পিলখানা তখন মৃত্যুপূরী (গল্প)-১

পিলখানা তখন মৃত্যুপূরী (গল্প)-১
————————– ডঃ রমিত আজাদ

পথটা একটা তীক্ষ্ণ একটা বাঁক নিতেই হুমড়ি খেয়ে গায়ের উপর এসে পড়লো কোন সহযাত্রী। “ইয়া খোদা! ইয়া খোদা!” বলে চিৎকার করে উঠলেন তিনি। শত চেষ্টা করেও তার চেহারাটা দেখা গেলোনা। সহযাত্রীটি কোন একটা দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো ঐযে ঐদিকে ঐদিকে। কথাটার মানে বোঝা গেল না। আঁকাবাঁকা সর্পিল পাহাড়ী পথে এগিয়ে চলছে বহুদিনের পুরাতন একটি ঘোড়ার গাড়ী। সেই পথে গাড়ীর সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটন্ত সূর্য ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো বহু আগেই, পাহাড়ের ওপারে ডুবতে ডুবতে সে একেবারেই আড়ালে চলে গেলো। নেমে এলো এক মলিন জোৎস্না। সেই ম্যাটম্যটে আলোয় চুতুর্দিক কেমন ভুতুড়ে মনে হলো। হঠাৎ একটি সাদাসিধা গ্রাম্য মসজিদের মিনার উঁকি দিলো। তার অনতিদূরেই ক্ষেতের একপাশে দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করে প্রার্থনা করছে একজন কিষাণী বধু। বোধহয় অকালে হারিয়ে যাওয়া স্বামীর জন্য প্রকাশ করছে তার ব্যথাভরা বুকের অব্যক্ত হাহাকার। তরুনী বধুটির মুখের দিকে তাকিয়ে ধড়াশ করে উঠলো জেবুন্নিসা করিমের বুক। এ যে তিনি নিজেই! সেই ১৯৭৫ সালের তিনি। সাথে সাথে শত শত মেশিনগানের গুলির শব্দে বিদীর্ন হতে থাকলো চতুর্দিক। বৃষ্টির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসতে শুরু করলো ঘোড়ার গাড়িটির দিকে। “থামান, থামান। কি হচ্ছে এখানে?” চিৎকার করে উঠলেন জেবুন্নিসা। চিৎকার শুনে কোচোয়ান গাড়ী থামানোর আয়োজন করতেই। চতুর্দিকে ডেকে উঠলো শত শত কুকুর, পরক্ষণেই মনে হলো কুকুর নয় ওরা নেকড়ে। তাদের চিৎকার পাহাড়গুলোর গায়ে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এসে কানের পর্দা ফাটিয়ে ফেলতে চাইছে। দুঃস্বপ্নটি হঠাৎ করে ভেঙে গেলো জেবুন্নিসা করিমের। স্বপ্ন ভেঙে গেলেও উনার নিশ্বাস এখনোও দ্রুত ওঠানামা করছে। বুকে হাত দিয়ে দেখলেন ঘেমে গেছেন তিনি। কি এক বিদঘুটে স্বপ্ন! আবার কুকুর কেঁদে উঠলো কোথাও, এবার স্বপ্ন নয়, সত্যি। মুরুব্বীদের মুখে শুনেছেন এই কান্না অমঙ্গলের। গা কেমন ছমছম করে উঠলো একটা অজানা আশংকায়।

