লিস্টনিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ ৮

লিস্টনিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ ৮

উপরের পেইন্টংটি ১৮৬১ সালে Frederick William Alexander de Fabeck কর্তৃক অংকিত বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকা শহরের ছবি।

 

 

বাইরে নেমে একটু চিন্তায় পড়লাম, কিভাবে যাব ঢাকা ইউনিভার্সিটি। মোস্তাহিদ বলল

ঃ চল, বাস ধরি।

ঃ এখান থেকে কোন বাস যায়, জানিনা। (আমি বললাম)

ঃ বাহ ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা, ঢাকার খোঁজ রাখেনা।

ঃ আহা ঢাকার খোঁজ তো রাখি, কিন্তু ঢাকার বাসের খোঁজ তো রাখিনা।

ঃ বড়লোক মানুষ, বাসের খোঁজের দরকার কি?

ঃ আরে সেটা কথা না। চলাফেরা তো মেইনলি রিকসায়ই করি। লং ডিসটেন্স হলে আব্বার ভাঙা গাড়ীটা আছেই।

ঃ ভাঙা না বলে পুরাতন বল। তোদের যখন গাড়ী ছিল, তখন তো মানুষের কাছে গাড়ী ছিল স্বপ্নের মত।

ঃ দোস্ত, তখন সততার মূল্য ছিল। সৎ টাকায় গাড়ি কেনা যেত। সম্মানজনক চাকুরী করে লোকে ভালো স্যালারী ড্র করতে পারত।

ঃ হ্যাঁ, শুনেছি বৃটিশ আমলে একজন সরকারী কর্মকর্তা বিলাসবহুল জীবন যাপন করতেন। তার কিছু বর্ণনা পেয়েছি, বাংলা সাহিত্যের অনন্যসাধারণ গ্রন্থ যাযাবরের দৃষ্টিপাতে।

ঃ এতো বৃটিশ আমলের কথা। এমনকি পাকিস্তান আমলেও সি, এস, পি, অফিসার, আর্মি অফিসার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রথিতযশা সাংবাদিক ইত্যাদি সম্মানী চাকুরীজিবিরা ভালো স্যালারি পেতেন। যা দিয়ে তারা তাদের স্ট্যাটাস মেইনটেইন করতে পারতেন। আর এখন স্যালারির যা অবস্থা, সংসারই চলেনা। এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ে গেল। কে যেন প্রবচন বলেছিল,”বাংলাদেশে সরকারী কর্মকর্তার বেতন, মেয়েদের মীনস্‌ পিরিয়ডের সাথে তুলনীয়, উভয় ক্ষেত্রেই একমাস অপেক্ষা করতে হয় এবং আসার পর চারদিনেই শেষ হয়ে যায়।”

হা হা হা!!! সবাই কোরাসে হাসলো ।

ঃ তারপরেও তো দেখি, ঢাকার রাস্তায় দামী দামী গাড়ির চলাচল শুরু হয়ে গি্যেছে। ঐ যে জীপের মত গাড়ীগুলো পাজেরো নাম। দিনদিনতো কেবল বাড়ছেই। কোথায় পায় এত এত টাকা?

ঃ এরশাদ শাসনামল দোস্ত। দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে দেশ। সৎ ভালো মানুষদের করুণ অবস্থা আর দুর্নিতীবাজরা পাজেরো জীপ হাকিয়ে বেড়াচ্ছে।

ঃ হ্যারে, গত ছয় বছর ধরে তো এই চিত্রই দেখছি। ঐদিন আমাকে এক দোকানদার ঠকানোর চেষ্টা করছিল। আমি ধরার পর আমাকে বলে, “আরে মন্ত্রী-মিনিষ্টাররাই চুরি করে, আমি আর ভালো থাইকা কি করমু?”।

ঃ মাছের একটা মড়ক শুরু হয়েছে। প্রথমে রোগটা হয় মাথায়, তারপর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। আমাদের দেশের এখন হয়েছে ঐ অবস্থা।

ঃ কে এই এরশাদ?

