স্বাধীন দেশের পরাধীন নাগরিক

১২ বছর বয়সে যখন ক্যাডেট কলেজএর গেট দিয়ে প্রবেশ করলাম তখন দু’ ধরনের অনুভুতি ভর করেছিল আমায়।প্রথমত স্বপ্ন পুরন হওয়ার আপ্লুত এক আনন্দ, দ্বিতীয়ত অচেনা এক নতুন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার অজানা এক আতঙ্ক। সেদিন নিজেকে অনেক বড় মনে হছিল, কিন্তু এখন যখন ক্লাস ৭ কিংবা ৮ এর কোন ছেলের দিকে তাকাই তখন নিজে নিজে চিন্তা করি আসলে কতটা ছোট ছিলাম আমরা।

সেই ক্ষুদ্র বয়সে কৈশোর জীবনে বাবা-মা পরিবার পরিজন ছেড়ে বের হয়েছি। ওই সময়ে কলেজ এ ঢোকার আগ পর্যন্ত আসলে মনে হয়েছিল যে ভালই হবে, আব্বু-আম্মুর কড়া শাসন অনুশাসন এর গণ্ডিতে এখন আর নেই আমি। আমি এখন আমার আকাশের স্বাধীন এক পাখি। কিন্তু এই ক্ষুদ্র মন তখন বুঝতে পারেনি এই স্বাধীনতার আড়ালে কত বড় পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে যাচ্ছি আমি। আব্বু-আম্মুর কড়া শাসনের সাথে সাথে তাদের আদর,স্নেহ,মমতাও উড়ে যাচ্ছে আমার কাছ থেকে। ইচ্ছে হলেই এখন আর কোন অন্যায় আবদার করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকা সম্ভব নয়। রাতে নিশ্চিন্তে এই মনে করে ঘুমিয়ে পরতে পারব না যে, আম্মু এসে ঠিকই মশারি খাটিয়ে দিয়ে যাবে কিংবা রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পরলে আম্মু এসে আমাকে ঘুম থেকে না জাগিয়েই ঘুমের মধ্যে আমাকে খাইয়ে দিয়ে যাবে। চাইলেই আমি এখন আর আব্বুর হাত ধরে বাইরে যেতে পারব না। চাইলেই এখন আর ভয় লাগছে বলে আম্মুর কোলের মধ্যে গিয়ে শুয়ে পরতে পারব না। কলেজ এ ঢোকার পর থেকেই আমার এই ভুলগুলো ভাঙ্গতে শুরু করল। হটাত করেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম স্বাধীন দেশের পরাধীন এক নাগরিক হিসেবে। যেখানে আমাকে শুধু শুনতে হবে এবং করতে হবে, কেন করতে হবে তা জিজ্ঞেস করার কোন যোগ্যতা আমার নেই।

এভাবেই নিজের কৈশোর জীবনকে সপে দিয়েছিলাম ক্যাডেট কলেজ জননীর বন্দিশালায়। বাবা-মায়ের আদর স্নেহ বিসর্জন দিয়ে পরাধীনতার এই জীবনের পুরোটাই কি হতাশা? প্রাপ্তি বলতে কি কিছুই নেই? কলেজ এ ৬ বছরের অবস্থানে প্রাপ্তি কি তা বুঝতে পারিনি। ক্লাস ১২ এ হয়ত একটু বুঝতাম কিন্তু এখন পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারি। ক্যাডেট কলেজ আমাকে দিয়েছে এমন কিছু উপহার যা আমার পক্ষে জীবনে কখনই ভুলে থাকা সম্ভব নয়। ক্যাডেট কলেজ আমাকে দিয়েছে অক্রিত্তিম কিছু বন্ধু, কেয়ারিং কিছু সিনিয়র এবং কিছু স্নেহশীল জুনিয়র।

