প্রসঙ্গঃ বাংলাদেশ ক্রিকেট এবং কিছু অগোছালো চিন্তাভাবনা

ক্রিকেট খেলায় আমি কতটুকু পারদর্শী, তা নিয়ে আমার ২য় ব্লগে অনেকটা লিখেছিলাম। যারা এই ব্লগের পুরাতন সদস্য তারা হয়তো মনে রেখেছেন। কিন্তু তারপরও আমি কিন্তু ক্রিকেট খেলা দেখতে খুব এনজয় করি। আমি যেখানে থাকি সেখানে মোবাইল এবং ইন্টারনেট না থাকলেও আমাদের নিজস্ব ডিস টিভি থাকার কল্যানে এবারকার বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলাগুলো দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। তাই ছোট্ট এই ছুটিতে এসে ভাবলাম, এই ক্রিকেট নিয়েই কিছু একটা লিখে ফেলি।

এবার বাংলাদেশের ক্রিকেটের যে দিকটা আমার কাছে সবচেয়ে ভাল লেগেছে তা হলো- খেলোয়াড়দের মধ্যে একটা ম্যাচিউরিটি এসেছে। বিশেষ করে আমাদের ওপেনার দুজন এবং টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে আমি একটা বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি, যেটা এতদিন পর্যন্ত অন্যতম একটা দূর্বলতা ছিল। বিশেষ ভাবে বলতেই হয় তামিম ইকবাল এবং সাকিব আল হাসানের নাম। এছাড়াও আশরাফুল (শুধু ওয়ানডেতে), রাকিবুল, মুশফিকুর, জুনায়েদ সিদ্দিকী ও অন্যান্যরা প্রায় সবাই ভাল ব্যাটিং করেছে। স্পিন বোলিং এ আমাদের সাফল্য ছিল এবার চোখে পড়ার মতো। প্রায় প্রতিটি খেলাতেই আমাদের কেউ না কেউ খুব ভাল খেলেছে, এবং এই ধারাবাহিকতাটা ছিল চোখে পড়ার মতো। একই সাথে প্রতিপক্ষের বাউন্সারে আমাদের ব্যাটসম্যানদের দূর্বলতা এখনো রয়ে গিয়েছে সেটা স্বীকার করে নিতেই হবে।

অনেকে হয়তো বলতে পারেন, এবারে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল ওয়েষ্ট ইন্ডিজের ৩য় দল এবং দূর্বল জিম্বাবুয়ে- যার কারনে বাংলাদেশের এত সাফল্য। কিন্তু তাই বলে আমি বাংলাদেশের এই সাফল্যকে কোন অংশেই খাটো করে দেখবনা। কারন, আমাদের ক্রিকেটাররা এবার সত্যি সত্যিই পজেটিভ ক্রিকেট খেলেছে, ম্যাচিউরড ক্রিকেট খেলেছে- যেটা এতদিন খেলতে পারেনি। এভাবে খেলতে পারলে যেকোন অসম্ভবকেই সম্ভব করে তোলা সম্ভব। খেয়াল করে দেখুন, এ পর্যন্ত শুধুমাত্র ইংল্যান্ড বাদে অন্য সব দেশকেই কোন না কোন ম্যাচে হারানোর রেকর্ড কিন্তু বাংলাদেশের আছে। অতএব আমি মনে করি আমাদের ক্রিকেটাররা পৃথিবীর যেকোন দেশকেই হারানোর ক্ষমতা রাখে এবং অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশেরও ক্রিকেটে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। শুধুমাত্র একটু সঠিক দিক-নির্দেশনা আর অধ্যবসায় থাকলেই এটা সম্ভব হতে পারে।

