বিষন্ন বিরিওজা – ১

বিষন্ন বিরিওজা – ১
———————– ডঃ রমিত আজাদ

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, আমার কি হয়েছে। আমার কি ঘুম ভেঙেছে, নাকি আমি ঘুমিয়েই আছি? আমার মনে হলো আমি আধো ঘুম আধো জাগ্রত একটা অবস্থার মধ্যে আছি। আমার চোখ কি খোলা? ঠিক তা বুঝতে পারলাম না। আমার মনে হলো আমার চোখ আধো বন্ধ, আধো খোলা। একটু পরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো আমার। একটা মেয়ের হাত আমার মুখের উপর। আমার কপালটা স্পর্শ করবে করবে এমন। আমি একটু ভালোভাবে চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সেটা করতে পারলাম না। চোখ কিছুতেই পুরোপুরি খুলতে পারছিনা। হাতটি আমার মুখের উপর থেকে সরে গেল। আমি ভাবলাম এবার উঠে বসব। কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। যেমন ছিলাম তেমনি শুয়ে আছি। একটু পর আবার হাতটি ফিরে এলো। আবারো আমার কপাল স্পর্শ করবে করবে এমন। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে, পাশ ফিরতে চাইলাম, তাহলে মেয়েটির পুরো শরীরটা দেখতে পাবো। নাহ্, আবারো কিছুই করতে পারছি না। কি অদ্ভুত! এমন হচ্ছে কেন?

যখন ঘুম পুরোপুরি ভাঙল তখন সকাল নয়টা বাজে। আমি একেবারে ঝরঝরে তরতাজা। ঘুমের মধ্যে কোন সমস্যা হয়েছে এমন অনুভূতিই শরীরে নেই। বিশাল কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। গ্রীস্মের ঝকঝকে দিন। এই প্রচন্ড ঠান্ডা দেশের গ্রীস্মের দিনগুলি অদ্ভুত সুন্দর হয়। এমনই একটি সুন্দর আগস্ট মাসের দিন। বিছানায় উঠে বসলাম। স্মৃতিতে আবার ফিরে এলো ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক ঘটনাটি। কি ঘটেছিল? ঠান্ডা মাথায় পুরো ঘটনাটি মনে করার চেষ্টা করলাম। সব কিছুই স্পষ্ট মনে করতে পারলাম। কিন্তু তারপরেও বুঝতে পারলাম না, এটা স্বপ্ন ছিল কিনা। আমার মন বলছে এটা স্বপ্ন নয়। আমি খুব বেশী স্বপ্ন দেখি, স্বপ্নহীন রাত আমার জীবনে ছিল মাত্র একবার। স্বপ্নের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার সাথে আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনার কোন মিল নেই। কার সাথে ডিসকাস করব এই বিষয়? সেই মুহূর্তে পাশে কেউ ছিলও না। ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস্ ডরমিটরির ঐ রূমটিতে আমি একাই থাকি।

বাংলাদেশী কারো সাথে ডিসকাস করার সুযোগ এই হোস্টেলে নেই। কারণ এখানে আমি একাই বাংলাদেশী । আমার হোস্টেলটি যেই এলাকায় তার নাম আতাকারা ইয়ারোশা স্ট্রীট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত এক চেক সৈন্যের নাম আতাকার ইয়ারোশ, তারই সম্মানে স্ট্রীটটির নাম। এটি মূলতঃ একটি স্টুডেন্টস টাউন। স্ট্রীটের দুপাশে ছোট-বড় নানা সাইজের হোস্টেল। ইউক্রেনের পুরাতন রাজধানী খারকভে এত বেশী ইউনিভার্সিটি, ইনস্টিটিউট রয়েছে যে এটাকে ছাত্রছাত্রীদের শহর বলা হয়। আমার হোস্টেলে না থাকলেও আশেপাশের বিভিন্ন হোস্টেলে দু’চারজন করে বাংলাদেশী রয়েছে। তাদের কারো সাথে গিয়ে ডিসকাস করা যেতে পারে।

