লিস্টনিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ ১১

 

লিস্টনিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ ১১

রমিত আজাদ

Listening to the Wind of Change

 

রমনার সবুজ বুকে দাঁড়িয়ে চারদিকটাকে ছবির মত সুন্দর মনে হলো হঠাৎ। পায়ের নীচে ঘন সবুজ ঘাঁসে ছাওয়া তেপান্তর, ছোট-বড় হরেক রকমের সবুজ গাছে আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া চতুর্দিক, তাদের কোন কোনটাতে ভাবী সন্তানের আগমনের ইঙ্গিত, অর্থাৎ ফুটে আছে মন কাড়া সব নানা রঙের ফুলের শোভা, সন্তান বরণ করবার জন্যেই বোধহয় ওগুলোর গোড়ায় জন্মানো সবুজ ঘাঁসের ওপর আল্পনা এঁকেছে ঝরা ফুলের পাঁপড়ি। আর মাথার উপরে উদাসী আকাশটি যেন নীল চাদোয়া, তার ঠিক মাঝখানটাতে একেবারে মাথার উপরেই গনগন করছে মাঝ দুপুরের ঝকঝকে সূর্যটা, এই অপরূপ শোভার মাঝে সদ্য কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্য প্রাপ্ত আমরা চারজন নিজেদেরকেই মনে করলাম শিল্পির তুলিতে আঁকা ছবি যেন।

 

যে বড় গাঁছটির নীচে আমরা বসে ছিলাম, সেটিতেও ফুটে আছে  অদ্ভুত একটি ফুল। বেশ মিষ্টি একটা গন্ধ এবং দেখতেও বেশ সুন্দর। ফুলের লাল পাপড়ীর মধ্যেখানে নাগ বা সাপের মতো ফণা তুলে আছে হালকা গোলাপী হলুদে মিশ্র রং এর পুং কেশরের একগুচ্ছ ক্ষুদে পাপড়ী। ফুলটির প্রতি আমি দারুন ভাবে আকৃষ্ট হই।  আকারে যেমন বড়, রূপে তেমনি নয়নাভিরাম, সৌরভে মনোহরা।  শহরের ভিতর এমন গাছ সচরাচর চোখে পড়েনা। কি নাম গাছটার? বোঝার চেষ্টা করলাম। বুঝতে হলোনা, গাছটির গায়েই নাম লেখা আছে, ‘নাগলিঙ্গম’। এখন বুঝতে পারলাম, এর অপর নাম ‘নাগকেশর’। নামটা আমার খুব ভালো লাগে। নাগলিঙ্গম নামটি তামিল নাম এর বাংলা নামটিই নাগকেশর এই কিছুদিন আগেই আমাদের পারিবারিক পাঠাগারে একটি উপন্যাস পড়েছি, ‘নাগকেশরের দিনগুলি’। নামটি মোহনীয়, খুলে পড়লাম, ভালো লাগলো। রোমান্টিকতা ও সামান্য যৌনতার ছোঁয়া আছে এমন কাহিনী। আমার এই বয়সে যেমন ভালো লাগে, আরকি। এর ফল দেখতে কামানের গোলার মতো। সে কারণেই ইংরেজিতে এর নাম ক্যাননবল। নাগলিঙ্গমের আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণ অঞ্চলে। বৈজ্ঞানিক নাম Couroupita guianensis। নাগলিঙ্গম আমাদের দেশে বেশ দুর্লভ। এখানে এর নাগলিঙ্গম নাম হয়েছিল সাপের ফণার মতো বাঁকানো পরাগচক্রের কারণে। নাগকেশরের ফল আমাজান বনের সামান জনগোষ্ঠীর এটি একটি প্রিয় খাবার । এর ফুল, পাতা এবং বাকলের নির্যাস ঔষধ হিসেবে বহুল প্রচলিত। এটি এনটিবায়েটিক, এনটিফাঙ্গাল এবং এনটিসেপটিক হিসেবে অনেকে ব্যবহার করে থাকেন। পেটের পীড়া দূরীকরণে এর ভূমিকা ব্যাপক। পাতা থেকে উৎপন্ন জুস ত্বকের সমস্যা দূরীকরণে খুবই কার্যকর। দক্ষিণ আমেরিকার সামানরা এর পাতা ম্যালেরিয়া রোগ নিরাময়ে ব্যবহার করে থাকে। বহুল গুণ সম্পূর্ণ এই উদ্ভিদের সংখ্যা এখন পৃথিবীতে খুবই কম।
উজ্জ্বল গোলাপি রঙের ফুল। পাপড়ি ছয়টি। বসন্তে যেমন শিমুল গাছতলা ঝরা ফুলে ভরে থাকে, নাগলিঙ্গমের তলাও তেমনি এর অজস্র পাপড়িতে ছেয়ে থাকে। প্রকাণ্ড বৃক্ষ। পাতা লম্বা, ডগা সুচালো। শাখার সঙ্গে প্রায় লেগে থাকে। নাগকেশরের সৌন্দর্য্যে এতটাই মুগ্ধ হলাম যে, মনে হলো, উজ্জ্বলতায় তরুরাজ্যে অনন্য নাগলিঙ্গম ছাড়া বড় কোনো বাগান পরিপূর্ণ হয় না  সেই নাগকেশর গাছের নীচেই দাঁড়িয়ে আছি।

