অভিমান করে চলে গেলেন দেলোয়ার হোসেন স্যার

অভিমান করে চলে গেলেন দেলোয়ার হোসেন স্যার

 

গত ২৪শে নভেম্বর গিয়েছিলাম রিইউনিয়নে। সিলেট ক্যাডেট কলেজের রিইউনিয়ন, নিজের প্রাণের কলেজের রিইউনিয়ন। অনেকগুলো বছর ধরেই অধির আগ্রহ অপেক্ষা করছিলাম। ২৪ তারিখ দুপুরের দিকে কলেজে ফিরে যখন নিজের ঘরে ফেরার আনন্দে উদ্ভাসিত, ঠিক সে সময়েই একটি দুঃসংবাদ পেলাম। আমাদের প্রিয় দেলোয়ার হোসেন স্যার আর নেই।

প্রথমে ভেবেছিলাম তিনি অসুস্থতা জনিত কারণে ইন্তেকাল করেছেন। কিন্তু পরে যা শুনলাম তাতে আর আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না। রংপুর ক্যাডেট কলেজের উপাধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন (৫৪) ক্যাম্পাসের বাড়িতে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে কাপড় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তিনি মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করেছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলতাফ হোসেন জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় খবর পাওয়ার পর সেখানে গিয়ে সিলিং ফ্যান থেকে মরদেহ নামানো হয়। আত্মহত্যা করার আগে তিনি একটি চিঠি লিখে গেছেন। তাতে লেখা, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। জীবনে বাড়ি করতে পারিনি। শরীরের অবস্থাও ভালো নয়। তাই এ জীবনে বেঁচে থেকে লাভ নেই।’

 

টুকরো টুকরো স্মৃতি মনে পড়ল। ১৯৮২ সাল। মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ি। দেলোয়ার হোসেন স্যার এলেন বরিশাল ক্যাডেট কলেজ থেকে। ছিপছিপে গড়নের, কালো রং কিন্তু দেখতে সুন্দর, ইমপ্রেসিভ একজন তরুণ শিক্ষক। অদ্ভুত সুন্দর তার বাচনভঙ্গী আর শিক্ষকতার কায়দা। রাস্ট্রবিজ্ঞানের এই শিক্ষক দু-একটি লেকচারেই কেড়ে নিলেন আমাদের মন।পাশাপাশি তার কাছ থেকে প্রথম শুনলাম, যা অতিতে আমরা কখনই শুনিনি প্রায়। তিনি বললেন, ” তোমরা তো ভালো ছাত্র, আর্টস নিয়ে তো আর তোমরা পড়বে না। ক্লাস নাইন থেকেই সায়েন্স পড়া শুরু হবে। তারপরতো আর্টস-এর সাথে যোগাযোগ শেষ। কিন্তু আমি মনে করি, একজন সত্যিকারের মানুষ হিসাবে  আর্টস-এর কিছু বিষয় জানা অবশ্য প্রয়োজন।” এরপর তিনি স্কুল টেক্সট বুক বোর্ডের বইটি একপাশে সরিয়ে রেখে বললেন, “এই বইটি থাক, আমি তোমাদেরকে আমার মত করে পড়াব।” এরপর তিনি আমাদেরকে আলো দেখালেন, দর্শনের আলো, রাস্ট্রবিজ্ঞানের আলো, সমাজবিজ্ঞানের আলো। পথ চলা শুরু করলেন সক্রেটিস থেকে, সেই পথ ধরে পরিচয় করিয়ে দিলেন প্লেটো, এরিস্টটল,  মেকিয়েভেলি, দর্শনের জগতের সব তারকার সাথে। মেকিয়েভেলির সেই কথাটি এখনও কানে বাজে, “শাসককে হতে হবে, সিংহের মত শক্তিশালী, শৃগালের মত ধুর্ত।” শোনালেন রোম সাম্রাজ্যের বিচিত্র সব কাহিনী।সাম্রাজ্যবাদ, রাজতন্ত্র আর গণতন্ত্রের চুলচেরা পার্থক্য বুঝিয়ে দিলেন।শুনলাম বৃটিশ শাসনামল আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প। ভাষা আন্দোলনের অমর গাঁথা। যেই জাতীয় নেতাদের আমরা ভুলতে বসেছি, তিনি শোনালেন সেই শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দি, আর মাওলানা ভাষাণীর সংগ্রামী জীবন কাহিনী। ক্লাস সেভেন ও এইট, এই দু বছরেই তিনি আমাদের শেখালেন অনেক অনেক কিছু। তাকে শিক্ষক হিসাবে না পেলে, আমরা হয়তো তা কোন দিনই শিখতে পারতাম না।

 

পরবর্তিকালে বিদেশে মাইনর কোর্স হিসাবে পড়তে হয়েছিল, দর্শন, রাস্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান। বিদেশী শিক্ষকদের  প্রশংসা পেয়েছিলাম। আমি মনে করি, এই প্রশংসা দেলোয়ার হোসেন স্যারের প্রাপ্য।

