি, হে এথেন্সবাসীগণ? স্পষ্টতঃই এটা এখন আমার দায়িত্ব। এটা কি আর বোঝানোর অপেক্ষা রাখে, আমার শাস্তি কি হওয়া উচিৎ? কি হবে সেটা? সেই ব্যক্তিটিকে কি প্রতিদান দেয়া যেতে পারে যিনি তার সারা জীবন নিরলস পরিশ্রম করেছেন; কিন্তু সেইসব জিনিস নিয়ে কখনোই ভাবেননি যা নিয়ে বেশিরভাগ মানুষই ভাবে — সম্পদ, পারিবারিক স্বার্থ, সামরিক প্রতিষ্ঠান, সংসদে ও ম্যাজিস্ট্রেসিতে বক্তৃতা দেয়া, ষড়যন্ত্রে অংশ নেয়া, অভ্যুত্থান সংঘটন করা, ইত্যাদি।আমাদের নগরীতে যেমনটি ঘটে থাকে। এ কথা বলতে হবে, আমি এত বেশি সৎ যে রাজনীতিবিদ হওয়ার যোগ্যতা রাখিনা, কারণ অত সৎ লোক রাজনীতিবিদ হতে পারেনা, যেখানে গিয়ে আমি আপনাদের ও আমার মঙ্গল করতে পারবো না, সেখানে আমি কখনো যাইনি; কিন্তু যেখানে গেলে আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকের উপকার করতে পারবো সেখানেই আমি গিয়েছি, এবং আপনাদের মধ্য থেকে প্রত্যেকের ভিতরে প্রত্যয় জাগানোর চেষ্টা করেছি এই বলে যে তার উচিৎ হবে নিজের দিকে নজর দেয়া, এবং তিনি যেন ব্যক্তিস্বার্থ দেখার আগে সৎগুন ও প্রজ্ঞার প্রতি মনযোগী হন, নগরীতে কি আছে সেটা না ভেবে একটু নগরীর দিকে নজর দিক; এবং প্রতিটি বিষয় ও কাজে তার দৃষ্টিভঙ্গী এমনই হওয়া উচিৎ। এরকম একজন ব্যক্তির কি হওয়া উচিৎ? নিঃসন্দেহে ভালো কিছু, হে বিচারকগণ! যদি তাকে প্রতিদানই দিতে হয়, তাহলে ভালো কিছুই দেয়া উচিৎ। সেই দরিদ্র ব্যক্তি যিনি আপনাদের মঙ্গল সাধন করে থাকেন, যিনি আপনাদের কিছু উপদেশ দেয়ার জন্য অবকাশ খুঁজছেন তার যথাযোগ্য প্রতিদান কি হওয়া উচিৎ? প্রিটেনিয়ামে খোরপোশ-ই তার জন্য ভালো প্রতিদান হবে, হে বিচারকগন! অলিম্পিকে দুই অথবা আরো অধিক ঘোড়ায় টানা রথের দৌড়ে বিজয়ী যেকোন ব্যক্তির চাইতে এই প্রতিদান সক্রেটিসের অনেক বেশি প্রাপ্য। যেহেতু আমি অভাবী আর তার অনেক আছে; এবং সে আপনাদেরকে কেবল আপাতঃ আনন্দই দিয়ে থাকে, এবং আমি আপনাদের দেই সত্যিকারের সুখ। এবং আমাকে যদি বলা হয় ন্যয্যদন্ড কি হবে, আমি বলবো প্রিটেনিয়ামে খোরপোশই হবে যথাযথ প্রতিদান।
সম্ভবত আপনারা মনে করছেন যে, এই মুহূর্তে আমি যা বলছি তা উন্নাসিকতা থেকে বলছি, যেমন বলেছিলাম কিছু অপরাধীর অশ্রুসজল চোখে প্রার্থনা করা সম্পর্কে। কিন্তু আসলে তা নয়। বরং আমি তা বলছি এই কারণে যে আমি নিশ্চিত জানি, স্বেচ্ছায় কখনোই কারো মনে আঘাত দেইনি, যদিও আপনাদেরকে আমি এই বিষয়ে কনভিন্স করতে পারছি না — কারণ আমরা আলোচনা করেছি খুব অল্প সময়; । আমার মনে এই এই বিশ্বাস আছে যে, যদি অন্যান্য নগরীর মতো এথেন্সেও মৃত্যুদন্ডের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সময় একদিন না হয়ে কয়েকদিন হতো, তাহলে আমি আপনাদেের কনভিন্স করতে পারতাম। কিন্তু আমি আমার বিরূদ্ধে এতদিন যাবৎ ছড়ানো কুৎসাগুলোকে এক মুহূর্তে খন্ডন করতে পারবো না; এবং যেহেতু আমি বিশ্বাস করি যে, আমি কখনোই কাউকে আঘাত দেইনি, সেইরূপে আমি নিজেকেও আঘাত দেবনা। আমি নিজে থেকে কখনোই বলবো না যে, অমঙ্গল আমার প্রাপ্য, আমি আমার শাস্তি দাবী করবো না। কেন আমি এটা করবো? এটা কি এইজন্য যে মিলাটাসের দাবী অনুযায়ী মৃত্যুদন্ড পেতে আমি ভীত? আমি তি জানিই না মৃত্যু ভালো না মন্দ, কেন আমি এমন কোন শাস্তির দাবী করবো যা নিশ্চিত অমঙ্গল হবে? আমি কি কারাদন্ড চাইবো? কেন আমি কারাপ্রকোষ্ঠে বাস করবো? কেন আমি এইভাবে বাৎসরিক এগারোজন ম্যাজিস্ট্রেটদের ক্রীতদাসে পরিনত হবো? অথবা শাস্তিটা কি জরিমানা হবে, এবং যতদিন পর্যন্ত সেই জরিমানা আমি মেটাতে না পারছি ততদিন কারারুদ্ধ থাকবো? এখানেও আমার আপত্তি আছে। কারাগারে বসে আমাকে মিথ্যা কথা বলতে হবে, কারন জরিমানার শাস্তিও আমার জন্য যন্ত্রনাদায়ক হবে, কেননা আমার কোন টাকা-পয়সাই নেই, তাই তা পরিশোধও করতে পারবো