সক্রেটিসের এ্যাপোলজি – পর্ব ৬, ৭, ৮, ৯

সক্রেটিসের এ্যাপোলজি – পর্ব ৬

মূল বক্তৃতাঃ মহাজ্ঞানী সক্রেটিস
লিখেছেনঃ প্লেটো

অনুবাদঃ ডঃ রমিত আজাদ (Dr. Ramit Azad)

(পূর্ব প্রকাশিতের পর থেকে)…

হে বিচারকগণ! আমি চাই, আপনারা আমার সাথে এই পরীক্ষায় অংশগ্রহন করুন, যেখানে আমি তাঁর (মিলেটাসের) অসঙ্গতি সম্পর্কে ধারণা করছি; আর আপনি মিলেটাস, উত্তর দিবেন। আর শ্রোতাবৃন্দ আমি আপনাদের আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমার সেই অনুরোধ সম্পর্কে যে, আপনারা অনুগ্রহপূর্বক হইচই করবেন না, যদি আমি আদালতের রীতি অনুযায়ী না বলে আমার স্বভাবসুলভ ধাঁচেই বলি:
মিলেটাস, এমন কেউ কি আছে, যে মানুষের কর্মগুলোর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে কিন্তু মানুষের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না? হে এথেন্সবাসীগণ, আমি চাই, তিনি বরাবরের মত হইচইয়ের মধ্যে দিয়ে একটা ইন্টারাপ্শনের অপেক্ষা না করে উত্তর দিন। এমন কেউ কি আছে যে ঘোড়া সংক্রান্ত সব কিছুতে বিশ্বাস করে কিন্তু ঘোড়ায় বিশ্বাস করে না? অথবা বাঁশির সুরে বিশ্বাস করে কিন্তু বাঁশির বাদকে বিশ্বাস করেনা? না বন্ধু; যেহেতু আপনি উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন, অতএব আমি আপনাকে এবং আদালতকে উত্তর দিব। এমন কেউ এই পৃথিবীতে নাই। যাহোক এখন পরবর্তি প্রশ্নের উত্তর আপনাকে দিতে হবে: এমন কেউ কি আছে যে আধ্যাত্মিকতা ও আধ্যাত্মিক প্রতিনিধিত্বে বিশ্বাস করে কিন্তু উপদেবতা (ডেমিগড)-সমূহে বিশ্বাস করেনা?

এমন হতে পারেনা। (মিলেটাস উত্তর দিলেন)

পরিশেষে আদালত আপনার মুখ থেকে উত্তর বের করে আনলো, কি সৌভাগ্যবান আমি! তাহলে অভিযোগপত্রে আপনি দাবী করছেন যে, আমি বিশ্বাস করি ও শিক্ষা দেই আধ্যাত্মিকতায় ও আধ্যাত্মিক প্রতিনিধিত্বে (হোক সে নতুন অথবা পুরাতন তাতে কিছু যায় আসেনা): যেভাবেই হোক আমি আধ্যাত্মিক প্রতিনিধিত্বে বিশ্বাস করি, — এমনই আপনি বলেছেন আপনার হলফনামায়; এবং এইভাবেই আমি ঐশ্বরিক সত্তায় বিশ্বাস করি, আর যেহেতু আমি ঐশ্বরিক সত্তায় বিশ্বাসই করি সুতরাং আমার পক্ষে উপদেবতায় বিশ্বাস না করা কি সম্ভব? নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি, আমি বিশ্বাস করি, অতএব আমি ধরে নিচ্ছি যে, আপনার মৌনতাই আপনার সম্মতি। এবার আত্মা (spirits) বা উপদেবতা (demigods) কারা? তারা কি দেবতা বা দেবতাদের পুত্ররা নয়?

অবশ্যই তারা তাই।

– সুতরাং, উপদেবতাদের যদি আমি স্বীকার করি, আপনারা যেরকম বলেন, উপদেবতারাও দেবতা, তাহলে বিষয়টা দাঁড়ালো এই যে, যা আমি আগেই বলেছি, আপনি তামাশা করছেন ও ধাঁধাঁ দিচ্ছেন, এই কথা বলে যে, আমি একইসাথে ইশ্বরে বিশ্বাস করি আবার করিনা, কেননা অন্ততপক্ষে উপদেবতাদেরতো আমি স্বীকার করি। অপরপক্ষে, উপদেবতারা যদি পরী বা অন্য কোন সত্তার মায়েদের গর্ভজাত দেবতাদের অবৈধ সন্তান হয়, প্রচলিত রীতি অনুযায়ী এরকমই মনে করা হয়, তাহলে এমন কোন মানুষ আছে যে উপদেবতাদের স্বীকৃতি দেয় কিন্তু দেবতাদের স্বীকৃতি দেয়না? এটা তেমনই হাস্যকর হবে যদি কোন মানুষ ঘোড়া ও গাঁধার সমন্বয়ে যে খচ্চরের জন্ম সেই খচ্চরকে স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু ঘোড়া ও গাঁধাকে স্বীকৃতি দেয়না। একেবারেই ননসেন্স! মিলেটাস, সম্ভবত আমাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করানোটাই আপনার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো। আপনি অভিযোগনামায় পয়েন্টটি এই কারনে অন্তর্ভুক্ত করেছেন যে, আমাকে দোষী সাব্যস্ত করার খাঁটি কোন পয়েন্ট আপনার হাতে ছিলোনা। কিন্তু যার বিন্দুমাত্র বোধশক্তি আছে এমন কেউ আপনার এই কথা কোনদিনই বিশ্বাস করবে না যে, একই মানুষ দৈব ও অলৌকিকতায় বিশ্বাস করে অথচ ইশ্বর, উপদেবতা ও অলৌকিক সত্তায় বিশ্বাস করেনা।