যাকগে, আপাততঃ বাদ দেই। এত সুন্দর উষ্ণ রৌদ্রজ্জ্বল দিন। তার উপর ভ্যাকেশন চলছে। এত সুন্দর দিনটা মাটি করার দরকার নেই। হাতমুখ ধুয়ে, ব্ল্যাক কফি, অমলেট আর টোস্ট দিয়ে একটা চমৎকার ব্রেকফাস্ট সারলাম। এখন কি করা যায়? ঘরে বসে থাকব না অবশ্যই। সামারে ঘরে বসে থাকার মত বেরসিক আমি নই। বাইরে বের হতে হবে। জিনসের প্যান্টের সাথে মানানসই হালকা নীল রঙের একটা টি শার্ট পড়লাম। তারপর রূমে তালা দিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম বাইরে।

খারকভ শহরটি মস্কো বা কিয়েভ-এর তুলনায় সুন্দর না হলেও, ঢাকা বা দিল্লির তুলনায় অনেক অনেক সুন্দর। প্রতিটি রাস্তাই ম্যাকাডাম সড়ক। অর্থাৎ পিচ ঢালা গাড়ী চলার রা্স্তার দুপাশে চওড়া ফুটপাত। ফুটপাতের দুপাশে দুই সারি করে রাস্তার এপাশে ওপাশে চার সারিতে গাছ।বাংলাদেশ গাছের দেশ হওয়ার পরও শহরগুলো বৃক্ষহীন রুক্ষ, একেবারেই নেড়া। আর এখানে অল্প কিছু ভ্যারাইটির গাছ নিয়েই শহরগুলোকে ওরা করে তুলেছে গাছে গাছে ভরপুর। তবে এই গাছের সৌন্দর্য্য সারা বছর দেখার সুযোগ নেই। শীতমন্ডলীয় জলবায়ুর কারণে, বছরে প্রায় ছয়মাসই গাছগুলো থাকে পাতাশূণ্য। চিত্রকরদের আঁকা পত্রপল্লবহীন বৃক্ষরাজী যেমনটি আঁকা থাকে ক্যানভাসে ঠিক তেমনটিই এখানে বাস্তবে দেখা যায়। আর বাকী ছয়মাস উজ্জ্বল সবুজ পাতায় পাতায় ছেয়ে থাকা গাছগুলো ঢেকে ফেলে সমস্ত পথঘাট।

বরফ ঢাকা তুহীন শীতের পর এমন পত্রপল্লবের মায়া আর মৃদু মৃদু উষ্ণ হাওয়ার পরশ মনটাকে সারাক্ষণ ফুরফুরে রাখে। এটা ঘরে বসে থাকার সময় নয়, তাই ছেলে-বুড়ো, তরুণ-তরুনী সবাই বেরিয়ে আসে বাইরে। আমাদের তরুণদের এই সময়ের আরেকটি আকর্ষণ হলো, সংক্ষিপ্ত পোষাকের তরুনীরা। শীতকালে যে তাদের সংক্ষিপ্ত পোষাকে দেখা যায়না তা নয়, তবে সেটা ঘরের ভিতরে। আর সামারে বাইরেই দেখা যায় মিনি স্কার্ট, শর্টস ইত্যাদি পরিহিতা তরুনীদের। পুরুষ মানুষের নারীকায়ার প্রতি আকর্ষণ অস্বাভাবিক কিছু নয়। গ্রীস্মের ঘন সবুজ বৃক্ষরাজী, ফলের শোভা ও উষ্ণ হাওয়ার পাশাপাশি এটাও বেশ উপভোগ করি।
উদ্দেশ্যহীনভাবে কতক্ষণ ঘোরাঘুরি করে তারপর ক্যাফেতে ঢুকে এক কাপ কফি খেলাম। তারপর ভাবলাম কোথাও যাওয়া দরকার। কোথায় যাই? সকালের ঘটনাটি কারো সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছে করছিল। শেষমেষ ঠিক করলাম নীলিমার কাছে যাব।

