ঘুম

সবাই হয়তো ভাবছেন, আমি এক একটা লেখা জমা দিয়ে বারবার ঘুমিয়ে পড়ি। আসলে ব্যাপারটা কিন্তু সেরকম কিছু নয়। গত দেড়মাস সিসিবিতে আমার অনুপস্থিতি উরফে ঘুমানোর কারন দুটি। প্রথমত, দীর্ঘদিন ধরে ল্যাপটপ নষ্ট থাকা আর দ্বিতীয়ত, একসাথে দুটি এ্যাপয়েন্টমেন্টে কাজ করার কারনে প্রচন্ড ব্যস্ত সময় পার করা। যাই হোক এবার ঈদ পরবর্তী ছুটিতে এসে কিছুটা সময় বের করতে পারলাম। সিসিবিতে কিছু একটা লিখার জন্য দুদিন যাবত আমার আঙ্গুল চুলকাচ্ছে। বারবার কী-বোর্ডের উপর হাত চলে যাচ্ছে। কিন্তু কি লিখব? আজ ঘুম থেকে উঠে বিছানায় শুয়ে শুয়ে এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঠিক করে ফেললাম, আজ “ঘুম” নিয়েই কিছু একটা লিখে ফেলব।

ঘুম নিয়ে অনেক আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। কার লেখা এখন ঠিক মনে আসছে না। গল্পের মূল বিষয়টা ছিল এরকমঃ আদিম যুগে মানুষ যখন ঘুম কী জিনিষ সেটা জানতো না, তখন সবাই মিলে ঘুম কে একটা জন্তু ভাবত। এই জন্তুটা প্রতিদিন রাতে আসে, আবার দিনের আলো ফোটার আগে পালিয়ে যায়। রাতে এটা এসে সবাইকে আক্রমণ করে, সবার অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করে চলে যায়। সকালে সবাই দেখে যে, রাতের মূল্যবান অনেকটা সময় এই জন্তুটা কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যায় এবং সবাই রাতে কিভাবে সময় পার করল সেটাও ভুলিয়ে দেয়। তাই সবাই মলে ঠিক করলো এই জন্তুটাকে ধরে মারতে হবে। এই জন্তুর হাত থেকে সবাইকে নিস্তার পেতে হবে। সবাই এই নিশি জন্তুকে ধরার জন্য প্রিপারেশন নিল। সে রাতে সবাই মিলে একসাথে জেগে থাকার সিদ্ধান্ত নিল। কেউ গাছের ডালে উঠল, কেউবা ঘরের চালে তীর, বল্লম নিয়ে। জন্তুটাকে মারতেই হবে। ধীরে ধীরে রাত গভীর হলো। হঠাৎ করে একজন গাছের উপর থেকে পড়ে গেল। সাথে সাথে তার চিৎকার- ধর, ধর জন্তুটা পালাল। এভাবে বারবার জন্তুটা আসে আর পালিয়ে যায়, কিন্তু কেউ দেখতে পায়না, ধরতেও পারেনা।

এরপর সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল, একজন আরেকজনকে হুশিয়ার করে দিবে যাতে ঐ জন্তু আক্রমণ করতে না পারে। এবার সবাই সামনা সামনি বসল, একজন আরেকজনকে হুশিয়ার করতে থাকল। এভাবে সারারাত তারা জেগে থাকল। এবার জন্তুটি এলনা। তারা তো মহাখুশি। ঐ জন্তু ভয়ে পালিয়েছে, আর আসবেনা। কিন্তু এবার দেখা গেল অন্য সমস্যা। সবার শরীর দূর্বল হওয়া শুরু করল। আর এই সুযোগে সেই জন্তুটি আবার আসল। কি মুশকিল! আগে জন্তুটা শুধু রাতে আসতো, কিন্তু তখন থেকে দিনেও আসা শুরু করল। কোনভাবেই ঐ জন্তুকে আটকানো যাচ্ছেনা। সবাই মিলে তখন আবার বসল, আলোচনা করল বিষয়টা নিয়ে। জন্তুটা না আসলে তো সবার শরীর দূর্বল হয়ে পড়ে, সবাই অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে সবার ভুল ভাঙ্গলো। জন্তু ভেবে তারা যাকে মারতে চেয়েছে সেটা আসলে জন্তু নয় সেটা হলো ঘুম, যা মানুষের জীবনধারনের জন্য অপরিহার্য।