ফজরের নামাজ পড়ে নাস্তা বানানো শুরু করলেন তিনি। তার ছেলে আজ একটু আগে আগে বেরোবে। অফিসের কাজ ঠিক বলা যাবেনা, কর্মক্ষেত্রের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাবে সে। আজ সরকার তাকে একটি পদক দেবে, বীরত্বসূচক পদক! জেবুন্নিসা করিম পেশায় একজন আইনজীবি। বয়সের কারণে আজকাল আর কোর্টে যান না। তবে এককালে তার যথেষ্ট নাম-ডাক ছিলো। ছেলেটা ঢাকার বাইরে পোস্টেড। শুধু পদকটি নেয়ার জন্য কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে ঢাকায় এসেছে। ছেলেটা তার হাতের তৈরী ওমলেট খেতে খুব পছন্দ করে। তাই তিনি ডিম ফাটিয়ে ওমলেট রেডী করছেন। পরোটা ওর খুব প্রিয়, সেই পরোটাও তৈরী করেছেন। কোরবাণী ঈদের মাংস অনেক দিন জাল দেয়ার পর কেমন ঝুরা ঝুরা হয়ে যায়। সেই ঝুরা মাংস ও পরোটা দিয়ে খেতে খুব ভালোবাসে। এখন ঝুরা মাংস পাওয়া যাবে না। তবে গরুর মাংস ভুনা করেছেন তিনি। ঘন দুধ দিয়ে কড়া চা ওর নাস্তার তালিকায় থাকে। সেটাও করেছেন তিনি। ছুটিতে যখনই ছেলে আসে তখনই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন তিনি। মায়ের মন! কি জানি ছেলেটা ওখানে কি খায়? ছেলে নিজেই বলে, “তোমার হাতের খাবার এই পৃথিবীতে সবচাইতে মজার খাবার মা।”
ঃ মা। (পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরলো ছেলে)
ঃ ওরে আমার পাগোল! এই বয়সেও তোর পাগলামী গেলোনা?
ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। সাথে সাথে বিদ্যুৎ খেলে গেলো তার শরীরে। মিলিটারি ইউনিফর্ম পরিহিত ছেলেকে অবিকল তার স্বামীর মতো মনে হচ্ছে। কমব্যাট পোষাকের কাধে জ্বলজ্বল করছে রূপালী শাপলা, যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর র্যং কের প্রতীক। বুকের নেমপ্লেটে ছোট্ট করে লেখা ‘মিজান’। মেজর মিজান জেবুন্নিসা করিমের একমাত্র ছেলে।

স্বামীর একেবারে কপি তার ছেলে। স্বামীর কথা মনে হতেই তার চোখ ভিজে আসে। কি দোষ করেছিলো তার স্বামী? তিনি অফিসার ছিলেন এই কি তার অপরাধ ছিলো? লেখাপড়া শিখে অফিসার হয়ে দেশ সেবা করেছিলেন, কেবল এই অপরাধেই তাকে জীবন দিতে হলো? অথচ তার স্বামীই জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। একমাত্র ছেলেটিকে পাঁচ বছরের রেখে খুব কম বয়সে তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়।

মিজানঃ কি হলো মা? তুমি আবার কাঁদছো? আবার বাবার কথা মনে হয়েছে?
জেবুন্নিসাঃ না রে বাবা। ও কিছু না। (চোখ মুছতে মুছতে বললেন মা) চল নাস্তা খাবি। তোর বোধহয় দেরী হয়ে যাচ্ছে।
মিজানঃ না মা। দেরী হবে না। তুমি টাইমলি সব করেছ। তোমার মধ্যে ভীষণ পাংচুয়ালিটি রয়েছে। একেবারে ফৌজিদের মতো। অবশ্য নিজে ফৌজি না হলেও তুমি ফৌজির মেয়ে, ফৌজির স্ত্রী।
জেবুন্নিসাঃ হ্যাঁ রে। এখন আবার ফৌজির মা।
মিজানঃ এই দেখো! আমরা ফৌজিরা কেমন তোমাকে ঘিরে ফেলেছি!
জেবুন্নিসাঃ আচ্ছা সব যুদ্ধবাজরা আমার আপন মানুষ হলো কেন বলতো? (তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে তার আক্ষেপের কথাটা আবার বললেন) আচ্ছা আর্মীতে না গেলে কি তোর চলতো না?
মিজানঃ ওহ্হো মা! তোমার আবার সেই পুরণো কথা! আমরা যুদ্ধবাজ নই। আমরা খুব শান্তিপ্রিয়। কিন্তু জগৎ তো শান্তিময় নয়। তুমি কি জানো মা গৌতম বুদ্ধ অহিংস বাণী প্রচার করেছিলেন?
জেবুন্নিসাঃ (বিদ্রুপ করে বললেন) নাহ্, তোর মা তো অশিক্ষিত গৌতম বুদ্ধের কথা জানবে কি করে? এ্যাডভোকেট তো হয়েছি পড়ালেখা না করে!
মিজানঃ হা, হা, হা, এই দেখো, কেমন তোমাকে খেপিয়ে দিলাম।
জেবুন্নিসাঃ সারাটা জীবনই তো তুই আমাকে ক্ষেপালি।
মিজানঃ জানি মা তুমি বলেছ, ছোট বেলায় আমি কিছু খেতে চাইতাম না। তুমি প্লেট হাতে নিয়ে আমার পিছনে পিছনে দৌড়াতে। তারপর একসময় রাগ করে আমাকে ধমক দিয়ে উঠতে।
জেবুন্নিসাঃ (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) হ্যাঁ, তুই খুব আহ্লাদি ছিলি। একটু কিছু বললেই ভ্যাঁ করে কেঁদে দিতি। তখন তোর বাবা দৌড়ে এসে তোকে কোলে তুলে নিয়ে বলতো, “ওকে কিছু বলবে না জেবু, ও ছাড়া আমাদের আর আছে কে?”
মিজানঃ বাবার কথা আমার অল্প অল্প মনে পড়ে মা। যখন বাইরে বজ্রপাত হতো আমি লাফ দিয়ে বাবার কোলে আশ্রয় নিতাম। বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতেন, “ভয় পেয়োনা বাবা, ও কিছু না, আমি এর চাইতেও বড় বজ্রপাতের হাত থেকে তোমাকে রক্ষা করেছি।”