 

 

 

 

ঃ খুব সুন্দর গাছটা! তাইনা (আমীন বলল)

ঃ ফুলগুলো কি অদ্ভুত! (বলল মোস্তাহিদ)

ঃ আগে কখনো দেখিনি (ইমতিয়াজ বলল)

ঃ দেখার কথা না। এটা বিরল প্রজাতির গাছ। যতদূর জানি সারা শহরে খুব কমই আছে। (বললাম আমি)

ঃ সুন্দর গাছ দেখলে মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। (বলল ইমতিয়াজ) তোমাদের ঢাকা শহরে গাছ খুব একটা নেই। আমরা ময়মনসিংহে কিছু বেশি গাছ দেখি।

ঃ এরকম ছিলা না কিন্তু। (আমি বললাম) এক সময় ঢাকাতে অনেক গাছ ছিল। মানুষের বাড়িতে তো অবশ্যই, তার পাশাপাশি, মূল শহরেও গাছের কমতি ছিলনা। এই যে কাছের রাস্তাটি যার নাম এখন কাজী নজরুল ইসলাম এ্যাভিনিউ। এর মাঝখান দিয়ে ছিল চওড়া আইল্যান্ড, পুরো আইল্যান্ড জুড়ে ছিল সারি সারি কৃষ্ণচূড়া। মৌচাক থেকে রামপুরা পর্যন্ত রাস্তাটিও একই রকম ছিল। শেরাটন হোটেলের হোটেলের সামনেও ছিল কৃষ্ণচূড়ার সারি। সারা শহরে এত বেশী কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল যে এটাকে মাঝে মাঝে কৃষ্ণচূড়ার শহর বলা হতো।

ঃ এত এত গাছ সব গেল কোথায়? (প্রশ্ন করল ইমতিয়াজ)

ঃ এই শেরাটনের সামনে একটা বিশাল বড় গাছ ছিল না? আমার মনে আছে। কি হলো পরে গাছটার? (প্রশ্ন করল আমীন)

 

ঃ হ্যাঁ, ছিল। (একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি)। সেটাই বলতে চাচ্ছিলাম আমি। গাছগুলো কাটা হয় ‘৭৮-‘৭৯ সালের দিকে।

ঃ কিন্তু কেন?

ঃ ঢাকা শহরে জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল। রাস্তা চওড়া করার প্রয়োজন পড়ল। তাই আইল্যান্ড তুলে দিয়ে  রাস্তাগুলো চওড়া করা হয়। সবুজ ঘাসের জায়গা দখল করে নিল, কালো পিচ।

ঃ এটা কি অন্য কোনভাবে করা যেত না? সিটি এক্সপানশন কি কেবল উর্ধ্বমূখী করতে হবে?

ঃ জানিনা, যারা করে তারা বলতে পারবে।

ঃ আর শেরাটনের সামনের গাছটি? ওটা কেটে তো রাস্তা চওড়া করা হয়নি, ওটার কি দোষ ছিল?

ঃ আসলে রাস্তা চওড়া করা একমাত্র কারণ নয়। আব্বা বলেছে প্রচ্ছন্ন আরো একটি কারণ ছিল।

ঃ কি সেটা?

ঃ সেই সময়ে কম্যুনিস্ট সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। এরা উঁচু গাছের উপরে বসে থাকত। ডানপন্থী শাসকদের গাড়িবহরে ঢিল মারত। কখনো সখনো অস্ত্র নিয়েও বসে থাকত। পরিস্থিতি ভয়ংকরই ছিল বলা যেতে পারে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই অনেক স্ট্রাটেজিক জায়গায় গাছ কাটতে হয়েছে। শেরাটনের সামনে, কোনার দিকে, ঐ তিন রাস্তার মোড় যেখানে এখন একটি প্রপাত টাইপের ফোয়ারা দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে ছিল ঐ বিশাল গাছটি। পুরো মোড়টি ঢেকে রাখতো তার বিশাল গাছপালা, বিদেশীরা তো নিঃসন্দেহে আমরা বাংলাদেশীরাও ঐ গাছটির বিশালত্ব দেখে মুগ্ধ হতাম। সেই গাছটি হঠাৎ কাটা শুরু হলো। প্রকৃতি প্রেমিকরা অনেক প্রতিবাদ করেছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র মন কাড়া একটা কবিতাও লিখেছিল ঐ গাছটি নিয়ে। কিন্তু কোন কাজ হয়নি।

শেষ পর্যন্ত গাছটি কাটাই হয়েছিল। গাছটি বিশাল বলে কাটতে কয়েকদিন সময় লেগেছিল। আমার বুকে ঘটনাটি ক্ষত সৃষ্টি করেছে কারণ গাছটি কাটার দিন আমি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোন এক কারণে আব্বা ঐ দিন ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিল, আমি আব্বার সাথে ছিলাম। গাছ কাটা দেখে আব্বা সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমরা দু’জন অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিকে হত্যা করার ঐ দুঃখজনক ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিলাম।

ঃ কি নাম ছিল গাছটির?

