চিরবিদায় নিলেন আমার ফুপু ভাষা সৈনিক ডাঃ কামরুননিসা


—————————————— ডঃ রমিত আজাদ

চিরবিদায় নিয়েছেন ভাষা সৈনিক ডাঃ কামরুননিসা। গতকাল ১৩ই সেপ্টেম্বর ২০১২ বৃহঃস্পতিবার সকাল আটটায় তিনি ঢাকায় তার উত্তরার বাসভবনে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বৎসর। তিনি বেশ কিছুদিন যাবৎ ক্যন্সারে ভুগছিলেন। তিনি দুই কন্যা, আত্মীয়-স্বজন ও অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গিয়েছেন। তাঁর স্বামী মরহুম ডাঃ মতিয়ুর রহমানও একজন চিকিৎসক ছিলেন। তিনি ১৯৮৪ সালে ইন্তেকাল করেন। ডাঃ কামরুননিসা পটুয়াখালির বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও গণপরিষদের সদস্য মরহুম এ্যাডভোকেট এমদাদ আলীর চতুর্থ কন্যা। মরহুম এ্যাডভোকেট এমদাদ আলী, শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হকের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে বৃটিশ বিরোধী ও পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন, এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেন ও পটুয়াখালী থেকে বিজয়ী হয়ে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

ডাঃ কামরুননিসা ১৯৫২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী ছিলেন। এই সময় মহান ভাষা আন্দোলন শুরু হলে তিনি মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে ঝাপিয়ে পড়েন। সেই অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন।

তার বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (বাংলাদেশ) ও ডো মেডিক্যাল কলেজ (পাকিস্তান) থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্তিতে তিনি বাংলাদেশ , পাকিস্তান ও লিবিয়ায় একাধিক হাসপাতালে চিকিৎসক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

লিবিয়ার বাইশ বৎসরের দীর্ঘ কর্মজীবন শেষে, তিনি পুণরায় মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন । দীর্ঘদিন তিনি দেশের মানুষকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন এবং পাশাপাশি সামাজিক কর্মকান্ডেও অংশ নেন।

গতকাল বাদ আছর জানাজা শেষে, বণাণী গোরস্থানে মরহুমাকে দাফন করা হয়। বেসরকারী টেলিভিশন ‘চ্যানেল আই’ ভাষা সৈনিক ডাঃ কামরুননিসার ইন্তেকালের শোক সংবাদ প্রচার করেছে।

আজ তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই। আপনারা তার আত্মার মাগফেরাৎ কামনা করে দোয়া করবেন।

ফুপুকে যেমন দেখেছি:

ফুপুকে প্রথম জ্ঞানত দেখি ১৯৭৫ সালে। তখন তিনি লিবিয়ায় কর্মরত ছিলেন ছুটিতে দেশে বেড়াতে এসেছিলেন। তখন বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। তাই এলাকায় উনার আলাদা সম্মাণ ছিল। তার সাথে এলেন তার স্বামী ডাঃ মতিয়ুর রহমান, বড় মেয়ে ফ্লোরিন ও ফুটফুটে কোলের সন্তান ছোটমেয়ে দিনা। ভাষা আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে যেভাবে কারাবরণ করেছিলেন তাতে তাঁর তেজী ও সাহসী ভূমিকাই প্রকাশ পায়। ঐ সময়ের ছোট্ট একটি ঘটনা দিয়ে তার সাহসিকতার আরেকটি পরিচয় পাওয়া যাবে। ঢাকায় একদিন তিনি ও তার বড় বোন সন্ধ্যার পর রিকসায় চড়ে ঘরে ফিরছিলেন। রিকসা মিন্টু রোডের উঁচু গাছ ঘেরা নির্জন রাস্তায় প্রবেশ করার একটু পরেই দু’জন ছিনতাইকারী তাদের পথরোধ করে দাঁড়ালো। এই পরিস্থিতিতে সাথে টাকা-পয়সা, গয়না-গাটি যা ছিল, তা দিয়ে দেয়াটাই নিরাপদ ছিল। কিন্তু ফুপু হঠাৎ রিকসার উপর দাঁড়িয়ে উঠে, বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে উঠলেন। প্রায় সাথে সাথেই ধেয়ে এলো একটি মটর সাইকেল। মটর সাইকেলের শব্দ শুনতে পেয়ে পিঠটান দিল ছিনতাইকারী দু’জন। মটর সাইকেল আরোহী ছিলেন জগন্নাথ কলেজের একজন নীতিবান ছাত্র। তিনি এসে তাদেরকে উদ্ধার করলেন, এমনকি পাহাড়া দিয়ে বড় বোনসম আমার দুই ফুপুকে অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন।