জেবুন্নিসাঃ হ্যারে বাবা তোর বাবা যখন মুক্তিযুদ্ধে যায়। তখন তুই এক বছরের ছিলি। যাওয়ার সময় আমি শক্ত করে ওর হাত ধরে বলেছিলাম, “যুদ্ধে না গেলেই কি নয়?” তোর বাবা, তোর দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলেছিলো, “ওকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধে যাচ্ছি।” আমার হাতটা তখন আপনা থেকেই শিথিল হয়ে এসেছিলো।

এবার মেজর মিজানেরও চোখ ভিজে এলো। যেই বাবা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। তার সেই দেশপ্রেমিক বাবাকেই কয়েক বছর পরে বিনা অপরাধে কি নির্মমভাবেই না হত্যা করা হয়েছিলো।

মিজানঃ আমরা বাংলাদেশীরা আক্রমণকারী নই মা। আমরা শান্তিপ্রিয়। কিন্তু আমাদের কাঁধে বারবার যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো। তোমাকে বুদ্ধের কথা বলেছিলাম। বুদ্ধের জন্ম বাংলাদেশ থেকে খুব দূরে নয়। ঐ বুদ্ধের একজন অনুসারী ছিলেন, তার নাম বোধিধর্ম। তিনি বলেছিলেন যে, ‘আমরা অহিংস হলেও, জগৎ তো অহিংস নয়, তাই কাউকে আক্রমণ না করলেও, কারো দ্বারা আক্রান্ত হলে, তার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে।’ সেই উদ্দেশ্যেই তিনি মার্শাল আর্ট সৃষ্টি করেন।

