পরবাসী ঈদ সমাচার

ঈদ উল আযহা উপলক্ষে এক খানা লেখা লিখবো বলে ঠিক করলাম।তখন হটাত মনে হল বিসয়বস্তু কি হতে পারে। প্রথমেই মাথায় এলো যে বিদেশে বসে ঈদ করতে ক্যামন লাগছে তাই নিয়ে লিখে ফেলি। কিন্তু মনের অজান্তেই ক্যানও যেন মনে হচ্ছিল এই লেখা শুরু হলেই মন খারাপ করা কথা বার্তা শুরু হবে।

 

ক্যাডেট কলেজ পার হয়ে বি এম এ, অবশেষে সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়া , আবেগ বলে এর কিছু কি থাকার কথা?? অনেকেই মনে করেন যে আমি বোধহয় একটু আবেগহীন মানুষ।মায়ের আচল এর নিচে থাকতে পারার ক্ষুদ্র ইচ্ছা, বাবার হাত ধড়ে ঈদের নামাজ পরতে যাওয়ার সুপ্ত ইচ্ছা অনেক সময় সুপ্ত ই থেকে যায়। এতে মন খারাপ হলেও অনেক সময়ই তা লুকিয়ে রাখার এক আপ্রান চেষ্টা প্রতিনিয়ত। সেই চেষ্টায় আমি খুব সম্ভবত বেশ ভালই সফল । কারন আমাকে যারা চেনেন তাদের বেশির ভাগই মনে করেন যে আমি একজন বিশেষ পর্যায়ের আবেগহীন মানুষ।কোন ধরনের আবেগ আমাকে ছুয়ে যায় না।

 

কাজেই ঈদের অনুভুতি লিখতে গিয়ে পাছে আবার আবেগহীন এক মানুষের আবেগ যদি বিন্দুমাত্র প্রকাশ হয়ে যায়! তাই ওই চিন্তা বাদ।আমাকে থাকতে হবে কঠিন হয়ে , চোখের পানির সাথে করতে হবে লাগাতার ধর্মঘট।বুক কাপাকাপি নামক কোন ফালতু জিনিসকে কোন ভাবেই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না, বিশেষ করে মস্তিষ্কের সাথে হৃদয় তথা হার্ট এর সংযোগ যাতে কোন ভাবেই না পায় সেদিকে রাখতে হবে বিশেষ খেয়াল।

 

কাজেই লেখার আর কিছুই নেই, শুধু বাকি থাকল ক্লাসের রুটিন বলার মত করে ঈদ উপলক্ষে কি কি করছি তার এক খানা ক্ষুদ্র বর্ণনা দেয়া।

জগতের অনেক পাপের মধ্যে অন্যতম পাপ(!) করেছি , আমি এখনও ব্যাচেলর। কাজেই প্রথম সমীকরণ ব্যাচেলর অফিসার ২ ঈদের কোনটা তেই ছুটি পাবে না। খুব বলতে ইচ্ছা হয়েছিল , বউ না থাকলেও তো বাপ মা আছে। বাপ মা র সাথে ঈদ করার অধিকার না থাকা  কি  এখনও ব্যাচেলার থাকার শাস্তি?? যাই হোক যেটা বলতে পারব না ওইটা নিয়ে ক্যাচাল করে কি লাভ। সেই সুবাদে ২ খানা ঈদ ই কপালে পরল মিশন এলাকায়। দেশ থেকে ছুটি থেকে প্রত্যাবর্তন ১০ রোযার পড়ে। ইতিমধ্যে ঈদ উল ফিতর পার করেছি এখানে। তার ই ধারাবাহিকতায় আগামীকাল ঈদ উল আযহা। ঈদ উল ফিতর যেহেতু ইতিমধ্যে পার হয়ে গিয়েছে তাই পুরনো চাল ভাতে না বাড়িয়ে নতুন চাল খোজাই ভালো কি বলেন??

 

ঈদ উপলক্ষে কাম্পের প্রধান বিনোদন এক খানা স্থানীয় গরু কেনা, তা জবাই করে সকল ক্যাম্পে সেই মাংস পউছে দেয়া এবং এই মাংস দিয়েই ঈদের প্রীতিভোজ উদযাপন। এটি প্রধান বিনোদন হওয়ার মূল কারন ইউ এন কর্তৃক সরবারহ করা ফ্রোজেন বোনলেস গরুর মাংস খেতে খেতে লোকজন এখন হাড্ডি খাওয়ার জন্য উন্মুখ। ইউনিটের কোয়ার্টার মাস্টার হওয়ার সুবাদে খাওয়া দাওয়ার এই বাপারগুলা আমিই দেখি। কাজেই গরুর মাংস ভাগ করার সময় সবার মূল আকর্ষণ কত কেজি হাড্ডি হল??(এই কথা দেশের কসাই সমাজ শুনলে বহুত খুশি হইত) এমনকি এক ক্যাম্প থেকে আমার প্রিয় এক সিনিয়র তো ফোন করে বলেই ফেল্ল,“রায়হান পারলে একটু বেশি করে হাড্ডি দিয়ে দিও” (স্যার আপনি এই লেখাখানা যদি পড়েন তাইলে নিজ দায়িত্তে মাফ কইরা দিয়েন)