না। আর আমি যদি নির্বাসন চাই (এটাও একটা সম্ভাব্য শাস্তি হতে পারে), আমি হয়তো ভীত হতাম যদি আমি এমনভাবে অস্থির হয়ে যেতাম যে বুঝতেই পারতাম না এমন হচ্ছে কেনঃ আপনারা যারা আমার নিজের নগরীরই নাগরিক যারা আমার আলোচনা ও কথা সহ্য করতে পারেন না, এবং সেই কথাগুলোকে আপনাদের এতো বেশি যন্ত্রনাদায়ক ও ঘৃণ্য মনে হয় যে, আপনারা তা আর শুনতে চান না, সেখানে অন্যরা কি আমাকে সহ্য করতে প্রস্তুত আছে? হে বিচারকগণ! এরকম হবে বলে মনে হয়না। আমার এই বয়সে আমি কি ধরনের জীবন যাপন করবো, নগরী থেকে নগরীতে ঘুরে বেড়াবো,
প্রতিনিয়ত আমার নির্বাসন থেকে নির্বাসনে স্থানান্তরিত হতে থাকবো, এবং চিরকাল বিতাড়িতই হতে থাকবো! কেননা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি; যেখানেই আমি যাইনা কেন, তরুণরা সবসময়ই আমার চতুর্দিকে ভীড় জমাতে থাকবে; আর যদি আমি তাদের তাড়িয়ে দেই, তাহলে তাদের অনুরোধে তাদের বড়রা আবার আমাকে তাড়িয়ে দেবে; আর যদি আমি তাদের কাছে আসতে দেই, সেই ক্ষেত্রে তাদের পিতারা ও বন্ধুরা আমাকে তাড়িয়ে দেবে তাদের স্বার্থে।
এখন কেউ হয়তো বলবেনঃ ঠিকআছে সক্রেটিস, আপনি কি পারেন না আমাদের এখান থেকে দূরে অন্য কোথাও সরে গিয়ে, সেখানে আপনার জিহ্বাটাকে একটু সংযত রাখতে? এখন এর উত্তর আপনাদেরকে বোঝানো আমার জন্য অনেক কষ্টকর। আমি যদি বলি যে আপনাদের কথা অনুযায়ী কাজ করা হবে ঈশ্বরের প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শন করা, এবং এই কারণে আমি আমার জিহবাকে সংযত রাখতে পারিনা, আপনারা হয়তো বিশ্বাস করবেন না যে আমি সিরিয়াস; এবং যদি আমি বলো যে প্রত্যহ সততা ও এই জাতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করাটা, যেমন আপনারা শুনেছেন যে আমি নিজেকে ও ব্যাক্তিদের পরীক্ষা করে থাকি, এটা মানবজাতির জন্যে বিশাল মঙ্গলময়, এবং অপরিক্ষীত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন, মনে হয়না যে আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করবেন। তারপরেও আমাকে বলতে হবে কোনটা সত্য, যদিও আপনাদের মধ্যে প্রত্যয় জন্মানো আমার জন্য কঠিন। আবার আমি এই ভাবতে অভ্যস্ত নই যে আমি নিজের কোন ক্ষতি ডিসার্ভ করি। যদি আমার টাকা থাকতো তাহলে একটা হিসাব করতাম যে, আমার দোষের জন্য ঠিক কত টাকা জরিমানা দিতে হবে, এবং খুব খারাপ যেন কিছু না হয়। কিন্তু আমার কিছুই নাই। এজন্য আমি আপনাদের অনুরোধ করবো যে, আমাকে আমার আর্থিক সঙ্গতি অনুযায়ী জরিমানা করুন। হয়তো আমি এক মিনা (রৌপ্যমুদ্রা) দেয়ার সামর্থ্য রাখি, সিতরাং আমি প্রস্তাব রাখবো যে, আমাকে ঐ শাস্তিটি দিনঃ প্লেটো, ক্রিটো, ক্রিটোবুলাস এবং এ্যাপোলোডোরাস, আমার বন্ধুদের প্রস্তাবিত-মূল্য ত্রিশ মিনা, এবং তারা জামিনদার হবেন। অতএব আমি প্রস্তাব রাখছি যে, ত্রিশ মিনা জরিমানাই শাস্তি হোক; এই জরিমানার বিশ্বস্ত জামিনদার তারা হতে পারবেন।
(চলবে)
:boss: :boss: :boss:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
ধন্যবাদ।
অসাধারন। যতই পড়ছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। পরের পর্বের অপেক্ষায়...
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য
ধন্যবাদ।
সময়ের অভাবে কাজটা একটু স্লো করছি।
এই সিরিজটা পড়তে হবে।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
ধন্যবাদ।
পড়, কেমন লাগলো জানাবে।
:clap: :clap: :clap:
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
ধন্যবাদ।
জমিয়ে রাখছি, পুরোটা এক সাথে পড়বো বলে 🙂
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
ধন্যবাদ।
ঠিকআছে, এক সাথেই পড়। তবে এ্যপোলজির তিনটি অংশের দুটোরই অনুবাদ করে ফেলেছি পর্ব দশ পর্যন্ত। বাকী আছে শুধু শেষ অংশটি। ঐটি বেশি বড় নয়।