আজাইরা প্যাচাল ০১

ক্যাডেট কলেজের ছেলেদের অনায়াসে দুই ভাগে ভাগ করে দেয়া যায়। একদল যাদের লক্ষ থাকে প্রচণ্ড বিদ্বান হবার, এই জন্য তারা ত্রিকোণমিতির এসএউ আহমেদের বইয়ের পাশাপাশি হারুনুর রশীদের বইও সমাধানের চেষ্টা চালায়। বাকিদের ‘চির উন্নত মম শির’, মানে হাঁটু-বাহিনীতে যোগ দেয়া আর কি। এই পার্টি পড়ালেখা বাদে কলেজের অনান্য সকল কাজে আত্মনিয়োগ করে। স্যারদের টিজ করা, কোন ফ্রেন্ড কোনদিন ভুল করে কোন শব্দ উচ্চারণ করেছে তা নোট করে বাকিদের জানান দেয়া, কলেজের ডাবগুলো যেন পানি ধারণেরও সময় না পায় তা নিশ্চিত করা, সর্বোপরি তারা যে বস তা সকলে যেন জানতে পারে তার ব্যবস্থা করা। অতন্ত্য গর্বের সাথে বলতে হয় আমি ছিলাম এই পার্টির নেতা গোছের একজন। রাজনীতিতে নেতা হতে চাইলে একজনকে যেমন কিছুদিন হাজত বাস করতে হয়, কলেজেও ঠিক একই ব্যপার। বড় মাপের কয়েকটা ধরা না খেলে কেউ ঠিক নেতা বলে মেনে নিতে চায়না। আমাকেও খেতে হয়েছে। প্রথম বড় মাপের ধরা খাই এসএসসি ‘র উচ্চতর গণিত পরিক্ষার আগের রাতে।

সারারাত অংক করতে হবে এই চিন্তায় মাথা যখন অস্থির তখন চাপ মুক্ত হবার জন্য ডিনারের আগেই বিড়ি ফুঁকার শখ জাগল। শখের দাম লাখ টাকা। রাত ৮ টা বাজে। স্যারদের হাউসে থাকার দুই কোটি ভাগ সম্ভাবনা। হাউসে ধরাইলেই কেলেংকারি। কু-কর্ম সম্পাদনার জন্য তাই হাউসের পশ্চাদ্‌দেশটাই বেছে নিলাম। কিন্তু হায় যেই না বাইরে পা দিয়েছি অমনি টপ টেরর শামিম স্যারের সামনে। আমার হাতে তখন জলজ্যান্ত একটা গোল্ডলীফ সিগারেটের প্যাকেট। উত্তেজনায় পকেটে না ঢুকিয়েই বের হয়েছি। শামিম স্যার আমার হাত থেকে প্যাকেট টা নিলেন। এবং চাঁবাতে চাঁবাতে বললেন, “আজকে একজনকে বের করেছি। তুমিও রেডি হও”। সেই একজনটা কে তা চিনতে অসুবিধা হলনা। গত শুক্রবার পবিত্র দিনে তিনি প্রচণ্ড অপবিত্র কাজ করে ফেলেছিলেন। লোকমুখে জানা গিয়েছিল জুনিয়রটির অবস্থা মরণাপন্ন। তাকে মেডিনোভা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কলেজের অন্যান্য ছোট ছোট কোমলমতি শিশুদের বাঁচাতে কর্তৃপক্ষ তাই তাকে আজীবনের জন্য বাধাদান করে বাড়িতে ফেরত পাঠিয়েছে। এই বিবেচনায় আমার অপরাধ অত্যন্ত নগন্য। তাও হুমকি বলে কথা। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। পরদিন পরীক্ষা শুরু হবার ৪৯ মিনিট পর খেয়াল করলাম আমি সেটের একটা অংক বাদে আর কিছুই তখনও স্পর্শ করি নাই। সবাই জান দিয়ে যুদ্ধ করছে, আর তখন আমি মনে মনে ভাবছি আমার বাবাজানের রুদ্র মূর্তির কথা।