হে বিচারকগণ, মিলেটাস আমার বিরুদ্ধে যেইসব অভিযোগ আনছে, সেইসব অপরাধে আমি অপরাধী নই, আমার মনে হয়না যে এর চাইতে বেশি আর কিছু প্রমান করার প্রয়োজন আছে, এতক্ষণ যা বলেছি সেটাই যথেষ্ট। যে সম্পর্কে আমি শুরুতেই বলেছিলাম, অনেকেরই যে আমার বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্নতা রয়েছে, এটা নির্ভেজাল সত্য। আমার যদি ধ্বংস হয় তবে আমার ধ্বংস ডেকে আনবে, মিলেটাসও নয় এনিটাসও নয়, বরং একটি বিরাট অংশের ঘৃণা ও নিন্দা, যা ইতিপূর্বে অনেক সৎ ব্যক্তিকেই হত্যা করেছে, মনে হয় আরো অনেককেই হত্যা করবে, মনে করবেন না যে, এই জাতীয় হত্যার তালিকায় আমিই সর্বশেষ ব্যক্তি হবো।

অনেকে বলতে পারেনঃ সক্রেটিস, যে কাজ করার জন্য অতঃপর আপনার অকাল মৃত্যু হতে যাচ্ছে, সেইসব কাজ করার জন্য আপনি কি লজ্জ্বিত নন? তাকে আমি ন্যায্যভাবে উত্তর দিবোঃ এখানেই আপনি ভুল করছেন, যে ব্যক্তি মানুষের মঙ্গল সাধনের জন্য মাঠে নেমেছে, তাকে নিহত হবার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতেই হয়, এই নিয়ে তিনি তেমন চিন্তিত নন, তিনি ভাবেন কেবল একটি বিষয় – যা করছেন তা ঠিক করছেন না ভুল করছেন, ভালো মানুষের কর্ম সম্পাদন করছেন না খারাপ মানুষের কর্ম সম্পাদন করছেন। এদিকে, আপনার দৃষ্টিকোন থেকে, ট্রয়ের যুদ্ধে যেসব বীরদের পতন ঘটেছিলো তারা খারাপ, এবং থেটিসের পুত্রও তাদের মধ্যে একজন, যে বিপদের চাইতে মর্যাদাহানীকে বেশি ভয় পেত, এবং যখন তিনি হেকটরকে হত্যা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলেন, তখন তাঁর দেবী মাতা তাকে বলেছিলেন, “পুত্র আমার, তুমি যদি তোমার বন্ধু পেট্রোক্লাসের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে হেকটরকে হত্যা করো, তবে তুমি নিজেই মারা যাবে।” ‘ভাগ্য’, দেবী বলেছিলেন এই জাতীয় ভাষায়, “প্রায়ামের পুত্র হেকটরের পর তোমার নিহত হবার পালা”, এই সাবধানবাণী শোনার পরেও তিনি বিপদ বা মৃত্যু কোনটিকেই ভয় পেলেন না, বরং বন্ধুর হত্যার প্রতিশোধ না নিয়ে কাপুরুষের মতো বেঁচে থাকার লজ্জ্বাটাকেই বেশি ভয় পেলেন। ‘আমি তৎক্ষণাৎই মরতে চাই’, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “শত্রু আমাকে হত্যা করুক, এখানে জাহাজের পাশে বসে প্রতীক্ষা করা, বা সকলের বিদ্রুপের পাত্র হয়ে পৃথিবীর একটা বোঝা হওয়ার চাইতে সেটাই ভালো হবে।” সেইসময় একিলিসের কি মৃত্যু ও বিপদ সম্পর্কে কোন চিন্তা ছিলো? হে বিচারকগণ! বাস্তবে এমনই হয় কিন্তু: কোন ব্যক্তি নিজেকে যে অবস্থানে বসিয়েছে, এই ভেবে যে, এটাই তার জন্য সব চাইতে ভালো জায়গা, অথবা তার কমান্ডার তাকে যেখানে বসিয়েছে, সেখানে বসেই তাকে বিপদ মোকাবেলা করতে হবে, না মৃত্যু না অন্য কোন বিপদ কোন কিছুর ভয়ই তার তখন পেলে চলবে না, ভয় যদি পেতেই হয় তবে একটাই ভয়, তা হলো মর্যাদাহানির ভয়। এবং হে বিচারকগণ! এটাই হলো সত্য।