ঃ নাগকেশর।

 

 

এই দুঃখজনক ঘটনা শুনে সবই বিমর্ষ হয়ে গেল।

ঃ নাঃ! মনটাই খারাপ হয়ে গেল। (বলল মোস্তাহিদ)

ঃ তোদের মন ভালো করে দেই? (বলল আমীন)

ঃ কি করে? (বলল মোস্তাহিদ)

ঃ ঐ দেখ।

একটু সামনেই দুপাশে ঝাউ গাছের শোভা নিয়ে ঢালাই করা পার্কের পথ। ভর দুপুর বলে প্রায় খালি। হঠাৎ সেই পথ ধরে হেটে আসতে দেখলাম এক অপরূপা তরুণীকে।

সবাই এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। হলুদ রঙের ফ্যশনেবল সালোয়ার কামিস পড়া। এরকম সালোয়ার-কামিসের ডিজাইন আজকাল হিন্দী ফিল্মগুলোতে দেখা যায় বোম্বের নায়িকাদের পড়নে। মেয়েটির পায়ে বাহারি পেন্সিল হিল। কাট কাট শব্দ তুলে হেটে যাচ্ছে। এই কাট কাট শব্দ শুনলে যে কোন পুরুষেরই দৃষ্টি ঐ দিকে চলে যায়। আশেপাশের বাতাসে ঢেউ তুলে মেয়েটি উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গেল। খুব সম্ভবতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকেই গেল। ওখানকার ছাত্রী হবে হয়তো। যতক্ষণ মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছিল, আমরা দেখছিলাম, দূরে মেয়েটির মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত।

 

চাপা কৌতুকে চিকচিক করছে আমীনের চোখ।

ঃ তোদের একটা কৌতুক বলি? (বলল আমীন)

ঃ বল (বলল মোস্তাহিদ)

ঃ একবার সাদা জোব্বা পরিহিত, টুপি মাথায় তিন মোল্লা যাচ্ছে পথ দিয়ে, প্রথম জনের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, দ্বিতীয় জনার বয়স চল্লিশোর্ধ, আর তৃতীয় জন একেবারেই তরূণ বছর বিশেক বয়স। হঠাৎ অপরূপা এক অষ্টাদশী তরুণী গেল তাদের সামনে দিয়ে। তার রূপ সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে প্রথম মোল্লা বলল, “মাশাল্লাহ, মাশাল্লাহ”, দ্বিতীয় মোল্লা বলল, “সোবাহানাল্লাহ, সোবাহানাল্লাহ”, আর তরুণ মোল্লাটি বলল, “ইনশল্লাহ, ইনশল্লাহ”।

সবাই হেসে উঠলাম।

ঃ উহ্‌, খালি খালি মোল্লাদের বদনাম না? (ক্ষেপে গেল মোস্তাহিদ)

ঃ আহা এটা একটা কৌতুক মাত্র, তুই সিরিয়াসলি নিচ্ছিস কেন? (বলল ইমতিয়াজ)

ঃ খালি খালি না, তোদের মোল্লারা সব ঐ কিসিমেরই। (ঘাঁড় বাকিয়ে বলল আমীন)

ঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ শুধু মোল্লাদের দোষ। আর আমরা? আমরা কি মেয়েটার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকিনি?

ঃ তা তো তাকিয়েছিই। (একটু দমে গিয়ে বলল আমীন)

ঃ তাহলে?

ঃ আরে এটা বয়সের দোষ। (বলল ইমতিয়াজ)

ঃ না, বয়সের গুন (বললাম আমি)

এবার সবাই হেসে উঠল। আসলেই তো সুন্দরী তরুণী সামনে দিয়ে গেলে তরুণরা তাকিয়ে দেখবে এটাই তো স্বাভাবিক।

ঃ তোদের মোল্লারা মাদ্রাসায়, ঘোড়ার ডিম পড়ে। (আবার একটু কটাক্ষ করল আমীন)

ঃ কেন ঘোড়ার ডিম কেন? আধ্যাত্মিক লেখাপড়াকে ঘোড়ার ডিম বলছিস কেন? (আবারও প্রতিবাদ মোস্তাহিদের)

ঃ ঘোড়ার ডিম না তো কি? ঐ পড়ে ঘোড়ার ঘাস কাটা ছাড়া আর কি করতে পারবে?

