আমার প্রথম ভূত দর্শন

১৯৯৩ সাল। আমার ক্লাস এইটের ঘটনা। তখন আমি ছিলাম মেঘনা হাউসের ৩৩ নম্বর রুমে, অর্থাৎ ৩ তলায় জুনিয়র ব্লকের সেকেন্ড কর্ণারমোষ্ট রুম। বাথরুমে যেতে হলে ৮/৯ টা রুমের সামনে দিয়ে করিডোর ধরে হেটে যাওয়া লাগত। এমনিতেই আমি একটু ভীতু ছিলাম, তার উপর যখন শুনলাম রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের আমলে ঐ ব্লকের কোন এক রুমে একজন ছাত্র ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্নহত্যা করেছিল এবং মাঝে মাঝে ভুত হয়ে চলে আসে তখন ভয় আরো বেড়ে গিয়েছিল।

আমার সাধারনত এক ঘুমেই রাত পার হতো (এখনো হয়)। তাই আমার রাতে বাথরুমে যাওয়ার অভ্যাস ছিলনা। একদিন রাতে ঘুমানোর আগে বেশি পানি খেয়ে ফেলেছিলাম। সেই রাতে (রাত ২টা/আড়াইটার দিকে হবে) ঘুম ভেঙ্গে গেল। মাঝরাতে রুমের দরজা খুলে বাহিরে যেতে একটু ভয় লাগছিল। তারপরও প্রেসার বেশি হওয়ার কারনে যেতে হলো। করিডোর দিয়ে হেটে যখন বাথরুমের দিকে যাচ্ছিলাম তখন দেখি করিডোরের এইপাশের লাইটগুলো জ্বলছে কিন্তু অপরপাশের সব লাইট অফ। বাথরুমটা ছিল লম্বা করিডোরের প্রায় মাঝামাঝি জায়গাতে। বাথরুমের মেইন দরজার কাছাকাছি হয়ে দেখলাম করিডোরের আরেক মাথায় অন্ধকারে দুইটা লম্বা মূর্তির মতো ছায়া নড়াচড়া করছে। একটু ভয় লাগল। আমার দেখার ভুলও হতে পারে এই ভেবে আর তাকালাম না ঐ দিকে। একটু ভয় হলেও মনের ভিতর কিছুটা সাহস করেই বাথরুমে ঢুকে গেলাম।

যেই আমার কর্মটি সমাধা করলাম অমনি দেখি বাথরুমের লাইট অফ হয়ে গেল। আমি ভাবলাম, ইশ্‌, এমন একটা সময়ে কারেন্ট চলে গেল!!! কিন্তু দেখলাম বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে রাস্তার ল্যাম্প পোষ্টের আলো আসছিল। তার মানে কারেন্ট যায়নি। আমার আবার ভয় করতে লাগল। তাহলে কি এটা ছায়ার মতো ঐ ভূতের কাজ? ভেন্টিলেটরে উকি দিয়ে দেখলাম আমাদের সাইডের করিডোরের সব লাইটও অফ। অথচ আসার সময় কিন্তু অন ছিল। আমার ভয় আরো বেড়ে গেল। এখন তাহলে রুমে ফিরব কিভাবে? রুমে ফিরতে পারব তো? নাকি এই বাথরুমের ভিতরে ভুত এসে আমাকে মেরে ফেলবে? এসব ভাবতে ভাবতে ততক্ষনে টেনশনে ঘামতে শুরু করেছি।

বাথরুমের ভিতরে অনেকক্ষন ধরে অপেক্ষা করলাম। কিন্তু লাইট আর জ্বলেনা। বের হওয়ার সাহসও পাচ্ছিলাম না। কি করা যায়? যত দোয়া জানতাম সব মনে মনে পড়া শুরু করলাম। কিন্তু ভয় কমলো না। এভাবে প্রায় ১৫-২০ মিনিট হয়ে গেল। কতক্ষন আর বাথরুমে থাকা যায়? হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি এল। এভাবে ভয়ের চোটে মরার চেয়ে সাহস দেখিয়ে মরা ভাল। ঠিক করলাম, অন্ধকারেই বের হবো। খুব আস্তে আস্তে বাথরুমের দরজাটা খুললাম যাতে কোন শব্দ না হয়। পা টিপে টিপে বের হয়ে বেসিন গুলোর পাশে মেইন দরজার কাছে আসলাম। এবার করিডোরে মাথা বের করে দুই দিকেই উকি দিলাম। তাকিয়ে দেখলাম দুই দিকে শুধুই অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছিলনা। কি করব ভাবলাম একটু। বাথরুমে থাকাটা নিরাপদ হবেনা। যা হবার হবে, আমি মনে মনে একটু সাহস সঞ্চয় করলাম। এবারে কোন দিকে না তাকিয়ে দোয়া পড়তে পড়তে সোজা হাটা দিলাম আমার রুমের দিকে।