সক্রেটিসের এ্যাপোলজি – পর্ব ৭

হে এথেন্সবাসীগণ! (আমি সৈনিক থাকাকালীন অবস্থায়) পতিদাইয়া, এ্যামফিপলিস ও ডেলিয়াম-এ আমার কমান্ডার জেনারেলগণ, আর দশজনার মতোই, আমাকে যেখানে থাকতে আদেশ করেছিলেন, আমি সেখানেই ছিলাম এবং মৃত্যুর মুখোমুখী হয়েছিলাম (অর্থাৎ কর্তব্যকর্মে অবহেলা করিনি) — এখন আমি এমনটাই জ্ঞান করি ও ধারণা করি যে, ইশ্বর আমাকে দার্শনিকের কর্তব্য, অর্থাৎ নিজের ও অন্যের সম্পর্কে অনুসন্ধান করার নির্দেশ দিয়েছেন, এখন যদি আমি মৃত্যুভয়ে কিংবা অন্য কোন ভয়ে আমার এই দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যাই, এটা নিঃসন্দেহে একটা অদ্ভুত আচরনটি হবে, এবং আদালতে হয়তো আমাকে কৈফিয়তও দিতে হতে পারে ইশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার অপরাধে, মৃত্যুভয়ে দৈববাণীকে অমান্য করার অপরাধে ও জ্ঞানী নই তারপরেও নিজেকে জ্ঞানী মনে করার অপরাধে। না এমন আমি করবো না, কারণ মৃত্যুকে ভয় করা মানে অজানাকে জানার ভান করা, জ্ঞানী হওয়ার ভান করা, আদতে জ্ঞানী নয়; কারন, কেউতো জানেনা যে মৃত্যু কি, কেউতো জানেনা যে মৃত্যুই সবচাইতে মঙ্গলকর কিনা, অথচ সবাই মৃত্যুকে এমনভাবে ভয় করে যেন, মৃত্যুই সবচাইতে অশুভ। এটা সেই অজ্ঞতা যেখানে মানুষ যা জানেনা তা জানার অহংকার করে, এই অজ্ঞতা কি লজ্জাজনক নয়? এবং আমি মনে করি যে, এই ক্ষেত্রে আমি সাধারণভাবে অন্যদের চাইতে পৃথক, এবং সম্ভবতঃ এই বিষয়ে আমি নিজেকে অন্যদের চাইতে জ্ঞানী বলে দাবী করতে পারি। — এই বিশ্বজগৎ সম্পর্কে আমি যতটুকুই জানিনা কেন, আমার এমন ধারণা করা ঠিক হবে না যে, আমি কিছু জানিঃ কিন্তু আমি জানি যে ইশ্বর হোক আর মানুষ হোক কারো প্রতি অন্যায় করা ও অবাধ্যতা প্রদর্শন করা, খারাপ ও লজ্জাজনক, এবং মন্দকে গ্রহন নয় বরং আমি কখনোই একটি সম্ভাব্য ভালোকে ভয় পাবো না অথবা তাকে এড়িয়ে যাবো না। অতএব যদি আপনারা যেই এনিটাস বলেছেন যে, সক্রেটিসের আদালতে আসা উচিৎ হয়নাই, আর যেহেতু এসেই গিয়েছেন সেহেতু বিচারপূর্বক তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া উচিৎ, সেই এনিটাস কর্তৃক প্রনোদিত না হয়ে, আমাকে এখন ছেড়ে দিন; এনিটাস ধীরে ধীরে আপনাদের অন্তরে সঞ্চারিত করেছে যে, আমাকে যদি শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে আপনাদের সন্তানেরা আমার কথা শুনে বিপথগামী হয়ে যাবে — আপনাদের পুত্রগণ আমার বাণী শুনে দারুণভাবে উচ্ছন্নে যাবে – যদি আপনারা বলেন যে, সক্রেটিস এইবারের মতো আমরা এনিটাসের সাথে একমত নই এবং আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি, তবে শর্ত একটি আছে, আপনি এইসব গবেষণা আর করবেন না এবং দর্শন ছেড়ে দেবেন, আর যদি আপনাকে পুনর্বার এই করতে দেখা যায়, তবে মৃত্যুদন্ডই হবে আপনার শাস্তি; — যদি আপনারা আমাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য এই শর্ত আরোপ করেন, আমি উত্তর দিব: হে এথেন্সবাসীগণ, আমি আপনাদের শ্রদ্ধা করি, আমি আপনাদের ভালোওবাসি, কিন্তু আমি আপনাদের কথা শুনবো না, আমি শুনবো আমার ইশ্বরের কথা। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত আমার জীবন ও শক্তি রয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি দর্শন চর্চা ও শিক্ষাদান থেকে বিরত হবো না। , যার সাথেই দেখা হয় না কেন আমি আমার স্বভাবসুলভ পদ্ধতিতে তাকে উৎসাহ প্রদান করে বলি, — বন্ধু, আপনি — এথেন্সের মত একটি মহৎ, প্রজ্ঞাবান ও শক্তিধর নগরের নাগরিক, — আপনি বিশাল পরিমানের অর্থ, খ্যাতি ও যশ পুঁজিভূত করেছেন অথচ প্রজ্ঞা ও সত্য, সততা ও আত্মার (অন্তরের) উন্নয়নের বিষয়ে বিন্দুমাত্রও যত্নবান নন, বিষয়টির দিকে আপনি কোনদিন মনযোগই দেননি, এতে কি আপনি লজ্জিত নন? আর যদি সেই ব্যক্তি যার সাথে আমি তর্ক করছি যদি বলেনঃ হ্যা, আমি বিষয়টির বিষয়ে সচেতন; তখন আমি ছেড়ে দেইনা বা সাথে সাথেই যেতে দেইনা, আমি তাকে জেরা করতে শুরু করি, পরীক্ষা-প্রতিপরীক্ষা করতে শুরু করি, এবং যদি আমি বুঝতে পারি যে তার মধ্যে আসলে কোন সততা নেই, শুধু শুধুই বলছে যে সে সচেতন, মহৎকে অবমূল্যায়ন ও ক্ষুদ্রকে অতিমূল্যায়ন করার জন্য আমি তাকে ভর্ৎসনা করি। এবং আমি একই বিষয়ের পুণরাবৃত্তি করবো প্রতিটি মানুষের সাথে (যার সাথেই আমার দেখা হবে), কি যুবা কি বৃদ্ধ, কি নাগরিক কি বহিরাগত, বিশেষত নাগরিকদের সাথে, যেহেতু তারা আমার ভাই। আপনাদের নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে চাই, এটাই ইশ্বরের আদেশ; এবং আমি বিশ্বাস করি যে, আমি ইশ্বরের আদেশ পালন করার কারণে রাষ্ট্রের যে অধিকতর কল্যাণ হয়েছে সেরূপ কল্যাণ আর কখনো হয়নি। আমি যা করছি তা আর কিছুই নয় কেবল আপনাদের মধ্যে প্ৰত্যয় জন্মানোর চেষ্টা করা, যার সাথেই দেখা হয়, কি বৃদ্ধ কি যুবা, আপনাদের এই বোঝাতে চাই যে, আপনারা আপনাদের দেহ ও সম্পদের দিকে নজর দেয়ার আগে আপনাদের আত্মার উৎকর্ষসাধনের প্রতি প্রথম যত্নবান হোন। এমনভাবে যত্নবান হোন যেন তা হয় যতদূর সম্ভব উৎকৃষ্ট। আমি আপনাদের এই বলতে চাই যে, পুণ্য (সদ্গুণ) টাকা থেকে আসে না, বরং পুণ্য (সদ্গুণ) থেকেই টাকা আসে। শুধু টাকাই নয়, যেকোন মানবীয় মঙ্গলই পুণ্য (সদ্গুণ) থেকে আসে, তা সে ব্যাক্তি জীবনেই হোক আর সামাজিক জীবনেই হোক। এটাই আমার ডকট্রাইন (শিক্ষা), এবং এই ডকট্রাইন (শিক্ষা) যদি তরুণদের বিপথগামী করে, তাহলে আমি একজন অনিষ্টকারী। আর যদি কেউ বলে যে এটা আমার শিক্ষা নয়, তাহলে সে অসত্য বলছে। অতএব, হে বিচারকগণ! আমি আপনাদের বলছি, আপনারা এনিটাসের প্রস্তাব অনুযায়ী কাজ করুন অথবা না করুন, এবং আমাকে বেকসুর খালাস দিন অথবা না দিন; অথবা যাই করুন না কেন, মনে রাখবেন, আমি আমার পথ থেকে সরে দাঁড়াবো না, এমনকি এর জন্য যদি আমাকে একাধিকবার মৃত্যুবরণ করতে হয় তারপরেও না।