নীলিমা থাকে শহরের ভিতরেই আরেকটি স্টুডেন্টস টাউনে। আতাকারা ইয়ারোশা থেকে দশ-বারো কিলোমিটার দূরে হবে। জায়গাটির নাম ‘ৎেসলিনা গ্রাদস্কায়া’। ও পড়ে খারকভ স্টেট মেডিকেল ইনস্টিটিউশনে। উঠে গেলাম একটি ট্রলিবাসে। সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভালো। ট্রান্সপোর্টের জন্য কখনো কাউকে কোন কষ্ট করতে হয়না। নানা ধরনের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট আছে। বাস, ট্রলিবাস, ট্রাম, মেট্রো ইত্যাদি ট্রান্সপোর্ট খুব ভালো সার্ভিস দেয়। তাও সামান্য খড়চায়। প্রথম দিকে তিন রুবলের একটা মান্থলি কার্ড কিনে নিলেই মাটির উপরের সব পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যাভার করা যেত। আর আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোসহ হলে পাঁচ রুবলের মত লাগত। এই রেট চলেছে বহু বছর। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর ভাড়া কিছুট বৃদ্ধি পেয়েছে সত্য, তারপরেও তেমন কিছু নয়। আর স্টুডেন্ট হিসাবে ৫০% ডিসকাউন্ট তো আছেই। মাসের শুরুতে একটা মান্থলি কার্ড কিনে নেই, তারপর সারা মাস যেখানে খুশী যাই। সালাম এই বিষয়ে পলিসি মেকারদের।

চলতে চলতে বেশ কয়েকটি স্টপেজ পার হয়ে টুয়েন্টি থার্ড অগাস্ট পার হয়ে দুটা রেসিডেন্সিয়াল এরিয়াকে কানেকটিং দুই লেনের একটি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল ট্রলিবাসটি। এখানে রাস্তার দুইধারে ফরেস্ট পার্ক । সেখানে সারি সারি লাগানো আছে, বিরিওজা গাছ। এই গাছটি ইউক্রেন, রাশিয়াতে খুব কমন। ঐ ফরেস্ট পার্ক এরিয়া পেরিয়ে অবশেষে ‘ৎেসলিনা গ্রাদস্কায়া’ স্টপেজে এসে থামলো। আরো কয়েকজনের সাথে আমইও সেখানে নেমে পড়লাম। কিছু খোলা জায়গা পেরিয়ে মেডিকেল ইনস্টিটিউটের ১০ নং হোস্টেলটিতে এসে পৌছুলাম। হোস্টেলের গেটে একজন বসে থাকে, রুশ ভাষায় তাকে ভাখতিওর বলে। সে কর্কশ গলায় বলল, ” তোমার স্টুডেন্ট আইডি কার্ডটা রেখে যাও”। এই দেশে এই একটা সমস্যা সমাজতন্ত্রের কল্যাণে বুরোক্রেসি এত হাই লেভেলে আছে যে, কেউ সামান্য একটু ক্ষমতা পএলএই সেটা শো না করে ছাড়েনা। ওর কাছে কার্ডটি রেখে, উপরে উঠে গেলাম। এখানকার বিল্ডিং কোড অনুযায়ী দালান পাঁচ তলার উপরে হলেই, লিফট রাখতে হবে। এই হোস্টেলটি সাত তলা। নীলিমা থাকে ছয় তলায়। আমি লিফট পারতপক্ষে কম ব্যবহার করার চেস্টা করি। আমি যখন ল্যংগুয়েজ কোর্সে ছিলাম, তখন একটি লিফট্ দুর্ঘটনায় ফাদেল নামে আমার সিরিয়ান এক বন্ধু মারা গিয়েছিল। ও ছিল বারো তলায়। লিফটের ভিতরে ওর সুটকেসটি ঢোকানোর পরপরই লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ও তখন দরজা খোলার সুইচে বারংবার চাপ দিতে থাকে, এক পর্যায়ে দরজা খুলে যায়। ফাদেল নিশ্চিন্ত মনে লিফটে পা রাখে। আসলে লিফট তখন আর সেখানে ছিলনা। লিফট চলে গিয়েছিল উপরে। ম্যালফাংশন হয়ে লিফটের দরজা খুলে গিয়েছিল। পা দেয়ার সাথে সাথে ফাদেল বারো তলা থেকে নীচে পড়ে যায়। হাসপাতালে নিতে নিতেই ও মৃত্যুবরণ করে। ঘটনাটি আমার মনে গভীর দাগ কেটেছে। সেই থেকে আমি খুব সাবধানে লিফট ব্যবহার করি।