লক্ষ্য করে দেখুন আমাদের দেশ আন্তর্জাতিকভাবে একদিনের ম্যাচ খেলছে বিগত ১২ বছর ধরে, অথচ সেই হিসেবে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের ক্রিকেটের সাফল্য কিন্তু অনেক কম। আমাদের উপমহাদেশের দল শ্রীলঙ্কার কথাই ধরুন না, খুব কম সময়ের মধ্যেই তারা কিন্তু সাফল্যের শিখরে (৯৬ এ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন) চলে যেতে পেরেছিল। ওরা যদি পারে তাহলে আমরা কেন পারবনা? হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, ভৌগলিক কারনে আমাদের দেশের খেলোয়াড়রা শারীরিকভাবে অপেক্ষাকৃত দূর্বল এবং কম উচ্চতাসম্পন্ন, কিন্তু পরিকল্পিত ডায়েট প্রোগ্রাম, উন্নত কোচিং এবং নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে কিন্তু এই দূর্বলতাগুলোকে কাটিয়ে উঠা সম্ভব। আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে শিক্ষা নিতে পারি, কিভাবে একটি দেশে ক্রিকেটকে প্রমোট করা হচ্ছে। যার কারনে ইতোমধ্যে ভারত তাদের পেস বোলিং এর দূর্বলতা অনেকটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।

কয়েকবছর আগে গ্রামীন ফোনের উদ্যোগে পেসার হান্টের একটা বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, যারফলে আমরা বর্তমান জাতীয় দলের বেশকয়েকজন পেসারকে খুজে পেয়েছি। আমি মনে করি এ ধরনের গঠনমূলক উদ্যোগে অন্যান্য প্রাইভেট এবং মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীগুলো এগিয়ে এসে আমাদের ক্রিকেটকে আরো সমৃদ্ধ করতে পারে। এছাড়াও আমাদের ক্রিকেটারদের উন্নত প্রশিক্ষনের জন্য প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট ও অন্যান্য টেকনিক্যাল বিষয়ে সাহায্য করার কথাও এই কোম্পানীগুলো ভেবে দেখতে পারে। উন্নত দেশগুলো নাকি বিশ্বের সব দেশের ভাল বোলারদের বোলিং এ্যাকশন, ব্যাটিং ষ্টাইল ইত্যাদি ভিডিওফুটেজ স্লো মোশনে দেখিয়ে নিজস্ব খেলোয়াড়দের ট্রেনিং দিয়ে থাকে। আমি জানিনা, আমাদের দেশে এ ধরনের কোন ট্রেনিং ব্যবস্থা আছে কিনা। আমার কাছে এ বিষয়টাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। এজন্য বিশ্বের সব ভাল খেলোয়াড়দের ভিডিও ফুটেজ আমাদের সংরক্ষন করা উচিত।

আমি যখন ছোট ছিলাম তখন নির্মান স্কুল ক্রিকেটের কথা খুব শুনতাম। স্কুল-কলেজ পর্যায়ের ক্ষুদে খেলোয়াড়দের নিয়ে ছিল এই আয়োজন। কিন্তু ইদানীং আগের মতো খুব একটা এই ক্রিকেটের নাম শোনা যায়না। সবাই এখন ব্যস্ত জিপিএ-৫ পাওয়ার প্রতিযোগিতায়…। একজন ভালো ক্রিকেটার হওয়াও যে একজন ছাত্রের জীবনের লক্ষ্য হতে পারে, এটা তাকে বুঝতে তো দিতে হবে। এছাড়াও আমার কাছে মনে হয় আমাদের দেশে ক্রিকেটের ঘরোয়া লীগ গুলো অনেক কম পৃষ্ঠপোষকতা পায়। অথচ ভারতের মতো দেশ তাদের টি-টোয়েন্টি লীগের খেলা অন্য আরেক দেশে (দঃ আফ্রিকায়) পরিচালনা করেছে এবং সে দেশের খ্যাতনামা কোম্পানীগুলো এবং স্বচ্ছল ব্যক্তিরা কিভাবে এগিয়ে এসে তাদের ক্রিকেটকে প্রমোট করছে। আমাদের যদিও চট্টগ্রামে একটি টি-টোয়েন্টি লীগ হয়েছিল কিন্তু তা দেশের জনগনের মধ্যে অতটা সাড়া ফেলতে পারেনি।