” আব্বু তুমি আজকে কোথা্য় যাবে?”
চোখ মুছতে মুছতে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে কথাটি বললো, মেজর মিজানে একমাত্র ছেলে ঈমন।
মিজানঃ ওরে বাবা! ঘুম থেকে উঠে গিয়েছ? এত্তো সকালে?
ঈমনঃ সকাল কোথায় বাবা? আমাকে স্কুলে যেতে হবে না?
মিজানঃ হু, তাইতো, স্কুলে তো যেতেই হবে। তুমি যেন কোন স্কুলে পড় বাবা?
ঈমনঃ তুমি শুধু আমার স্কুলের নাম ভুলে যাও। আমার স্কুলের নাম, ‘শহীদ লেঃ সেলিম শিক্ষালয়’।
মিজানঃ (ছেলের স্কুলের নাম ভালোই জানা আছে মেজর মিজানের, কিন্তু তারপরেও ছেলেকে অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্যে ইচ্ছে করেই বারবার জিজ্ঞেস করে) ওরে বাবা! এতো বড় বীরের নামে স্কুল! লেঃ সেলিম কে ছিলেন তুমি জানো?
ঈমনঃ জানি। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর শহীদ।
মিজানঃ গুড বাবা। তোমার অনেক বুদ্ধি। এই এতো বড় বীরের নামের স্কুলে তুমি পড়ো, তোমাকেও বীর হতে হবে।
ঈমনঃ আমি বীর হবো, দাদার মতো বীর, দাদীর আব্বুর মতো বীর।
মিজানঃ সাবাস! এই না হলে আমার ছেলে! এখন তৈরী হয়ে নাও স্কুলে যেতে হবে। কিছুদিন এই স্কুলে পড়বে তারপর তোমাকে ক্যাডেট কলেজে দিয়ে দেব।
ঈমনঃ (উল্লসিত হয়ে) যাবো, ক্যাডেট কলেজে যাবো!
জেবুন্নিসাঃ না যেতে হবেনা ক্যাডেট কলেজে। আর আমি ফৌজি চাইনা।
মিজানঃ (হো হো করে হেসে উঠলো) পারবে না মা, পারবে না। ফৌজি তোমার ভাগ্যে লেখা।
মনে মনে আরেকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলেন জেবুন্নিসা করিম। মেজর মিজান সিলেট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলো। ১৯৮২ সালে ছোট্ট মিজান ক্যাডেট কলেজে গেলো। মার মন মানেনা। আবার ইউনিফর্ম! সবাই বলে ‘যাক আপা, বড় মানুষ হবে। আর্মিতে যেতেই হবে এমন তো কোন কথা নেই। অন্য কিছু করবে, কিন্তু ক্যাডেট কলেজের প্রশিক্ষণটা নিয়ে কোয়ালিটি অর্জন করুক।‘ সেই মিজান কলেজ শেষ করে আর্মিতেই গেলো। যেদিন আইএসএসবি-র পরীক্ষা পাশের লেটারটি হাতে করে উল্লসিত হয়ে বলেছিলো, “মা আমি টিকে গেছি, বাবার মতো সামরিক অফিসার হবো”। জেবু্নিসা করিমের বুকটা আরেকবার ধড়াস করে উঠেছিলো।

ততক্ষণে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে জেবুন্নিসা করিমের গ্রাম সম্পর্কের বোন সাবিহা বাণু। বিধবা সাবিহা বাণু উনাদের সাথেই থাকেন। “চলো বাবু, হাতমুখ ধুয়ে রেডী হয়ে নাও, আমরা স্কুলে যাবো।”
ঈমনঃ তুমি প্রাইজ আনতে যাবে বাবা? দাদী বলেছে।
মিজানঃ হ্যাঁ বাবা, পদক আনতে যাবো।
ঈমনঃ প্রাইজকে কি পদক বলে?
মিজানঃ হ্যাঁ বাবা। তোমাদের স্কুলে বলে প্রাইজ। আর্মীতে বলে পদক। এই দেখো কয়েকটা আমার বুকে রয়েছে।
ঈমনঃ তোমার তো অনেকগুলো আছে। এবারেরটা আমার বুকে ঝুলিয়ে দিও। আমি ওটা নিয়ে আম্মুর কাছে যাবো।

এবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলার পালা মেজর মিজানের। ছেলেটিকে চার বছরের রেখে তার স্ত্রী এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। চাকরীর কারণে, মা হারা এই ছেলেটিকে সেও কাছে রাখতে পারেন না।। ছেলে থাকে তার দাদীর কাছে। দেখাশোনা করে গ্রাম সম্পর্কের খালা সাবিহা বাণু।