ঃ নামাজ-রোজা, মিলাদ শরীফ ধর্মীয় কাজ কর্মকে তোর কাছে  ঘোড়ার ঘাস কাটা মনে হয়?

ঃ অবশ্যই ঘোড়ার ঘাস কাটা। উৎপাদনের সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে? এই আমাদের মুসলমানগুলোর মাথার মধ্যে কেরা পোক আছে। এইজন্যই আরবগুলা জোব্বা পড়ে উটের পিঠে চড়ে মরুভূমীতে বেহুদা ঘুরে বেড়ায়, আর ইতিউতি তাকায় কোথায় কোন রমনি দেখা যায় যাতে তিসরি শাদি মোবারকটা করা যায়।

 

ঃ এই, এই এটা কিন্তু বেশী হয়ে গেল। (ক্ষেপে গেল মোস্তাহিদ)। আর ঐ আরবদের দ্বারে দ্বারে তোমরা বাঙালীরা ভিক্ষা কর।

ঃ (একটু দমে গেলেও উত্তর দিন আমীন) ভিক্ষা করতাম না। ওরাই ভিক্ষা করত শুধু তেল থাকাতেই বেঁচে গেছে। আর ঐ তেলের কারণেই শালারা আজ দাঁত কেলিয়ে হাসে।

ঃ আরে থামাও তো তোমাদের ঝগড়া। (বলল ইমতিয়াজ)। কই আরব আর কই মোল্লা এই সব নিয়ে আমরা বন্ধুরা বন্ধুরা ঝগড়া করছি।

ঃ উহ্‌। তেলের টাকায় তেল হয়েছে ওদের। (আবারও খেকিয়ে উঠল আমীন)। বল, তিন-চারটা বিয়ে করা ছাড়া, মুসলমানরা কোনকালে কোন অবদান রাখতে পেরেছে?

এবার আর থেমে থাকতে পারলাম না আমি। বললাম

ঃ নারে, আমীন। এমন ধারণা ঠিক না। মুসলমানরা মানব সভ্যতায় অনেক অবদানই রেখেছে।

এবার সবার দৃষ্টি গেল আমার দিকে। বিভিন্ন বিষয়ে জানার চেষ্টা করি বলে ওরা আমার কথা বরাবরই মনোযোগ দিয়ে শোনে।

ঃ বলত, বলত (উৎসাহ নিয়ে বলল মোস্তাহিদ)

আমি শুরু করালাম

ঃ আমাদের মানব সভ্যতার উন্নয়নে বেশ কয়েকটি যুগ এসেছে, এদের মধ্যে একটি হলো Islamic Golden Age – ইসলামের স্বর্ণ যুগ।

ঃ কবে থেকে শুরু হয়েছিল এটা?

ঃ ৬১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে।

ঃ কিসের সাথে মিল আছে যেন সালটির?

ঃ আমাদের নবীজি (স) জন্মগ্রহন করেছিলেন ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে, আর নবুয়ত পেয়েছিলেন ৪০ বৎসর বয়সে। ৫৭০ যোগ ৪০ সর্বমোট ৬১০।

ঃ ও হ্যাঁ তাইতো! চমৎকার হিসাব। তারপর?

 

ঃ ইউরোপ তখন অন্ধকারে নিমজ্জিত। ক্যাথলিক চার্চের অনুশাসনে শ্বাসরূদ্ধকর পরিস্থিতি। চার্চ তখন সারা ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা বন্ধ করে দিয়েছে। এ সময়ে মানব জাতির ত্রাণকর্তা হিসাবে আবির্ভুত হন, আমাদের নবীজি (স)। তিনি এসেই সব চাইতে বেশী গুরুত্ব দিলেন লেখাপড়া ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায়। তোরা তো জানিস হেরার গুহায় অনেকগুলি বছরের ধ্যানমগ্নতা থেকে তিনি পেলেন ঐশী বাণী, পবিত্র কোরান। যার শুরুটাই হলো, “ইকরা —-“, মানে “পড়….”। তিনি বললেন, “জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর ও নারীর জন্যে ফরজ।” যখন ইউরোপে নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল, তখন নবীজি নারীদের বাধ্য করলেন শিক্ষা গ্রহন করতে।

ঃ ইউরোপে নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল নাকি? (প্রশ্ন আমীনের)

ঃ ছিল তো।

ঃ তারপর বল (বলল মোস্তাহিদ)

ঃ নবীজি (স) আরো বললেন, “জ্ঞান অর্জন করতে হলে ……।

আমি শেষ করার আগেই সবাই সমস্বরে আমার সাথে গলা মিলালো

” প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশে যাও”

 

ঃ হঠাৎ চীনের কথা বললেন কেন?