বন্ধুত্ব নিয়ে অনেক গল্প উপন্যাস লেখা হয়েছে, অনেক চলচ্চিত্র নাটক ও তৈরি হয়েছে। কিন্তু ক্যাডেট কলেজ এর বন্ধুত্ব এই সব কিছুর উরধে, সব থেকে আলাদা,সব চাইতে মহান। একমাত্র ক্যাডেট কলেজ এর বন্ধুর পক্ষেই সম্ভব নিজে কোন দোষ না করেও আরেক বন্ধুকে বাঁচানোর জন্য ওই দোষের ভাগী হওয়া কিংবা পুর দোষটাই নিজের কাঁধে তুলে নেয়া। নিঃস্বার্থ বন্ধুত্তের সংজ্ঞা যদি কেউ জানতে চায় তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ অবশ্যই ক্যাডেট কলেজ। আমি দেখেছি কিভাবে বন্ধুর জন্য রাত জেগে সেবা শুশ্রূষা করেছে অন্যরা। বাবা-মা, ভাইবোন ছাড়া আর কোথাও কি কেউ এভাবে রাত জেগে বসে থাকতো আমার জন্য? বন্ধুর কষ্ট লাঘব করার জন্য অনেককেই দেখেছি দুঃসাহসিক অনেক কাজ করতে এমনকি কলেজ আউট হওয়ার তীব্র রক্ত চাহনি উপেক্ষা করেও। কলেজ আউট কিংবা জরিমানার খড়গের উপর দাড়িয়েও কিভাবে বন্ধুকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা কথা বলতে হয় অথবা একতাবদ্ধ হয়ে থাকতে হয় তা এই ক্যাডেট কলেজই আমাকে শিখিয়েছে। এই ক্যাডেট কলেজই আমাকে চিনিয়েছে এমন বন্ধুদের যে অন্যের দোষের কারণে নিজে মার খেয়ে পিঠের চামড়া উঠে যাওয়ার পরেও ওই বন্ধুর নামটি এক বারের জন্যও উচ্চারন করেনি। বরং ক্লাস এসে হাসতে হাসতে এমন ভাব করেছে যেন কিছুই হয় নি। আর পরীক্ষার হল গুলোর কথা না হয় নাইবা বললাম।

একটি পরাধীনতা যদি এত কিছু দিতে পারে সেই পরাধীনতায় আমার কোনই দুঃখ নেই। তাইতো দেখেছি ক্লাস ১২ এর বিদায় এর সময় ক্লাস ৭ থেকে ১১ এর সকল ক্যাডেট কিভাবে তাদের জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদে। এখনও কোন কলেজ ভাই , এমনকি যেকোনো ক্যাডেট বা এক্স ক্যাডেট এর সাথে দেখা হলেই অনেক আপন মনে হয়, আর পুরোটাকেই মনে হয় একটা অনেক বড় পরিবার। কৈশোর কে বিসর্জন দিয়ে ছোট একটা পরিবার ছেড়ে  এসে এত্ত বড় একটা পরিবার এর সদস্য হয়ে এমন নিঃস্বার্থ এবং অক্রিত্তিম কিছু বন্ধু, সিনিয়র এবং জুনিয়র পেয়েছি, এর চাইতে বড় প্রাপ্তি আর কিইবা হতে পারে!!!!!!!!!!

আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করিনা। তবুও যদি কোনদিন আমার আবার জন্ম হয়, তবে  আমার সেই জীবনেও আবারও আমি একজন ক্যাডেট হতে চাই।

৩,২৭৮ বার দেখা হয়েছে

৩৯ টি মন্তব্য : “স্বাধীন দেশের পরাধীন নাগরিক”

  1. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    বহুদিন পরে একটা ক্যাডেট লাইফ নিয়ে লেখা।
    খুবই পুরনো বহুচর্বিত কথাগুলো কেন যে এখনো এত ভাল লাগে গায়ে শিহরণ জাগে তা কে জানে।
    ভাল লিখেছ ভাই।

    জবাব দিন
  2. কিবরিয়া (২০০৩-২০০৯)

    খুব ভালো লাগলো।
    একদম আমার মনের কথা 😀


    যেমন রক্তের মধ্যে জন্ম নেয় সোনালি অসুখ-তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে বীভৎস ক্ষরতা।
    জাতির শরীরে আজ তেম্নি দ্যাখো দুরারোগ্য ব্যাধি - ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ি রূপে
    - রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

    জবাব দিন
  3. রিয়াজ (৯৮-০৪)
    আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করিনা। তবুও যদি কোনদিন আমার আবার জন্ম হয়, তবে আমার সেই জীবনেও আবারও আমি একজন ক্যাডেট হতে চাই।


    জানি সত্য নয়,শুধু কল্পনায়...ইচ্ছের ঘুড়ি আমরা ওড়াই...স্বপ্ন গুলো সত্যি হবে তারি অপেক্ষায়

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রায়হান (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।