অতসীদের বাসায় আরেকদিন

অতসীদের পরিবারের সাথে আমার সম্পর্কটা এখন বেশ সহজ। তার বাবা বাদে ফ্যামিলির সবাই আমার সম্পর্কে জানে। তবে তার বাবা জানলে আমার অবস্থা যে কি হবে, সেটা আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না। আমার নিজের উচ্চতা ছয় ফিট (গর্ব করতাছি না…), সেজন্য মনে হয় আমার থেকে কম উচ্চতার মানুষদের দেখে কখনও ভয় পাব না আমি। কিন্তু এই পাঁচ ফিট দশ ইঞ্চি মানুষটাকে দেখে কেন জানি আমার গলা শুকিয়ে যায়, নিজের অজান্তেই। কোন ব্যাংক কর্মকর্তার যে এরকম বিশাল শরীর এবং ভেংচানো মুখ থাকতে পারে, তা এতদিন ছিল আমার ধারনার বাইরে।

যাই হোক, আসল কথায় আসি। অতসী আবার ছুটিতে আসবে……এবং সে সময় আমি মেরিন একাডেমীতে। অতসীকে দেখতে খুব্বি ইচ্ছা করছে……কিন্তু আমাকে ছুটি কে দিবে? গার্লফ্রেন্ড ছুটিতে এসেছে- সেটা বলে তো আর ছুটি নেওয়া যায়না। শেষ পর্যন্ত আমার মৃত দাদাকে আরেকবার মারতে হল। সবার সামনে দেখাচ্ছি আমার ছলছলে চোখের পানি……কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমি আনন্দে লাফাচ্ছি।

অবশেষে ছুটিতে আসলাম ১২ এপ্রিল। সে আসবে ১৩ তারিখ……এবং (গোপন প্রক্রিয়ায়) তার কাছেও আমার আসার সংবাদটা পৌঁছে গেছে। এবং সেও আনন্দে লাফাতে লাফাতে বাসায় আসছে। ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ (আহহ, কি মধুর টাইমিং…)। বাসায় এসে চিন্তা করতে লাগলাম…কিভাবে কি করব এই পাঁচটা দিন। প্রথম দিনটা গেল বিশাল আনন্দের মাঝে। ১৩ তারিখ দুপুর পর্যন্ত নিজের উত্তেজনা কষ্ট করে চাপিয়ে রাখলাম……তারপর থেকেই শুরু করলাম শাশুড়িআম্মার ফোনে কল দেওয়া। তিন-চারবারের চেষ্টার পর মহারানী ফোন ধরলেন…এবং যে খবর দিলেন, তা শুনে আমার উত্তেজনা আরও ১০০ গুন বেড়ে গেল। তার বাবা নাকি ব্যাংকের কাজে গতকাল এক সপ্তাহের জন্য ঢাকা গেছেন……এবং এ সুযোগে তার মা আমাকে তাদের বাসায় পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দাওয়াত করেছেন (হই হই হই……ধিঙ্কা চিকা ধিঙ্কা চিকা)। আমি তো এক লাফে আকাশে উঠে গেলাম খবরটা শুনে। আকাশ থেকে নামার পর শুরু হল আমার প্রস্তুতি……কি কাপড় পরব, ছোট্ট শালা-শালির জন্য কি গিফট নিয়ে যাব…ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার মা তো আমার প্রস্তুতি দেখে হতভম্ব। শেষে খালি একটা কথাই বলল মা…”যা-ই করস না কেন বাবা, কোন উল্টাপাল্টা জিনিসের মাঝে ফাইঁস্যা যাইসনা”… (ছি ছি ছি, কি বল মা……আমি তোমার পোলা না!!!……)।

এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ- ১৪ এপ্রিল। সকাল বেলা বেশ ফুরফুরে মেজাজে বাসার পাশে বৈশাখী মেলাতে ঘুরলাম। ১১টার দিকে নিজের পছন্দের গাড় নীল পাঞ্জাবি আর কালো জিন্স পড়ে রওনা দিলাম। পথিমধ্যে আমার ড্রেস দেখে এক দোস্তের কমেন্ট “আইজকা যতটা অফার পাইবি, সন্ধ্যা বেলা আমারে জানাইস” (এম্নেই তো আকাশে উড়তাসি, তার মইদ্ধে দোস্তের এই কমেন্ট শুইন্যা আমি মহাকাশে চইল্যা গেলাম…)। তার বাসায় পৌছাতে পৌছাতে লাগল ১২টা।