ঃ খুব সম্ভবত দুটি কারণে, এক, চীন তখন জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় অনেক উন্নত ছিল দুই, চীন অনেক দুর্গম ছিল। অর্থাৎ  জ্ঞান চর্চা করতে হলে উন্নত দেশে যাও, সেটা যত দুর্গমই হোক না কেন।

 

ঃ আচ্ছা এখন ইসলামিক গোল্ডেন এজ সম্পর্কে বল (বলল মোস্তাহিদ)

ঃ এটা অনেক বিশাল। অল্প কথায় শেষ করা যাবেনা। শুধু এইটুকু বলি যে ৬১০ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত ছিল এই যুগ। এই কয়েক শতাব্দী দীর্ঘ এই সময়ে শত শত মুসলিম মণিষী মানব জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় অভূতপূর্ব অবদান রেখে মানব সভ্যতাকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।

ঃ শত শত মুসলিম মণিষী! নাম বলত কয়েক জনার (উষ্মা জড়িত কন্ঠে বলল আমীন)

ঃ আল বিরুণী, আল তুসি, ইবনে সিনা, ওমর খৈয়াম, আল কিন্দি, আল জাবির, আল খাওয়ারিজিমি, আল রাজী, আল হাসান ইবনে আল হাইয়াম, ইবনে খলদুন, তকি-আল-দিন এমনি আরো অনেকে চিকিৎসা থেকে শুরু করে ফিজিক্স পর্যন্ত বহু বিষয়ে তাদের অবদান অনস্বীকার্য্য।

ঃ আল বিরুণীর নাম তো শুনেছি। গণিতবিদ ছিলেন।

ঃ ওমর খৈয়ামের আবার বিজ্ঞানে কি অবদান? কবি ছিল জানি। ঐ যে লোচ্চার মত সুরা ও সাকী নিয়ে কি কি সব কবিতা লিখেছেনা? (আবারও উষ্মা নিয়ে বলল আমীন)

ঃ তোর আবারও সেই ইসলাম বিরোধী মনোভাব। (বলল মোস্তাহিদ)। খৈয়ামের রুবাইয়াত পড়েছিস?

ঃ রুবাইয়াত পড়া লাগেনা। শুনেছি, “রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে, …।” এই সব হাবিজাবি।

ঃ ও, না পড়েই পন্ডিত! হুইন্যা মাতব্বর! (এবার ঠেস দিয়ে বলল মোস্তাহিদ)

ঃ রুবাইয়াৎ বিশ্বসেরা কাব্য ।পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় তা বহু আগেই অনুদিত হয়েছিল। আমাদের দেশে প্রথম অনুবাদ করেছিলেন সম্ভবতঃ কাজী নজরুল ইসলাম। তাছাড়া ওমর খৈয়াম কেবলই কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন পলিম্যাথ। (বললাম আমি)

ঃ পলিম্যাথ আবার কিতা? (প্রশ্ন করল আমীন)

ঃ পলিম্যাথ মানে যিনি একই সাথে অনেক বিষয়ে পান্ডিত্য রাখেন। ওমর খৈয়াম ছিলেন এমনই একজন। তিনি একাধারে ছিলেন দার্শনিক, গণিতবিদ ও জোতির্বিদ। পাটিগণিত ও জ্যামিতিকে সমন্বয়কারী যে কোঅর্ডিনেট জিওমেট্রি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় ওমর খৈয়ামই তার প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়া তিনি মেকানিক্স, ভূগোল, খনিজবিজ্ঞান, সঙ্গিত এবং ইসলামী থিওলজী-র উপর একাধিক গবেষণামূলক গ্রন্থ (treatises) লেখেন।

ঃ এবার বুঝলে বাছাধন, মুসলমানদের অবদান কতখানি! (আবারো ঠেস দিল মোস্তাহিদ)

ঃ হুঁ (রিকোগনাইজ না করার ভঙ্গিতে বলল আমীন)। ঐ কিছু বই-পত্র লেখা আর কি। বিজ্ঞান? আধুনিক বিজ্ঞান তো ইউরোপীয়দের সৃষ্টি, নিউটন, গ্যালিলিও, বেকন ওরাই তো স্টার।

ঃ না ওদের অনেক আগেই মুসলমানরাই আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা করে। Islamic Golden Age সম্পর্কে বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে আজ থাক আরেকদিন বলব। আজ শুধু একটা বিষয়ে বলি।

ঃ বল বল, বলে ওর থোতা মুখ ভোতা করে দে। (ক্ষেপে গিয়ে বলল মোস্তাহিদ)

রাগত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো আমীন।

ঃ না না এভাবে বল না, বল ওর ভুল ভাঙিয়ে দিতে। (বলল শান্ত স্বভাবের ইমতিয়াজ)

ঃ আধুনিক বিজ্ঞানে একটি মেথড আছে। তাকে বলা হয় Experimental Scientific Method এরিষ্টটল বলেছিলেন বিশুদ্ধ চিন্তা থেকে থিওরী তৈরী করা যায়। অর্থাৎ বিজ্ঞানের মধ্যে পরীক্ষার বিষয়টি তিনি ভাবেনই নি। এদিকে কোন সত্য যাচাইয়ের জন্য তা পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণ করা উচিৎ এই ধারণাটি প্রথমবারের মত ইনট্রোডিউস করেন মুসলিম বিজ্ঞানীরা ।

বিভিন্ন বইয়ে বিষয়টি এইভাবে পাওয়া যাবে – Reaching the rational experimental scientific method – based on induction and measurement, as well as sighting, experiment and representation – is considered an important Islamic addition to the march of science worldwide.