১/২ টা রুম ক্রস করতেই আমি হালকা শব্দ শুনলাম পিছন থেকে, কারা যেন আমাকে ফলো করছে। আমি পিছনে তাকানোর সাহস পেলাম না, কিন্তু হাটার স্পীড বাড়িয়ে দিলাম। সাথে সাথে মনে হলো পিছনে কারা যেন আমার কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করছে। এবার আরো ভয় বেড়ে গেল। তখনো আমার রুম অনেক দূরে। আরো ৫/৬ টা রুম পরে আমার রুম। প্রচন্ড ভয়ের চোটে এবার দিলাম দৌড়। সাথে সাথে পিছনেও ধুপধাপ দৌড়ের শব্দ। আমি কোনমতে রুমে ঢুকে দরজার ছিটকিনি উপরে তুলে দিয়ে ফ্লাই করে আমার বেডে গিয়ে পড়লাম। রুমমেটদের ঘুমের একটু ডিসটার্বও হলো মনে হয়। কিন্তু কেউ জাগলো না।

যেই দরজার ছিটকিনি আমি কখনো এক চান্সে লাগাতে পারতামনা, সেদিন ভয়ের চোটে এক চান্সেই লাগিয়ে ফেললাম। শীতকাল ছিল, তাই রুমের জানালা বন্ধই ছিল। আমি বালিশে মুখ গুজে ছিলাম কয়েক মূহূর্ত। টের পেলাম, আমার ভিতরে হ্রদপিন্ডটা ড্রামবিটের মতো লাফাচ্ছে। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলাম বিশাল দুটি ছায়া জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি কোন শব্দ করলাম না, কম্বলের ভিতরে ঢুকে চুপ করে মূর্তির মতো ভীতু চোখে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। দেখলাম ছায়াগুলো জানালায় কিছুক্ষন অপেক্ষা করল, রুমের ভিতর কি যেন পর্যবেক্ষণ করল। তারপর নিঃশব্দে সরে গেল। ভয়ে বাকি রাত আমার আর ঘুম হলোনা।

পরদিন সকালে রুমমেটরা ঘুম থেকে উঠলে তাদের এই ভূতের গল্প বললাম। কেউই বিশ্বাস করলনা। ঐদিন সকালেই ব্রেকফাষ্টের সময় আমার টেবিল লীডার ইমতিয়াজ ভাই শয়তানী মার্কা হাসি দিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “রাতে বেশি ভয় পাইছিলা নাকি?” সাথে সাথে বুঝে গেলাম গতরাতের ঐ কারসাজি কে করেছে। হিসেব করে বের করলাম লম্বা ঐ দুজন হলো ইমতিয়াজ ভাই আর ওবায়েদ ভাই। ল্যাম্পপোষ্টের আলোতে ওনাদের ছায়াগুলো একটু বেশিই বড় লেগেছিল। ক্যান্ডিডেটস হওয়ার কারনে ওনারা রাত জেগে পড়ত আর আড্ডা মারত করিডোরের ঐ মাথায়। ইমতিয়াজ ভাই আর ওবায়েদ ভাইয়ের উপর আমার খুব রাগ হচ্ছিল তখন, কিন্তু কিছুই করার ছিলনা। শুধু বললাম, ভাইয়া, আপনারা হয়তো অনেক মজা পেয়েছেন, কিন্তু আমি খুবই ভয় পেয়েছি।

এরপর থেকে আমি রাতে পানি খাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলাম, যেন মাঝ রাতে আর কখনো ঘুম না ভাঙ্গে 😛

৩,৫৮৯ বার দেখা হয়েছে

৪৪ টি মন্তব্য : “আমার প্রথম ভূত দর্শন”

  1. রহমান (৯২-৯৮)

    প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি পাঠকদের কাছে, কারন এতক্ষন এই পোষ্টের কমেন্ট অফ হয়ে ছিল। আমার এখানে নেট খুবই স্লো। ইদানিং একটা লেখা আপলোড করতে অনেকক্ষন লাগে। প্রায়ই আপলোড হবার সময় মাঝপথে ডিসকানেক্টেড হয়ে যায় ফলে লেখা সম্পূর্ণ আসেনা এবং কমেন্ট অপশনে অটো অফ হয়ে থাকে।

    সাময়িক এই অসুবিধার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত 🙁

    জবাব দিন
  2. রহমান ভাই
    বুঝতে পারছি আপনার নেটে খুব সমস্যা। পোস্টটা প্রকাশ করতে আপনার অনেক ধকল গেছে। প্রথমে দেখ্লাম এক প্যারা মাত্র এসেছে, তাও কমেন্ট অফ করা। তার কিছু পরে আবার আরেকটা প্যারা এলো, তাও কমেন্ট অফ। এখন পড়তে এসে দেখি ঠিক হয়েছে।

    ভাইয়া, এইরকম নেটে সমস্যা থাকলে আগে পুরো লেখাটা নোট্প্যাডে বা অন্য কোথাও লিখে তারপর কপি করে পোস্ট এডিটরে এনে পেস্ট করে দিয়েন। তারপর প্রকাশ করে দিবেন। তাইলে আধা লেখা প্রকাশ হবার সুযোগ থাকে না।
    আর আপনার পোস্টগুলিতে শুরুতে কমেন্ট অফ থাকে কেন বুঝতে পারছি না। নইলে তো এমন হবার কথা না। অন্য কারো কখনো এমন হয়নি। আপনার লাস্ট কয়েকটা পোস্টে এমন হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে আপনি পোস্ট এডিট করার সময় 'এলাউ কমেন্ট' অপশনের টিক মার্কটা ভুলে তুলে দিচ্ছেন বারবার।

