সীমান্তের হৃদয়বান মানুষেরা অসহায় রোহিঙ্গা মা ও শিশুদের কাছে খাদ্য ও পানীয় পৌছে দিন – মানুষের বাধভাঙ্গা ভালোবাসার কাছে মানুষের হৃদয়হীনতা পরাজিত হোক

সীমান্তের ওপার থেকে সামান্য আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসা ঐ মা ও শিশুগুলোর দুঃখ দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনা। আমি নিজেও তো একবার আমার স্ত্রী ও দুধের শিশুকে নিয়ে এমনি বিপদে পড়েছিলাম। ঘটনাটি বছর দশেক আগে, আমি ও আমার স্ত্রী তখন ইউরোপীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত। আমাদের সাথে ছিল এক বছরের শিশুপুত্র। তুহীন শীতের রাত, বাইরে মাইনাস দশ ডিগ্রী তাপমাত্রা। খালি গায়ে বাইরে একঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকলে একটি সুস্থ-সবল মানুষ শীতে জমেই মারা যাবে। রাত একটার দিকে প্রচন্ড একটি চিৎকার শুনতে পেলাম, “আগুন আগুন আমাদেরকে বাঁচান।” হুড়মুড় করে বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। দরজা খুলে বাইরে তাকাতেই দেখি, বানের পানির মত মানুষ করিডোর আর সীঁড়ি দিয়ে ছুটে নীচে নামছে। কোথায় আগুন লেগেছে বিল্ডিংয়ের কোথায় পুড়ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম, তবে বিপদ যে ভীষণ এটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না। খুব দ্রুত কাপড়-চোপড় পড়ে স্ত্রীকে বলাম, “তুমি বাচ্চাটাকে নিয়ে বিল্ডিংয়ের বাইরে চলে যাও আমি আসছি”, স্ত্রী ইতিমধ্যই দু-একটি প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ছোট একটি ব্যগ গুছিয়ে ফেলেছিল। বললাম, “ব্যাগটি নিয়ে আমি বের হবো, তুমি বাচ্চাটাকে নিয়ে বেরিয়ে জীবন রক্ষা কর।” সেই চরম বিপদের সময় আমার মনে হয়েছিল, টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ কিছুই নয়, জীবন রক্ষা করাটাই সব চাইতে বড় কথা।

ওরা বেরিয়ে গেল। আমি আরও কিছুক্ষণ রইলাম। ব্যগটা আরেকবার চেক করলাম, পাসপোর্ট (যা আমাদের ঐ দেশে অবস্থানের বৈধতা প্রমাণ করে), দু-একটি প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র, টাকা পয়সা, ইত্যাদি সেখানে ছিল। আমি বিল্ডিংয়ের বাইরে বেরিয়ে এসে যা দেখলাম, এরকম ভয়াবহ দৃশ্য আমার জীবনে আর কখনো দেখিনি। বিল্ডিংটির দুটো ঊইং ছিল, আমি যেই ঊইংটিতে ছিলাম সেটি অক্ষত রয়েছে তবে অপর ঊইংটি দাউ দাউ করে জ্বলছে। ভিতরে মানুষ পুড়ছে, তারা মরণ যন্ত্রণায় চিৎকার করছে, কেউ কেউ পাঁচতলা ছয়তলার উপর থেকে লাফ দিয়ে পরছে। এইসব দৃশ্য দেখে মাথা ঠিক রাখা যায়না। বাইরে শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। চকিতে আমার সম্বিত ফিরে এলো। কোথায় আমার স্ত্রী ও শিশু? চারপাশে খুঁজতে শুরু করলাম, কোথাও ওদের দেখতে পেলাম না। পাগলের মত চিৎকার করে স্ত্রীর নাম ধরে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু আরো হাজারো চিৎকারের ভীড়ে আমার চিৎকার বারবারই হারিয়ে যাচ্ছিল। তুহীন শীতের ঐ বরফাচ্ছন্ন পথ ধরে পাগলের মত মেইন রোডের দিকে ছুটে গেলাম। কিছুদূর ছুটে যাওয়ার পর, একটি আন্ডার পাসের পাশ থেকে আমার স্ত্রী আমাকে ডাক দিলেন। আমাদের শিশুটিকে কোলে নিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেই মূহুর্তে পৃথিবীর সব সম্পদ আমার সামনে এনে হাজির করলেও আমি অত খুশী হতাম না।

