সক্রেটিসের এ্যাপোলজি – ১

সক্রেটিসের এ্যাপোলজি – ১

মূল বক্তৃতাঃ সক্রেটিস
লিখেছেনঃ প্লেটো

অনুবাদঃ ডঃ রমিত আজাদ

(যে কয়েকটি সংলাপ ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছে তার মধ্যে একটি হলো এ্যপোলজি (Apology)। আধুনিক ইংরেজীতে Apology অর্থ ক্ষমা প্রার্থনা করা। কিন্তু গ্রীক ভাষায় Apology-অর্থ ভিন্ন। সেখানে Apology-অর্থ defense। আদালতে বিচারের সময় আত্মপক্ষ সমর্থন করে সক্রেটিস যে ভাষণ দেন এ সংলাপ তারই বর্ণনা। নিচে মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের বক্তৃতা হুবুহু তুলে দেয়া হলো।)

হে এথেন্সবাসীগণ (বিচারের জুরিগণ) আমার অভিযোগকারীদের দ্বারা আপনারা কতটুকু প্ররোচিত হয়েছেন আমি জানিনা। কিন্তু তাদের কথা এতো বেশী প্ররোচনামূলক ছিলো যে, তারা আমাকে প্রায় ভুলে যেতেই বাধ্য করেছে যে, আমি কে। উপরন্তু তারা খুব কমই সত্য বলেছে।

কিন্তু তাদের বলা অনেক মিথ্যা কথার মধ্যে একটি আমাকে বেশ বিস্মিত করেছে যা ছিল — আপনারা বিচারকরা যেন যথেষ্ট শক্ত থাকেন এবং আমার বাগ্মিতার প্রভাবে বিহ্বল হয়ে না পড়েন। এই কথা বলে তারা নিজেদেরকে নির্লজ্জ্বই প্রমান করলো, এবং আরো বোঝালো যে, সক্রেটিস মুখ খুললেই প্রমানিত হয় যে তিনি একজন মহান বক্তা। বাগ্মিতার জোর বলতে তারা যদি সত্যের জোরকেই বুঝিয়ে থাকে, তাহলে আমি বলবো যে, আমি বাগ্মি। তবে তাদের মতো করে নয়। যাহোক, আমি যেমনটি বলেছিলাম যে, তারা একফোটাও সত্য কথা বলেনা। বরং আমার কাছ থেকে আপনারা যা শুনবেন তা সবই সত্য: তবে আমি তাদের মতো নানান শব্দ আর প্রবাদে অলংকৃত করে ভাষণ দিতে পারবো না। আমি শপথ করে বলছি, আমি খুব সহজ ভাষায় এই মুহূর্তে আমার মনে যা আসে তাই ব্যবহার করেই ভাষণ দেব। যেহেতু আমি আমার কার্যের ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে নিঃসংশয় (অথবা, আমি নিশ্চিত যে আমি সঠিক পথেই আছি ): আমার জীবনের এই সময়ে আমার উচিৎ ছিলোনা আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত হওয়া, তবে আমি যা বিশ্বাস করি আমি তাই বলবো, আপনারা আমার কাছ থেকে অন্য কিছু আশা করবেন না, হে পূর্বনির্ধারিত বক্তব্যসম্পন্ন শিশুসুলভ এথেন্সবাসী বক্তাগণ (বিচারকগণ)। এবং আমি আপনাদের কাছ থেকে একটি অনুগ্রহ প্রার্থনা করবোঃ আমি আমার অভ্যস্ত উপায়ে ভাষণ দিয়েই আত্মপক্ষ সমর্থন করবো, এবং আপনারা আমার কাছ থেকে সেইরকমই শুনবেন যেমনটি আমি জনসমাবেশে, পোদ্দারদের টেবিলে, অথবা অন্য যে কোন জায়গায় বলতে অভ্যস্ত। আমি আপনাদের অনুরোধ করবো বক্তৃতা চলাকালে বিস্মিত না হতে অথবা আমাকে বিরত না করতে। যেহেতু আমার বয়স সত্তর বছরের উপরে এবং ইতিপূর্বে আমি কখনো বিচারালয়ে উপস্থিত হইনি, তাই সঙ্গত কারণেই আমি আদালতের ভাষা জানিনা। তাই আমি চাই আপনারা আমাকে আদালতের একজন অনভিজ্ঞ ব্যক্তি হিসাবেই বিবেচনা করুন, এবং আপন শৈলীতে বক্তব্য রাখার জন্য আপনারা অবশ্যই আমাকে ক্ষমা করুন। এই দেশের রীতি অনুযায়ী — আমি কি কোন অন্যায় অনুরোধ করছি? বক্তৃতার পদ্ধতিটি ভালো বা মন্দ যাই হোক না কেন, সেটা নিয়ে বিচলিত হবেন না, কেবলমাত্র আমার কথার সত্যতা নিয়ে ভাবুন, এবং ঐদিকেই মনোনিবেশ করুন যে, বক্তা যেন সত্য বক্তব্য রাখে এবং বিচারক যেন ন্যায়বিচার করে।

