ফিরে দেখা একটি বছর…

আমার আজকের এই পোষ্টটি আমার কাছে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারন, সম্ভবত এটি লাইবেরিয়ার মাটিতে বসে আমার লেখা শেষ পোষ্ট। এক বছরের অনুভুতি লিখতে গিয়ে লেখাটি অনেক বড় হয়ে গেল। হয়তো সামনের একটা লম্বা সময় সিসিবিতে থাকতে পারব না। তাই সিরিজ বানিয়ে ঝুলিয়ে না রেখে একবারেই সম্পূর্ণ লেখাটি দিয়ে দিলাম।

প্রারম্ভিকা

২০০৮ সালের ০৬ মার্চ আমরা এই লাইবেরিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলাম । ০৭ মার্চ দুপুরে এসে পৌছিয়েছিলাম। দেখতে দেখতে একটি বছর পার হয়ে গেল। আমি এখন প্রহর গুনছি কখন মনরোভিয়াতে গিয়ে আমার ফ্লাইটে উঠব, আর কখন ঢাকাতে গিয়ে নামব। কিভাবে একটি বছর পার হয়ে গেল ভাবতেই অবাক লাগে !!! এই একটি বছর আমার জীবনে খুবই স্মরনীয় হয়ে থাকবে। আমার জন্য বছরটি যেমনি ছিল বিভিন্ন অভিজ্ঞতাপূর্ণ ও আনন্দের; ঠিক তেমনি বিভিন্ন অপ্রীতিকর এবং বেদনাদায়ক ঘটনাতেও পরিপূর্ণ। সুখ-দুঃখের এক মিশ্র অনুভুতি আমি এখন বয়ে চলেছি… লাল-নীল-সবুজ আর কালো রঙের সব স্মৃতিগুলো তাই মাঝে মাঝে মাথাচারা দিয়ে উঠে। অনেক কিছু দেখা হলো, পাওয়া হলো, অভিজ্ঞতাও হলো। কিন্তু এতকিছু পাওয়ার মাঝেও কি যেন নাই, কি যেন চলে গেল, কি যেন হারিয়ে গেল…

ছুটি কাটিয়ে এসেছিলাম গত অক্টোবরে। দীর্ঘ পাঁচ মাস পর এখন দেশে ফিরব। মা, বাবা, প্রিয়তমা স্ত্রী, বোন, ভাগ্না-ভাগ্নী ও সব আত্নীয়-স্বজনদের কাছে ফিরে যাব। নিঃসন্দেহে তা আনন্দের, কিন্তু এতসব আনন্দের মাঝেও এক অদ্ভুত শূন্যতা যে আমাকে গ্রাস করছে তা যেন আমি ঠিকই টের পাচ্ছি।

না, আমি কোন নৈরাশ্যের কথা বলতে চাইনা, আমি আশার কথা বলতে চাই, নতুন আলো দেখতে চাই। তাই ঠিক করেছি কোন হতাশার কথা আর লিখবনা।

আমার আজকের বিষয় নিয়ে কিছু বলি। ফিরে দেখা একটি বছর…আমার ইউএন মিশনের একটি বছর। এই একটি বছর আমার জীবনের অন্যরকম একটি অধ্যায়। প্রিয় দেশ এবং প্রিয়জনদের থেকে দূরে, বহুদূরে এই আফ্রিকার জঙ্গলে এসে কত বিচিত্র সব অভিজ্ঞতাই না হয়েছে। তারই কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ এখানে তুলে ধরছি।


এখানে আসার পর প্রথম প্রথম এখানকার মানুষদের ভাষা বোঝাটা খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল আমার জন্য। যদিও এরা ইংরেজীতে কথা বলে কিন্তু প্রতিটি শব্দের শেষের অক্ষরটি উচ্চারণের সময় উহ্য রাখার কারনে মূল শব্দটা ধরাই খুব দূরুহ হয়ে পড়ত। যেমন-আমাদের ওরা ডাকে “বিব” বলে যার অর্থ হলো “বিগ বস্”। “খারাপ” শব্দটির ইংরেজী “ব্যাড” কে ওরা বলে “নোগু” যার অর্থ হলো “নো গুড”। এছাড়াও অনেক অদ্ভুত সব ইংরেজী এরা ব্যবহার করে যা শুনলে প্রথম দিকে কিছুই বোঝা যেতনা। কিছুদিন যাবার পর অবশ্য এসব ইংরেজীতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।