অদ্ভুত কারণে তখনকার কলেজ ক্যাপ্তেনের সাথে আমার ভাল সম্পর্ক ছিল। শামিম স্যারের হাত থেকে কোন প্রতিদান ছাড়াই (!!) তিনি আমাকে সে যাত্রায় বাঁচিয়ে আনলেন। ধরা খাওয়ার ইতিহাস সেখান থেকেই শুরু। এরপর শেরকি, বেদাতি নানা কর্মকাণ্ডে বহুজন আমাকে কব্জা করেছিলেন। কই মাছের প্রাণ বলে কথা। হাইপার ড্রাইভ দিয়ে সবগুলা থেকেই ফিরে আসছি। কিন্তু ক্লাস টুওয়েলভে এসে কি যে হল। এক সপ্তাহের ব্যবধানে তিন তিনটা ধরা খেয়ে গেলাম। প্রতিটা প্রিন্সিপাল স্যারের নিকট জমা পড়ল। কারণগুলো হাস্যকর। একটা মসজিদে নকশা করা গোল টুপি পড়ে যাওয়া। নিয়ম হল নকশা ছাড়া গোল টুপি পরিধান। আরেকটা, পুলওভার খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তাই পিটি গ্রাউন্ডে না গিয়ে রুমে চুপচাপ বসে আল্লাহ আল্লাহ করছিলাম। ভাগ্যের কি লিখন সে দিনই মহামান্য এডজুটেন্ট স্যার মাথা গণনা করলেন এবং যথারীতি ধরা খেলাম। এই সকল কারণে এডজুটেন্ট সাহেব যখন রাত্রে তার নিজের রুমে আমার একান্ত সাক্ষাৎ কামনা করে ডেকে পাঠালেন তখন জানতে পারলাম আমার টাইয়ের নট ঢিলা ছিল। এইটা তৃতীয় কারণ। ফলশ্রুতিতে অতি দ্রুত হাউসে আমার নামে নোটিস চলে আসল। আগামী নয় দিন আমার আর গেমস করা হবেনা। তার পরিবর্তে সেই সময়টুকু খাকি পোশাক পরে ইটের বস্তা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।

এডিশনাল তথ্য হিসেবে জানতে পারলাম আমার মগজ ধোলাইয়ের দায়িত্ব এ যাত্রায় এডজুটেন্ট নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। এবারও বেঁচে গেলাম। বেঁচে গেলাম বলা ঠিক না। প্রথম দিনের ডোজের ১৬ মিনিটের মাথায় অজ্ঞান হয়ে গেলাম। আমাকে অতিদ্রুত ঢাকাস্থ সিএমএইচ হাসপাতালে প্রেরণ করা হল। দুই সপ্তাহ পর কলেজে ফিরে আসলাম। আমাকে দেয়া শাস্তি ততদিনে মেয়াদ-উত্তীর্ণ। তাতে অবশ্য কিছু লাভ হলনা। নতুন করে রিচার্জ করে তা ফেরত পাবার জন্য এডজুটেন্ট আমার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। জানিয়ে দিলেন তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন আমি যেন ঠিক ভাবে জীবন যাপন করতে না পারি এই ব্যবস্থা তিনি খুশি মনে করবেন। আমি তার বউয়ের বয়ফ্রেন্ডের চাইতেও বড় শত্রু হয়ে গেলাম। কিন্তু তাতে কি বা আসে যায়। আমি তখন ডাক-সাইটে বিখ্যাত নেতা। রাজনীতিবিদদের মতো আমি কিছুদিনের মধ্যেই নতুন একটা দল খুলে ফেললাম। এই দলের মূলনীতি তারা কোথাও চান্স পাবার জন্য ভাল ছাত্রদের মতো ফাইট করবে না, একইসাথে হাঁটু-বাহিনীতে যোগদান করে নিজের জীবনটাকে কুয়ার ড্রেনে বিসর্জন দেবেনা। কলেজ থেকে বের হবার তিন মাস পর কোথায় থাকব তা বের হবার দুই মাস পনের দিন পর দেখা যাবে। এই ধরণের মধ্যবর্তী অবস্থা। দলের অনান্য সাংবিধানিক নিয়ম কানুন আমার পূর্ববর্তী দলের অনুরূপ।