এথেন্সবাসীগণ! হৈচৈ করবেন না, ইন্টার্আপ্ট করবেন না, শুধু আমার কথা শুনুন; আমাদের মধ্যে সমঝোতা হয়েছিলো যে, আপনারা আমার কথা শেষ পর্যন্ত শুনবেন: আমার আরো কিছু বলার আছে, যা শুনে আপনারা অঝোরে কেঁদে ফেলতে পারেন, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে, আমার কথা শুনলে আপনাদের মঙ্গলই হবে। সুতরাং আমি আপনাদের না কাঁদতে অনুরোধ করছি। আমি আপনাদের জানাতে চাই যে, যদি আপনারা আমার মত একজন মানুষকে হত্যা করেন, তাহলে আমার যে পরিমান ক্ষতি হবে, তার চেয়ে আপনাদের অধিক ক্ষতি হবে। কোন কিছুই আমার ক্ষতি করতে পারবে না, মিলেটাস নয়, এনিটাসও নয়। কারণ একজন ভালো মানুষের ক্ষতি করার ক্ষমতা ঈশ্বর দুষ্টলোককে দেননি। দুষ্টলোক শুধু নিজেদেরই ক্ষতি করতে পারে। আমি অস্বীকার করিনা যে, এনিটাস তার চেয়ে একজন ভালো মানুষকে হত্যা করতে পারে বা তাকে নির্বাসনে পাঠাতে পারে, বা রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে; এবং সে কল্পনা করতে পারে যে, এরূপ করে সে তার যথেষ্ট ক্ষতি করেছে, অন্যেরাও সেরূপ মনে করতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি তাদের সাথে ঐক্যমত পোষণ করিনা। অন্যায়ভাবে একজনকে হত্যা করে সে নিজের যে পরিমান অকল্যাণ করবে তা নিহত ব্যক্তির অকল্যান থেকে অনেক বেশি।

এবং এখন বিচারকগণ! আপনারা যেমনটা মনে করছেন, আমার আত্মপক্ষ সমর্থন আমার মঙ্গলের জন্য নয়, বরং তা আপনাদের মঙ্গলের জন্যে, যাতে আপনারা আমাকে অভিযুক্ত করে ঈশ্বরের কাছে পাপের ভাগী না হন, কেননা আমি ঈশ্বরের তরফ থেকে আপনাদের জন্য একটি উপহার। আমাকে হত্যা করে আপনারা আমার মত আরেকজনকে খুব সহজে পাবেন না। আমি এখন একটি উদ্ভট কথা বলবো যে, আমি একজন গো-মাছি (gadfly), রাষ্ট্র-যন্ত্রের কাছে আমি ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত একটি উপহার; আর রাষ্ট্রকে এই মুহূর্তে তুলনা করা যায় একটি অশ্বের সাথে যা বৃহৎ ও মহৎ কিন্তু তার আকৃতির কারণে গতিতে শ্লথ, এখন অতীব প্রয়োজন তাকে আন্দোলিত করে দ্রুতগামী করা। এবং আমি হলাম সেই গো-মাছি যাকে ঈশ্বর পাঠিয়েছেন রাষ্ট্র-যন্ত্রের কাছে, এবং সারাদিন সর্বস্থানে আপনাদের সাথে দৃঢ় বন্ধনে রয়েছি এবং আপনাদের প্রত্যেকের মধ্যে প্ৰত্যয় জন্মানোর, প্রত্যেককে ভর্ৎসনা করার ও প্রত্যেককে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছি।