    ভালো থাকবেন। 😀

    জবাব দিন
    • রহমান (৯২-৯৮)

      অনেক ধন্যবাদ কামরুল। ঠিকই ধরেছ। গত দেড় ঘন্টা ধরে ট্রাই করে তারপর লেখাটা সম্পূর্ণ পাবলিশ করতে পেরেছি। আমি কিন্তু লেখাটা এডিটরে টাইপ করিনি, এম এস ওয়ার্ডে পুরাটা লিখে এনে এডিটরে পেষ্ট করেছিলাম। তারপরও এই সমস্যা হলো।

      এ্যালাউ কমেন্ট বক্সেও আমি টিক তুলনি, আমি খেয়াল করলাম, ওটা বারবার অটো উঠে যায়। যখন কোন লেখা আপলোড করার সময় অনেকক্ষন টাইম নিচ্ছে, তখন এক পর্যায়ে ডিসকানেক্টেড হয়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র তখনই কমেন্ট অপশনটা অটো অফ হয়ে যাচ্ছে, মানে টিক চিহ্নটা আপনাআপনি উঠে যাচ্ছে। আমার মনে হয় এটা ওয়ার্ডপ্রেসের ডিফল্ট সিস্টেমের কারনেই হচ্ছে।

      একটা কাজ করলে কেমন হয়? এ্যালাউ কমেন্ট বক্সের বদলে ডোন্ট এ্যালাউ কমেন্ট করলে আর টিক চিহ্ন মুছে যাওয়ার ব্যাপারটা ঘটতো না।

      টেকি ব্যাপার নিয়ে সিক রিপোর্ট বাদ দিয়ে এখানে আলোচনা করে ফেললাম। আশা করি বিরক্ত হওনি 😛

      জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    ধুর, ভয়ের কি ছিল??? 😛
    ঐ ছায়া দুটো যে ইমতিয়াজ ভাই আর ওবায়েদ ভাইএর ছিল এটা তো আমিই বুঝতেছিলাম, কেন যে রহমান ভাই বুঝেন নাই...!!! 😀 B-)

    অফটপিকঃ ভয়ের ঘটনাগুলো পরে মনে করে আমরা যতই হাসাহাসি করি না কেন, ঐ সময়ের যে ফিলিংস্টা সেটা কাউকে বুঝানো সম্ভব না...এ কেবল ভুক্তভোগীই বুঝতে পারবেন... :-B


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  4. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    আমার পাশের বেডের দুই ব্যাচ সিনিয়র গিয়াস ভাই মারা যাওয়ার পর পুরা কলেজ ভুতের ভয়ে খাটে খাটে জোড়া লাগাইয়া ঘুমাইতো। পুরা একমাস। সব পোলা বইল্লা কথা। নাইলে খবর আছিল!! 😉 😉 😉


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • রহমান (৯২-৯৮)

      আমরা সবাই জানি ভূত বলে কিছু নেই :no: , কিন্তু তারপরও ঐ ধরনের পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতায় মনের ভিতরে একরকম ভয় কাজ করে, কাল্পনিক ভূতের জন্ম হয় মনের ভিতরেই...

      জুনার এই কমেন্টটা দেখঃ

      ঐ সময়ের যে ফিলিংস্টা সেটা কাউকে বুঝানো সম্ভব না…এ কেবল ভুক্তভোগীই বুঝতে পারবেন…
      জবাব দিন
  5. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    আমাদের কলেজেও অনেক ভুত টাইপ মিথ ছিল। কলেজের তিন নম্বর ফুটবল গ্রাউন্ডে একটা পাকা কবর, কার কবর কেউ বলতে পারে না, মুক্তিযুদ্ধের পড়ে নাকি অনেক কংকাল পাওয়া গিয়েছিল এথলেটিক্স গ্রাউন্ডের পাশের ক্যানালে, পানির ট্যাংকিতে নাকি লম্বা লম্বা ছায়া দেখা যেত প্রায়ই (এডিসন ভাই ঘটনা কি সত্য নাকি?)

    ক্লাস সেভেনের শেষের দিকে "ড্রাকুলা" সবাই পড়ল হট কেকের মত। ডনের আবার দুইটা গজ দাত আছে দুইপাশে, পাতলা পুতলা চেহারা, খাড়া নাক, একদম পারফেক্ট "ড্রাকুলা", এটা বের করল রকিবুল। তার ধরনা ডন ব্যাটা নির্ঘাৎ ড্রাকুলা। ডন এটা বুঝতে পেরে ওর সামনে এসে দাত খিচানো শুরু করে দিল সময়ে অসময়ে।

    আহারে, কই গেল সেই সব দিন।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রহমান (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।