ঘুম নিয়ে কত গবেষনাই না হয়েছে। ঘুম নিয়ে হয়েছে গান, হয়েছে অনেক ছড়া ও কবিতা। যেমন- আইয়ুব বাচ্চুর ‘ঘুম ভাঙ্গা শহরে’, ‘ঘুমন্ত শহরে’, ‘ঘুমাও তুমি’; হাবিবের ‘রাত নির্ঘুম’, এছাড়াও ‘নির্ঘুম রাত কেটেছে’ (কার গান মনে নেই) অথবা অনেক ছড়া যেমন- ‘ঘুম পাড়ানী মাসি পিসী’, ‘আয় আয় চাদ মামা… খোকার চোখে ঘুম নেই, ঘুম দিয়ে যা’, ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে’ টাইপ অনেক অনেক ছড়া বা গান। এরমানে ঘুম আমাদের জীবনের সাথে এতটাই মিশে আছে যে ঘুম নিয়ে গল্প, কবিতা, ছড়া, গান সব কিছুই তৈরী হয়েছে। আসলে এই ঘুম তো আমাদের জীবনেরই একটা অংশ।

ঘুমের কারনে কিন্তু অনেক বিপদও ঘটার নজির আছে। মাত্রাতিরিক্ত ঘুম অনেক বিপদের কারন। যেমন আমাদের দেশের অধিকাংশ ট্রাক চালকেরা রাতের বেলায় লং রুটে গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়ে। ফলাফল গাছের সাথে অথবা বিপরীত দিক থেকে আসা অন্য কোন গাড়ির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ। আবার বেশি ঘুমিয়ে সময়মতো সকালে/বিকেলে উঠতে না পারলে গাড়ি মিস, ক্লাস মিস সহ অনেক সুদর্শনা ‘মিস’ কেও জীবন থেকে মিস করার চান্স আছে।

আমার কলেজের এক বন্ধুর ঘুমানোর কাহিনী আগে একবার আমার “খুশকি” তে বলেছিলাম। সে এতো ঘুমাতো যে, তার মাথায় ডিকশনারী ছুড়ে মারার পর সে হাই তোলে ঘুম থেকে উঠে টেবিলের উপরে চক দেখে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘এই, চক মারে কে রে?’ বলে অবশ্য আবারো ঘুমিয়ে পড়েছিল! আমার আরেক বন্ধু (কোর্সমেট) একবার ক্লাসে ঘুমানোর কারনে মাথায় ডেক্স নিয়ে পেছনে দাড়িয়ে থাকার পানিশমেন্ট খেয়েছিল। আশ্চর্য্য হলেও সত্যি যে, তার কিছুক্ষন পর ডেক্স মাথায় নিয়ে দাড়িয়ে ঘুমানোর কারনে ডেক্স সহ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। একই কোর্সমেট 1st term এ থাকতে ঘুমের ঘোরে রুমের এক কোনায় গিয়ে বাথরুম ভেবে নিজের রুমেই ছোট প্রাকৃতিক কাজটি সেরে ফেলেছিল। পরে সেই রুম পরিস্কার করতে গিয়ে সবাই জানাজানি হয়ে গেল।