সক্রেটিসের এ্যাপোলজি – পর্ব ৮

আপনারা খুব সহজেই আমার মত আরেকজনকে পাবেন না, এই কারণে আমি আপনাদের উপদেশ দেব আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে। আমি সাহস করে বলছি যে, আপনারা রাগান্বিত হতে পারেন (হঠাৎ করে ঘুম থেকে জেগে ওঠা ব্যক্তির মত), এবং আপনারা চিন্তা করতে পারেন যে, এনিটাসের উপদেশ অনুসারে আমাকে সহজেই হত্যা করে আপনারা বাকী জীবন নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারবেন। তবে ঈশ্বর আমার স্থলে অন্য একজন গো-মাছি (gadfly) পাঠালে আপনাদের সেই নিশ্চিন্ত নিদ্রা আর হবেনা। যখন আমি বলি যে, আপনাদের প্রতি আমি ঈশ্বর প্রেরিত একজন, তখন আমার এই মিশনের প্রমানটি এইরূপ: — যদি আমি অন্য সবার মতো হতাম, আমি নিঃসন্দেহে আমার ব্যাক্তিগত সব সুবিধা-অসুবিধাগুলোকে তুচ্ছজ্ঞান করতাম না, অথবা অন্যের তাচ্ছিল্যকে এই এতগুলো বছর ধরে এত ধৈর্যের সাথে অবলোকন করতাম না, এবং আপনাদের জন্য কাজ করতাম না, প্রত্যেকের কাছে পিতা অথবা বড় ভাইয়ের মত আলাদা আলাদাভাবে গিয়ে পূণ্য (সদ্গুন) সম্পর্কে প্রেরণাদান করতাম না; এমন আচরণকে আমি বলবো মানুষের সহজাত প্রকৃতির চাইতে ভিন্ন কিছু। এর দ্বারা আমার যদি কোন মুনাফা হতো, অথবা আমার এইসব প্রেরণাদান করার বিনিময়ে যদি টাকা-কড়ি নিতাম, তাহলেও আমার কাজের কিছুটা হলেও হিসাব-নিকাশ থাকতো; কিন্তু এখন আপনারা উপলব্ধি করবেন যে, আমার অভিযোগকারীরা নির্লজ্জতা সত্ত্বেত্ত এই কথা বলতে সাহস করবেন না যে, কখনো কারো কাছ থেকে আমি একটি কানা-কড়িও নিয়েছি; এর সপক্ষে তাদের কোন সাক্ষীও নেই, বরং পর্যাপ্ত পরিমানে সাক্ষ্য রয়েছে কেবল তার পক্ষে যা আমি বলছি — আমার দারিদ্র্য।

লোকে অবাক হতে পারে, কেন আমি জনে জনে গিয়ে উপদেশ দেই, এবং অপরের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাই, অথচ সর্বসাধারণের সমস্যার বিষয়ে রাষ্ট্রকে কোন উপদেশ দেইনা। আমি আপনাদের বলছি কেন আমি তা করি। আপনারা আমাকে বহুবার বহু জায়গায় এক দৈববাণী বা দৈব নিদর্শনের কথা বলতে শুনেছেন। এই দৈববাণী ঈশ্বরের নিকট থেকে আমার কাছে আসে, এবং এই ঈশ্বরকে মিলেটাস তার অভিযোগপত্রে বিদ্রুপ করেছে। আমি যখন শিশু ছিলাম তখন এই দৈব নিদর্শন, যা ছিলো এক ধরনের কন্ঠধ্বনি, আমার নিকট প্রথম আসা শুরু করে। এই দৈববাণী আমাকে অনেক কাজ করতে নিষেধ করেছে, কিন্তু কখনো কোন কাজ করতে নির্দেশ দেয়নি। এই দৈববাণীই আমাকে রাজনীতিবিদ হতে নিরুৎসাহিত করেছে। এবং আমি মনে করি এটাই ঠিক হয়েছে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, হে বিচারকগগণ! যদি আমি রাজনীতিতে নামতাম আমি অনেক আগেই উচ্ছন্নে যেতাম, এবং নিজের ও আপনাদের কারো জন্যই ভালো কিছু করতে পারতাম না। এবং অনুগ্রহপূর্বক আমার সত্য ভাষণ শুনে আপনারা রাগান্বিত হবেন না: সত্য কথাটি হলো এই যে, এমন কোন সৎ ব্যক্তি নাই যিনি আপনাদের বিরুদ্ধে অথবা কোন জনদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে করে, রাষ্ট্র কর্তৃক কৃত অনাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারবে; যে ব্যক্তি ন্যায়ের জন্য লড়াই করবে, তার জীবন সংক্ষিপ্ত হলেও, তার উচিৎ হবেনা সর্বসাধারণের সমস্যায় জড়িয়ে পড়া বরং ব্যক্তিগতভাবে কাজ করাটাই ঠিক হবে।