এবারের বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা দেখতে গিয়ে একটা বিষয় আমাকে খুবই অবাক করেছে, তা হলো- এবারে খেলোয়াড়দের গায়ের জার্সি। জার্সির কোথাও “বাংলাদেশ” নামটা দেখলাম না। আশ্চর্য!!! এই খেলোয়াড়রা কিন্তু বিদেশের মাটিতে আমাদের দেশের রাষ্ট্রদূত, অথচ তারা কোন্‌ দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে তা বিদেশীদেরকে বোঝানোর কোন সিষ্টেম রাখা হয়নি এবারের জার্সিতে। আরেকটি বিষয় আমার কাছে খুব দৃষ্টিকটু লেগেছে, তা হলো খেলোয়াড়দের জার্সি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক ছোট করে বানানো। যার কারনে কোন খেলোয়াড়কেই জার্সি ইন করে খেলতে দেখা যায়নি। পত্রিকা থেকে জানলাম, জার্সি ইন করার জন্য অতিরিক্ত যতটুকু কাপড় লাগে, সে কাপড়টুকুই নাকি এবারের জার্সিতে ছিলনা। হায়!!! এও কি সম্ভব??? আমাদের দেশ এতটাই গরীব হয়ে গিয়েছে যে, ন্যাশনাল টিমের জার্সি বানানোর কাপড় শর্ট পড়লো??? আরো জানলাম, প্র্যাকটিস সেশনে নাকি খেলোয়াড়রা বোলিং করতে গিয়ে জার্সি টানাতেই বেশি ব্যস্ত ছিল, কারন বিদেশীদের সামনে বারবার বোলিং করতে গিয়ে নাকি জার্সি উপরে উঠে কোমড় এবং বক্ষদেশ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। আর খেলোয়াড়রা এবার পুরাতন জার্সি পরে খেলল কেন? এত লম্বা ট্যুরে তো কমপক্ষে চার জোড়া জার্সি থাকা উচিত প্রত্যেকের। পত্রিকায় আরো লিখেছে যে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে নাকি খেলোয়াড়দের পোশাক বানানো বাবদ প্রতিবছর মোটা অংকের টাকা দেয়া হয়। আমার প্রশ্ন হলো তাহলে ঐ টাকা যায় কোথায়? আফিসোস হয় খুব, আমরা নাকি গার্মেটন্স শিল্পে বিশ্বে প্রথম সারির দিকে… আমাদের খেলোয়াড়দের গায়ের পোষাক দেখলে বিদেশীরা কি তা আদৌ বিশ্বাস করবে বলুন?

আমাদের দেশের ক্রিকেটাররা ভালো খেললে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনা, গন-সংবর্ধনা, ক্রিকেট বোর্ডের সংবর্ধনা সহ আরো অসংখ্য সংবর্ধনায় খেলোয়াড়রা কিছুদিন আকাশে উড়তে থাকে। ক্রিকেটাররা একেকজন “মুই কি হনু” টাইপ হয়ে যায়। তার কিছুদিন পরই আবার “যেমন ছিলে” টাইপ “যেমন ছিলাম”… অর্থা সংবর্ধনার জোয়ারে একেকজন ভেসে গিয়ে আসল খেলাই ভুলে যায়। আবার খারাপ খেললে আমাদের খেলোয়াড়দের প্যান্ট খুলতেও মিডিয়াগুলো কোন ছাড় দেয়না। আমার মতে, অতিরিক্ত কোনকিছুই ভাল নয়। বেশি সংবর্ধনাও দেয়া উচিত নয়, আবার খেলোয়াড়দের অপমান করে পত্রিকায় কিছু লেখালেখি করাটাও অন্যায়। সবারই খারাপ সময় যায়, রেজাল্ট খারাপ হতেই পারে। তবে আমি মনে করি এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট যে রাস্তায় হাটছে তা একটি পজেটিভ সাইন। এ অবস্থাতে খেলোয়াড়দেরকে অতিরিক্ত সংবর্ধনা না দিয়ে তাদের এটা বুঝাতে হবে যে, এতদিনে বাংলাদেশ ক্রিকেট তার আসল রূপ পাচ্ছে, এটাই বাংলাদেশের স্বাভাবিক পারফরমেন্স, আমাদের সবসময় এরকমই খেলা উচিত। আমরা বিশ্ব জয় করে ফেলিনি, আমাদের এখনো বহু বহু দূর যেতে হবে। খেলোয়াড়দের মধ্যে এই আত্ববিশ্বাস গড়ে তুলতে হবে যে, “আমরা পারি” – আরো নির্দিষ্ট করে বলতে চাইলে বলা যায়- “আমরাই পারি”। অর্থাৎ আমাদের বর্তমান এই টিমটাকে দিয়েই সম্ভব… সব কিছুই সম্ভব। এটা আমার বিশ্বাস, একান্তই আমার…