আমার প্রথম অপারেশনাল কার্যক্রম ছিল ব্যান-ইঞ্জিনিয়ার কর্তৃক প্রায় ২০০-২৫০ কেজি ওজনের একটি পরিত্যক্ত বোমাকে নিস্ক্রিয় করার সময় স্থানীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বলা বাহুল্য এত কাছ থেকে এত বড় বোমা দেখার সুযোগ আমার আগে তো কখনো হয়নি, ভবিষ্যতেও কখনো হবে কিনা সন্দেহ আছে। এই বোমাটি ২০০৩ সালের আগে কোন এক সময় নাইজেরিয়া এই দেশে ফেলেছিল। কিন্তু কোন এক অজানা কারনে বোমাটি অবিস্ফোরিত অবস্থায় থেকে যায় এবং গত বছরের শুরুর দিকে একটি খাল থেকে উদ্ধার করা হয়। ঐ বোমাটিকে নিস্ক্রিয় করার জন্য আমাদের একটি ট্রাকে করে ফায়ারিং রেঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ডোজার দিয়ে ৬ ফুট গর্ত খুড়ে মাটির নিচে চাপা দিয়ে প্রায় ৫০ টি টিএনটি এক্সপ্লোসিভ, ডেটোনেটিং পাউডার, ডেটোনেটর এবং আরো অন্যান্য বিস্ফোরকের মাধ্যমে মাটির নিচেই বিস্ফোরন ঘটানো হয়। বিস্ফোরনের পূর্বে স্থানীয় পুলিশকে দিয়ে আশেপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মাইকিং করে এবং পেট্রোলিং এর মাধ্যমে স্থানীয় মানুষদের সরিয়ে দিতে হয়েছিল। প্রায় এক কিলোমিটার দূরে এসে আমরা শেডের নিচে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে বিস্ফোরণ পর্যবেক্ষন করলাম। অবাক হয়ে দেখলাম, অত দূর থেকে এসে আমাদের সামনের পুকুরে বোমার ভিতরের স্পিলন্টার, বোমা পোতার স্থানের উপরের অংশের উঠে আসা মাটির দলা এবং পাথরের কনা এসে ছিটকে পড়ল এবং আকাশের দিকে ঘন কালো ধোয়ার কুন্ডলী উঠল। প্রচন্ড আওয়াজে আমাদের কানে তালা লেগে যাবার অবস্থা, আশেপাশের সব পাখি ভয়ে পালিয়ে গেল। এরপর আমরা সেখানে গিয়ে দেখি বিশাল এক পুকুর তৈরী হয়ে গিয়েছে যার গভীরতা নূন্যতম ২০ ফুট। বুঝলাম হিরোশিমার নাগাসাকির এটম বোমার মতো অতটা না হলেও এই বোমাটি ছিল যথেষ্ঠ শক্তিশালী। আমার জন্য নিঃসন্দেহে এক বিরল অভিজ্ঞতা এটি। একবার ভাবলাম বোমাটি আমাদের ট্রাকে বহনের সময় অথবা ডোজার দিয়ে মাটি চাপা দেয়ার আগেই মাটির উপরে যদি ওটি ফাটত তাহলে কি হতে পারত !!!