যাই হোক দেখা গেলো সব মিলিয়ে গরুতে মাংস হল ১৫৯ কেজি আর হাড্ডি মাত্র ৭২ কেজি । হাড্ডি মাংসের অনুপাত ২ ঃ ১ হয়ে যাওয়ায় যার ফলে অনেকেই খুব হতাশ। আমি জানি আমার এই হাড্ডি প্রীতির গল্প শুনে অনেকেই অবাক হচ্ছেন। আমি কিন্তু এক বিন্দুও বাড়িয়ে বলছি না, ঘটনা সম্পূর্ণ এটাই। ইতিমধ্যে মাংস সব ক্যাম্পে পৌঁছে গিয়েছে এবং সবাই আগামীকাল প্রিতিভজে হাড্ডি চিবানোর খায়েস নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

 

সন্ধ্যা থেকে চিন্তা করছিলাম কি করা যায় । ঈদের আগের রাত বলে কথা , বেকার বসে বসে কাটিয়ে দেয়ার মানেই হয় না। কাজেই সমাধান একটাই নিজ দায়িত্তে বিনোদন খুজে নাও। মোবাসশির(ঝ ক ক ৯৯-০৫), নাজমুল(ঝ ক ক ০১-০৭) এবং অন্যান্য অফিসার মিলে ঠিক করলাম নিজেরাই মাস্তি করবো।  কি আর করা নিজেদের রুমের সামনে প্রজেক্টর লাগানো হল , সাউন্ড বক্স লাগানো হল , ধুম ধারাক্কা কিছু ভিডিও গান চলল যার বেশির ভাগ ই শোনার চাইতে দেখার প্রতিই আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল । বাংলাদেশী বাংলা, ইন্ডিয়ান বাংলা, হিন্দি , ইংলিশ এর সাথে যোগ হল মিশরীয় বন্ধু কাপ্টেন আহমেদ এর কিছু আরবিয় ভিডিও গান। চলল কিছুক্ষণ নাচানাচি , বিনোদন নিংড়ে বের করে নেয়ার আপ্রান প্রয়াস।

 

রাত শেষে আগামীকাল ভোর হবে আমাদের ঈদের দিন।তবে ঈদের দিন বলেই আর ১০ টা ঈদের দিনের মত শুয়ে বসে কাটানর সুযোগ হয়ত থাকবে না সবার। আমি বাক্তিগত ভাবে হয়ত কিছুটা ফ্রি থাকবো দুপুরে প্রীতিভোজ থাকায়।(আগেই বলেছি কোয়ার্টার মাস্টার হিসেবে খাওয়া দাওয়া সম্পর্কিত জিনিসগুলো যে আমি ই দেখি) তবে ব্যাটালিয়নের বেশির ভাগ সদস্যর আগামিকালের ঈদের দিন কাটবে অন্যান্য দিন গুলোর মতই। হয়ত তার চাইতেও বেশি বাস্ততায়। কারন আগামিকালের সকল ঈদ জামাতের নিরাপত্তা দিতে হবে( এখানে বলে রাখি আমাদের ব্যাটালিয়নের দায়িত্বপূর্ণ এলাকা প্রায় পুরো বাংলাদেশের আয়তনের কাছকাছি) , আমাদের ক্যাম্প যে শহরে সেখানে একটা কনসার্ট হবে তার নিরাপত্তা দিতে হবে , স্থানীয় এয়ার পোর্ট এ মিশরীয়রা কাজ করছে এয়ারপোর্ট উন্নয়নের । তাদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার দায়িত্ব ও আমাদের। তারা হয়ত আগামীকাল কাজ করবে না কিন্তু নিরাপত্তা দেয়া তো আর বন্ধ করা যাবে না। আর কাম্পের নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য তো আছেই। সব মিলিয়ে হিসেব করলে দেখা যাবে কাম্পের ৯০% ভাগের বেশি লোক সারাদিন কোন না কোন দায়িত্তে নিয়োজিত থাকবেন। হয়ত এর মাঝেই কিছুটা সময় বের করে দেশে একটু কথা বলবেন ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন আর সব শেষে আবেগহীন কণ্ঠে খুব ভালো আছি সুরে কথা বলে অনেক আনন্দ করছি এই গুলো বলে ফোন রেখে দেবে। ভাগ্য ভালো ফোন চোখের পানি দেখা যায় না!!!!!!  কারন তা না হলে মিশনের অনেক শান্তি কথাটা যে ভুল প্রমানিত হতে কিংবা সেনাবাহিনীর লোক গুলো আবেগহীন পাষাণ এই উক্তিগুলো ভুল প্রমানিত হয়ে যেত।