আমি যা বলছি তার কনভিন্সিং প্রমান আমি উপস্থাপন করতে পারি, শুধু কথা নয়, বরং কাজের মধ্যে দিয়ে- যেটাকে আপনারা অনেক বেশি মূল্যায়ন করেন। আমার জীবনের একটি ঘটনা শুনুন, তাহলে আপনারা বুঝতে পারবেন কেন আমি মৃত্যুভয়ে ভীত নই, এবং সেই ভয়ে ন্যায়ের পথ থেকে দূরে সরে থাকিনা, এবং মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ন্যায়ের পথটাকে আঁকড়ে ধরে আছি। আমি এই আদালতের একটা ঘটনা বলবো, আমি যা বলবো তা হয়তো ক্রোধ উদ্রেককারী ও বিরক্তিকর হবে, তবে সত্য নিঃসন্দেহে। এই এথেন্স রাষ্ট্রের কোন সরকারী পদই আমি কখনো অলংকৃত করিনি তবে আমি সিনেটর ছিলাম: আন্টিওকিস (Antiochis) ট্রাইব যেটা কিনা আমার নিজের ট্রাইব, একবার বিচারের সভাপতি হলো, বিচারটি ছিলো আরগিনুসায়ে (Arginusae)-র যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছিলো তাদের মৃতদেহ যে জেনারেলরা আনেনি তাদের বিচার। এবং আপনারা প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, তাদের সকলের একত্রে বিচার করা হবে, এটা ছিলো বেআইনি, পরবর্তিতে আপনারাও এটা স্বীকার করেছেন। কিন্তু সেই সময়ে প্রিটানেসদের মধ্যে থেকে আমিই একমাত্র ছিলাম যে বেআইনী কাজের বিরোধিতা করেছিলাম, এবং আমি আমার ভোট আপনাদের বিরূদ্ধে দিয়েছিলাম; এবং যখন ওরেটররা আমাকে ইমপীচ করার ও গ্রেফতার করার হুমকী দিলো, এবং আপনারা নিজেরাই এটা দাবী করে চিৎকার করতে থাকলেন, আমি তখন মনস্থির করলাম যে আমি ঝুঁকিটা নেবো, আমি মৃত্যুভয় বা কারারূদ্ধ হওয়ার ভয় না করে, আপনাদের বেআইনী কাজের ভাগীদার না হয়ে, আইন ও ন্যায়বিচারের পক্ষে থাকবো। এই সব কিছু ঘটেছিলো গণতন্ত্রের শাসনামলে। কিন্তু যখন ত্রিশজন শাসকের শাসনামল এলো, তারা আমাকে ও আরো চারজনকে গম্বুজ-সংবলিত গোলাকার অট্টালিকা-য় ডেকে পাঠালেন, এবং আমাদের বললেন সালামিসের সালামানিয়ান লিওন-কে সাথে নিয়ে আসতে, যেহেতু তারা তাকে মৃত্যুদন্ড দিতে চাচ্ছিলেন। তারা এই জাতীয় অনেক আদেশই অনেককে দিয়েছিলো যত বেশি সম্ভব অভিযুক্তদের খুঁজে বের করার জন্য। তখন আমি কথায় না আমার কাজের মধ্যে দিয়ে দেখালাম, মৃত্যু আমার জন্য – একটা ফালতু বিষয় (একটু রুক্ষভাবেই বলে ফেললাম!), আমার জন্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো অন্যায় ও অধর্ম থেকে বিরত থাকা। সরকারের অত্যাচারী হাত যত শক্তিশালীই হোক না কেন আমি তার ভয়ে মোটেও ভীত নই, তা কোনক্রমেই আমাকে অন্যায়ের পথে নিতে পারবে না; এবং যখন আমরা গম্বুজ-সংবলিত গোলাকার অট্টালিকা (rotunda) থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম, অন্য চারজন সালামিসে গিয়ে লিওনকে ধরে নিয়ে আসলো, কিন্তু আমি শাসকদের কথা না শুনে শান্তভাবে বাড়ী চলে গেলাম। আর এই অবাধ্যতার কারণে আমার মৃত্যুদন্ড হতে পারতো, কিন্তু খুব শীগগীরই ঐ ত্রিশজন শাসকের পতন ঘটে ও ঐ শাসনের অবসান হয়। আপনাদের এখানে উপবিষ্ট অনেকেই আমার কথার সাক্ষ্য দেবেন।

সক্রেটিসের এ্যাপোলজি – পর্ব ৯

এখন আপনারা কি সত্যিই কল্পনা করতে পারেন যে, আমি যদি একটি সামাজিক জীবনযাপন করতাম, যেখানে একজন ভালো মানুষের মতো আমি সব সময়ই সত্য ও ন্যায়ের পথে ছিলাম ও সেটাকেই প্রধান কর্তব্য মনে করেছি, তাহলে আমি এই এতগুলো বছর বেঁচে থাকতে পারতাম? অবশ্যই নয়, হে এথেন্সবাসীগণ, না আমি না অন্য কেউ। কিন্ত আমি সব সময়ই আমার কাজে এক পথেই ছিলাম, সেটা সর্বসাধারণের জন্যও ব্যাক্তিসাধারণের জন্যও, আমি কখনোই ন্যায়ের বিপক্ষে কাজ করার জন্য কারো সাথেই সম্মত হইনি, এমনকি তাদের সাথেও না যাদেরকে আমার কুৎসারটনাকারীরা আমার শিষ্য হিসাবে আখ্যা দিয়ে থাকে। আমি কখনো কারো শিক্ষক ছিলাম না, কিন্তু আমার মিশন চলার সময় কেউ যদি আমার কাছে আসতে ও আমার কথা শুনতে ভালোবাসে, সে যুবাই হোক কি বৃদ্ধই হোক, আমি তাকে বাধা দেইনি। আলাপচারিতার জন্যে আমি কখনো কারো কাছ থেকে টাকাও নেইনি, ধনী হোক আর দরিদ্র হোক যে কেউই আমাকে প্রশ্ন করতে পেরেছে, আমার কথা শুনতে পেরেছে; আর তারা ভালো ছিলো কি মন্দ ছিলো, ন্যায়সঙ্গতভাবে আমি তার উত্তর দিতে পারিনা, কারণ তাদের কাউকে আমি কোন জ্ঞান শিক্ষা দেইনাই, শিখানোর অঙ্গীকারও করিনাই। এবং কেউ যদি খাস করে বলে যে, সে আমার কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে এমন কিছু শিখেছে ও শুনেছে যা এই পৃথিবীর কেউই কখনো শোনেনি, আমি বলবো যে তিনি মিথ্যা বলছেন।