Such a method  is completely different from that of the Greek, Indians or others, as such civilizations used often to content themselves with assuming theories without attempting to scientifically prove them. They were almost theoretical philosophies that are not applied in most cases even if they were true.

 

পুর্ববর্তি সকল থিওরীকে মুসমান বিজ্ঞানীরা পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণের সিদ্ধান্ত গ্রহন করলেন। কে বা কত খ্যাতিমান ব্যাক্তি এই এই থিওরীর জনক ঐদিকে নজর না দিয়ে তারা থিওরীগুলোতে এক্সপেরিমেন্টাল মেথডের প্রয়োগ ঘটান। এর ফলস্বরূপ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সত্য মেনে আসা অনেক থিওরীই ভুল প্রমাণিত হয়।

এবং তারা ঐ থিওরী কেবল ভুল প্রমাণ করেই ক্ষান্ত হননি। পাশাপাশি তারা নতুন এ্যসাম্পশন করে আবারো এক্সপেরিমেন্টাল মেথড প্রয়োগ করে নতুন থিওরী তৈরী করেন। এই করতে গিয়ে তারা আগ্রহের সাথে অজস্র এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন।

মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে যারা এই সকল এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজনার নাম উল্লেখ করছি। জাবের ইবনে হাইয়ান – আধুনিক রসায়নের জনক বলেছেন – “… and the perfection of that making is science and experiments; he who did not work or carry out experiment never won anything.”। তার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল-খাওয়াস-আল-কাবির'(The Great Book of Properties)-এ তিনি বলেছেন, “এই বইয়ে আমি ঐ সমস্ত বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করছি যা আমরা কেবল শুনিনাই বা দেখিনাই বা পড়িনাই বরং যা পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। যা সত্য হিসাবে গৃহিত হয়েছে কেবল সেটাই প্রকাশ করছি, আর যা ভুল প্রমাণিত হয়েছে তা বর্জন করছি”।

এভাবে জাবের ইবনে হাইয়ান ছিলেন প্রথম বিজ্ঞানী যিনি laboratory scientific experiment ইনট্রোডিউস করেন। তিনি মাঝে মাঝে Experiment-কে The Experience বলতেন। তিনি আরো বলেছেন, ” যিনি Experience করলেন না তিনি বিজ্ঞানী নন, বরং যিনি Experience করলেন তিনিই বিজ্ঞানী, যেকোন ইন্ডাস্ট্রীতে Experienced maker হলো দক্ষ আর inexperienced হলো অলস।”

 

আল রাজী ছিলেন প্রথম ডাক্তার (physician) যিনি যেকোন চিকিৎসা প্রথমে পশুদের উপর প্রয়োগ করে পরীক্ষা করতেন। যোকোন ঔষধ বা চিকিৎসা মানুষের উপর প্রয়োগের আগে পশু বিশষতঃ বানরের উপর পরীক্ষা চালাতেন। তিনি বলেছিলেন, “যদি কোন থিওরী পরিক্ষার দ্বারা ভুল প্রমাণিত হয় তবে সেটাকে ভুলই মেনে নিতে হবে সেই থিওরী যত খ্যাতিমান বিজ্ঞানীর দ্বারাই সৃষ্ট হোক না কেন।”

 

আল-হাসান-ইবনে-আল-হাইয়াম ১১ শতকের বিজ্ঞানী যাকে আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের জনক বলা হয়, তিনি এক্সপেরিমেন্টাল মেথডের সফল প্রয়োগ করেন। তার লিখিত বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘কিতাব-আল-মানাযির'(A book on Optics) অজস্র  এক্সপেরিমেন্টাল মেথড প্রদর্শন করেন। তিনিও একজন পলিম্যাথ ছিলেন। তিনি একাধারে ছিলেন গণিতবিদ, ডাক্তার, প্রকৌশলী ও প্রজ্ঞী। তিনি তার কিছু লেখায় ইউক্লিড ও টলেমির সমালোচনাও করেন। ইউরোপে তিনি আল হাযেন নামে পরিচিত, তাকে দ্বিতীয় টলেমিও বলা হয়। তিনি induction ও syllogism গ্রহন করেন এবং আনালজি-র দিকেও মনযোগ দেন। এভাবে তিনি ১৭শতকের ফ্রান্সিস বেকন আল হাযেনকেই অনুসরন করেন।

 