ঃ তুই যতটুকু জানিস, আমিও ততটুকুই জানি। ১৯৮২ সালে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জাস্টিস সাত্তারকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় আসে। সেনাপ্রধান হিসাবে সরাসরি সামরিক শাসন জারি করে। এর কিছুকাল পরে একটি প্রহসনমূলক নির্বাচনের পর রাষ্ট্রপতি হয়। এখনো ক্ষমতায় আছে।

ঃ এর বেশি কিছু জানা প্রয়োজন। তার অতীত, পেশাগত জীবনের কার্যক্রম, ভবিষ্যত পরিকল্পনা, ইত্যাদি। আচ্ছা এরশাদ কি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিল?

ঃ যতদূর জানি, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেনাই। ৭১-এর বিজয়ের পর যে সকল সেনা কর্মকর্তারা পাকিস্তান থেকে ফেরত এসেছিল এরশাদ তাদের একজন। যতদূর জানি তাদের মধ্যে সিনিয়র মোস্ট । শুনেছিলাম, কি কারণে যেন, তার চাকরীও খোয়া গিয়েছিল, পরে তার মামা রাজনীতিবিদ এম, কোরবান আলীকে ধরে চাকরী ফেরত পায়।

ঃ তাই নাকি? এম, কোরবান আলী তো এখন মন্ত্রী।

ঃ আচ্ছা তাকে সরানোর জন্য তো অনেক আন্দোলন হচ্ছে। কিন্তু কাজ তো কিছু হচ্ছেনা। আমরাও তো অনেক মিছিল মিটিং করলাম। (বলল ইমতিয়াজ)

ঃ এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর দেশের মানুষ মনে করেছিল, কঠোর শাসক ক্ষমতায় এসেছে, এবার দেশে শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু কিছুদিন পরে জনগণ বুঝতে পারল যে তারা ভুল বুঝেছে। বাংলাদেশের জনগণ আরো একবার প্রতারিত হলো। শৃংখলা তো দূরের কথা বরং দুর্নীতিকে সে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। আমাদের দেশে যেকোন অপশক্তির বিরূদ্ধে একটি কাউন্টার ফোর্স হলো দেশের ছাত্রসমাজ। তারাই প্রথম নড়াচরা শুরু করল এই দুশাসনের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে ১৯৮৪ সালে যখন একটি উদ্ভট জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষিত হলো।

ঃ মজিদ খানের শিক্ষানীতি?

ঃ হ্যাঁ। ঐ মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ ব্যপক আন্দোলন গড়ে তোলে। যতদূর মনে পড়ে ১৯৮৪ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী, ছাত্রদের মিছিলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এরশাদের অনুগত বাহিনী। তাকে এই কাজে সহযোগীতা করেছিল জেনারেল আবদুর রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের উপর আক্রমণ চালায়, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যারা। এমন ঘটনাও আছে যে শিক্ষকদের কক্ষে ঢুকেও লাঠিপেটা করা হয়, শিক্ষক তার আইডি কার্ড দেখানোর পরও লান্ছিত হন। কয়েকজন ছাত্রও নিহত হয়েছিল। এরপর একটা কথা মুখে মুখে ফিরেছিল আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ১৪ই ফেব্রুয়ারী।

ঃ ন্যাক্কারজনক!

 

ঃ যাহোক। এখন ঢাকা ইউনিভার্সিটি যাই কিভাবে। এখান থেকে বাস টেম্পো কিছু কি পাওয়া যাবেনা? (বলল মোস্তাহিদ)

ঃ দোস্ত, এরশাদের আমলে রাস্তা-ঘাট কিছু পাকা হয়েছে, পান্থ পথের মত দু’য়েকটা লিংক রোড হয়েছে একথা সত্য, কিন্তু ট্রান্সপোর্টের যে কোন উন্নতি হয়নি এটা আরো বেশী সত্য।