এর কিছুদিন পর আমি যাই রাজধানী মনরোভিয়াতে ‘এএলও’ (এয়ার লিয়াজো অফিসার) নামক একটি কোর্স করার জন্য। সেটি ছিল মূলত একটি টেকনিক্যাল কোর্স/ট্রেনিং। হেলিকপ্টার এবং ছোট বিমান উঠা-নামা করানো, পাইলট ও কনট্রোল টাওয়ারের সাথে কথপোকথন এবং আবহাওয়া পরিস্থিতির রিপোর্টিং সহ অনেক নিয়মকানুন শিখলাম। ৫ দিনের ঐ ট্রেনিং করে একটি ইউএন সার্টিফিকেট পাবার আনন্দটাই যেন ছিল খুব বেশি। পরবর্তীতে আমার ঐ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগষ্টের দিকে প্রায় একমাস এএলও হিসেবে দায়িত্ব পালনও করি। ঐ সময়ের মধ্যে অনেক পাইলটের সাথে কথপোকথন ও সাক্ষাত হয়েছে, হয়েছে বিভিন্ন দেশের হেলি-পাইলট ও হেলি যাত্রীদের সাথে পরিচয়।

কোর্স শেষে ফিরে এলাম আমার ক্যাম্পে যেটি কিনা রাজধানী থেকে ২০০ কিমি দূরে। প্রতিদিন রুটিন মাফিক পিটি গেমসের পাশাপাশি চলল আমাদের সাপ্তাহিক ডমিনেশন পেট্রোলিং (টহল), পাক্ষিক বর্ডার পেট্রোলিং, হেলি রেকি (হেলিকপ্টারে চড়ে টহল), ভিআইপি এস্কর্ট, মাসিক পে সিকিউরিটি এস্কর্ট, বিভিন্ন ভিআইপি দের ভিজিট, মেডিক্যাল আউটরিচ প্রোগ্রাম, ভিটামিন-এ ক্যাপসুল বিতরণ, জমি সংক্রান্ত বিরোধ ও ঝগড়া বিবাদ এর শান্তিপূর্ণ সমাধান, স্থানীয় পুলিশ, ইমিগ্রেশন চেকিং অর্গানাইজেশন, মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ও জেলখানাতে প্রাশাসনিক ও কারিগরী সহায়তা প্রদান, ষ্ট্যাটিক ও মোবাইল চেক পোষ্টের মাধ্যমে ড্রাগ ট্রাফিকিং, চোরাই কাঠ, রাবার ও অন্যান্য মালামাল চেক করা, এগ্রো ফার্ম পরিচালনা ও স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ, এবং অন্যান্য দৈনন্দিন রুটিন মাফিক কার্যক্রম। এসবের ফাঁকে ফাঁকে হলো আন্ত কোম্পানী ভলিবল, আন্তঃ ইউনিট ভলিবল, ফুটবল, বাস্কেটবল সহ আরো কিছু অন্যান্য সামরিক বিষয়ক প্রতিযোগিতা। স্থানীয় লাইবেরিয়ানদের সাথে ছিল আমাদের প্রীতি ফুটবল ম্যাচ। উল্লেখ্য যে, লাইবেরিয়ানরা খুবই ভাল ফুটবল খেলে। তাদের ড্রিবলিং, পাসিং এবং বল কন্ট্রোল দেখার মতো। শুধুমাত্র ভাল বল আর কোচের অভাবে ওরা ওদের সামর্থ অনুযায়ী নিজেদেরকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করতে পারছেনা। আমার বিশ্বাস, আগামী বিশ্বকাপে না হলেও তার পরের বিশ্বকাপ ফুটবলে লাইবেরিয়ার নাম দেখা যেতে পারে।


