বিশ্বকাপ ৯৮ আর কিছু ভোল পাল্টানোর গল্প

১। ‘৯৮ এর বিশ্বকাপ। বয়স দশও হয়নি, তারপরও বিশ্বকাপের আমেজটা পেয়ে বসেছিলো ভালো মতোই। প্লেয়ার বলতে যদিও এক রোনালদোকেই চিনতাম, তারপরও আমার মাথায় খালি বিশ্বকাপই। বিশ্বকাপ বলতে খাতায় সারাদিন একটা বেল মাথা ৯ নম্বরের রোনালদো আর নীল রং এর উডিউড পেকার টাইপের বিশ্বকাপের মাসকট ফুটিক্স আঁকা !

২। বিশ্বকাপ শুরু হলো। বাসার ছাদে ব্রাজিলের পতাকা লাগলো, কারণ ফ্যামিলিগত ভাবেই সবাই ব্রাজিলের কড়া সমর্থক। পাড়ার সবাই মিলে চাঁদা দিয়ে শহরের সবচাইতে বড় পতাকাও বানানো হলো, কারণ আর্জেন্টিনার সাপোর্টাররা ২০০ গজি পতাকা বানিয়েছে, অনেক উঁচু বাঁশের উপর লাগানোর পরও সে পতাকা মাটি ছুঁয়ে যায়। আমরা ব্রাজিল সমর্থকরা অবশ্য তাদের মতো প্রোপোরশন বিরোধী পতাকা বানাইনি… আমাদের পতাকা ক্লাস টু এর বইয়ে পড়া ১০ : ৬ এর অনুপাতেই ছিলো। আর তাই প্রতিদিন মাটিতে পড়ে থাকা আর্জেন্টিনার পতাকাটিকে পদদলিত করে ব্রাজিলের মস্ত পতাকাটিকে সগৌরবে আকাশে উড়তে দেখে আমরা যারপরনাই গর্বিত আর আনন্দিত হতাম!

৩। বিশ্বকাপ কেবল অর্ধেকটা হয়েছে। আর্জেন্টিনা নেদারল্যান্ডের কাছে হেরে বাদ পড়লো… ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতলেও হয়তো এতোটা খুশি হতাম না, এইবার যতোটা খুশি হলাম! পুরা শহরে আর্জেন্টিনার পতাকা খুলে জ্বালাও পোড়াও অবস্থা। হঠাৎ খেয়াল হলো, দেশে কোন আর্জেন্টিনার সাপোর্টারই নাই! কই যেন সবাই উধাও! দুই একজনের বাসার ছাদে আবার বাংলাদেশের পতাকা ওড়া শুরু করলো, ভাবখানা এমন যে, কি হবে এইসব দল করে, আমি বাংলাদেশ করি!

সমস্ত বাসার ছাদে তখন খালি পতপতিয়ে ব্রাজিলের পতাকা উড়ছে… আহহহ! কি আনন্দ!

৪। অবশেষে ফাইনাল। আমার ব্রাজিলের সাথে দূর্বল ফ্রান্স… নো চান্স ব্রাদার… নো চান্স! বিশ্বকাপ আমরাই পাব!

খেলা শুরু হলো… ইস…. রোনালদো রে!!!! …এইটা কি মিস করলিরে… হবে হবে! এইবারের বার গোল হবে ….!
আশায় বুক বাঁধি…

গোল হবার ছিলো, হইলোও। ২৭ মিনিটে কর্নার থেকে জিদানের হেড..গোল! মাথাটা আউট হয়ে গেলো …

সমস্যা নাই..হইবেক হইবেক। ব্রাজিলের গোল হইবেক। হইলোও আবার গোল..আবার কর্নার, আবার হেড, আবার জিদান! ৪৩ মিনিট সময় তখন …. আশ্চর্য হয়ে ভাবছি, এগারো জন প্লেয়ার এই একটা জিদানের মাথা কাইটা ফালাইতে পারেনা?