ঃ আন্ত নগর ট্রেন ব্যবস্থা তো এরশাদের করা।

ঃ হ্যাঁ, এই উদ্যোগটা ভালো। তাছাড়া ঢাকার বাইরে পাকা রাস্তা-ঘাটও অনেক নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু ঢাকার অভ্যন্তরে ট্রান্সপোর্টের কোন উন্নতি হয়নি।

ঃ তাহলে বাস-টাস এগুলো বাদ দেই। রিকসায় উঠে যাই।

ঃ টাকা অনেক লাগবে। (বলল ইমতিয়াজ)

ঃ টাকা রোমান দেবে। ওর কাছে কিছু পাওনা আছে। (বলল মোস্তাহিদ)

ঃ আমার কাছে তোর টাকা পাওনা আছে! আকাশ থেকে পড়লাম আমি।

দুষ্টামির হাসি হাসল মোস্তাহিদ। তুই টিউশানি পেয়েছিস না? তোর ইনকাম তো ভালো। আমাদের কিছু খাওয়াবি না?

ঃ ও আচ্ছা এই কথা।

ঃ টুউশানি কর নাকি। (বলল কামাল)

ঃ হ্যাঁ, শুরু করেছি গতমাস থেকে।

ঃ কাকে পড়াও?

ঃ ভিকারুন নিসা স্কুলের একটি মেয়েকে।

ঃ মেয়েকে, খুব সুন্দরী নাকি? (বলল কামাল)

ঃ দুরো, ক্লাস এইটের মেয়ে। অনেক ছোট।

ঃ ও। হতাশ কন্ঠ কামালের।

 

রিকসা ঠিক করা হলো। একটিতে উঠল মোস্তাহিদ, কামাল আর আমিন। আরেকটিতে উঠলাম আমি আর ইমতিয়াজ। মগবাজার মোড় থেকে, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনের পদ্মার পাশ দিয়ে মিন্টু রোড হয়ে ইউনিভার্সিটি যেতে যেতে কথা হচ্ছিল ইমতিয়াজের সাথে। আমি বললাম

ঃ এই যে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মা দেখছ, এখানে থেকেছিলেন কিংবদন্তীর মুষ্টিযোদ্ধা মোহম্মদ আলী।

ঃ তাই নাকি? তুমি দেখেছিলে?

ঃ হ্যাঁ। একবার দেখেছিলাম। ১৯৭৮ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী মুষ্টিযোদ্ধা মোহম্মদ আলী সপরিবারে বাংলাদেশ সফর করেন। সে সময় বিশ্বব্যাপী তার সুনাম, তিন-তিনবার হেভিওয়েট বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন হয়ে খ্যাতির তুঙ্গে ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের জনগণ তার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা অনুভব করত, তিনি মুসলমান হয়েছিলেন বলে। এসময়, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁকে আমন্ত্রণ জানা বাংলাদেশ সফর করার। তিনি সানন্দে রাজী হন। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র, যেটির মাত্র উদ্ভব হয়েছে বিশ্ব মানচিত্রে। পৃথিবী যাকে ভালো করেই চেনেই না। ১৯৭৪ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী কিসিন্জারের বক্তব্যে বাংলাদেশ এসেছিল ‘বট্‌মলেস বাস্কেট’ হিসাবে। এরপর তার পরিচয় একটি হতদরিদ্র রাষ্ট্র হিসাবে। সেই দেশ সফর করতে রাজী হবেন মোহম্মদ আলীর মত জীবন্ত কিংবদন্তি তা কেউ ভাবতেই পারেনি। কিন্তু তিনি আমাদের রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলেন। তার অনিন্দসুন্দরী স্ত্রী ভেরোনিকাকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিল।

 