ঘুম নিয়ে আমি নিজে কিছুটা এক্সপেরিমেন্ট করেছি। আমি চেষ্টা করে দেখলাম ঘুমকে সম্পূর্ণ ভাবে ত্যাগ করা সম্ভব না হলেও অনেকটা কমানো সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন প্রচন্ড ডিটারমিনেশন এবং কনফিডেন্স। আমি খুব কম ঘুমিয়ে থাকতে পারি, এবং চেষ্টা করলে সারা রাত না ঘুমিয়ে পরে সারা দিন জেগে থাকতে পারি। বিএমএ তে প্রথম ৩ টার্ম একদম পড়াশোনা করিনি। ফাইনাল টার্মে বিএসসি পরীক্ষার ১০ দিন আগে টনক নড়ল। ভাল রেজাল্ট করতে হবে। সিরিয়াসলি পড়া শুরু করলাম। ঐ ১০ দিন গড়ে ১৮ -২০ ঘন্টা করে পড়লাম। জীবনেও যা করিনি ঐ ১০ দিন তাই করলাম। মাত্র ২-৩ ঘন্টা করে ঘুমালাম। আল্লাহর রহমতে ঐ পড়াতেই কাজ হয়ে গেল। 1st class পেয়ে গেলাম। বুঝলাম ডিটারমিনেশন আর কনফিডেন্স অনেক বড় দুটি শক্তি।

একটা আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, মানুষ তার জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময়ই ঘুমিয়ে কাটায়। কি অবাক হলেন? দিনে/রাতে মিলিয়ে ৮ ঘন্টা ঘুমানোর অভ্যাস কিন্তু অধিকাংশ মানুষেরই। ইনফ্যাক্ট, আলস্যের কারনে বেশি ঘুমানোর অভ্যাসটা আমাদের অনেকেরই আছে। একটু চেষ্টা করলেই এই আলস্যকে দূর করা সম্ভব। শৈশবে ঘুমের পরিমান বেশি থাকে এবং বৃদ্ধ বয়সে হয়ে যায় এর উল্টো। ডাক্তারদের মতে, শরীর সুস্থ্য রাখার জন্য নূন্যতম ৬ ঘন্টা ঘুমই নাকি যথেষ্ঠ। আমরা যদি এই অভ্যাসটা গড়ে তুলতে পারি তাহলে জীবনের এক-তৃতীয়াংশ না ঘুমিয়ে এক-চতুর্থাংশ ঘুমিয়ে বাকি সময়টা অন্য ভাল কোন কাজে (যেমন- ফজরের নামাজ, তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া, বা যার যার ধর্ম চর্চা করা; ভাল কোন বই পড়া, অথবা অন্য যেকোন রকম ভাল কাজ করা) ব্যয় করতে পারি।

আমার এইসব আতেল টাইপ লিখা পড়তে গিয়ে আপনাদের মনে হয় ঘুম পাচ্ছে, ঠিক না? দেখি এবার আপনাদের ঘুম ভাঙ্গাতে পারি কিনা। শেষ করবো আরেকটা মজার ঘুমের কাহিনী দিয়ে। ঘটনাটা বছর তিনেক আগের। আমার এক কোর্সমেট (এক্স ক্যাডেট) নতুন বিয়ে করেছিল। বিয়ের কয়েকদিন পর একদিন রাত ১২ টার সময় অন্য আরেক কোর্সমেট একটা জরুরী কারনে তাকে ফোন করেছিল। সে তখন ঘুমের ঘোরেই সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল। কথার শেষ পর্যায়ে আমার প্রশ্নকারী বন্ধুটি জিজ্ঞাসা করল,

ঃ ভাবী কোথায়?
আমার বন্ধুর ঘুম জড়ানো কন্ঠে উত্তর
ঃ উপরে।
ঃ মানে? তুই না ৪ তলায় থাকিস, এত রাতে ভাবী ছাদে গেল কেন? ঝগড়া করেছিস?
ঃ আরে না, ও তো এখানেই, আমার উপরে… 😐

(ছাপার অযোগ্য মনে হলে শেষের প্যারাটা মডারেটরকে মুছে দেয়ার জন্য অনুরোধ করছি।)