মহারানীর বাসায় এসে কেন জানি এতক্ষণের আনন্দ চলে গিয়ে হালকা ভয় ভয় করতে লাগল। আমি একটা সিঙ্গেল সোফায় বসে আছি……আমার সামনে একটা সেন্টার টেবিলের ব্যবধানে বসে আছে তিন ভাইবোন। বড় বোনের মুখে স্মিত হাসি (তার “জান” কে দেখে সে খুব্বি আনন্দিত তখন……)। মেঝ বোন পেঁচার মত মুখ করে আমাকে দেখছে, যেন আমি তার নতুন সতীন। এবং সবচেয়ে ছোটজনের চেহারায় অসীম কৌতুহল……যেন আমি মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দা। আমি তাদের একেকজনের চেহারার দিকে তাকিয়ে তাদের মনের ভাব বোঝার চেষ্টা করছি। মহারানীর চোখে চোখ পরতেই একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিল সে। আমিও একটু হাসলাম। এমন সময় “পেঁচকরানী” (বাধ্য হইয়া নামটা দিসি……মহারানী শুনলে অনশন শুরু করবো…) মুখ খুলল।

–         ভাইয়া, আপনি তো এখন মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন, তাই না?

–         (মুখে একটা অনাবশ্যক হাসি ঝুলিয়ে) জি আপু।

–         ভাইয়া, ওখানে আপনাকে কি করতে হবে? জাহাজের ইঞ্জিনের নাট-বল্টু খুলবেন? হিহিহিহি….।

–         (তোর মাথার নাট-বল্টু খুলুম…) তোমার দৌড় তো ঐ পর্যন্তই…কিন্তু আরও অনেক কাজ আছে আমাদের। আসলে তুমি এখনও ছোট তো, বললে বুঝবেনা। তারপরও বলি……

বলে একটা লম্বা-চওড়া ED শুরু করতে যাচ্ছিলাম……এমন সময় শাশুরিআম্মার গলা শুনা গেল। খাওয়ার জন্য ডাকছেন তিনি।

ডাইনিং রুমে গিয়ে মনটা শান্ত হল। ভাবছিলাম পহেলা বৈশাখ দেখে আম্মা আবার পান্তা ভাত-শুটকি ভর্তা দিয়ে দাওয়াত চালিয়ে দেয় নাকি! তা করেননি তিনি (আলহামদুলিল্লাহ্‌…)। চারজন একসাথে বসলাম……সার্ভ করছিলেন আম্মা। প্লেটে প্রথমেই পোলাওয়ের সাথে একগাদা গরুর মাংস তুলে দিলেন তিনি……আমার ধারণক্ষমতা থেকে অনেক বেশি। আমি না না করেও ঠেকাতে পারলাম না। শেষে আস্তে আস্তে ঝোল দিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। বিপদটা বুঝলাম গরুর মাংস দাঁত দিয়ে ছেঁড়ার সময়। মাংস ঠিকমতো সিদ্ধ হয়নি। বুঝছিলাম না আম্মাকে বলব কি না। যা থাকে কপালে- চিন্তা করে দাঁত দিয়ে মাংসের সাথে যুদ্ধ শুরু করলাম। এবং এক মিনিট পর বুঝতে পারলাম যে মাংসের ঢাল আমার দাঁতের তলোয়ার থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। আমার অবস্থা খেয়াল করছিল দুই রানী। বড় রানী রাগছে, আর ছোট রানী ভেংচি কাটছে। আমি বাধ্য হয়ে আম্মাকে বললাম,

–         আনটি, মাংস মনে হয় ঠিকমত সিদ্ধ হয়নি।

–         জানতাম তুমি এ কথা বলবে……আসলে আমরা এভাবেই মাংস রান্না করি। তোমার আঙ্কেল হাল্কা শক্ত মাংস পছন্দ করে। খেতে খেতে আর সবার অভ্যাস হয়ে গেছে।

–         কিন্তু আনটি মাংস হাল্কা শক্ত না, বেশ শক্ত।

–         প্রথম প্রথম যারা খায়, তাদের এরকমই মনে হয়।

আম্মার সাথে গলা মেলালো পেঁচকরানীও।

–         ভাইয়া দাঁত দিয়ে কাটেন না……আপনার দাঁত কি এত্তই নরম নাকি??