এয়ারপোর্টে জনতার ঢল নেমেছিল তাঁকে দেখতে ও অভ্যর্থনা জানাতে। এয়ারপোর্ট থেকে নেমে খোলা জীপে করে যখন তিনি শহরের দিকে যাচ্ছিলেন চারিদিকে শুধু ধ্বনি উঠছিল, ‘ইয়া আলী, ইয়া আলী’। আমেরিকা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে, হতদরিদ্র বুভুক্ষ মানুষের একটি দেশে তার এতটা জনপ্রিয়তা দেখে তিনি নিজেও বিস্মিত হয়েছিলেন। তিন দিন তিনি বাংলাদেশে ছিলেন। সরকার তাকে আতিথেয়তার সর্বচ্চো করেছিলেন। তাকে কক্সবাজারে এক খন্ড জমিও উপহার দেয়া হয়। পুরো তিন দিন রেডিও-টিভিতে আলীর সম্মানে একটি গান বাজত, পুরোটা মনে নেই, যেটুকু মনে আছে, ‘ … আলী বলে আমি কালো পাহাড়, এসো লড়বে যদি,..।’ আলী যেখানেই যেতেন তার চারদিকে জনতার ঢল নামত। আমরা পুরো পরিবার একদিন গেলাম রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায়, যদি উনার দেখা পাই। সেখানে একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম। পুলিস বললেন, “জ্বী উনি একটু পরেই আসবেন।” আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “উনাকে দেখা যাবে?”, “জ্বী, আপনারা দাঁড়ান আসলেই দেখতে পাবেন”, সজ্জ্বন পুলিশটিকে বেশ তৃপ্ত মনে হলো এরকম একটা ভালো ডিউটি দিতে পেরে। পুলিশটি আবার বলল, “সকালে আসলে কথাও বলতে পারতেন।” আমরা অবাক হলাম, “কথাও বলা যেত?”, “হ্যাঁ উনি সকালে গেটের সামনে হাটাহাটি করেন, লোকজনের সাথে কথা বলেন”। এবার আমরা সত্যিই বিস্মিত হলাম। খ্যাতির শীর্ষে থাকা মানুষ নানা কারণেই সাধারণ মানুষের সাথে দেখা দিতে চান না, আর মোহম্মদ আলী ভবন ছেড়ে রাস্তায় বেড়িয়ে আসেন, লোকের সাথে কথাবলার জন্য! একটু পরে একটা গাড়ী আসল মুহূর্তে চারদিকে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। পুলিশটি বলল আপনারা একটু সরে দাঁড়ান গাড়ীটি ঢুকতে দিন। গাড়িটা একটু ধীরে ভিতরে প্রবেশ করল। আনন্দ ও বিস্ময় নিয়ে দেখলাম, ভিতরে বসে আছেন অতি বিনয়ী, কালোপাহাড়, বিশ্বখ্যাত মোহম্মদ আলী। চারিদিকে রব উঠল, ‘ইয়া আলী, ইয়া আলী’। দুয়েকজন ফুল ছুড়ে দিল আলীর গাড়িতে।

 

(অনেক কাল পরে, আমার এক প্যালেষ্টাইনি বন্ধু বলেছিল যে, সে মোহম্মদ আলীর জীবনির উপরে ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখেছে। সেখানে আলীর বাংলাদেশ সফরেকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ সফর শেষ করে তিনি মস্কো সফরে যান। লিওনিদ ব্রেজনেভের সাথে সাক্ষাৎ করান।)

 

আফ্রিকান-আমেরিকান বংশোদ্ভূত আলীর আসল নাম ক্যাসিয়াস মারসেলাস ক্লে। তিনি ১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি কেন্টাকির লুইভিলেতে জন্মগ্রহণ করেন।