প্রথমে, আমি উত্তর দেব আমার বিরুদ্ধে আনীত পুরাতন অভিযোগগুলোর ও অভিযোগকারীদের, তারপর ধীরে ধীরে উত্তর করবো পরবর্তিগুলোর। পুরাতন অভিযোগগুলোর ও অভিযোগকারীদের সংখ্যাও অনেক, যারা অনেকগুলো বছর ধরেই আপনাদের কাছে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করে আসছে। এদের আমি এনিটাস ও তাদের সহযোগীদের চাইতেও বেশি ভয় পাই, এরা ভীষণ বিপজ্জনক, কিন্তু পুরাতন অভিযোগকারীরা আরো বেশি ভয়ংকর, হে বিচারকগণ! এদের বেশিরভাগই আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে অবস্থান নিয়েছিলো সেই সময়ে, যখন আপনারা শিশু ছিলেন। তারা প্রচার করেছেন যে, ‘সক্রেটিস নামে একজন জ্ঞানী ব্যক্তি আছেন যিনি স্বর্গ সম্পর্কে অনুধ্যানী চিন্তা করেন ও মর্ত্যের গোপন বিষয় সম্পর্কে অনুসন্ধান করেন, এবং যা ভালো তাকে মন্দ বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন।’ এই কাহিনীর প্রচারকরাই হলো সেই অভিযোগকারীরা যাদেরকে আমি ভয়ংকর মনে করি, কেননা কাহিনীর শ্রোতারা মনে করে, যে ব্যক্তি এইসব গবেষণা করে সে দেব-দেবীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। এবং এই অভিযোগকারীদের সংখ্যা বিস্তর আর অভিযোগগুলোও অনেক পুরাতন। তারা এই সব উত্থাপন করেছে আপনাদের সেই বয়সে যখন আপনারা খুব সহজেই সব কিছু বিশ্বাস করতেন অর্থাৎ আপনাদের শিশুকালে, কেউ কেউ হয়তো তখন যুবা ছিলেন। কথাগুলো বলা হতো অভিযুক্তের অনুপস্থিতিতে, যাতে উত্তর দেয়ার কেউ না থাকে। আর সবচাইতে কঠিন হলো, অভিযোগকারীদের আমি চিনিও না, তাদের নামও জানিনা, কেবল হাস্যরসোদ্দীপক কবিতার কবি ছাড়া। সেই সব ব্যক্তিবর্গ যারা আপনাদেরকে আমার বিরুদ্ধে প্ররোচিত করেছে কেবলমাত্র দ্বেষ এবং আক্রোশ থেকে, অথবা এই কারণে যে, তাদের কেউ কেউ নিজেরাই অভিযুক্ত হয়েছিলো অন্যদের দ্বারা। এই শ্রেণীর লোকজনদের মোকাবেলা করা খুবই কঠিন, যেহেতু আমি তাদেরকে এখানে পাচ্ছিনা, তাই তাদেরকে জেরা করারও সুযোগ আমার নেই, এইভাবে আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য অনেকটাই ছায়ার সাথে লড়াই করতে হবে, এবং তর্ক করতে হবে তাদের সাথে যারা সম্পুর্নরূপে অনুপস্থিত। আমি আপনাদের অনুরোধ করবো, আমার সাথে একমত হতে যে, আমার দুই প্রকার অভিযোগকারী রয়েছে, এক সাম্প্রতিক অভিযোগকারীরা, দুই পুরাতন অভিযোগকারীরা, এ সম্পর্কে আমি আগেই আপনাদের বলেছিঃ এবং আশা করি আপনারা আমাকে অনুমতি দেবেন পুরাতন অভিযোগগুলোর উত্তর আগে দিতে, যেহেতু ঐ অভিযোগগুলোও পুর্ববর্তি ও অনেক বেশি, তারপর উত্তর দিবো সাম্প্রতিক অভিযোগগুলির।
ঠিকআছে, হে বিচারকগণ! এখন আমি আত্মপক্ষ সমর্থন শুরু করবো, এবং আমার বিরুদ্ধে প্রচারিত এতোকালের কুৎসা দূর করার চেষ্টা করবো। এই আত্মপক্ষ সমর্থনে আমি আমার সাফল্য কামনা করছি, যদি তাতে আমার ও আপনাদের সকলেরই মঙ্গল হয়। তবে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি যে, কাজটি খুব সহজ নয়; ইশ্বরের নামে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে, আমি আত্মপক্ষ সমর্থন শুরু করছি।