একবার একদিন খুব ভোরে হৈ-চৈ শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে দেখি স্থানীয় এলাকাবাসীরা তিনজন চোরকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছে। একজন পুলিশ এবং একজন ভার্সিটির ছাত্র চোর তিনজনকে এলাকাবাসীর রোষানল থেকে বাচানোর জন্য আমার ক্যাম্পের ভিতরে এনে লুকিয়ে রেখেছে। তিনটা স্যুটকেস সহ ধরা পড়া তিনজনের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বেঁচে থাকার প্রচন্ড আকুতি। ওদিকে বাহিরে তাকিয়ে দেখলাম প্রায় ৩০০-৪০০ জন পুরুষ ও মহিলা আমার ক্যাম্পের গেইটের বাহিরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে এবং চোর তিনজনকে তাদের হাতে তুলে দিতে বলছে। সবার হাতে বড় বড় লাঠি এবং পাথর। চোরদেরকে এই ৩০০-৪০০ লোকের হাতে তুলে দিলে ওখানেই পিটিয়ে মেরে ফেলবে। আমি এগিয়ে গেলাম। এলাকাবাসীর সাথে কথা বললাম। কিন্তু উশৃংখল জনতা কিছুতেই শুনবে না আমার কথা। তাদের অভিযোগ, এই তিনজন প্রতিষ্ঠিত চোর, এর আগেও এরা বহুবার চুরি করেছে, জেলও খেটেছে কিন্তু ছাড়া পেয়ে বারবার চুরি করে এরা। এদেরকে পিটিয়ে না মারলে কারো শান্তি হবেনা। স্থানীয় একজন মাত্র পুলিশ ছিল ওখানে। এত জনতার ভীড়ে তাকে নিতান্তই অসহায় মনে হচ্ছিল। আমার ক্যাম্প হলো আমাদের ব্যাটালিয়নের সবচেয়ে ছোট ক্যাম্প যেকানে জনবল খুবই কম এবং বস্তুত পক্ষে রাস্তার উপরে একটি চেক পোষ্ট মেইন্টেইন করা এই ক্যাম্পের প্রধান কাজ। এলাকাবাসী সবাই মিলে ক্যাম্পে আক্রমণ করলে সেটা আমাদের জন্য যথেষ্ঠ বিপদজনক হতে পারত। আমি পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে সাথে সাথে মোবাইলে ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারে জানালাম এবং রিজার্ভ ফোর্স চেয়ে রাখলাম। এদিকে আমি জনতাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া যাবেনা। পিটিয়ে হত্যা করা মানবাধিকার লংঘন। এবারে এই চোরদের অনেক কঠিন সাজা হবে, এরা আর কোনদিনও চুরি করার চিন্তাও করবা না, এরা সারা জীবনে জেলেই পড়ে থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু জনতা ছিল অসম্ভব ক্ষিপ্ত। আমি স্যুটকেসের মালিকদের ডাকলাম, তাদেরকে বুঝালাম, তারা সহ থানায় চোরদেরকে নিয়ে যাব বললাম, কিন্তু তারা রাজী হলেও ক্ষুদ্ধ জনতা মানলনা। তাদের আচরণ আরো আক্রমনাত্নক হয়ে উঠল। কেউ কেউ আমাদের লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছোড়া আরম্ভ করল। আমরা আত্নরক্ষা করার জন্য শেল্টার নিলাম এবং পরিস্থিতি অবনতির দিকে দেখে আমি আমার ক্যাম্পের সবাইকে সশস্ত্র হবার নির্দেশ দিলাম। জনতাকে হুশিয়ার করে বললাম, আমরা এসেছি শান্তির জন্যে, শান্তিপূর্ণভাবে আমরা এই চোরদের বিচার করব, কিন্তু রক্তপাতের মাধ্যমে নয়, আমাদের উপর আস্থা রাখার জন্য, আমাদের ক্যাম্পের গেইট ছেড়ে দাঁড়ানোর জন্য। আমি গাড়ী রেডি করলাম, চোরদেরকে পুলিশ এবং মালিক সহ থানায় নেবার জন্য। কিন্তু জনতা গেইট থেকে নড়ছিলনা এবং পাথর ছুড়ে গাড়ীর কাঁচ ভেঙ্গে দেবার হুমকি দিল। অস্ত্র দেখে তারা বিন্দু মাত্র ভয় পেলনা। কারন তারা তো ১৪ বছর ধরে এই অস্ত্র নিয়েই যুদ্ধ করেছে। আমি ফাকা গুলি করে ভয় দেখানোর পরিকল্পনা করলাম, ইতিমধ্যে আমাদের রিজার্ভ ফোর্স ও সাথে নাইজেরিয়ান পুলিশের একটি ভ্যান আসল। নাইজেরিয়ানদের হাতে টিয়ার গ্যাস আর লাঠি। ওরা ভ্যান থেকে নেমেই জনতার উপরে শুরু করল লাঠিচার্জ। যেই জনতা অস্ত্রকে ভয় পেলনা এবার তারা লাঠির বাড়ি আর টিয়ার গ্যাসের ভয়ে দিল দৌড়। বুঝলাম মাইরের উপর ঔষধ নাই। মূহূর্তের মধ্যে আমার ক্যাম্পের গেইট ফাঁকা হয়ে গেল। সাথে সাথে আমাদের গাড়ীতে করে চোর, এবং মালিকসহ সহ সবাইকে থানায় পাঠিয়ে দিলাম। অবশেষে শান্তিপূর্নভাবে সমস্যাটার সমাধান হলো। তিনটা জীবন বাঁচাতে পেরে সেদিন সত্যিই খুব ভাল লাগছিল।