এখন আমাকে প্রশ্ন করা হতে পারে, আপনার সাথে কথপোকথন করে মানুষ পুলকিত হয় কেন? এথেন্সবাসীগণ, আমি ইতিমধ্যেই আপনাদের এই বিষয়ের পুরো সত্যটাই বলেছি: তারা আমি জ্ঞানের ভানকারীদের কেমন করে পরীক্ষা করি সেটা দেখতে পছন্দ করে; এর মধ্যে একটা আমোদ আছে। এখন, কোন ব্যক্তিকে পরীক্ষা করে দেখার দায়িত্ব ঈশ্বর আমাকে দিয়েছেন; এবং এটা আমাকে জ্ঞাপন করা হয়েছে দৈববাণীর মাধ্যমে, স্বপ্নের মাধ্যমে, এবং আরো যত রকমভাবে ঈশ্বর কাউকে তা জ্ঞাপন করেছেন সব ভাবেই। হে বিচারকগণ, এটা সত্য, আর শুধু সত্যিই নয় খুব সহজেই প্রমাণসিদ্ধ। আমি যদি যুব সম্প্রদায়কে বিপথেই নিতাম বা নিয়ে থাকি, তাহলে সেই সব ব্যক্তিরা যারা এক সময় যুবা ছিলো এবং এখন বড় হয়েছেন, তারা এই বয়সে এসে সচেতন হতেন এবং বুঝতেন যে এক সময় আমি তাদের কূ-পরামর্শ দিয়েছি, এবং তারা এগিয়ে এসে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেন, এবং প্রতিশোধ নিতেন; আর যদি তারা নিজেরা আসাটা পছন্দ না করতেন, সেই ক্ষেত্রে অন্ততপক্ষে তাদের আত্মীয়রা, বাবা, ভাই অথবা অন্য কোন স্বজনরা এসে বলতেন যে, আমার দ্বারা তাদের পরিবার কতই না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন তো তাদেরই সময়। তাদের অনেককেই আমি এই মুহূর্তে আদালতে উপস্থিত দেখতে পাচ্ছি। ঐ যে ওখানে আছে ক্রিটো, যিনি আমার সমবয়সী এবং আমার ডেমে-র, এবং তার পুত্র ক্রিটোবুলাসকেও আমি ওখানে দেখতে পাচ্ছি। তারপর স্ফেটাসের লাইসানিয়াস, যিনি আয়েসচিনের পিতা – তিনিও উপস্থিত আছেন; আরও আছেন সেফিসাসের আন্টিফোন যিনি এপিগেনে-এর পিতা; তারপর যারা আমার সাথে ছিলো এখানে তাদের অনেকেরই ভাইয়েরা উপস্থিত আছেন। ওখানে আছে থিওসডোটাইড্স-এর পুত্র নিকোস্ট্র্যাটাস, এবং থিওডটাস-এর ভাই, থিওডটাস নিজে যেহেতু এখন আর বেঁচে নাই, সুতরাং তার পক্ষে আর কোনক্রমেই সম্ভব না নিজের ভাইকে অভিযোগ উত্থাপন থেকে থামিয়ে দেয়া; এবং আরিস্তনের পুত্র আদেইমান্তাস, তার ভাই প্লেটো-ও উপস্থিত আছে; এবং আপোলোডোরাস এর ভাই আয়েন্তোদোরাস-কেও এখানে দেখতে পাচ্ছি। আমি খ্যাতিমান আরো অনেকের নামই উল্লেখ করতে পারি, যাদেরকে সাক্ষি হিসাবে এখানে হাজির করা মিলেটাসের উচিৎ ছিলো; এবং তাই তিনি করুন, যদি তিনি ভুলে গিয়ে থাকেন — আমি উনার জন্য পথ তৈরী করে দেবো। এবং তাকে বলতে দিন, যদি তার স্বপক্ষে কোন স্বাক্ষ্য-প্রমাণ থাকে। তাতো নয়ই, হে এথেন্সবাসিগণ বরং উল্টোটাই সত্য। মিলেটাস ও এনিটাস আমাকে দুর্নীতিবাজ বলে আখ্যা দিয়েছেন, আর ঐ সব লোকজন সবাই আসলে সেই দুর্নীতিবাজের পক্ষে সাক্ষ্য দিতেই প্রস্তুত রয়েছেন; শুধু যে বিপথগামী তরুণেরা তা নয় — সেখানে কোন একটা মোটিভেশন থাকলেও থাকতে পারে — কিন্তি তাদের অবিপথগামী অগ্রজ আত্মীয়-স্বজনরাও আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিবেন। এবার বলুন, তারাও কেন আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিবেন? এই কারণে যে, তারা সত্য ও ন্যায়ের স্বার্থে এটা করবেন, এবং এই কারণে যে তারা জানেন যে আমি সত্য বলছি, আর মিলেটাস বলছে মিথ্যা।