এভাবে মুসলিম বিজ্ঞানীরাই মানব জাতিকে প্রথম দেখিয়েছেন Experimental Scientific Method-এর মাধ্যমে কিভাবে সন্দেহ ও মায়া(illusion)-কে কাটিয়ে উঠে থিওরীকে যাচাই করে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়।

 

ঃ বুঝলাম Experimental Scientific Method ভালো জিনিস। মুসলমানরা ইনট্রোডিউস করেছে। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান? খোনকার মোল্লা তৈরীর মাদ্রাসা ছাড়া আর কিছু প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে মুচলমানেরা। (ইচ্ছা করেই ‘ছ’ এর জায়গায় ‘চ’ ব্যবহার করল আমীন)।

ঃ কি বলিস (বললাম আমি), আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাও মুসলমানরাই।

ঃ কেন, এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছিলনা?

ঃ ছিল। কিন্তু সেগুলো আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মত নয়। সেখানে মুলতঃ ধর্ম শিক্ষা দেয়া হতো। ইউরোপে এরকম বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া হতো ক্যাথলিক খ্রীষ্টান ধর্মীয় শিক্ষা, আর আমাদের এখানকার ময়নামতি, নালন্দা ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেয়া হতো বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা।

 

ঃ আর মুসলমানরা কিধরনের বিশ্ববিদ্যালয় চালি করে?

ঃ যেখানে আধুনিক সাবজেক্টগুলো অর্থাৎ রসায়ন, গণিত, চিকিৎসা শাস্ত্র, আলোকবিজ্ঞান, জোতির্বিদ্যা, প্রকৌশল, দর্শন, সমাজবিদ্যা ইত্যাদি পড়ানো হয়।

ঃ কোথায় তা চালি করা হয়েছে শুনি?

ঃ বেশ কয়েকটি জায়গায়, যেমন বাগদাদের বায়তুল হিকমা (House of Wisdom), কায়রোর আল আজ হার বিশ্ববিদ্যালয়, কর্ডোভা ও তালাআদের বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্যাদি।

 

ঃ তাহলে আমাদের মুসলমানদের আজ এমন করুন অবস্থা কেন?

ঃ সে অনেক কথা, তবে এই উপমহাদেশ সম্পর্কে এক কথায়ই বলব, এর কারণ বৃটিশ শাসনামল।

ঃ কি করল তারা। আর তারা আসার আগেই বা কোন ঘোড়ার ডিম ছিল?

ঃ তারা আসার আগে অনেক কিছুই ছিল। আমরা স্বাধীনতা হারাই ১৭৫৭ সালে পলাশীর ট্রাজেডিতে। তার আগে আমাদের এখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা হতো নিসঃন্দেহে।

ঃ কে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করত, সিরাজউদ্দৌলা? ওতো একটা লোফার ছিল। (বলল আমীন)

ঃ না, প্রথম কথা সিরাজউদ্দৌলা লোফার ছিল না। এগুলো সবই ইংরেজদের প্রচারণা। তিলকে তাল করা হয়েছে। তিনি খুব কাঁচা বয়সের ছিলেন। কোন কোন সোর্স থেকে পাই, তার বয়স ছিল উনিশ বছর আবার কোথাও কোথাও লেখে,  তার বয়স ছিল একুশ বছর। যাহোক বেশিটাই যদি ধরি অর্থাৎ একুশ হলেও তো খুবই কম বয়স। ঐ কাঁচা বয়সে একটু-আধটু নারী আসক্তি থাকতেই পারে।

ঃ সেটাই বা থাকবে কেন?

ঃ থাকবে কেন? ঐ যে একটু আগে হলুদ পরীটার দিকে তুমি যেমন লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলে তেমনি কারণে। (আবারো ঠেস দিল মোস্তাহিদ)। আর তোমার এক মামা আছেনা? ঐ যে এরশাদের পদস্থ আমলা, তার সাথে খুব দহরম-মহরম। এই চল্লিশ বছর বয়সেও তো ইটিশ-পিটিশ করে। গভীর রাতে খেয়ে ফুল হয়ে ঢাকা ক্লাব থেকে বের হয়।

ঃ আসলে সেটা বড় কথা না। সিরাজউদ্দৌলা তার নানা ইংরেজদের পিলে কাঁপানো কঠোর শুশাসক আলিবর্দী খানকে মৃত্যু শয্যায় কথা দিয়েছিলেন আর কোনদিন তিনি শরাব স্পর্শ করবেন না। তিনি বাকী জীবন কথা রেখেছিলেন। দেশকেও তিনি ভালোবাসতেন, প্রজাহিতৈষী ছিলেন। একটু ভালো করে খেয়াল করে দেখ সেই চরম সংকটে, ঐ একুশ বছরের যুবকই তো ঝাপিয়ে পড়েছিল দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে, আর এই দেশের জন্যই তিনি প্রাণ দিয়েছিলেন।