এটা ছিল আমার নিজের ক্যাম্পের ঘটনা। এ ধরনের বা এর চেয়েও ভয়াবহ আরো অনেক ঘটনাই অনেক ক্যাম্পে ঘটেছে। ২০০৭ সালে একবার আমাদের আগের ব্যাটালিয়নের এক ক্যাম্পে স্থানীয় জনগন আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। সেটাও অনেকটা এ ধরনের কারনেই ঘটেছিল, কিন্তু সেবার জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ফায়ার ওপেন করতে হয়েছিল যেখানে অনেকেই আহত হয়েছিল। ২০০৬ এ আইভরি কোষ্টে গেরিলারা সশস্ত্র আক্রমণ করে ২ টা বাংলাদেশী ক্যাম্প দখল করে নিয়েছিল, পরবর্তীতে অবশ্য ক্যাম্পদুটো বাংলাদেশীরা পূনর্দখল করে কিন্ত সেবার আমাদের দিকের অনেক বেশি ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল।


রোজার ঈদে দেশে গিয়েছিলাম এক মাসের ছুটিতে। তখন ছিল সেপ্টেম্বর মাস। এরই মধ্যে শুনি প্রথম দুঃসংবাদটি। আমাদের একজন সদস্য সেরিব্রাল ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ করেই আমাদের ছেড়ে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। খুব কষ্ট পেলাম, কিন্তু কাউকে বুঝতে দিলাম না। ছুটিটা খুব একটা ভাল কাটলনা আমার। ছুটি শেষ করে আবার এলাম এখানে। আসার কিছুদিনের মধ্যেই দ্বিতীয় ধাক্কা- আরেকজন সদস্য গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল। এবার আর কেউ ঝুকি নিতে চাইলনা। রোগীকে জরুরী ভিত্তিতে দেশে ফেরত পাঠানো হলো। কিন্তু হায়, তাকেও বাঁচানো গেলনা। ঢাকা সিএমএইচে তার মৃত্যু হলো। দ্বিতীয়বার হোচট খেলাম।