৩,০৬৯ বার দেখা হয়েছে

৪৬ টি মন্তব্য : “ঘুম”

  1. রকিব (০১-০৭)

    কি যে দিনকাল পড়লো!! সিনিয়ররা খালি ইটা ছোড়াছুড়ি করে। :gulti:
    বহুদিন পর রহমান ভাই লেখা দিলেন। টুশকীরে খুব মিস করি। 😕


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. রেজওয়ান (৯৯-০৫)

    আমি একবার ঘুমাইতে ঘুমাইতে সি এল এইচ থেকে এক্কেবারে জাহাঙ্গীর কোম্পানী পর্যন্ত গেসিলাম 😀 ( ৪০০ গজ তো হইবেই )
    তাও ফার্স্ট টার্মে থাকতে......গিয়ে ফাইনাল টার্ম স্কয়ার এ দাড়াইয়া ছিলাম......আমার এক ফাইনাল টার্ম কলেজ ভাই আইসা আমারে নাড়া দিয়া উঠাইছে :))

    জবাব দিন
  3. তানভীর (৯৪-০০)

    হায় ঘুম! 🙁 🙁

    আমার জীবনে বাকি সব কিছু একদিকে আর ঘুম আরেকদিকে। আফসুস, বেসরকারী চাকুরীজীবি হয়ে এখন অনেক কম ঘুমাতে হয়! 🙁 আমি তো পারলে আমার জীবনের অর্ধাংশই ঘুমিয়ে কাটাতাম!

    এখন নিশ্চয়ই আপনার ল্যাপটপ ঠিক আছে, আর সেই সাথে এ্যাপয়েন্টমেন্টের ঝামেলাও নাই। তাহলে ঝটপট লিখে ফেলুন "খুশকি"র ষষ্ঠ পর্ব। 🙂

    জবাব দিন
    • রহমান (৯২-৯৮)
      আমি তো পারলে আমার জীবনের অর্ধাংশই ঘুমিয়ে কাটাতাম!

      😮 বলো কি? গুম কুব কারাপ জিনিস। বেশি হইলেও প্রব, আবার কম হইলেও প্রব...

      তাহলে ঝটপট লিখে ফেলুন “খুশকি”র ষষ্ঠ পর্ব

      🙁 মেটারিয়্যালস্‌ যোগাড় কইরতেসি। কয়েকদিন টাইম দেও ;;)

      জবাব দিন
  4. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    জনৈক মনীষী বলেছেন-পৃথিবীতে সবচাইতে আনন্দের তিনটি জিনিসের একটি হচ্ছে খাওয়া-দাওয়া,অপরটি ঘুম এবং আরেকটা...*ক্স" :-B :-B

    রহমান মামা,লিখাটা সেইরাম হইছে,ইস্পিশালি লাস্ট প্যারাটা :goragori: :goragori:

    জবাব দিন
  5. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    ঘুম নিয়া নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দেওয়ার জন্য রহমান তোমাকে সিসিবি পিকনিকে বিশেষ পদক দেওয়া হবে। পিকনিকে আইস্যা পড়ো। হা.................হু......ম ঘুম পাচ্ছে........ঘু.....ম... 😕


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  6. দিহান আহসান

    অনেকদিন পর ভাইয়া, কেমন আছেন?

    কত্তদিন ঘুমাইনা, তবে ভাইয়া ঠিক বলেছেন, ঘুমের পাগল এই আমি এখন দিনে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিই। 🙂
    লেখা সিরাম হইসে :thumbup:
    এহহে!! অনেক রাত হয়ে গেলো, যাই ঘুমাতে যাই। ;))

    জবাব দিন
  7. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    কোনভাবে যদি ঘুম জিনিষটাকে বিদায় করে দেয়া যেত..... শুধু শুধু টাইম লস


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রেজওয়ান (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।