হাফটাইমে বাইরে থেকে ফ্রান্স ফ্রান্স আওয়াজ আসছে। সমস্ত আর্জেন্টিনার সাপোর্টার বের হয়ে এসেছে খোলস থেকে আবার। কালকে খবর আছে…!

যখন সত্তর মিনিট হলো, বুঝে গেলাম, আর লাভ নাই। বিভিন্ন রং এর কলম এনে মামাকে ধরায় দিয়ে বললাম, “মামা, একটা ফ্রান্সের পতাকা আঁকায় দেও গালের মধ্যে …” অনেক সময় নিয়ে মামা পতাকা আঁকায় দিলেন। তবে গালে না, ঘাড়ের উপর। ৯০ মিনিটে যখন ফ্রান্স আরেকটা গোল দিলো, ফ্রান্সের বিজয়ানন্দে লাফাইতে লাফাইতে ঘুমাতে গেলাম।

৫। পরেরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি শহরের সেই পুরনো চেহারা। কোথাও নেই কোন পতাকা…যেন বিশ্বকাপ বলে কোন জিনিসই হয়নি। সবাই যেইখানে নীরব, তখন আমি আমার বন্ধুদের মাঝে হঠাৎই সরব হয়ে গেলাম… কারণ ফ্রান্সের একমাত্র সাপোর্টার আমিই।

বন্ধুদের বলা মাত্রই সবাই সটান, “তুই না ব্রাজিলের সাপোর্টার? ”

আমি গর্ব করে শার্টটা খুলে ঘাড়ের দিকটা ইঙ্গিত করি, “ব্রাজিল?? সেইটা আবার কি! আমি ফ্রান্স!! ”

… আশ্চর্য! সবাই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে! আমি আবার বলি, “শালারা, বিশ্বকাপ হাইরা হাসতাছস, লজ্জা লাগেনা?”

এইবারে তারা সরব হলো। আমাকে নিয়ে সেলুনে গিয়ে দুইটা আয়না নিয়ে দেখালো, কি সুন্দর করেই না আমার ঘাড়ের উপর একটা ব্রাজিলের পতাকা আঁকানো হয়েছে! সেলুনে ভালোই সেলুকাস হলো, আমার চোখ দিয়ে লজ্জায় টপটপ করে পানি পড়লো, আর মনটা বললো, “মাম্মা…খালি বাসায় আসো! আইজকা তোমার একদিন, কি আমার একদিন! “

১৬ টি মন্তব্য : “বিশ্বকাপ ৯৮ আর কিছু ভোল পাল্টানোর গল্প”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    ভাল লিখেছো রাফায়েত, মজা পেয়েছি 😀

    পরের বিশ্বকাপের স্মৃতিগুলোও লিখে ফেলো।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    এটা কি বিশ্বকাপ নিয়ে লেখালেখি প্রতিযোগিতায় অংশ নিলো?
    তাই যদি হয়, তবে ট্যাগ করে দেয়া উচিত।
    এ সুযোগে 'প্রতিযোগিতা'র কর্ণধারদেরও অনুরোধ করবো ট্যাগ করার বিষয়টি উত্থাপন করার জন্য।

    লেখা জব্বর লেগেছে। '৯৮ এর বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচটা আমার জন্যেও একটা বিশাল এনিগমা। পরের বার চ্যাম্পিয়ন হয়েও এ শোক কাটিয়ে দিতে পারেনি।

    জবাব দিন
  3. নাফিস (২০০৪-১০)

    লেখা দিছেন দেইখা ভালো লাগলো 😀
    ভোল পাল্টানো টা আমিও করছি এক দুইবার। ৯৮ এর বিশ্বকাপে খেলার মাঝখানে আমি দুইবার বাথরুমে হিসু করতে গিয়েছিলাম। ওই ফাঁকে দুই বার ই জিদান হেড করে গোল করে দেয়। সেই সময় আমার ধারণা হয়েছিল যে সব নষ্টের মূলে আমার বাথরুমে যাওয়া। এই কারনেই জিদান গোল দিলো। =)) :))