এরপর পর মূহুর্তের ভাবনা হলো এই তুহীন শীতের রাত্রিতে কোথায় আশ্রয় নেব? কাছাকাছি অন্য বাংলাদেশী ছাত্ররা থাকত। তাদের কাছে গেলাম। তারা হৃদয়হীন না। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল, “ভাইয়া আপনি বেঁচে আছেন!” আমার সন্তানটিকে কোলে তুলে নিল, “বাবু তুমি ভালো আছো?” আমার স্ত্রীকে সসম্মানে বলল, “ভাবী কোন চিন্তা করবেন না, আমরা আছি”।

সবাইকে দেখলাম পোষাক পরে রেডি হচ্ছে, ঐ বিল্ডিং-এ যাবে, বিপদগ্রস্ত মানুষদের উদ্ধার করেতে। স্ত্রী ও সন্তানকে নিরাপদে রেখে, আমিও ওদের সাথে বেরিয়ে পড়লাম, যদি বিপদগ্রস্তদের কোনভাবে সাহায্য করতে পারি।

সেই ভয়াবহ রাতটিকে আমি কোনদিন ভুলব না। সেটা অনেকগুলো কারনে, তার মধ্যে সবচাইতে বড় যে জিনিসটি দেখতে পেয়েছিলাম, সেটি ‘মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা‘।

এবার বিপরীত চিত্রটি কল্পনা করি। আমরা ছুটে গেলাম ঐ মানুষগুলোর কাছে, তারা ধাক্কা দিয়ে আমাদের করিডোরে ফেলে দিয়ে বলল,” আপনি বিপদে পরেছেন তাতে আমাদের কি। যান যান ঐ আগুনে ফিরে যান।” তবে কি আমরা ঐ রাতেই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতাম না? আমার ফুটফুটে সন্তানটির বয়স কি আজ দশ বছর হতো? যে এখন চোখ বড় বড় এই কাহিনী শোনে আর বলে, “বাবা কোন আঙ্কেলরা আমাদের বাঁচিয়েছিল? আর যদি মানুষ না হয়ে কোন জ্বীন-ফেরেশতা আমাদের রক্ষা করত, তাতে মানুষের গৌরব বাড়ত না কমত?

মানবতা, মানবতা, মানবতা, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাই, মানবজাতিকে এতদূর নিয়ে এসেছে। আর আমরা যতটুকু পিছিয়েছি, তা কেবল মানুষের হৃদয়হীনতার জন্যই। তারপরেও আমার নাতিদীর্ঘ জীবনে ও ইতিহাসের পাতায় যতটুকু দেখেছি, মানুষের বাঁধভাঙ্গা ভালোবাসার কাছে মানুষের হৃদয়হীনতা বরাবরই পরাজিত হয়েছে।

সামান্য আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসা ঐ রোহিঙ্গা মা ও শিশুগুলোর দুঃখ আর সইতে পারিনা। মানুষ হিসাবে আমাদের পবিত্র দায়িত্ব, তাদের রক্ষা করা। আমাদের জাতীয় কবিই তো বলেছেন, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জান? কান্ডারি বলে ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।’

সীমান্তের হৃদয়বান মানুষেরা অসহায় রোহিঙ্গা মা ও শিশুদের কাছে খাদ্য ও পানীয় পৌছে দিন। আমরা যারা দূরে আছি তারাও চেষ্টা করব কোন না কোনভাবে তাদের সাহায্য করতে – মানুষের বাধভাঙ্গা ভলোবাসার কাছে মানুষের হৃদয়হীনতা আর একবার পরাজিত হোক

১,০৮৩ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “সীমান্তের হৃদয়বান মানুষেরা অসহায় রোহিঙ্গা মা ও শিশুদের কাছে খাদ্য ও পানীয় পৌছে দিন – মানুষের বাধভাঙ্গা ভালোবাসার কাছে মানুষের হৃদয়হীনতা পরাজিত হোক”

  1. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    রমিত ভাই,
    আপনার অভিজ্ঞতা বেশ রোমহর্ষক। বেঁচে এসেছেন জেনে ভালো লাগল। মানুষের প্রকৃত রূপ দেখা যায় চরম বিপদের সময় যখন কারো প্রাণ-সংশয় দেখা দেয়।

    আপনার অভিজ্ঞতার সাথে রোহিঙ্গাদের বিপদের একটা মিল (প্রাণ সংহার) থাকলেও বেশ কিছু অমিলও আছে। এদের মধ্যে সবথেকে বড়টা হচ্ছে- আপনার সময় বাঙ্গালিত্ব আর মানুষ পরিচয়ের মাঝে কোন দেয়াল ছিল না, কিন্তু এখন রোহিঙ্গাদের বেলায় তাদের বার্মীজ অনাগরিকত্ব (সেইসাথে মনে হয় খানিকটা মুসলমানত্বও) তাদের 'মানুষ' পরিচয়ের থেকে বড় হয়ে উঠেছে......