এরপর বেশ কিছুদিন ভাল ছিলাম। এরই মধ্যে সায়েদের মাধ্যমে পরিচিত হলাম এই সিসিবির সাথে। আমি যেন হাতের মুঠোয় আকাশ পেলাম। দিন নাই, রাত নাই যখনি সময় পেতাম সিসিবিতে ঢু মারতাম। প্রথম দিকের লেখাগুলোতে পাঠকদের বেশ সাড়া পেয়ে মহা উৎসাহে উঠে পড়ে লেগে গেলাম। সিসিবি হয়ে উঠল আমার নিত্যদিনের অবসরের সঙ্গী। অন্যান্য কলেজের অনেক অপরিচিত সিনিয়র, জুনিয়রদের সাথেও পরিচিত হয়ে উঠলাম। এই ভার্চুয়াল জগতটাকে আমি খুবই উপভোগ করা শুরু করলাম। লেখার চেয়ে বেশি আনন্দ পেতাম সবার কমেন্ট পড়ে এবং পাল্টা কমেন্ট করে। সিনিয়র ভাইদের মধ্যে বিশেষ করে ব্লগের এমপি সানাউল্লাহ লাভ 😡 লু ভাই, রসিক শওকত মাসুম ভাই, সব্যসাচী জাত লেখক ফয়েজ ভাই, বিশিষ্ট চিন্তাবিদ মাহমুদ ভাই, স্পোর্টস রিপোর্টার এহসান ভাই; বন্ধুদের মধ্যে বিশেষ করে আমাদের ব্যাচের জিনিয়াস ঘুঘু তাইফুর, টুশকি সায়েদ, চল্লিশোর্ধ কাইয়ুম, জুনিয়রদের মধ্যে ঝুনা রসিক জুনায়েদ, যাষ্ট ফ্রেন্ড মাস্ফ্যু, প্রায় সময় মাথার উপরে দিয়ে যাওয়া এবং আন্ধা হয়ে যাওয়ার মতো করে লেখা আন্দালিব, চায়ের দোকানদার রকিব, এডু/মডু কামতাজ… থুক্কু কামরুল, (আষাড়+শ্রাবণ)-জিহাদ, কাজলা দিদিদের একমাত্র ভাই কামরুল-তপু, সবজান্তা (ভাল অর্থে) মুহাম্মদ, তার্কিক রায়হান আবীর, ছিদ্রান্বেষী সাকেব, একাধারে কবি-লেখক ও গল্পকারক টিটো, ছুম্মা আমিন, প্রবাসে বকবক করা (প্রলাপরত) তৌফিক, ধর্মীয় চিন্তাবিদ আলম (আলম এবং আবীরকে একবার আমার এক লেখায় বকা দিয়েছিলাম, তোমরা মনে কষ্ট রেখোনা ভাইয়ারা) , ছানাপোনা তুহিন; পরিচিত জুনিয়রদের মধ্যে ডজার কিন্তু চরম লেখক তানভীর, কালে-ভদ্রে উকি দেয়া মুঃ নুরুল হাসান (তারেক) পিরা ভাষার জনক রবিন…, বন্য (দুষ্ট) ফুয়াদ, উদীয়মান লেখক রাশেদ; আবার এদিকে আমার ভাইস্যার বা স্যারভাইদের তালিকার মধ্যে আছেন এডিসন ভাই, ওবায়দুল্লাহ ভাই, ইউসুফ ভাই, ব্যাচেলর কমান্ডার আহসান ভাই 😛 , সানবীর ভাই, জুলহাস ভাই সহ আরো অনেকে। বোনদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এডিটেড সেলিনা আপু, বোমা/ স্যাম-ঝ্যাং সামিয়া, । এছাড়াও নতুন বেশ কিছু ভাল মানের লেখকের আগমন ঘটেছে সিসিবিতে যাদের সাথে আমি গত কদিনে পরিচিত না হলেও নীরবে লেখা পড়ে গিয়েছি তারা হলেন রায়হান-রশিদ ভাই, জাহিদ ভাই, মোস্তফা মামুন ভাই, সুব্রত ভাই, সামীউর, আদনান এবং নবাগতা সুরভি … ছাড়াও আরো অনেকে। আরো আরো অনেকের নামই মনে আসছে কিন্তু সবার নাম লিখতে গেলে এই লেখা আর শেষ হবেনা। যাদের নাম বাকি থাকল তারা কেউ মনে কষ্ট নিবেন না প্লিজ। এতকিছু উল্লেখ করার কারন- এই যে বিশাল এক সিসিবি পরিবার আমাদের, সেই পরিবারের সদস্য হয়েছি গত এক বছর সময়ের মধ্যেই। আমি যখন সদস্য হই তখন মোট সদস্য ছিল ২০০ এর কিছু বেশি আর মাত্র সাড়ে তিন মাস পরে এখন এই সংখ্যা ৭৬০ এর উপরে। খুব পজেটিভ একটা লক্ষণ। সত্যিকার অর্থেই সিসিবি আমার এই এক বছরের অভিজ্ঞতার মধ্যে অন্যতম একটি অংশ। সিসিবির কারনেই আমার এই এক বছর বিশেষ করে শেষের অংশটি খুব দ্রুত কেটে গেল, কখনো নিজেকে অলস মনে হয়নি। আমি তাই সিসিবির সবার কাছে কৃতজ্ঞ।