বাবা ক্যাসিয়াস পোস্টার লিখতেন। মা ওডিসা ছিলেন গৃহিণী। তাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন শেতাঙ্গ আমেরিকানদের ক্রীতদাস। চেষ্টা করেও জীবনে সেই দাগ মুছে ফেলতে পারেনি তার পরিবার। ১২ বছর বয়সে মোহম্মদ আলী ও তার বন্ধুরা, সাইকেলে চড়ে গিয়েছিলেন এক অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষে স্ট্যান্ডে ফিরে  মোহম্মদ আলী দেখতে পেলেন তার সাইকেলটি চুরি হয়ে গিয়েছে। ক্রোধে ফেটে পড়েন তিনি। কলাম্বিয়া অডিটোরিয়ামের বেসমেন্টে যান পুলিশ অফিসার জো মার্টিনের কাছে নালিশ জানাতে। এই জো মার্টিন আবার কলাম্বিয়া জিমের বক্সিং কোচও ছিলেন। মোহম্মদ আলী জো মার্টিনকে বলেন, “যে আমার সাইকেল চুরি করেছে, তাকে মেরে তক্তা বানিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়।” জো মার্টিন হেসে বলেন, “ফাইট করতে চাইলে, আগে ফাইট শিখতে হবে।” তার কয়েকদিন পরেই  জো মার্টিনের জিমে বক্সিং শিখতে শুরু করলেন  মোহম্মদ আলী ।  খুব ভালো ছাত্র ছিলেন আলী। দ্রুত শিখে নিয়েছিলেন মুষ্টিযুদ্ধের নিয়ম-কানুন। ১৯৬০ সালে সামার অলিম্পিকে সোনার মেডেল পান ১৮ বৎসর বয়স্ক মুহম্মদ আলী ।

 

মোহম্মদ আলী এমন একটা সময়ে জন্মেছিলেন যখন আমেরিকায় বর্ণবৈষম্য পুরোদমে চলছিল। কৃষ্ণাঙ্গরা ছিল. নির্যাতিত, অছুত। একবার এক শপে তিনি গি্যেছিলেন জামা কিনতে। একটি জামা পছন্দ হলে তিনি ট্রায়াল দিতে চাইলেন। কিন্তু ম্যানেজার কিছুতেই ট্রায়াল দিতে দেবেনা। একজন আলীকে চিনতে পেরে তার পরিচয় দিয়ে বলল, “ইনি বক্সার ১৯৬০ সালে সামার অলিম্পিকে সোনার মেডেল পেয়েছেন, আমেরিকার মুখ উজ্জ্বল করেছেন।” কিন্তু ম্যানেজার বলল, “তাতেও কাজ হবেনা। কোন নিগ্রোর চামড়ায় ঐ জামা লাগলে আর কোন শ্বেতাঙ্গ সেটা কিনতে চাইবে না।” এই বৈরী সামাজিক আবহাওয়ার মধ্যে থেকে তিনি যুদ্ধ করেন। যুদ্ধ করেন, অপরাপর মুষ্টিযোদ্ধাদের সাথে রিং-এ, এবং বর্ণবৈষম্যের মত সামাজিক কুপ্রথার  সাথে সমাজে। আমেরিকায় প্রয়োজনের সময় প্রাপ্তবয়স্ক যে কোনো নাগরিককে বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেবার বিধান আছে- ‘ড্রাফট/ড্রাফটিং’ নামে যা পরিচিত। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ড্রাফটিং পুরোমাত্রায় চালু ছিলো। মুষ্টিযোদ্ধা মোহম্মদ আলী ড্রাফটে যেতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেছিলেন, “কোন ভিয়েতনামি কং আমাকে কখনোই নিগার বলেনি, কিন্তু আমার স্বদেশী শ্বেতাঙ্গ ভাইয়েরা আমাকে এই কথাটি বলেছে বহুবার”। ড্রাফটে যেতে অস্বীকার করার অপরাধে তাঁর বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের খেতাব ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। এই সব কিছুর সাথে সংগ্রাম করে তিনি শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করেছিলেন।

 

ঃ আচ্ছা মোহম্মদ আলী তো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তাই না?