হেটে হেটে আমি ছয়তলায় উঠে গেলাম। ৬১০ নং রূমের সামনে এসে একটু সময় নিলাম। নীলিমা রূমে নাও থাকতে পারে। যদিও এখন ভ্যাকেশন চলছে, কিন্তু আমারই মতো হয়তো সামারের সুন্দর আবহাওয়া উপভোগ করতে বাইরে গিয়েছে। আবার রূমে থাকলেও, বয়ফ্রেন্ড নিয়ে বিজিও থাকতে পারে। নীলিমা কোলকাতার মেয়ে। ভারতীয় বাঙালী মেয়ে। অবশ্য ওকে দেখলে চট করে বোঝা যায়না যে, ও বাঙালী। ও শরীরে বড়সড়। গায়ের রং একটু বেশীই কালো। আবার ভারতীয় পোষাকেও ওকে আমি কখনো দেখিনি। প্যান্ট-শার্ট, স্কার্ট-টপস এই জাতীয় ইউরোপীয় বা আধুনিক পোষাক ব্যবহার করে। অনেকে ওকে আফ্রিকান বলে ভুল করে। এদিকে ওর বয়ফ্রেন্ডও আফ্রিকান। ওকে নিয়ে ভারতীয় কম্যুনিটিতে বদনামের অন্ত নেইঃ “মেয়েটার কোন কান্ডজ্ঞান নেই, শেষ পর্যন্ত একটা কালুর সাথে লাইন করল! শুধু কি লাইন? রীতিমত লীভ টুগেদার করে! না ভারতীয় মেয়েদের মান সম্মান আর কিছু রাখলো না!” নীলিমা অবশ্য পাল্টা কথা বলে, ” আহারে আমার ইন্ডিয়ান ছেলেরা! নিজেরা যে গন্ডায় গন্ডায় সাদা মেয়েদের সাথে রাত কাটাচ্ছ, লীভ টুগেদার করছ ওটা কিছু না! আর একটা ইন্ডিয়ান মেয়ে একটা আফ্রিকান ছেলের সাথে কিছু করলেই মান গেল? ওরা যদি লাইফ এনজয় করতে পারে, আমি পারব না?”