ছেলেটা চলে যাবার পর মায়ের দিকে তাকালো মেজর মিজান। মায়ের চোখ দেখে বুঝতে পারলো সে, মা কি বলতে চায়।
জেবুন্নিসাঃ এভাবে আর কতদিন বাবা?
মিজানঃ (যদিও বুঝতে পেরেছে, তাও প্রশ্ন করলো) কিসের মা?
জেবুন্নিসাঃ ছেলেটা মা মরা। তুই কি আর বিয়ে-শাদির কথা ভাবছিস না?
মিজানঃ তোমাকে আগেও বলেছি মা। লাবনীর জায়গায় আমি অন্য কাউকে ভাবতে পারিনা।
জেবুন্নিসাঃ ছেলেটার কথা ভেবে।
মিজানঃ অন্য কেউ ঈমনকে ভালোবাসবে কিনা তার কোন গ্যারান্টি নেই।
জেবুন্নিসাঃ তোর নিজের কি কোন সঙ্গ দরকার নেই?
মিজানঃ তুমি তো জানো মা আমার প্রথম প্রেম তুমি, দ্বিতীয় প্রেম বাংলাদেশ, তৃতীয় প্রেম লাবনী। লাবনী তো চলে গেছে, এখন আছি তোমাকে আর বাংলাদেশকে নিয়ে।
জেবুন্নিসাঃ তোর বাবাকে বিয়ে করা আমার ভুল হয়েছে।
মিজানঃ কেন মা?
জেবুন্নিসাঃ তোর বাবা কেবল দেশ দেশ করতো। তুই তোর বাবার মতোই হয়েছিস।
মিজানঃ নানার কথা বললে না মা? উনিও তো দেশের জন্য জীবন দিয়েছিলেন।
জেবুন্নিসাঃ দেশ তোদের কিছু দিয়েছে?
মিজানঃ দেশ কিছু দিতে পারেনা মা। দেশকে দিতে হয়।
জেবুন্নিসাঃ যুদ্ধ করে দেশকে কি দিবি? আর কোন পেশা ছিলোনা? ঐ দাশখত গায়ে দিতে হবে কেন?
মিজানঃ আহ্ মা। আবারো বলছি, কাউকে উসকানী দিয়ে যুদ্ধ লাগানোর জন্য আমরা নই। যুদ্ধ ঠেকানোর জন্য আমরা।
এরপর মেজর মিজান তার প্রিয় গানটি গেয়ে উঠলো

“মাগো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে;
তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি,
তোমার ভয় নেই মা- আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।।

এইটুক গাওয়ার পরই স্কুল ইউনিফর্ম পড়ে ছোট্ট ঈমন দৌড়ে এসে বাবার সাথে গলা মেলালো

“আমরা হারবনা, হারবনা,
তোমার মাটির একটি কণাও ছাড়বনা।।
আমরা পাজর দিয়ে দূর্গ হাটি গড়তে জানি,
তোমার ভয় নেই মা- আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।।
বাপ ছেলের গানের সুরে আবেগময় হয়ে উঠলো ঘরের আবহ।

ছোট্ট ঈমনকে স্কুলে নিয়ে গেলেন সাবিহা বাণু। যাওয়ার আগে মা মরা ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরলো মেজর মিজান। আলতো করে গালে চুমু খেয়ে বললো, “খুব ভালো করে ক্লাস করবে বাবা, বি এ গুড বয়।”
বাসার সামনের বাগানটি পার হয়ে ছেলের যাওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে ভাবছে মেজর মিজান। ‘আমি দেশ রক্ষা করি, মানে ঐ শিশুটিকে রক্ষা করি। আমার মাকে রক্ষা করি, সাবিহা বাণু খালাকে রক্ষা করি। আমার ভাই-বোনদের রক্ষা করি। এই দেশ বারবার আক্রান্ত হয়েছে ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা। আমাদের পূর্বপুরুষরা কয়েক জেনারেশন সংগ্রাম করে দেশকে মুক্ত করেছিলেন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে। আমার দাদা, নানা ও পিতারা এই দেশকে মুক্ত করেছিলেন পাকিস্তানী হানাদারদের হাত থেকে। আমার কি কোনই দায়িত্ব নেই? দেশ কি একেবারে শঙ্কামুক্ত? না, শ্বাপদ-সঙ্কুল এই পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তেই থাকে বিপদ। সম্ভাব্য যেকোন বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে হয়। স্বাধীনতা অর্জন করার চাইতে স্বাধীনতা রক্ষা করা আরো বেশী কঠিন। আমাদের পূর্বপুরুষরা আমাদেরকে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়ে গেছেন। এবার আমাদের দায়িত্ব সেই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করা। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ধ্রুব নক্ষত্রের মত কাজ করবে বাংলাদেশ সসস্ত্র বাহিনী। ঐ উদ্দেশ্যেই আমাদের গায়ে এই ইউনিফর্ম তুলে দিয়েছে দেশের জনগণ, ‘আওয়ার ডিউটি ইজ টু সার্ভ দ্যা নেশন, নট দ্যা ইন্ডিভিজুয়ালস’। যদি আমি সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারি তখনই আমার এই ইউনিফর্মের মর্যাদা রক্ষা হবে।’