ঃ হ্যাঁ, ১৯৬৪ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারী মোহম্মদ আলী বক্সিং করেন শক্তিমান সনি লিস্টনের সাথে। সনি লিস্টন ঘোষণা দিয়েছিল যে, খুব দ্রুতই ক্যাসিয়াস ক্লে-কে নক আউট করবে (মোহম্মদ আলীক-র পূর্ব নাম)। কিন্তু বাটারফ্লাই স্টাইলের মুষ্টিযোদ্ধা ক্যাসিয়াস ক্লে-কে ধরা তো দূরের কথা উল্টা এই মুষ্টিযুদ্ধে সনি লিস্টনই মারাত্মকভাবে আহত হয়, এবং ৭ম রাইন্ডেই পরাজিত হয়। এইভাবে তিনি হয়ে গেলেন হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন। এই জয়ের ঠিক একদিন পরেই তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। এবং ক্যাসিয়াস ক্লে থেকে মোহম্মদ আলী হন। এভাবে তার স্লেভ নামটি তিনি পরিত্যাগ করেন। এই পাবলিক এ্যানাউন্সমেন্টটি পাবলিক শুরুতে পছন্দ করেনি। এভাবে মোহম্মদ আলী ‘ন্যাশন অফ ইসলাম’ গ্রপটিতে যোগ দেন। গ্রুপটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এলিজা মোহাম্মদ।

 

এরপর আলী ভীষণ বিনয়ী হয়ে গেলেন। যেই আলী একসময় বলতেন “I am the greatest of all time!”. তিনি এখন বলতে শুরু করলেন I am the great and Allah is the greatest ।

 

(মোহম্মদ আলী ছিলেন সকল কৃষ্ণাঙ্গদের অনুপ্রেরণা। তার পথ ধরেই বারাক ওবামা আজকের এ্যামেরিকান রাষ্ট্রপতি।)

 

গল্প করতে করতে মিন্টো রোড পার হয়ে রমনা পার্কের পাশ ঘেষে চলে এলাম সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানে। এখানে এসে রিকসা ছেড়ে দিলাম। উদ্দেশ্য, পার্কের ভিতর দিয়ে হেটে হেটে কলা ভবনে পৌঁছে যাব। ভিতরে ঢুকে সবার মন ভরে গেল। ঢাকা শহরে কোন এক সময় সবুজের ছোঁয়া ছিল। ইট-রডের প্রকান্ড দালান নয়, ছিল মধ্যবিত্তের ছোট ছোট টিনের ঘর আর উচ্চবিত্তের একতলা-দোতলা বাড়ী। মধ্যবিত্ত হোক উচ্চবিত্ত হোক সবার বাড়ির আঙিনায়ই ছিল বাগান। ছিল আম, জাম, পেয়ারা, জামরুল, নারকেল, শুপারি গাছের শোভা। সন্ধ্যার পরপর প্রায় সবগুলো বাড়ীতেই ভাসত হাসনাহেনা অথবা মালতিলতার সৌরভ। ৮৪-৮৫ সালের দিক থেকে হঠাৎ করেই সব উবে যেতে থাকে, ঝপঝপ করে ব্যাঙের ছাতার মত এখানে সেখানে অকপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠতে থাকে নিম্ন মানের বহুতল ভবন। যার যেখানেই সুযোগ হয়েছে গড়ে তুলেছে গায়ে গা ঘেসে বিধঘুটে সব অট্টালিকা। প্রয়োজন নেই বাগানের, চুলোয় যাক গাছপালা, চাই শুধু টাকা। এক একটা তলা ভাড়া হবে, আর আমি টাকার সাগরে ভাসব। একবারও ভাবিনি বিপন্ন পরিবেশের কথা, একবারও ভাবিনি বুক ভরে নিশ্বাস নেয়ার কথা, একবারও ভাবিনি আমাদের শিশুদের খেলার মাঠের কথা।

 

সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানটি সবুজের সমারোহ। সবুজ ঘাস আর ছোট-বড় নানান সবুজ বীথি। আর এই সবুজ পটভূমিকে অলংকৃত করেছে নানা রঙের ফুল। গাঁদা, কসমস, হরেক রঙের গোলাপ, আরো কত কি নাম না জানা ফুল। ঢালাই করা সরু পায়ে চলা পথগুলোর দুপাশে হাটু পর্যন্ত উঁচু ঝাউ গাছ তার সৌন্দর্য্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। শান্ত-নির্জন পরিবেশে মাঝে মাঝে পাখীর কাকলী শুনতে পাচ্ছি, হঠাৎ হঠাৎ ডানা ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে দু’একটি বিহঙ্গ। মাথার উপরের উজ্জ্বল সূর্যটা, আর থোকায় থোকায় উড়ে যাওয়া সাদা মেঘগুলো পুরোপুরিই মানিয়ে গেছে এই উদ্দ্যানের সাথে। সব মিলিয়ে মনোরম নৈসর্গিক পরিবেশ।

 

রমনার ইতিহাস অনেক পুরাতন। সেই ১৬১০ সালে মোগল আমলে। এগারো শত বছরের পুরাতন ঢাকা শহরকে রাজধানী ঘোষণা করলেন মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর। ইসলাম খানকে পাঠালেন সুবেদার করে। নব্য রাজধানীতে সুবেদার ইসলাম খান গড়ে তুললেন বিশাল অঞ্চল জুড়ে এক নয়ানাভিরাম নগর অরণ্য বাগ-এ-বাদশাহী। এরই পরবর্তি নাম হয় রমনা। গড়ে উঠে দুটি অপূর্ব আবাসিক এলাকা মহল্লা চিশতিয়া ও মহল্লা সুজাতপুর।

 

টানা দুশো বছর ঢাকা ছিল বিশাল বাংলার রাজধানী ও প্রাণকেন্দ্র। দিনভর শোনা যেত বাদশাহ-সুলতানদের অশ্বারোহী সৈন্যদের জমকালো কুচকাওয়াজ ও দেশী-বিদেশী বণিকদের ব্যস্ততার গমগম শব্দ। ১৪১২ সালে দরবেশ শাহ আলী বাগদাদী ঢাকা আসেন, এবং এখানকার দরবেশ শাহ বাহারের শিষ্যত্ব গ্রহন করেন। যার টোম্ব এখনো আছে ঢাকার মিরপুরে। পর্তুগীজ ইতিহাসবিদ জাও দে বারোস ১৫৫০ সালে ঢাকার মানচিত্র স্থাপন করেন তার সুখ্যাত গ্রন্থ ‘ডিকেড্‌স অফ এশিয়ায়’। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রথম গভর্ণর উইলিয়াম হেজেস ১৬৮১ সালে ঢাকা এসে নগরীর সৌন্দর্যে মোহিত হয়েছিলেন। তার কাছে মনে হয়েছিল, এটি বাগান আর প্রাসাদের একটি অপূর্ব সুন্দর নগরী। ১৮ শতকের গোড়ার দিকে আর্মেনীয় ব্যবসায়ীরা পাট ও চামড়ার ব্যবসায় সাফল্য লাভ করলে, এখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এক সময় রাজধানী স্থানান্তরিত হলো মুর্শিদাবাদে, তার কিছুকাল পরে পলাশির ট্রাজেডি, আর সেইসাথে বহুকালের জন্যে সদ্য স্থাপিত ইংরেজ নগরী কলকাতা দখল করে নিল ঢাকার স্থান। কালের স্রোতে ঢাকা হারালো তার গৌরব। রমনা হয়ে উঠল জঙ্গল। ধীরে ঢাকার এমনই শোচণীয় অবস্থা হলো যে, একসময় লেখক বঙ্কিমচন্দ্র কটাক্ষ করে বলল, “ঢাকাতে থাকে কেবল, কাক, কুকুর আর মুসলমান”।

 

ঢাকা তার হৃত গৌরব ফিরে পাবার একটা সুযোগ পেল ১৯০৫ সালে যখন ভাইসরয় লর্ড কার্জন ঢাকাকে নতুন প্রদেশ পূর্ব বাংলা ও আসামের রাজধানী ঘোষণা করলেন। কিন্তু ঢাকার আকাশে সৌভাগ্যের চাঁদ বেশিদিন রইল না। ১৯১১ সালে পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে, ঢাকা রাজধানীর মর্যাদা আর একবার হারায়।