 

যাই হোক, তবুও হাসি মুখে আমরা আবেগহীন ভাবেই কাজ গুলো চালিয়ে যাব ইনশাল্লাহ। মানুষের নামাজের নিরাপত্তা দিতে পাড়াও তো অনেক সওয়াবের কাজ। অন্তত মিশনের সুবাদে কিছু অতিরিক্ত নেকি ও যুক্ত হল আমলে। দায়িত্ব পালনে সদা সচেষ্ট এই মানুষ গুলো তবুও আগামীকাল সারাদিন অনেক অনেক বেশি মিস করবে দেশকে , দেশে রেখে আসা পরিবারের মানুষগুলো কে , দেশের সকল বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনদের। এই টুকু উপলব্ধি আশা করি সবাই পাবেন।

 

সব শেষে এই দূর পরবাস থেকে সবাইকে জানাচ্ছি ঈদের শুভেচ্ছা। সবার ঈদ হয় আনন্দময়, সুন্দর এবং পরিবার পরিজন নিয়ে এক সাথে। একই সাথে ঈদ উল আযহার শিক্ষা যে ত্যাগের মহিমা তা যেন আমরা সঠিক ভাবে নিজেরদের জীবনের প্রতি পদক্ষেপে মনে রাখতে পারি এবং সে অনুযায়ী আমল করতে পারি আল্লাহর কাছে সব শেষে এই একটাই দোয়া। ঈদ মোবারক।

……………রায়হান সোবহান

১,২১০ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “পরবাসী ঈদ সমাচার”

  1. মোঃ সাদাত কামাল [০১-০৭]
    বিশেষ করে মস্তিষ্কের সাথে হৃদয় তথা হার্ট এর সংযোগ যাতে কোন ভাবেই না পায় সেদিকে রাখতে হবে বিশেষ খেয়াল।

    চমৎকার কথা। ১০০ বার পছন্দ করলাম ভাই। :clap:

    “রায়হান পারলে একটু বেশি করে হাড্ডি দিয়ে দিও” (স্যার আপনি এই লেখাখানা যদি পড়েন তাইলে নিজ দায়িত্তে মাফ কইরা দিয়েন)

    =)) ......

    হয়ত এর মাঝেই কিছুটা সময় বের করে দেশে একটু কথা বলবেন ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন আর সব শেষে আবেগহীন কণ্ঠে খুব ভালো আছি সুরে কথা বলে অনেক আনন্দ করছি এই গুলো বলে ফোন রেখে দেবে। ভাগ্য ভালো ফোন চোখের পানি দেখা যায় না!!!!!!

    :hatsoff: আল্লাহ্‌ আপনাদের কে ভালো রাখুক। আমীন।

    শেষে... ঈদ মোবারক। ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।
    শুভ কামনা রইল।
    নাজমুল কাদির আমার বন্ধু। ওকে আপনার সাথে ছবিতে দেখে ভালো লাগলো। আমরা একই সাথে ছয়বছর থেকেছি আমাদের হাউসে। নস্টালজিয়া হয়ে যাচ্ছি। ......


    ভালো থাকা অনেক সহজ।

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    ভাল লিখেছো রায়হান, পড়ে মান সিটির ঈদ মিস করলাম।

    তোমার বড় ঈদ ori কবে?


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. সন্ধি (১৯৯৯-২০০৫)

    বাইরে ঈদ করার আমার নিজের কাছে অন্য একটা দিক আছে। শেষ কবছর যেসব ঈদ পেয়েছি, দিনে দিনে যেন তা থেকে ছোটবেলার সেই উচ্ছ্বাস, ব্যাকুলতা, ভিন্নতার আমেজ হারিয়ে যাচ্ছিল। মনে হত একঘেয়ে আরও একটা ঈদ শেষ হয়ে গেল। সেই একই নামাজ পড়ে এসে আত্মীয়স্বজনের বাসায় যেয়ে ফিরনি-সেমাই খাওয়া, উদোরপূর্তি করে পেটপূজো, দুপুরের পর থেকে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হওয়া, আড্ডাবাজি একই ছকে আটকে যাওয়া গোলকধাঁধা মনে হচ্ছিল। কিন্তু নির্বান্ধব, সজনহীন পরিবেশে এসে ঈদ করে দেশের সেই ছকে বাঁধা ঈদকেই যেন পরম আরাধ্যের বস্তু মনে হল। মনে হল যেন আমি আবার সেই আগের উচ্ছলতা, প্রতীক্ষা, ছেলেমানুষি আনন্দটাকে ফিরে পেয়েছি নতুন করে। আশা করি, ভাগ্যদেবী যদি পরের ঈদ দেশে করার বিলিব্যবস্থা করেন তাড়িয়ে তাড়িয়ে প্রতিটুকু মজা শুষে নেব। পুরনো মদকে নতুন বোতলে ঢেলে নেশায় বুদ হব... 😀

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রায়হান (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।