মেজর মিজানকে চা ঢেলে দিতে দিতে, মা বললেন
জেবুন্নিসাঃ ঢাকাতে কদিন থাকবি যেন?
মিজানঃ অল্প কয়েকদিন মা। আমার তো টেকনাফে পোস্টিং। এখন বি.ডি.আর. সপ্তাহ চলছে। পদক নেয়ার জন্য আমাকে ডেকেছে। আজ পদক নিতে পিলখানায় যাবো। পদকটা নিয়ে আর দুদিন থেকেই টেকনাফ চলে যাবো।
জেবুন্নিসাঃ (ছেলে পদক পাচ্ছে, একথা ভেবে অবশ্যই গর্ব হয় জেবুন্নিসা করিমের। তারপরেও ছেলের কষ্টের কথা ভাবেন) এই যে জঙ্গলে জঙ্গলে থাকিস, তোর খারাপ লাগেনা?
মিজানঃ হা, হা। এটাই তো আমার কাজ মা। জঙ্গল আমাদের কাছে কোন সমস্যা না মা।
নব নবীনের গাহিয়া গান
সজীব করিব গোরস্থান,
আমরা দানিব নতুন প্রাণ
বাহুতে নবীন বল!
চল রে নও-জোয়ান,
শোন রে পাতিয়া কান
মৃত্যু-তরুণ-দুয়ারে দুয়ারে
জীবনের আহবান।
ভাঙ রে ভাঙ আগল,
চল রে চল রে চল
চল চল চল।।

জেবুন্নিসাঃ উহ্, কবিতা! সৈনিকের মুখে কবিতা!
মিজানঃ কবি নজরুল ইসলাম কিন্তু সৈনিকই ছিলেন মা। একজন সৈনিকই আমাদের জাতীয় কবি। ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরী, আরেক হাতে রণতুর্য!’
জেবুন্নিসাঃ (হেসে ফেললেন মা) থাক আর কবিতা বলতে হবে না। তোর সময় হয়ে এলো।

মেজর মিজানের শৈশব স্মৃতি বিজরিত অতি পরিচিত অতি পুরাতন মগবাজার মধুবাগের নানা বাড়িটির দরজা খুলে বাগানে এসে দাঁড়ালো মেজর মিজান। এই ঘিন্জি ঢাকা শহরের ভিতরেও ঘরের সামনে এখনো একটি বাগান রক্ষা করেছে তারা। চারপাশের পেয়ারা গাছ, জামরুল গাছ, নারকেল গাছ আর সুপুরীর সারির দিকে তাকিয়ে খুব ভালো লাগলো মেজর মিজানের। শান্ত শীতের সকালের আকাশটা আজ অদ্ভুত নীল। পরম করুণাময় অপার সৌন্দর্য্য দিয়ে তৈরী করেছেন তার প্রিয় জন্মভূমিটিকে।

জেবুন্নিসাঃ কাজ শেষে ঠিকঠাক মতো চলে আসিস বাবা।
মিজানঃ (মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বললো) ঠিক ঠিক চলে আসবো মা। ‘আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়, হয়তোবা মানুষ নয়, শঙ্খচিল শালিকের বেশে, আবার আসিব ফিরে নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে।’

জেবুন্নিসাঃ (মাও মুখে হাসি নিয়ে বললেন) খুব হয়েছে! আর কবিতা বলতে হবে না।

ছেলে চলে যাওয়ার পর ঘড়ির দিকে তাকালেন মা। ২৫শে ফেব্রুয়ারী, ২০০৯ সাল। হঠাৎ ভোরের স্বপ্নটার কথা মনে পড়তেই কি এক অজানা আশঙ্কায় ভরে উঠলো মা’র মন।