সিসিবির সাথে পরিচয়ের পরই আসে তৃতীয় ধাক্কাটি। আমাদের পার্শ্ববর্তী ইউনিটের একটি গাড়ী মারাত্বক এক সড়ক দূর্ঘটনার কবলে পড়ে ঘটনাস্থলেই একজন প্রতিবেশীকে হারানো, পরবর্তীতে হাসপাতালে আরো একজনকে হারানো, সেইসাথে বেশ কয়েকজনের গুরুতর আহত হবার ঘটনা যেখানে আমাদের এডিসন ভাইও ছিলেন। জীবনের ঝুকি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। যদিও বর্তমানে লাইবেরিয়াতে অন্যান্য দেশের তুলনায় ঝুকির মাত্রা কম কিন্তু তারপরও সর্বদা জীবনের ঝুকি নিয়েই আমাদের অপারেশনে বের হতে হয়, শত্রু বা গেরিলাদের মোকাবেলার জন্য সর্বদা সশস্ত্র অবস্থায় চলাফেরা করতে হয়। সবকিছু জেনেশুনেই এই চ্যালেঞ্জিং লাইফ বেছে নিয়েছি আমরা। মরতে তো একদিন হবেই, কিন্তু তবুও এভাবে দূর্ঘটনায় জীবন চলে যাওয়াটা খুব কষ্টকর।

একটা মজার ঘটনা দিয়ে শেষ করার চেষ্টা করবঃ

আমাদের এই মিশনে আসার আগে সৈনিকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল কিভাবে এয়ারক্রাফটের ভিতরে এয়ার হোষ্টেস/ষ্টুয়ার্টদের সাথে কথা বলতে হবে। কমন কিছু ইংরেজী সবাইকে শেখানো হয়েছিল। বিভিন্ন খাবারের ইংরেজীও শেখানো হয়েছিল। কিন্তু কোন এক সৈনিকের খাবারের প্রতি একটু বিশেষ দূর্বলতা ছিল। সে বিমানের ভিতরের সব খাবারই খেতে চাইত। স্বাভাবিক ভাবেই ইংরেজীতে সে ছিল দূর্বল। তো মিশনে আসার সময় বিমানের ভিতরে ব্রেকফাষ্টের পর এয়ার হোষ্টেস যখন তার কাছে এসে জানতে চাইল “টি অর কফি”? তখন সে তার উত্তরে ইংরেজী বলতে গিয়ে ভুলে বলে বসল “দোনো”। অর্থাৎ সে দুটোই খেতে বা পান করতে চায়। এয়ার হোষ্টেস তো বিপদে পড়ল। এই ‘দোনো’ মানে কি সেতো আর বোঝেনা। যতবারই এয়ার হোষ্টেস জিজ্ঞাসা করে “টি অর কফি”? উত্তর হলো “দোনো”। শেষে আমাদের একজন অফিসারের হস্তক্ষেপে ব্যাপারটি সমাধা হয়। এয়ার হোষ্টেসকে বোঝানো হলো “দোনো” একটি বাংলা শব্দ যার অর্থ হলো “কফি”। অফিসারের চোখের কড়া চাহনি দেখে ভয়ে সে সৈনিক ‘দোনো’ মানে কফি মেনে নিয়ে কফির কাপ হাতে নিল। যাহোক, কোনমতে সেবার মান সম্মান রক্ষা করা গিয়েছিল।

এবারে দেশে ফেরার সময় সেই কাহিনীটি সবাইকে মনে করিয়ে দিয়ে সংযত আচরণ করার নির্দেশ এবং মহড়া দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আমি টেনশন করছি যদি সেই এয়ারহোষ্টেস আবার আমাদের বিমানে থাকে আর বাংলাদেশী দেখে যদি ঐ ঘটনা মনে পড়ে যায় তাহলে এবার না এসে আবার জিজ্ঞাসা করে বসে “টি অর দোনো” ?