 

১৮২৫ সালে ঢাকার বৃটিশ কালেক্টর মিঃ ডো রমনার পূণঃনির্মানের কাজ হাতে নেন। ডো-র নির্দেশে শ্রমিকরা কয়েক মাস ঘাম ঝরিয়ে সেখান থেকে জংলা ঝোপঝার পরিস্কার করে ও পরিত্যক্ত দালান, মনুমেন্ট ও টোম্বগুলো  ভেঙে ফেলে। রেখে দেয়া হয় শুধু গ্রীক টোম্ব (যা বর্তমানে টি, এস, সি-র ভিতরে আছে), কালীমন্দির, ইরাণী বণিক শাহবাজ খান কর্তৃক ১৬৭৯ সালে নির্মিত শাহবাজ মসজিদ ও মীর জুমলা গেট (যা ঢাকা গেট নামেও খ্যাত)। এই রিনোভেটেড এলাকার নতুন নামকরণ হয় রমনা, এবং একে রেসকোর্স হিসাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রেসকোর্সের একপাশে গড়ে ওঠে বৃটিশ মিলিটারি ক্লাব। ঢাকার নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় ঘোড়দৌড় অতি দ্রুতই খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কাটাবনে একটি বিশাল আস্তাবলও তৈরী করা হয়। নবাবরা এখানে মনোরম বাগান গড়ে তোলেন এবং একটা অংশের নাম দেন শাহবাগ (বাদশাহী বাগান)।

 

এই রমনার একপাশে রয়েছে ঢাকা ক্লাব ও শিশু পার্ক, আরেক পাশে রয়েছে পুরাতন গভর্ণর হাউস (বর্তমানের হাইকোর্ট)। ঠিক তার পাশেই পরম শান্তিতে শুয়ে আছেন আমাদের জাতীয় নেতা শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী। জাতি তাদের অবিস্মরণীয় অবদানের কথা স্মরণ রেখে, কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসাবে তাদের সমাধির উপর গড়ে তুলেছেন প্রকান্ড স্মৃতিসৌধ। আরেক পাশে ঘুমিয়ে আছেন বীর যোদ্ধা ও বিদ্রোহী কবি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এখানেই ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”,  এখানেই আত্মসমর্পন করেছিল পাক হানাদার বাহিনী, এখানেই ময়দান প্রকম্পিত হয়েছিল লক্ষ লক্ষ বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধার বিজয় উল্লাস জয় বাংলা ধ্বনিতে। এই রমনা ইতিহাসের পাতা উল্টে উল্টে মনে করিয়ে দেয় কয়েক শত বছরের গৌরব গাঁথা। কানপেতে যেন শুনতে পাই শেরে বাংলার ব্যঘ্র হুংকার,  সোহ্‌রাওয়ার্দীর জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা, বিদ্রোহী কবির অগ্নিবীণার ঝংকার, বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী ভাষণ, পরাজিত নিয়াজির আত্মসমর্পনের দলিলে স্বাক্ষর দেয়ার খসখস শব্দ, আর হাজারো জনতার বিজয়োল্লাস।

 

 

(স্মৃতি ঝলমল সুনীল মাঠের কাছে,

পানি টলটল মেঘনা নদীর কাছে,

আমার অনেক ঋণ আছে, ঋণ আছে

বকের ডানায় ছাওয়া চরের কাছে,

চাঁদ জাগা বাঁশ বাগানের কাছে,

আমার অনেক ঋণ আছে, ঋণ আছে)

 

বিশ্বখ্যাত গায়িকা রূণা লায়লার গাওয়া এই গানটি একসময় আমার মনকে আপ্লুত করত, এখনো করে!

 

৬৫৭ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “লিস্টনিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ ৮”

মওন্তব্য করুন : ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।