প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ

নির্মলেন্দু গুণ শুভ জন্মদিন কবি।

পঞ্চ পান্ডবের পর বাঙলা ভাষায় আমার প্রিয় কবিদের অন্যতম নির্মলেন্দু গুণ। গুণকে ষাটের দশকের কবি বলা যায়; নাকি সত্তর। গুণকে আর যাই হোক দশকে আটকে রাখা যায় না। তিনি কালোত্তীর্ণ কিনা তা এখনি বলা সম্ভব নয়, কিন্তু তিনি যে যুগোত্তীর্ণ এতে কোন সন্দেহ নেই।

নিজের সম্পর্কে খুব সহজেই ঠাট্টা করতে পারেন এই কবি। দাড়ি রাখেন রবীন্দ্রনাথ সাজতে তাও বলেন। পাগল টাইপ, আলাভোলা এই কবি সংসার করবেন তা কি করে হয়, বৌ যথারীতি তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। একমাত্র মেয়ে থাকেন কবির সাথেই। মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসেন। ভালোবাসেন দেশকে, পতাকাকে। ভালোবাসেন মুজিব কে, মুজিব কন্যাকে। কোন এক কালে ভোটেও দাড়িয়েছিলেন।
কোন এক টিভি শোতে গেলে হুমায়ুন আহমেদ পাশে বসা শামসুর রাহমানকে জিজ্ঞাসা করেন এই মুহুর্তে বাঙলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি কে? শামসুর রাহমান হুমায়ুন আহমেদের কানের কাছে মুখ এনে বলেছিলেন নির্মলেন্দু  গুণ। গুণের আরেক বন্ধু আমার অত্যন্ত প্রিয় হুমায়ুন আজাদ গুণের সম্পর্কে, গুণের কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, গুণের কবিতা ব্যক্তিগত কামনা-বাসনা থেকে উঠে আসা। 
অন্যত্র হুমায়ুন আজাদ বলেন, ও তো (নির্মলেন্দু গুণ) তাও নিজের কামনা-বাসনা কে কবিতায় রূপ দিতে পেরেছে, অন্যরা তো তাও পারেনি। 

আমার এই দুই প্রিয় উপন্যাসিক ও কবি একত্রে গলায় গলায় মিলে মদ পান করতেন। তাদের প্রিয় ব্রান্ড ছিলো সিভাস রিগাল। জানি না গুণ আজ আজাদকে ছাড়া কি করে মদ খান? হয়তো প্রথম চুমুকটা পরলোকগত বন্ধুর উদ্দেশ্যে পান করেন। 
গুণ যে কম বয়সে সমকামী ছিলেন তাও কবিতায় বলেন অনায়াসে। কিন্তু তিনি যে নারী শরীর ভালোবাসেন তাও জানাতে ভুল করেন না। এলেন গিনসবার্গ উদ্দেশ্য করে লেখা কবিতায় তিনি অনায়াসে বলেন, ছেলেবেলায় আমিও ছেলে ভালোবাসতুম, কিন্তু তুমি যে ক্যানো আজো? 
দাড়ি থাকায় পাকিস্থান আমলে জামাত শিবির হিসাবে হেনস্তা হয়েছেন আবার পাকিস্থান আর্মি দের হাত থেকে ১৯৭১ এ জানে বেঁচেছেন। নিচের লেখাটি হুমায়ুন আহমেদের জ্যোস্না ও জননীর গল্প থেকে নেয়া। 

Page 319-20 Gun

কবির জন্ম হয়  জুন ২১, ১৯৪৫ (আষাঢ় ৭, ১৩৫২ বঙ্গাব্দ), কাশবন, বারহাট্টা, নেত্রকোণা) বাংলাদেশ। মাত্র ৪ বছর বয়সে মা বীনাপনিকে হারান তিনি ৷ মা মারা যাবার পর তাঁর বাবা আবার বিয়ে করেন৷ বারহাট্টা স্কুলে ভর্তি হন শুরুতে৷ স্কুলের পুরো নাম ছিলো করোনেশন কৃষ্ণপ্রসাদ ইন্সটিটিউট। দুই বিষয়ে লেটারসহ মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পান ১৯৬২ সালে৷ মাত্র ৩ জন প্রথম বিভাগ পেয়েছিল স্কুল থেকে৷ বাবা তাঁর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন- “কৃষ্ণ কৃপাহি কেবলম। মেট্রিক পরীক্ষার আগেই নেত্রকোণা থেকে প্রকাশিত ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণের প্রথম কবিতা ‘নতুন কান্ডারী’৷ মেট্রিকের পর আই.এস.সি পড়তে চলে আসেন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে৷ মেট্রিক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের সুবাদে পাওয়া রেসিডেন্সিয়াল স্কলারশিপসহ পড়তে থাকেন এখানে৷ নেত্রকোণায় ফিরে এসে নির্মলেন্দু গুণ আবার ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকা ও তাঁর কবি বন্ধুদের কাছে আসার সুযোগ পান৷ নেত্রকোণার সুন্দর সাহিত্যিক পরিমন্ডলে তাঁর দিন ভালোই কাটতে থাকে৷ একসময় এসে যায় আই.এস.সি পরীক্ষা৷ ১৯৬৪ সালের জুন মাসে আই.এস.সি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের ১১৯ জন প্রথম বিভাগ অর্জনকারীর মাঝে তিনিই একমাত্র নেত্রকোণা কলেজের৷ পরবর্তীতে বাবা চাইতেন ডাক্তারী পড়া৷ কিন্তু না তিনি চান্স পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগে৷ ভর্তির প্রস্তুতি নেন নির্মলেন্দু গুণ ৷ হঠাত্‍ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয় ঢাকায়৷ দাঙ্গার কারণে তিনি ফিরে আসেন গ্রামে৷ ঢাকার অবস্থার উন্নতি হলে ফিরে গিয়ে দেখেন তাঁর নাম ভর্তি লিষ্ট থেকে লাল কালি দিয়ে কেটে দেওয়া৷ আর ভর্তি হওয়া হলো না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ ফিরে আসেন গ্রামে৷ আই.এস.সি-তে ভালো রেজাল্ট করায় তিনি ফার্স্ট গ্রেড স্কলারশিপ পেয়েছিলেন৷ মাসে ৪৫ টাকা, বছর শেষে আরও ২৫০ টাকা৷ তখনকার দিনে অনেক টাকা৷ ১৯৬৯ সালে প্রাইভেটে বি.এ. পাশ করেন তিনি ( যদিও বি.এ. সার্টিফিকেটটি তিনি তোলেননি। ১৯৬৫ সালে আবার বুয়েটে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ 