নীলিমা আমার ব্যাচমেইট। সেকেন্ড ইয়ার থেকেই ওর সাথে আমার পরিচয়। তখন থেকেই ভালো সম্পর্ক। আমি মাঝে মাঝে ওর রূমে যাই, ওও আমার রূমে আসে। কখনো একা, কখনো বয়ফ্রেন্ড নিয়ে। আমি ওর রূমের সামনে দাঁড়িয়ে ওর রূমের ভিতর গানের শব্দ শুনতে পেলাম। একটু কান খাড়া করলাম। মান্না দে’র গান বাজছে, ‘চাইনা পূণ্য করে স্বর্গে যেতে, ঐ স্বর্গকে ধরে ফেলি হাতের মুঠোয়, যদি একবার হাতখানি রাখো এহাতে’। বুঝলাম রূমে আছে। দরজায় মৃদু নক করলাম। দ্বিতীয়বার নক করার আগে একটু সময় নিলাম। তারপর আবার নক করলাম। সাথে সাথে দরজা খুলল নীলিমা।
নীলিমাঃ রিমন! আমি জানতাম এটা তুমি।
আমিঃ কি করে বুঝলে।
নীলিমাঃ তোমাকে কি আমি আজ প্রথম দেখলাম? এতগুলো বছর ধরে তোমাকে চিনি। তুমিই একমাত্র ছেলে যে প্রথমবার নক করে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে, দ্বিতীয়বার নক কর। অন্য ছেলেরা পরপর শুধু নক করতেই থাকে // এসো ভিতরে এসো।
ভিতরে ঢুকে একটা সোফা কাম বেডে বসলাম। এখানকার ডরমিটরিতে এই ফার্নিচারটি কমন। দিনের বেলা এটি গুটিয়ে রূমটিকে ড্রইংরুমের মত সাজিয়ে রাখা হয়, আবার রাতে খুলে বেড বানিয়ে ঘুমানো হয়।
আমিঃ তারপর, বংফিম কোথায়?
নীলিমাঃ নাই।
আমিঃ নাই মানে? (মনে মনে ভাবলাম, আবার ওদের কাট আপ হয়ে গেল কিনা)
নীলিমাঃ নাই, মানে নাই। এ্যংগোলা গিয়েছে। সামার ভ্যাকেশন কাটাতে।
আমিঃ ও আচ্ছা। তাই বুঝি বসে বসে বাংলা গান শোনা হচ্ছে?
নীলিমাঃ না না। বাংলা গান তো আমি ও থাকতেও শুনি। তোর খবর কি বল?
আমিঃ উঁ, খবর খারাপ না। ভালোই। তুই দেশে যাবিনা, ছুটি কাটাতে?
নীলিমাঃ নারে, এবছর যাওয়া হবেনা। টিকিটের দাম খুব বেড়েছে। তুই যাবি?
আমিঃ না আমিও ঐ একই কারণে যেতে পারছি না।
নীলিমাঃ কি যে হলো, এই ইকোনমিক ক্রাইসিসে। ভীষণ অর্থনৈতিক সমস্যা।
আমিঃ বংফিম তো ঠিকই যাচ্ছে!
নীলিমাঃ আরে ও তো আর বাপের টাকায় যায়না। ওরা এ্যংগোলিয়ানরা, সরকারের কাছ থেকে মোটা অংকের স্টাইপেন্ড পা্য। তাতেই রাজার হালে আছে।
আমিঃ বেশ ভালো দেশ তো!
নীলিমাঃ বলতে পারিস। আমাদের মতো না। দেশের ছাত্রছাত্রীদের কোন মাথাব্যাথা নেই।
আমিঃ এংগোলার প্রেসিডেন্টতো রাশিয়াতে পড়ালেখা করেছিল।
নীলিমাঃ জানি। সেই কারণেই হয়তো সিমপ্যাথিটা বেশি। দাঁড়া, চা করি। না কি কফি খাবি।

আমিঃ চা/কফি যে কোন একটা কিছু হলেই হবে। তা চায়ের সাথে কি টা থাকবে? না কি কোলকাতা স্টাইলে বলবি, “দাদা কি খেয়ে এসেছেন না কি গিয়ে খাবেন?”
একগাল হাসলো নীলিমা,
নীলিমাঃ ফাজলামো রাখ। সবাই একরকম না। আর তুই তো জানিস, আমরা চিটাগাং থেকে মাইগ্রেট করা। ইস্ট বেঙ্গলীরা কন্জুস হয়না।
আমিঃ তুই তো আর মাইগ্রেট করিস নি। তোর দাদা করেছিল। তোর জন্ম তো কন্জুসের দেশেই।
নীলিমাঃ তা হলেও, ফ্যামিলি ট্রেডিশন থেকেই যায়। আমাকে কখনো কন্জুসামী করতে দেখেছিস?
আমিঃ না, তা দেখিনি। বরাবরই উদার। তা আজকে কি উদারতা। দেখাবি বল।
নীলিমাঃ এই নে বিস্কিট। খুব টেস্টি। নারকেল মেশানো আছে।
আমিঃ বাহ! দে খাই।
চা খেতে খেতে প্রশ্ন করল নীলিমা।
নীলিমাঃ শ্তো নোভিন্কা (নতুন কি আছে)?
আমিঃ কি নতুন চাস?
নীলিমাঃ তোর তো কোনকালে কোন গার্ল ফ্রেন্ড ছিল না। হঠাৎ গার্ল ফ্রেন্ড যদি হয়, সেটা নতুন কিছু হতে পারে।
আমিঃ না সেরকম নতুন কিছু নাই। তবে একটা আশ্চর্য্য নতুন বিষয় আছে।
নীলিমাঃ আশ্চর্য্য নতুন বিষয়! কি সেটা?