ঃ দেশের জন্য না। ধরা পড়ে নিহত হয়েছিল। (জোড় দিয়ে বলল আমীন)

ঃ না, তিনি কাপুরুষের মত পালাচ্ছিলেন না। বীর যোদ্ধা আলিবর্দী খান-এর সাথে একাধিক যুদ্ধে সিরাজ অংশ নিয়ে বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। প্রাণ ভয়ে লেজ গুটানোর মানুষ তিনি ছিলেন না।  তিনি পাটনা যাচ্ছিলেন সৈন্য-সামন্ত জোগাড় করে আবারও যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু আমাদের কপালের দোষ, তিনি ধরা পড়লেন ও নিহত হলেন। তাকে জনসমক্ষে বিচার করে জনমত যাচাই করে ফাঁসি দেয়া হয়নি। মীরজাফরের আপত্তি সত্ত্বেও ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে মিরনের নির্দেশে কাপুরুষের মত তাকে হত্যা করে সিরাজের সাথে একই থালায় ভাত খাওয়া বেঈমান মোহম্মদী বেগ। আমাদের কপালের লিখন, আমাদের নবাবকে বাঁচাতে পারলাম না। আর এর খেসারত আমাদের দিতে হয়েছে পরবর্তি দু’শো বছর।

 

মোস্তাহিদের চোখে জল চলে এলো। ভারী কন্ঠে সে বলল,

ঃ আমার দাদা বলেছে। সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করে ইংরেজরা কলকাতায় একটি মনুমেন্ট তৈরী করেছিল। তার নাম ছিল হলওয়েল মনুমেন্ট। পরবর্তিতে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে, ৩রা জুলাই, ১৯৪০ এ হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দিলেন । বাঙালী হিন্দু ও মুসলমানেরা এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে ইংরেজদের বাধ্য করে ঐ হলওয়ের মনুমেন্ট তুলে নিতে।

 

ঃ আচ্ছা এখন বলো আলিবর্দী-সিরাজউদ্দৌলার সময় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা কেমন ছিল। (বলল ইমতিয়াজ)

ঃ নবাব সিরাজউদ্দৌলার নানা আলিবর্দী খান শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। শিক্ষার প্রতি তার প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। তিনি শিক্ষিতদের সমাদর করতেন ও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তার আমলে বাংলার ফার্সী সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞান-এর বিশেষ উন্নতি হয়েছিল। ইতিহাসবিদ গোলাম হোসেন তাবাতাবাই লিখেছেন, নবাব আলিবর্দী খান প্রতিদিন দুই ঘন্টা আলেমদের সাথে জ্ঞানালোচনা করে কাটাতেন। মুহম্মদ আলী ফাজিল, হাকিম হাদী আলী খান, নকী কুলী খান, মির্যা হোসেন সেসেবি এবং আরো অনেক পন্ডিত ব্যাক্তি এই আলোচনায় যোগ দিতেন।

 

মুহম্মদ আলী ফাজিল ধর্ম, দর্শন প্রভৃতি শাস্ত্রে ব্যুৎপন্ন ছিলেন। হাকিম হাদী আলী খান চিকিৎসা শাস্ত্রে খুব খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাকে সে যুগের গ্যালেন আখ্যায়িত করা হয়েছিল। হাকিম তাজুদ্দিন মুর্শিদাবাদের আরেকজন বড় চিকিৎসা বিশারদ ছিলেন। কাযী গোলাম মুজাফফর, মুহম্মদ হাযিন, শাহ মুহম্মদ হাসান, আবুল কাশিম ও সৈয়দ মুহম্মদ আলী সেই সময়ের খ্যাতনামা পন্ডিত ছিলেন। ইতিহাস লেখক ইউসুফ আলী নবাবের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ ‘সিয়ার-উল-মুতাক্ষেরীণ’ রচয়িতা গোলাম হোসেন তাবাতাবাইও নবাব আলীবর্দী ও সিরাজউদ্দৌলার অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন। নবাব আলীবর্দী এতই সুশাসক ছিলেন যে তার সময়ে বাংলা ঐশ্বর্য্যশালী হয়ে উঠেছিল। সেই ঐশ্বর্য্যশালী বাংলাকে রক্ষা করারই প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়েছিলেন তার আদরের নাতি নবাব সিরাজউদ্দৌলা মনসুর-উল-মুল্‌ক। কিন্তু গুটিকতক বেঈমানের হঠকারিতায় সেই ঐশ্বর্য্য পড়ে শঠ-প্রতারক-লোলুপ ইংরেজদের হাতে। শুরু হয় লুন্ঠনের এক নবযুগের সূচনা – প্রটেস্টান্ট সাম্রাজ্যবাদ। বাংলার সকল ঐশ্বর্য্য স্থানান্তরিত হয়ে যায় ইংল্যন্ডে।

(চলবে)

৬৫০ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “লিস্টনিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ ১১”

মওন্তব্য করুন : Mohammad Sanaul Huq

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।