–         না আপু, মানে…মাংসটা আসলেই শক্ত।

–         দেখি দেখি।

বলে সে একটা মাংসের টুকরা নিল। মাত্র খেয়াল করলাম, আমিই প্রথম মাংস খাদক এখানে। একটু পর সে বলল, “নাহ…ঠিকই তো আছে…চেষ্টা করেন খেতে…” বলে আমার দিকে ভেংচি কাটল সে।

আমি তার কাজ-কারবার দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম……যেভাবেই হোক, যুদ্ধে আমাকে জিততেই হবে। আমি আবার নেমে পড়লাম ঢাল ছাড়া যুদ্ধে। এবং আরও এক মিনিট পর বুঝলাম, এ মাংস দাঁত দিয়ে কাটা অসম্ভব। বুঝলাম, ইজ্জত বাচাঁতে কিছু একটা করতে হবে। চারজন আমার খাওয়া পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছে ইতিমধ্যে। সিদ্ধান্ত নিলাম, ডাইরেক্ট মাংসের টুকরাটা গিলে ফেলব। গিলতে গিয়েই বুঝলাম, বিশাল ভুল হয়ে গেছে……টুকরাটা আমার গলার তুলনায় অনেক বড়। মাঝপথে গিয়ে আটকে গেল টুকরাটা। আপনাআপনি আমার মুখ লাল হয়ে গেল……লজ্জায়, ব্যথায় ও শ্বাস আটকে। অতসী বুঝল ব্যপারটা……কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে, আমি দৌড় দিয়েছি বাথরুমের দিকে।

স্বাভাবিক হয়ে আবার খাবার টেবিলে আসলাম, দেখি পেঁচকরানী আমার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দ হাসিতে ফেটে পড়ছে (স্বাভাবিক), আনটি অপরাধি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন……এবং অতসী ও তার ছোট ভাই মাংসের সাথে যুদ্ধ করছে, ঠিক যেভাবে আমি কিছুক্ষণ আগে করছিলাম। অতসী বলল,

–         মাংস আসলেই সিদ্ধ হয়নি, মা।

–         তাই নাকি?

–         হ্যাঁ মা……খুব্বি শক্ত…

শালাবাবুও গলা মিলাল “হ্যাঁ মা, খুব থক্ত” (তার নাকি উচ্চারণে সামান্য সমস্যা আছে)।

শাশুড়িআম্মা বললেন, “সরি বাবা, তোমাকে এত্ত কষ্ট দিলাম……”

–         না না আনটি, এটা কিছুনা……(আরেকটু হইলেই মরতে লইসিলাম…)

–         ভাবছিলাম একটু শক্ত হয়েছে…কিন্তু……

–         না আনটি, সমস্যা নাই……এরকম হতেই পারে……(আপনার মাইয়া আমার জীবন অর্ধেক ধ্বংস করসে…আর আইজকা আপনে পুরা ধ্বংস করবার নিসিলেন…)।

বলে অল্প একটু খেয়ে উঠে পড়লাম। আমার পিছু পিছু উঠে পড়ল পেঁচকরানীও। ড্রয়িং রুমে বসলাম, এমন সময় (হাল্কা ভেংচি মেরে) পেঁচকরানী বলে

–         ভাইয়া একটা কথা বলি?

–         বল (গররররর……)।

–         আপনি এত বোকা কেন?

–         মানে?

–         আমি কিন্তু মাংস না খেয়েই বলেছিলাম ঠিক আছে……আপনি মোটেও খেয়াল করেননি।

আমি চুপ করে রইলাম। কিছুক্ষণ পর সে-ই মুখ খুলল,

–         আপুর ভাগ্যটা আসলেই ভাল।

–         কেন??????????

–         থাক, আপনি বুঝবেন না……।

তার না বলা কথাটা বুঝে আমার মেজাজটা আরেক ডিগ্রী গরম হল। হায়রে কপাল আমার………।

 

পুনশ্চঃ আমার শালীর সাথে এখন আমার সম্পর্ক খুব্বি ভাল। সম্পর্ক ভালর উদাহরণগুলো না হয় না-ই দিলাম……।

 

২,৮০৩ বার দেখা হয়েছে

২৫ টি মন্তব্য : “অতসীদের বাসায় আরেকদিন”

মওন্তব্য করুন : টিটো রহমান (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।