অনেক গ্যাজাই ফেললাম, ঠিক না? আমার শেষকথা হলো, আমার মতো ক্রিকেট বিষয়ক গন্ডমূর্খ যদি অন্তঃত এতটুকু বুঝতে পারে তাহলে আমাদের বিসিবি, তথা দেশের অগনিত ক্রিকেট বোদ্ধারা না জানি কত বুঝে…???!!! আর ওনারা যদি এতই বুঝে তাহলে কোন এ্যাকশন কেন নেয়া হয়না??? অবশ্য আমি এটাও বুঝি যে, টিভিতে টক(আসলেই টক, একটুও মিষ্টি লাগেনা ঐ গুলা) -শোতে চায়ের কাপে ঝড় তোলা বা আমার মতো এরকম আতলামি করে লেখালেখি করা যতনা সহজ, বাস্তবে এসব বাস্তবায়িত করাটা এত সহজ হবেনা। কিন্তু আপনারাই বলেন আমি এতক্ষন ধরে যেসব বকবক করলাম, তার কিছুই কি সম্ভব না ? আমাদের ক্রিকেটের কি কোন ভবিষ্যত নেই? আমি তো স্বপ্ন দেখি আর কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা ক্রিকেটে বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন হবো। আপনাদের মধ্যে কেউ কি আমার মতো এই দিবাস্বপ্ন দেখেন?

১,৭০২ বার দেখা হয়েছে

২২ টি মন্তব্য : “প্রসঙ্গঃ বাংলাদেশ ক্রিকেট এবং কিছু অগোছালো চিন্তাভাবনা”

      • ফয়েজ (৮৭-৯৩)

        খোচা দিলাম নাকি? 🙂

        ১। আশারাফুল বের হতে পারেনি, আমার যেটা মনে হয়েছে।

        ২। ৩০০ এর উপরে রান চেজ করে যেতা কঠিন কাজ, প্রতিপক্ষ যেই থাকনা কেন। বাংলাদেশ এটা পেরেছে।

        ৩। জার্সি নিয়ে আমি কিন্তু বিব্রত হবার মত তেমন কিছু দেখিনি 😛 আমার বরং মনে হয়েছে জার্সি ছোট বাজেটের কারনে নয়, এটা স্টাইলের কারনে।

        খেলায় জেতাটা খুব জরুরী, প্রতিপক্ষ যেই হোক না কেন। আর ক্রিকেটের মন একটা "মাইন্ড গেমে" এটা আরও দরকারী, তাই বাংলাদেশের ছেলেরা কিছুটা হলেও এগিয়ে গেছে এটা মানতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। 🙂


        পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

        জবাব দিন
  1. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    আপনার সাথে কথা নাই।
    দেখা দেন না, কথা কন না, রইলেন কোন দূরে ! 😛


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  2. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    ভৌগলিক কারনে আমাদের দেশের খেলোয়াড়রা শারীরিকভাবে অপেক্ষাকৃত দূর্বল এবং কম উচ্চতাসম্পন্ন কিন্তু পরিকল্পিত ডায়েট প্রোগ্রাম, উন্নত কোচিং এবং নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে কিন্তু এই দূর্বলতাগুলোকে কাটিয়ে উঠা সম্ভব

    রহমান ভাই, আমি কিন্তু ভাইয়া আপনার সাথে এই ব্যাপারে একশ ভাগ একমত- শারীরিক দুর্বলতার এই কথাগুলা আগে হয়ত বিশ্বাস করতাম কিন্তু বি এম এতে থাকাকালীন অমানুষিক রকম ফিজিকাল ফিটনেস থাকা কিছু স্টাফকে দেখে আমি বিশ্বাস করতে শুরু করি যে ট্রেনিং আর ডায়েটের মাধ্যমে এই বাধা কাটিয়ে উঠা যায়। আল্লাহ, আমাদের পিটিএসও ভদ্রলোক যে কি লোক ছিলেন!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।