সেই সময়ের দরিদ্র বাংলাদেশে, মানুষদের কাছে বিদেশী উপহার ছিল প্রায় স্বপ্নের মতই। ফুপু কাউকে ডিপ্রাইভ না করে আমাদের সকল আত্মীয়-স্বজনের জন্য ব্যাগ ভর্তি করে উপহার নিয়ে এসেছিলেন । একমাসের মত ছুটি কাটিয়ে লিবিয়ায় তার কর্মস্থলে ফিরে যান।

পরেরবার এলেন কয়েক বৎসর পর। আবারও ব্যাগ ভর্তি উপহার সবার জন্য। সেই সাথে আনলেন বড় বড় সাইজের থোকায় থোকায় আঙুর। বড় তো দূরের কথা, সেই সময়ে ছোট আঙুরও দেশে দুষ্প্রাপ্য। সব আত্মীয় স্বজনের বাড়ি বাড়ি পৌছে দিলেন সেই আঙুর।

যতদূর মনে পড়ে ১৯৮০ সালের দিকে লিবিয়ার পাট চুকিয়ে একবারে দেশে ফিরে আসেন। তার ২২ বৎসরের চিকিৎসা ও কর্মজীবনে সন্তষ্ট হয়ে লিবিয়া সরকার তাকে নাগরিকত্ব দিতে চেয়েছিল, ফুপু বাংলাদেশের প্রতি দরদ দেখিয়ে নিজগুনে তা প্রত্যাখ্যান করেন।

প্রবাস কর্মজীবনের কষ্টার্জিত অর্থে তিনি দেশে নিজের বসত দালান তৈরী করেন। সেই দালানের কয়েকজন শ্রমিক ভাগ্যান্বেষণে লিবিয়া যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে, ফুপু সবাইকেই সাহায্য করেন।

আরেকবার দেশে ছোটখাট একটি বন্যা হলে, এলাকার তরুণরা উদ্যোগ নিয়ে ঢাকার মগবাজার টি এন্ড টি উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি ত্রাণকেন্দ্র খোলে। ফুপু নিজে গাড়ী চালাতেন। একদিন সেই গাড়ী চালিয়ে যখন যাচ্ছিলেন এলাকার তরুণরা তার গাড়ী থামিয়ে সাহায্য চাইল। তিনি সাহায্য তো দিলেনই, আরো বললেন, “আমি ডাক্তার, চলো তোমাদের ত্রাণকেন্দ্রে গিয়ে অসুস্থদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসি।” উনার এই বদান্যতায় সবাই মুগ্ধ হয়। এরপর বেশ কয়েকদিন তিনি সেই ত্রাণকেন্দ্রে বিনামূল্যে চিকিৎসা করেছিলেন।

যতদূর জানি ফুপু পটুয়াখালী শহরের প্রথম মহিলা এম,বি,বি,এস, ডাক্তার। শুনেছি আমার জন্মের পর আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ি। বাবা-মা আমার জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন প্রায়। এই সময় ফুপু দেশে আসেন, আমাকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলেন।

আমরা দাদার আমল থেকেই ঢাকায় আছি, তৃতীয় জেনারেশন ঢাকায় বলে গ্রামের সাথে যোগাযোগ প্রায় নাই। একদিন ফুপু ঠিক করলেন গ্রামে যাবেন। যেইকথা সেই কাজ, গিয়ে হাজির হলেন সেখানে। সেখানে গিয়ে দেখলেন তাদের সুপেয় পানির সমস্যা, কিছু রাস্তাঘাট মেরামতের অপেক্ষায়, ইত্যাদি। তিনি তার সঞ্চিত অর্থের একটা বিরাট অংশ ব্যায় করলেন গ্রামের উন্নয়নে। একেবারে বিনা স্বার্থে এইরকম কাজ করা যায় কেবল দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম থাকলে।

এই মহানহৃদয় ব্যাক্তি আজ আর আমাদের মধ্যে নেই, মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করি, যেন তিনি ফুপুকে বেহেশত নসীব করেন।

৮২৭ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “চিরবিদায় নিলেন আমার ফুপু ভাষা সৈনিক ডাঃ কামরুননিসা”

  1. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    আপনার ফুপুর কথা পড়ে ভাল লাগলো। একটি বর্ণাঢ্য এবং পরিপূর্ণ জীবন কাটিয়ে গেছেন। উনার প্রতি শ্রদ্ধা।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সামিয়া (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।