 

সেই গুনি শিক্ষক অভিমান করে চলে গেলেন। অর্থকস্টে জর্জরিত হবেন জীবনের শেষ দিনগুলি, তিনি তা মেনে নিতে পারেননি। আমার মনে পড়ে, অনেক কাল আগে যখন আমি তার ছাত্র ছিলাম। এক কোরবানী ঈদের পর, বাড়ী থেকে কলেজে ফিরে তিনি বলেছিলেন, “আমাদের বাড়ীতে এক বিডিআর-এর হাবিলদার কোরবানী দিয়েছে দুটি মহিষ। আর আমি দিলাম গরুর এক ভাগ। আমাকে গ্রামের একজন বলল, ‘হাবিলদার সাহেব কোরবানী দিল দুটি মহিষ, আর আপনি কি করলেন?’ দেখতো, এইট পাশ ‘হাবিলদারের তুলনা করে এম, এ, পাশ প্রফেসরের সাথে।” তাইতো, আমাদের এই অভাগা দেশে এম, এ, পাশ প্রফেসরের তো সত্যিই কোন মূল্য নেই!

 

জানি-তবু জানি

নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;

অর্থ নয় , কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়–

আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে

খেলা করে;

আমাদের ক্লান্ত করে,

ক্লান্ত-ক্লান্ত করে…”

১,৮০১ বার দেখা হয়েছে

২৪ টি মন্তব্য : “অভিমান করে চলে গেলেন দেলোয়ার হোসেন স্যার”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    ফড়িঙের দোয়েলের জীবনের সাথে এইটুকু তফাত আমাদের জীবনের,
    ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে কখনো সবকিছু।
    এমন মেধাবী, সংবেদনশীল মানুষের চলে যাওয়া কেমন প্রশ্নবোধক হয়ে রয়।
    কোন ভাষা খুঁজে পাইনা।
    দেলোয়ার হোসেন নামটা খুব কমন এমনিতে, এই নামে বেশ কয়েকজন স্যারকে পেয়েছিলাম।
    কিন্তু এঁকে পাইনি।
    স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা।

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    “আমাদের বাড়ীতে এক বিডিআর-এর হাবিলদার কোরবানী দিয়েছে দুটি মহিষ। আর আমি দিলাম গরুর এক ভাগ। আমাকে গ্রামের একজন বলল, ‘হাবিলদার সাহেব কোরবানী দিল দুটি মহিষ, আর আপনি কি করলেন?’ দেখতো, এইট পাশ ‘হাবিলদারের তুলনা করে এম, এ, পাশ প্রফেসরের সাথে।”
    সেই পন্ডিত মাশাই আর কুকুরের তিন পা।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    কেন জানি আমাদের সমাজ এখন আর দূর্ণীতি বা অসদোপায়ে সম্পদ অর্জনকে আর খারাপ চোখে দেখে না, শুধুমাত্র দেখে কে কত সম্পদশালী আর ক্ষমতাবান। সবাই যদি এই সব দুই নম্বর মানুষদেরকে ঘৃণার চোখে দেখা শুরু করে সৎ মানুষদের শ্রদ্ধা করা শুরু করতো তাহলে অনেক কিছু থেকে মুক্তি পাওয়া যেত।

    স্যারকে শ্রদ্ধা।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  4. সাইফ শহীদ (১৯৬১-১৯৬৫)

    ঢাকাতে থাকি তখন। একবার ঠিক করলাম এক তালিকা তৈরী করবো সৎ মিনিস্টার এবং সেক্রেটারীর লিস্ট। কয়েক জন বন্ধু মিলে নাম পেশ করতে লাগলাম। আমাদের 'ক্রাইটেরিয়া'-টা বোধ হয় একটু কড়াকড়ি হয়েছিল। যখনই এক জন কোন নাম বলে, অন্য আর একজন এসে শুনিয়ে দেয় গল্প কি ভাবে সেই ব্যক্তি সুবিধা আদায় করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত কাউকে খুঁজে পাইনি। বিশ্বাস হয়?...

    দেলোয়ার হোসেনকে আমি চিনিনা - তবে খুব দুঃখ পেলাম এক জন নীতিবান মানুষের এভাবে চলে যাওয়াতে।

    কিন্তু আমি মনে করি, একজন সত্যিকারের মানুষ হিসাবে আর্টস-এর কিছু বিষয় জানা অবশ্য প্রয়োজন।

    ফৌজদারহাটে কর্নেল ব্রাঊন এটা বিশ্বাস করতেন। তাই ক্লাশ টেন পর্যন্ত আমাদের সবাইকে Humanities পড়তে হতো।

    সুন্দর ভাবে লেখার জন্যে রমিত আজাদকে অনেক ধন্যবাদ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।