আমি সকালের পুরো ঘটনাটা ওকে খুলে বললাম। শুনে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে রইলো নীলিমা। তারপর ধীরে ধীরে বলল
নীলিমাঃ আমরা মেডিকেলের সিনিয়র কোর্সের ছাত্রী। আর দুয়েক বৎসর পরেই ডাক্তার হয়ে যাব। বিষয়টাকে মেডিকেল পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখলেই ভালো হয়। তারপরেও আমার কাছে অন্যরকমই মনে হচ্ছে। তোকে কয়েকটা প্রশ্ন করি।
আমিঃ কর।
নীলিমাঃ তুই ক’দিন হলো ঐ রূমে এসেছিস?
আমিঃ আরে নতুন। এই ভ্যাকেশনেই।
নীলিমাঃ এর আগে তোর কখনো এরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল?
আমিঃ না।
নীলিমাঃ তুই একটু খোঁজ নে তো। ঐ রূমে আগে কারা কারা ছিল। যারা ছিল তাদের ওরকম কোন অভিজ্ঞতা আছে কিনা।রূমটাও একটু ভালো করে চেক করে দেখিস।

আমার ডরমিটরিতে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। ফ্রীজ থেকে খাবার বের করে গরম করে নিয়ে খেতে খেতে টিভি সেটটা অন করলাম। প্রাইভেট চ্যানেলে একটা ম্যুভি চলছিল, ‘মিস্তিকা’ – রহস্যরোমাঞ্চ। হঠাৎ নীলিমার কথা মনে হলো – ‘রূমটাও একটু ভালো করে চেক করে দেখিস’। খাওয়া শেষ করে আমি একটু ভালো করে রূমটা দেখতে লাগলাম। রূমে শিফট হওয়ার সময় তো একেবারেই খালি ছিল। তেমন কোন কিছু তো থাকার কথা নয়। হঠাৎ দেয়ালে চোখ পড়ল। জানালার দিকে মুখ করে তাকালে ডান পাশের দেয়ালে ওয়াল পেপার হালকা ক্রীম কালারের উপর কালো আর মেরুন কালারের প্রিন্টের উপর কিছু একটা দেখলাম। ভালো করে দেখার জন্য কাছে এগিয়ে গেলাম। একটা ম্যাচের কাঠি, গাম দিয়ে ওয়াল পেপারে লগানো। ম্যাচের কাঠির রং আর ওয়াল পেপারের মূল রং একই রকম হওয়ায় চট করে চোখে পড়েনা। ম্যাচের কাঠিটার সাথে কি যেন। চোখ খুব কাছে নিয়ে দেখলাম একটা মেয়ের চুল কাঠিটা থেকে নীচের দিকে ঝুলছে। ওয়াল পেপার আর ম্যাচের কাঠির মাঝখানে চুলটা রেখে গাম দিয়ে লাগানো হয়েছে। চুলের রং দেখে বোঝা যাচ্ছে মেয়েটি স্বর্ণকেশিনী।

(চলবে)

৭৭৯ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “বিষন্ন বিরিওজা – ১”

মওন্তব্য করুন : ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।