স্বাধীনতার পূর্বে তিনি সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। সাংবাদিকতায়ও জড়িত ছিলেন। (ডেইলি পিপল এ সাব এডিটর ছিলেন। ) 

তিনি প্রধানত একজন আধুনিক কবি। শ্রেণীসংগ্রাম, স্বৈরাচার-বিরোধিতা, প্রেম ও নারী তার কবিতার মূল-বিষয় হিসেবে বার বার এসেছে। কবিতার পাশাপাশি ভ্রমণ কাহিনীও লিখেছেন। নিজের লেখা কবিতা এবং গদ্য সম্পর্কে তার নিজের বক্তব্য হলো –

” অনেক সময় কবিতা লেখার চেয়ে আমি গদ্যরচনায় বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি। বিশেষ করে আমার আত্মজৈবনিক রচনা বা ভ্রমণকথা লেখার সময় আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি যে আমি যে গদ্যটি রচনা করতে চলেছি, তা আমার কাব্য-রচনার চেয়ে কোনো অর্থেই ঊনকর্ম নয়। কাব্যকে যদি আমি আমার কন্যা বলে ভাবি, তবে গদ্যকে পুত্রবৎ। ওরা দুজন তো আমারই সন্তান। কাব্যলক্ষ্মী কন্যা যদি, গদ্যপ্রবর পুত্রবৎ।” 

কবির বহুল আবৃত্ত কবিতাসমূহের মধ্যে – হুলিয়াঅসমাপ্ত কবিতামানুষ (১৯৭০ প্রেমাংশুর রক্ত চাই), আফ্রিকার প্রেমের কবিতা (১৯৮৬ নিরঞ্জনের পৃথিবী) – ইত্যাদি অন্যতম।

আনন্দের বিষয় কবি বাংলা একাডেমী পদক পান ১৯৮২ সালে আর একুশে পদক পান ২০০১ সালে।

কবির প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ 

কাব্যগ্রন্থ

  • প্রেমাংশুর রক্ত চাই (১৯৭০)
  • না প্রেমিক না বিপ্লবী (১৯৭২)
  • কবিতা, অমিমাংসিত রমণী (১৯৭৩)
  • দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী (১৯৭৪)
  • চৈত্রের ভালোবাসা (১৯৭৫)
  • ও বন্ধু আমার (১৯৭৫)
  • আনন্দ কুসুম (১৯৭৬)
  • বাংলার মাটি বাংলার জল (১৯৭৮)
  • তার আগে চাই সমাজতন্ত্র (১৯৭৯)
  • চাষাভুষার কাব্য (১৯৮১)
  • অচল পদাবলী (১৯৮২)
  • পৃথিবীজোড়া গান (১৯৮২)
  • দূর হ দুঃশাসন (১৯৮৩)
  • নির্বাচিতা (১৯৮৩)
  • শান্তির ডিক্রি (১৯৮৪)
  • ইসক্রা (১৯৮৪)
  • প্রথম দিনের সূর্য (১৯৮৪)
  • আবার একটা ফুঁ দিয়ে দাও (১৯৮৪)
  • নেই কেন সেই পাখি (১৯৮৫)
  • নিরঞ্জনের পৃথিবী (১৯৮৬)
  • চিরকালের বাঁশি (১৯৮৬)
  • দুঃখ করো না, বাঁচো (১৯৮৭)
  • ১৯৮৭ (১৯৮৮)
  • যখন আমি বুকের পাঁজর খুলে দাঁড়াই (১৯৮৯)
  • ধাবমান হরিণের দ্যুতি (১৯৯২)
  • কাব্যসমগ্র, ১ম খণ্ড (১৯৯২, সংকলন)
  • কাব্যসমগ্র, ২য় খণ্ড (১৯৯৩, সংকলন)
  • অনন্ত বরফবীথি (১৯৯৩)
  • আনন্দউদ্যান (১৯৯৫ )
  • পঞ্চাশ সহস্র বর্ষ (১৯৯৫ )
  • প্রিয় নারী হারানো কবিতা (১৯৯৬)
  • শিয়রে বাংলাদেশ
  • ইয়াহিয়াকাল (১৯৯৮ )
  • আমি সময়কে জন্মাতে দেখেছি (২০০০)
  • বাৎস্যায়ন (২০০০) 