যবনিকা

পাঠকগণ, আগামী সপ্তাহ থেকে শুরু করে পরবর্তী একমাসের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে আমাদের ফিরতি ফ্লাইটগুলো। প্লিজ, সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আমরা যেন পরবর্তী ব্যাটালিয়নকে সুচারুভাবে দায়িত্ব হস্তান্তর করে সুস্থ্য ও সুন্দর ভাবে মাটি ও মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারি। কষ্ট করে সম্পূর্ণ লেখাটা পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

৩,৮৮৩ বার দেখা হয়েছে

৩৪ টি মন্তব্য : “ফিরে দেখা একটি বছর…”

  1. জুবায়ের অর্ণব (৯৮-০৪)

    আপনার চোরের ঘটনাটা পড়ে একটা অনুভুতিই হল- "আমি আপনাদের জন্য গর্ব বোধ করি।" এরকম একটা অর্জন নিয়ে সারাজীবন নিজেকে একজন সফল মানুষ হিসেবে দাবী করে পার করা যায়। এই মানবাধিকার চেতনা সারা বিশ্বের সব মানুষের মধ্যে জাগ্রত হোক।

    জবাব দিন
  2. জুবায়ের অর্ণব (৯৮-০৪)
    আমি আমার এই ভাইদের হত্যাকারীদের বিচার চাই, বিচার চাই, বিচার চাই!!! পারবেন এই হত্যার সুষ্ঠু বিচার করে দিতে???

    if it could do right at this moment i would have sacrificed my all and everything for that.

    জবাব দিন
  3. কামরুলতপু (৯৬-০২)
    কাজলা দিদিদের একমাত্র ভাই কামরুল-তপু,

    নিজের নাম দেখলে কি যে ভাল লাগে...

    ভাইয়া আরেকটা কথা পিলিজ লাগে আমাদের সাথে থাইকেন মাঝে মাঝে হইলেও। ব্যস্ততায় লেখা দিতে না পারলেও কমেন্ট কইরেন।

    আর আর্মিতে যাবার ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রে উল্টাটাও হতে পারে। আমার নিজের ছোটভাই যেমন এখন অনার্স পাশ করে ভাবছে আর্মি ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে ঢুকবে কিনা। হঠাৎ করে বুঝতে পেরেছি আর্মি আমাদের কতটুকু।

    জবাব দিন
  4. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
    এবার না এসে আবার জিজ্ঞাসা করে বসে “টি অর দোনো” ?

    =)) =)) :pira: :pira:

    হাহাশ। (কপিরাইটঃ নাজমুল)


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  5. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    "যে একজন ব্যক্তির জীবন বাঁচালো সে যেন সমগ্র মানবজাতির জীবন বাঁচানোর মত পূণ্য অর্জন করল"

    রহমান ভাই,নিশ্চয়ই জানেন ইসলামের এই অমর বানীর কথা।
    আপনাকে সেলাম...

    জবাব দিন
  6. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    দেশের ছেলে দেশে ফিরে আসো। 😀

    ভীষন ভালো লাগলো পোস্টটা। এখনকার মতো না পারলেও সিসিবিতে সক্রিয় থেকো। সায়েদও নিশ্চয়ই ফিরছে? এপ্রিলে এবিসিতে গেট টুগেদার হবে। তৈরি থেকো। যে কোনো শুক্রবার। পরে সময় জানাবো।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রহমান (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।