ঠিকআছে, এথেন্সবাসীগণ, এটা এবং এর মতো আরো বক্তব্যগুলো হলো আমার পক্ষসমর্থনমূলক যা আমি আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছি, আমি মনে করি যে এটাই যথেস্ট। তারপরেও আরো একটি কথা। খুব সম্ভবত এখানে এমন কেউ থাকতে পারে যে আমার কথা শুনে রাগান্বিত হতে পারে, সে একটু মনে করুক সে নিজে সমজাতীয় এমনকি এর চাইতেও গুরুতর মোকদ্দমায়, আদালতে এসে বিচারকদের সামনে চোখের জল ফেলে কত ভাবেই না প্রার্থনা ও অনুনয়-বিনয় করেছে, বিচারকদের অনুকম্পা পাওয়ার জন্য তার সন্তানদের আদালতে উপস্থিত করেছে, যা মূলত ছিলো আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের অংশগ্রহনে একটি সাজানো নাটক; পক্ষান্তরে আমি, যে কিনা খুব সম্ভবত জীবনের ঝুঁকিতে রয়েছি, এমন কোন কিছুই করবো না।
সে ঠিক উল্টোটা ভাবতে পারে, এবং সে আমার বিরূদ্ধ মনোভাব পূর্ব-নির্ধারিত করে এখানে বসতে পারে, এবং ক্রোধবশতঃ হয়ে আমার বিরূদ্ধে ভোট দিতে পারে কারণ সে আমার উপর অসন্তুষ্ট। এখন, আমি বলছি না যে আপনাদের মধ্যে এমন লোক আছেই, — মনে রাখবেন, আমি বলছি যদি এমন কেউ থেকে থাকে, আমি তাকে সুন্দরভাবে ও যুক্তিযুক্তভাবে উত্তর দিব: বন্ধু, আমি কাঠ-পাথরের তৈরী নই, আর দশজনার মতোই আমিও একজন রক্ত-মাংসের মানুষ, যেমনটি হোমার বলেছিলেন; এবং আমার একটি পরিবার রয়েছে, হ্যাঁ, আমার পুত্ররাও রয়েছে, হে বিচারকগণ! তারা তিনজন, একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষ, আর বাকী দুজন এখনো যুবক; তারপরেও মার্জনা চেয়ে বেকসুর খালাস পাওয়ার উদ্দেশ্যে আমি তাদেরকে এখানে নিয়ে আসবো না। কেন নয়? কোন আত্মসাম্মুখ্য থেকে নয় বা আপনাদের শ্রদ্ধা পাওয়ার উদ্দেশ্যেও নয়। আমি মৃত্যুকে ভয় করি কি করিনা সেটাও ভিন্নকথা, এ সম্পর্কে এখন আমি কিছু বলবো না। কিন্তু জনতার মতামতকে বিবেচনায় এনে আমি বলবো, আমি এমন কিছু করলে সেটা আমার জন্য অমর্যাদাকর হবে, আপনাদের জন্যও হবে, পুরো রাষ্ট্রের জন্যও হবে। যার কথা আমার কান পর্যন্ত পৌঁছেছে, এবং প্রজ্ঞার জন্য যার সুনাম রয়েছে, তার উচিৎ হবেনা নিজেকে ছোট করা। আমার মতামতটি গ্রহনযোগ্য হবে কি হবে না জানিনা, তবে জগতের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সক্রেটিস অন্যদের চাইতে শ্রেয়। এবং আপনাদের মধ্যে যাদেরকে প্রজ্ঞা এবং সাহস ও অন্য কোন গুনের ভিত্তিতে শ্রেয় মনে করা হয়, তারা যদি নিজেদের এভাবে ছোট করে, এটা কি লজ্জ্বাজনকই না হবে! আমি অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিদের দেখেছি যে, যখন তারা অভিযুক্ত হয়েছে, কি অদ্ভুত আচরণই না তারা করছে: তাদের দেখে মনে হচ্ছিলো যেন তারা মৃত্যুর পর এক ভয়ঙ্কর দুর্ভোগে পতিত হবে, এবং যদি আপনারা তাকে মৃত্যুদন্ড না দেন তবে তারা অনন্তকাল বেঁচে থাকবে; এবং আমি মনে করি যে, এটা রাষ্ট্রের জন্য অবমাননাকর, আর যদি বিদেশী কেউ এটা প্রত্যক্ষ করতো তবে সে বলতো যে, এথেন্সে এসে দেখলাম যে এথেন্সের সর্বাধিক খ্যাতিমান ব্যাক্তিবর্গ, যাদেরকে এথেন্সবাসীগণ প্রচুর সম্মান দিয়ে থাকে, তারা মেয়েমানুষের চাইতে উত্তম নয়। এবং আমি বলছি যে, আমরা যাদের সুখ্যাতি রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এমনটি হওয়া উচিৎ নয়; আর তারা যদি তা করে, আপনাদের (বিচারকগণের) উচিৎ হবেনা এটার অনুমতি দেয়া; উল্টো আপনাদের উচিৎ হবে যে ব্যাক্তি এই জাতীয় অশ্রুসিক্ত নয়নে বেদনাপূর্ণ দৃশ্যের সৃষ্টি করে নগরীকে হাস্যকর অবস্থায় নিয়ে যায় তাকে, যে ব্যাক্তি ধীর-স্থিরভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে তার চাইতে বেশী অভিযুক্ত করা ।

লোকে কি বলবে সেটা না হয় বাদই দিলাম, আমি মনে করি বিচারকের অনুকম্পা ভিক্ষা করে বেকসুর খালাস চাওয়াটা কখনোই সঠিক নয়, বরং যা করা উচিৎ তা হলো যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে বিচারকদের উপলব্ধি করানো। বিচারককে ঐ আসনে এইজন্য বসানো হয়নি যে, তিনি যে অনুকম্পা চাইবে তাকেই ক্ষমা করে দেবেন, বরং বিচারকের দায়িত্ব আইনের ভিত্তিতে বিচার করা, এই শপথ নিয়েই তিনি বিচারকের আসনে বসেছেন, নিজের খেয়াল-খুশী মতো রায় দেয়ার জন্য নয়; এবং আমাদের উচিৎ হবেনা আপনাদের (বিচারকদের) প্রণোদিত করা, অনুরূপভাবে আপনাদেরও উচিৎ হবেনা প্রণোদিত হওয়া, এতে শপথভঙ্গ হবে, এতে কোন পুণ্য থাকতে পারেনা। আমাকে অনুগ্রহপূর্বক সেই কাজ করতে বলবেন না, যাকে আমি মনে করি অসম্মানজনক, অধর্ম এবং ভুল, বিশেষতঃ এখন, যখন মিলেটাসের অভিযোগের ভিত্তিতে অভক্তির অভিযোগে অভিযুক্ত করে আমাকে বিচারকের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। হে বিচারকগণ! অনুনয় ও প্রার্থনা-র বলে আমি যদি আপনাদের শপথের বলকে বশীভূত করে ফেলি, তাহলে এটা দাঁড়াবে এমন যে আমি আপনাদের এই বিশ্বাস করতে শিক্ষা দিচ্ছি যে, ঈশ্বর নেই, অর্থাৎ নিজেকে ডিফেন্ড করতে গিয়ে উল্টো আমার বিরূদ্ধে আনিত নাস্তিকতার অভিযোগকেই সমর্থন করে ফেলবো। কিন্তু তা তো নয় — বরং উল্টোটা। হে বিচারকগণ! আমি বিশ্বাস করি যে, ঈশ্বর আছেন, এবং এক অর্থে আমার এই বিশ্বাস আমার অভিযোক্তাদের চাইতেও অনেক অনেক বেশি দৃঢ়। এবং আপনাদের ও আমার ঈশ্বরকে বলছি, আমার বিচার করুন, এমন বিচার যা আপনাদের ও আমার সকলের জন্যই হবে সর্বত্তোম।
(চলবে)

৬৫৯ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “সক্রেটিসের এ্যাপোলজি – পর্ব ৬, ৭, ৮, ৯”

মওন্তব্য করুন : ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।