এই করতে করতে একদিন কলেজ জীবন শেষ হয়ে গেল। এডজুটেন্ট স্যার তার কথা রেখেছিলেন। কলেজ থেকে বের হবার আগে আমি নিজের টেস্টিমোনিয়ালটা দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেখানে তিনি আমাকে তেল ছাড়া আছোলা বাঁশ দিয়ে রেখেছিলেন। দেখে মনটা বিস্বাদে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। দ্রুত ব্যাচের সবাইরে জানালাম এই তথ্য। বলে দিলাম তোদের সবারটার একই অবস্থা কববে ব্যাটা। এই টেস্টিমোনিয়াল দেখলে তোদের কারও আর হাঁটু হওয়া হবেনা। তোরা শেষ। এক্কেবারে শেষ। দুঃখী মনে তারা কলেজ ত্যাগ করল। অবশ্য এই ক্ষতিতে ব্যাটাদের কারোর কিছু হয় নাই। ৫০ টার মধ্যে ২৬ টা হাঁটুবাহিনীতে চান্স পেয়ে বিরাটা রেকর্ড করে ফেলল…আমি অবশ্য সামান্য মাইনকার চিপায় পড়ে গেছিলাম। সেইটা নিয়া আরেকদিন প্যাচাল পারা যাবে।

২,২০৯ বার দেখা হয়েছে

১৩ টি মন্তব্য : “আজাইরা প্যাচাল ০১”

  1. ঠিক, টেস্টিমোনিয়ালটাতে বাঁশ না দিলেও পারতো। তবে হাঁটু বাহিনীতে যোগ দিতে হয় নাই, এইটা আনন্দের সংবাদ। কোন দরকার নাই সে বাহিনীতে যাওয়ার। এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দে।

    জবাব দিন
  2. আমাদের এডজুটেন্ট ছিলেন, মহামান্য নুরুল আলম। তিনি ফৌজিয়ান। শুধু ফৌজিয়ান না টিপিকাল ফৌজিয়ান। আমাদের কলেজরে ডাকতেন রোটেন বিসিসি বলে। তার ছিল অসামান্য কলেজ ফিলিং। হোস্ট কলেজ সাধারণত আইসিসিতে যে চুরি করে তার রেকর্ড তিনি ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। বাস্কেটবলে প্রথম রাউন্ডে বিসিসি এর সাথে এফসিসি এর খেলা ছিল। সেই খেলা আজব কারণে ড্র হয়ে যায়। আমার জানামতে বাস্কেটবল খেলা ড্রতে শেষ হয়না। নিজের কলেজকে উঠানোর জন্য তিনি ওই খেলা ড্রতেই শেষ করেন। ফলে আমরা বাদ পড়ে যাই।

    জবাব দিন
    • আমাদের কলেজে তাদের একটা নাম ছিল। মকরা। এই পার্টি ছোট ক্লাসে থাকতে সবার টিজ খাইত কিন্তু ১১-১২ এ এই মকরা পার্টি ই হিট

      কিন্তু কামরুলতপু মকরা ছিলো না। 😉 😉 😉

      জবাব দিন
  3. তৌহিদ (৯৫-০১)

    ব্লগটা পরে মজা পেয়েছি কিন্তু একটা দুঃখের কথা মনে পরল ।আমার এক ব্যাচমেট আইএসএসবি তে চান্স পাওয়ার পর প্রিঞ্চিপাল নিজে ফোন করে তার গ্রিন কাড বাতিল করে দিএছিল, তার অপরাধ ডিসিপ্লিন এ সমস্যা । কলেজের টীচাররা কি এখনো মনে করে যে ক্যাডেট রা সামরিক বাহিনির নিয়মিত সদস্য ? তারা টীনএজার নয় ? তাদের নিজেদের শিক্ষক ভাবতে লজ্জা করেনা ?
    আমার অই বন্ধুর অই মুহুরতে আর্মি তে জাওয়া দরকার ছিল, সে বরতমানে ডাক্তারা ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রেশাদ (৮৯-৯৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।