প্রথমে মনে করার চেষ্টা করি, কি সেই অভিযোগ যা আমার বিরূদ্ধে কুৎসা প্রচার করেছে, এবং মিলেটাসকে উৎসাহিত করেছে আমাকে অভিযুক্ত করতে। আচ্ছা, ঐ নিন্দুকরা কি নিন্দা ছড়িয়েছে? তারাই হবে আমার প্রসিকিউটরগণ, এবং আমি তাদের বক্তব্যের সারসংক্ষেপ তুলে ধরবো একটি হলফনামায়ঃ ‘সক্রেটিস একজন দুষ্ট লোক, যিনি স্বর্গ সম্পর্কে অনুধ্যানী চিন্তা করেন ও মর্ত্যের গোপন বিষয় সম্পর্কে অনুসন্ধান করেন, এবং যা ভালো তাকে মন্দ বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন। এবং তিনি উপরোক্ত ডকট্রাইনগুলো অন্যদের শিক্ষা দেন।’ এই তো হলো অভিযোগ: এটা হলো তা, যা আপনারা নিজেরাই দেখেছেন এরিস্টোফেনের কমেডিতে ((Aristoph., The Clouds), সেখানে তিনি একজন ব্যক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন যার নাম সক্রেটিস, চলতে ফিরতে তিনি বলেন যে, তিনি বাতাসে হাটেন, এবং কিছু হাবিজাবি বলেন ঐসব বিষয়ে যা সম্পর্কে আমি কম অথবা বেশি কোন কিছু জানারই ভান করিনা — ব্যাপারটা এমন না যে কোন ন্যাচারাল ফিলোসফি-র ছাত্রকে অমর্যাদা করে কিছু বলছি। এই ভেবে আমি দুঃখ ভারাক্রান্ত হই যে, আমার বিরূদ্ধে মিলেটাস এত গুরুতর অভিযোগও উত্থাপন করেছে! কিন্তু আমার সরল সত্য হলো, হে এথেন্সবাসী বিচারকগণ, এতে আমার কিছু যায় আসে না। তবে উপস্থিত অনেকেই এই বিষয়ের সত্যতার স্বাক্ষী, তাদের কাছে আমি আপীল করছি। এবার বলুন, আপনাদের মধ্যে থেকে যারা আমার কথা শুনেছেন, এবং আপনাদের প্রতিবেশীদেরকেও জিজ্ঞাসা করুন, কেউ কি আমাকে ঐ সব বিষয়ে একটিও কথা বলতে শুনেছে? এবং অভিযোগের এই অংশ বিষয়ে তাদের স্বাক্ষ্য থেকেই বাকিটুকু (অন্যান্য অভিযোগগুলো কতটুকু সত্য) বিচার করতে আপনারা সমর্থ হবেন।

আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এসেছে আমি একজন শিক্ষক ও জ্ঞান দানের বিনিময়ে আমি টাকা নিয়ে থাকি; অন্যান্য অভিযোগের মত এই অভিযোগটিও সত্য নয়। তথাপি কোন ব্যক্তি যদি বাস্তবিকই মানব জাতিকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার ক্ষমতা রাখতো এবং এর বিনিময়ে সে টাকা পেত, তবে আমি বলবো যে এটা তার জন্য সম্মানেরই হতো। যেমন লিওনতিয়ামের গর্গী, কেওসে-এর প্রোডিক এবং এলিয়াসের হিপ্পিয়াস নগরে নগরে ঘুরে বেড়ায় ও তরুণদের এমন ভাবে পটাতে পারে যে, ঐ তরুণরা নিজেদের নগরী ও সবকিছু ফেলে তাঁদের ছাত্র হয়ে যায় এবং এর বিনিময়ে তরুণরা তাদের অর্থ ও কৃতজ্ঞতা দুইই দিয়ে থাকে। আমি জেনেছি যে, বর্তমানে এথেন্সে একজন পারিয়ান দার্শনিক আছে, এবং তার সম্পর্কে এই শুনেছি যে — আমার একজনার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে যিনি সোফিস্টদের পিছনে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করেছেন, তার নাম কালিয়াস ইবনে হিপ্পোনিকাস, তারও আবার দুই ছেলে আছে, আমি তাকে বললাম যে, “কালিয়াস আপনার ছেলে দুইটি যদি অশ্বশাবক বা বাছুর হয়ে জন্মাতো, তাহলে তাদেরকে বড় করে তোলা তেমন কোন সমস্যাই হতো না, একজন ঘোড়ার ট্রেনার বা রাখাল পেলেই চলতো। কিন্তু যেহেতু তারা মনুষ্য প্রজাতির, সেই ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষা দান করে গড়ে তোলার জন্য কাকে আপনি দক্ষ বলে মনে করেন? এমন কেউ আছে কি যিনি মনুষ্য ও সামাজিক গুনাবলী বিষয়ে প্রচুর দখল রাখেন? আমি অনুমান করে বলতে পারি যে, আপনি আপনার সন্তানদের সম্পর্কে এই বিষয়ে ভেবে দেখেছেন। এখন প্রশ্ন হলো এমন কেউ আছেন কি?” তারপর তিনি উত্তর করলেন, “অবশ্যই আছেন?” আমি বললাম, “কে তিনি? তার দেশ কোথায়? এবং তিনি কত টাকা নেন?” কালিয়াস উত্তর দিলেন, “পারি-র এভেনাস। তিনিই সেই ব্যক্তি। এবং তিনি পাঁচ মিন নিয়ে থাকেন।” আমি নিজের মনে বললাম, “ভাগ্যবান এভেনাস! যদি সত্যিই তার প্রজ্ঞা থেকে থাকে এবং সে যদি এতো কমই নিয়ে থাকে। আমি যদি সেইরকম কেউ হতাম তাহলে আমি অহংকারী ও দাম্ভিক হতাম। কিন্তু সত্য হলো এই যে, সেরকম কোন জ্ঞান আমার নেই।”

(চলবে)

৫৫৭ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “সক্রেটিসের এ্যাপোলজি – ১”

মওন্তব্য করুন : ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।