গল্পগ্রন্থ

  • আপন দলের মানুষ

ছড়ার বই

  • ১৯৮৭ সোনার কুঠার

আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ

  • আমার ছেলেবেলা
  • আমার কণ্ঠস্বর
  • আত্মকথা ১৯৭১(২০০৮)

অনুবাদ

  • ১৯৮৩ রক্ত আর ফুলগুলি

 

কবির কিছু কবিতা

১৮ টি মন্তব্য : “প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ”

  1. সামিউল(২০০৪-১০)

    পরথম!!!

    কবি আমারো অনেকে প্রিয় একজন মানুষ এবং কবি
    ক্যাডেট কলেজে তার একটা কবিতার সংকলন পেয়েছিলাম। সেখান থেকেই তার সাথে আমার পরিচয়। বেশ কিছু লেখা পড়েছি তার। অদ্ভুত ভাল লেগেছে সে সব লেখাগুলো। বিশেষ করে তার হুলিয়া আর নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ কবিতা দুটি বেশি রকমের সুন্দর।

    কবিকে দেখেছিও একদিন সোহরাওয়ারদী উদ্যানে। তার সাথে বসে একদিন কথা বলার খুব ইচ্ছা..

    :boss:
    ভাল কাজ করছেন রাজীব ভাই। কবিকে অনেক শুভেচ্ছা।


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
    • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

      😀
      কবি মাটির মানুষ।
      সবার সাথেই কথা বলেন।
      কোন রকম ঔচিত্যবোধ নেই।
      ভালোবেসে বইয়ে অটোগ্রাফ দেন।
      নিজের কোন বই মেলায় আসলে অনায়াসে বলেন, ঐটা কিনিস। ওটায় ভালো কিছু কবিতা আছে।
      কবি অনেকদিন আগে বইমেলায় নিজের বই নিজে বিক্রি করেছিলেন, টেবিল বিছিয়ে না মাটিতে সেটা মনে করতে পারছি না। পড়েছিলাম কোন এক লেখায়।


      এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

      জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    আহা, প্রিয় কবিকে নিয়ে ব্লগ।
    মনে আছে ক্যাডেট কলেজে কবির নির্বাচিতা গ্রন্থটি নিয়ে কতদিন যে মুগ্ধতায় কেটেছে! ওঁর কবিতা অনুকরণ করে বেশ কিছু লেখাও লিখেছিলাম
    আমাদের সময়ে এফসিসিতে হুলিয়ার মঞ্চায়ন হয়েছিলো। পরে আমাদের নানান অনুষ্ঠানে গুণের কবিতাই ছিলো অন্যতম প্রধান সহায়।
    কলেজে ক্লাস এইটে গুণসহ মোট তিনজন কবির ছোটগল্পের একটি সংকলন হাতে এসেছিল। গুণের গল্পের নায়ক একজন দেহপোজীবিনীর সংগে কথা বলছিলো, তাকে অনুভব করছিলো। গল্পটি সেই বয়সের জন্যে উপযুক্ত ছিলোনা; এমন নির্লজ্জ বয়ানের জন্যে অভিশম্পাত করেছিলাম গল্পকারকে।হা হা।

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন লাগলো রাজীব ভাই, সাথে কবিতাগুলো দেবার জন্য ধন্যবাদ :boss:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  4. কবি নির্মলেন্দু গুণ স্যার একজন কবি, কবি, এবং কবি । কবিতা তাঁর নেশা, পেশা, প্রতিশোধ গ্রহণের হিরণ্ময় হাতিয়ার । তাঁর কবিতা পাঠ করে আমরা শুদ্ধ হই । রাজীব, আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ।

    জবাব দিন
  5. মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

    বাহ, বহু শ্রমসাধ্য পোস্ট। বুঝা যাচ্ছে এ হচ্ছে কবির প্রতি তোমার অবারিত ভালবাসার প্রকাশ।

    একটা ছোট্ট ভুলের কথা বলি। তুমি নও শুধু, অনেকেই করেন। সেটি হলো, 'কাব্যগ্রন্থ' নয় 'কবিতাগ্রন্থ'। (সম্পাদিত)


    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

    জবাব দিন
  6. কবি নির্মলেন্দু গুণের সাহিত্যকর্ম আর্ন্তজালে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কবির পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের বেশকিছু জনপ্রিয় লেখকদের সাহিত্যকর্মও আমরা সংরক্ষণের কাজ করে যাচ্ছি। ধন্যবাদ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।