(চলবে)

প্রেমে দ্রোহে গর্জে ওঠা সৈনিক আজ নিথর নীরব
——————————- ডঃ রমিত আজাদ

প্রেমে দ্রোহে গর্জে ওঠা সৈনিক আজ নিথর নীরব,
ঘুমাও সৈনিক, ঘুমাও নীরবে, ঘুমাও,
আমি জেগে রব অবিরত নির্ঘুম,
আর অভিশাপ দেব ঐ সব পশুদের,
যাদের গভীর ষড়যন্ত্র
অকালে ঝরিয়েছে তোমাদের প্রাণ
মাথার খুলিতে মদ পান করেছে, যেসব নষ্ট মাতাল পশু,
হন্তারক কো্ন্ নতুন মীর্জাফর।

তোমার নির্ভীক নিশঙ্ক কন্ঠ আজ রুদ্ধ কেন সৈনিক?
তোমাদের জীবন্ত চোখে অনেক স্বপ্ন ছিলো,
তোমাদের অন্তিম বাসনাগুলো এক এক করে সাজালে,
বসন্তের ফুল হয়ে ফুটবে।
এমন বসন্তের আগুন রাঙা রঙ, মানুষের রক্তে রঙিন হলো!
আর মানুষের আলখেল্লার পিছনে দাঁড়িয়ে উল্লাস করেছে
হিংস্র পশুর রূপ, ভয়াবহ এক ষড়যন্ত্রের কোপানলে,
একি ষড়যন্ত্র না অঘোষিত কোন যুদ্ধ?

যে রমনী অলস অবসরে তোমার বাহুডোরে বন্দী হয়ে সুখ খুঁজে পেত,
সে আজ কলঙ্কের টিপ কপালে ধারন করে শিউরে উঠেছে
প্রিয় রমণীর তপ্তশ্বাসের উষ্ণতা আর নেই,
তোমার জন্য কাঁদে মেঘবতী নারী,
বৃষ্টি ঝরে ডাগর কালো চোখে!

হাহাকার করে উঠেছে,
ফুটপাতবাসী শীতার্ত কিশোর,
বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে যাওয়া বৃদ্ধ রহীম,
বুড়িগঙ্গার মাঝি ইয়াকুব মোল্লা,
মাদ্রাসার পরহেজগার শিক্ষক আবদুল করিম
শ্রমে ও ঘামে ঠেলে নেয়া জীবন,
বিপন্ন, বিদ্ধস্ত, জননী ও জন্মভূমি,
পৃথিবীর সব অস্ত্রাগার নিশ্চুপ রইলো,
সৈনিকের দক্ষ হাতে, কেবলই ছিলো শূণ্যতা,
হে কাপুরুষ, তুই নিরস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলি!

এক অন্তর্ভেদী চিৎকারে
আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে বলতে চাই,
তুমি কি আর জাগবে না সৈনিক?
দেখনা চেষ্টা করে,
যদি লিখতে পারো আরেকটি নির্মম কবিতা,
শিরায় শিরায় ধমনিতে ধমনিতে,
প্রবাহিত লাল রক্তে আর একবার জেগে উঠুক দ্রোহ!

আমার কন্ঠস্বর রুদ্ধ নয়,
কেবল চেপে ধরে আছে কে যেন!
দেখবি একদিন প্রবল শক্তিতে
সেই হাত ছাড়িয়ে নেব,
যদি শক্তি থাকে কারো
সেদিন আমাকে ফেরাস্।

(রক্তাক্ত বিডিআর বিদ্রোহের (পিলখানা হত্যাকাণ্ড) বার্ষিকী আজ ২৫ ফেব্রুয়ারী, সেই নির্মম হত্যাকান্ডে নিহত সকল শহীদদের আমার এই কবিতা ও গল্প উৎসর্গ করলাম)

১,১৩৬ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “পিলখানা তখন মৃত্যুপূরী (গল্প)-১”

মওন্তব্য করুন : ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।