    এ নিয়ে কান্নাকাটি করছিলাম অনেক। 😛

    জবাব দিন
  4. শাহরিয়ার (০৬-১২)

    সুন্দর লিখছেন ভাইয়া। এখনো কি প্লাস্টিক সাপোর্টার? 😛


    • জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব - শিখা (মুসলিম সাহিত্য সমাজ) •

    জবাব দিন
  5. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    হাহাহাহাহাহা। ভাল ছিল আমি কোন কালেই একনিষ্ঠ ছিলাম না তবে ১৯৯৪ সাল থেকেই হলুদ হিমুর সাপোর্টার! 😛


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  6. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    তিনটা নক আউট জিতে ফাইনালে আসাটা বিরাট চাপ। এই চাপের সাথে তাল মিলাতে পারা না পারাই বিরাট ব্যবধান সৃষ্ট করে। ৯৮-তে যে বার্ন আউটের সুচনা, তা ক্রীড়া বিশ্বকে ভবিষ্যতে আরও ভোগাবে।


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  7. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    লেখা ভাল হইছে। :thumbup:

    ব্রাজিল সমর্থকদের অনেকগুলো দীর্ঘশ্বাসের বছর আছে, যেগুলোর অন্যতম হচ্ছে ১৯৫০ (স্বাগতিক ছিল, শেষ ম্যাচ ড্র করলেই চ্যাম্প, তবুও... 🙁 ), ১৯৬৬ (কোথাকার কোন ইংল্যান্ড দল... 😡 ), ১৯৮২ (ব্রাজিলের সর্বকালের অন্যতম সেরা দল ছিল) এবং অবশ্য ১৯৯৮। তবে ১৯৯৮ এর সাথে দীর্ঘশ্বাসের সাথে আছে অনেক অবিশ্বাস এবং কন্সপিরেসি থিউরি...

    যেহেতু অন্যগুলো দেখি নি, তাই ১৯৯৮ ই আমার কাছে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি... :no:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      কন্সপিরেসি থিউরি এসাইড
      তিনটা নক আউট ম্যাচ ফেভারিট হিসাবে জেতার চাপ। (ফেভারিটেরই জেতার চাপ থাকে। আন্ডারডগের আবার চাপ কি?)
      তার মধ্যে সেমিফাইনাল এক্সট্রাটাইম শেষে পেনাল্টি শুট আউটে।
      এত কিছু করার পর ফাইনাল হোস্টের সাথে।
      বার্ন আউট না হওয়াটাই হতো অবাক কান্ড।
      লম্বা নক আউট শুরুর পর এই ঘটনা ঐ একবারই ঘটেছিল।
      দেখা যাক এইবার আবার হয় কিনা...


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
      • জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

        পারভেজ ভাই, এবারের টিমটাতে সিনিয়র কাকা বা রবিনহো- এরা দুইজন বা নিদেনপক্ষে একজন থাকলেও অনেক ভরসা পেতাম। হাই ভোল্টেজ ম্যাচে কমবয়সী খেলোয়াররা টেম্পারমেন্ট ধরে রাখতে পারবে কি না- চিন্তায় আছি। দেখা যাক... :dreamy:


        ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

        জবাব দিন
        • পারভেজ (৭৮-৮৪)

          একটা যৌক্তিক কনসার্ন।
          তবে হোস্টের একটা এডভান্টেজ আছে, সাহস দেবার জন্য কম্পোজার ফেরানোর জন্য রথি মহারথিদের অনেককে পাশে পাওয়া সম্ভব।
          যারা ট্যুরে আছে তাঁদের জন্য পরিস্থিতিটা আরও জটিল।


          Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

          জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।