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
    • রমিত ভাই

      গত কয়েকদিনে নাসাকা বাহিনী আর বার্মিজ নৌবাহিনী রোহিঙ্গাদের বহনকারী অজানা সংখ্যক নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে আশ্রয় না পেয়ে উত্তাল সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে অসংখ্য ট্রলার। তাদের খাদ্য নেই, আবার উত্তাল সাগরে যে কোন সময় ভেসে যাবার ভয় আছে।

      আজ ভাবতে খারাপ লাগছে, এদেশের জনসংখ্যা রাতারাতি আরো কয়েক কোটি বেড়ে গেলেও যাদের থাকা-খাওয়ার বিন্দুমাত্র সমস্যা হবার সম্ভাবনা নেই, সেই আমরা আজ লেগে গিয়েছি অসহায় সে মানুষগুলোকে তাড়াবার চেষ্টায়।

      তবে কয়েকটি খবরে দেখলাম, সেন্টমার্টিন উপকূলের মাছ ধরা জেলে ট্রলারগুলো গভীর সমূদ্রে গিয়ে অচ্ছুত সে মানুষগুলোকে বহনকারী কয়েকটি ট্রলারে খাবার আর পানি দিয়ে আসছে। রাতের গভীরে গোপনে দু-একটি ট্রলার ভিড়িয়ে রোহিঙ্গাদের নিজেদের বাড়ীতে আশ্রয় দিয়েছে স্থানীয় লোকজন।

      জানিনা কেন, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মনের ভেতর।

      আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন।

      জবাব দিন
  2. পিয়া(০৩-০৯)
    মানুষের বাধভাঙ্গা ভলোবাসার কাছে মানুষের হৃদয়হীনতা আর একবার পরাজিত হোক

    সহমত...ছিদ্রান্বেষী মানুষ সবেতেই সমস্যা খোঁজে,ষড়যন্ত্রের গন্ধ পায়...
    অতীতে কি হয়েছে,পররাষ্ট্রনীতি তে কি আটকাচ্ছে,মিয়ানমারের আভ্যন্তরীন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা,জামায়াত বা মুসলিম বিশ্বের সম্পৃক্ততা...কত কথাই বলছে দেশের স্বার্থ নিয়ে চিন্তিত সুশীল সমাজ...
    প্রান বাঁচানোর তাগিদে পালিয়ে আসা মানুষগুলির জন্যে এই বিষয়গুলি কি কোন অর্থ রাখে?তারা শুধু একটু আশ্রয় চায়...যেমন চেয়েছিল ৭১ এ প্রাণ বাঁচাতে ভারতে পাড়ি জমানো বাঙ্গালিরা...এক রোহিঙ্গা মা সীমান্তে সন্তান প্রসব করেছেন...এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে তারা পরিকল্পনা করে এদেশে আসতে চায়?তাদের জন্যে সমস্যায় ভরা বাংলাদেশে আরো বিরাট কোন সমস্যা হবে?

    জবাব দিন
  3. আসাদুজ্জামান (১৯৯৬-২০০২)
    মানুষের বাধভাঙ্গা ভলোবাসার কাছে মানুষের হৃদয়হীনতা আর একবার পরাজিত হোক

    কীইবা বলার আছে। এই জাতি তো এত হৃদয়হীন ছিলনা। আমার দেখা সময়টুকুতেই আমি এত নির্দয় আচরন আর কখনো দেখিনি। এই জাতি ব্যবসায়ী জাতি, এই জাতি মহাজন জাতিতে পরিণত হচ্ছে ক্রমেই। কারো দুঃখে কষ্টে এদের কিচ্ছু আসে যায় না। স্বজাতির প্রতিই নানান ঘটনা-দুর্ঘটনার মাধ্যমে হৃদয়হীন আচরন দেখে আসছিলাম। যারা স্বজাতির প্রতিই এমন, তারা বিজাতির প্রতি তো এমনই হবে। কষ্ট লাগে, সরল-সহজ এক জাতির এমন অমানবিক হয়ে উঠার পরিবর্তন দেখতে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।