একটি ছয় ঘন্টার প্রেমকাহিনী

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, অনেক লম্বা রাস্তা। ছয়টা ঘন্টা কিভাবে কাটাবে ভেবে পায়না অরন্য। সারাজীবনে অনেক ট্রেনে বা বাসে একা একা গিয়েছে সে, এই আশায় যে পাশে কোন এক সুন্দরী বসবে, আর কোন একটা উছিলা বানিয়ে আলাপ শুরু করবে সে। একসময় ফোন নাম্বার নিবে, প্রেম শুরু হবে দুইজনের। বিশাল অনুষ্ঠান করে বিয়েও হবে দুজনের।

“এক্সকিউজ মি ব্রাদার…জানালার পাশের সিটটা আমার।” মধ্যবয়সী এক হোমড়াচোমড়া লোক এসে পাশে বসে অরন্যের। স্বপ্ন স্বপ্নই থাকে অরন্যের। কানে হেডফোন লাগিয়ে হাজারেরও বেশিবার শোনা গানটাই আবার শোনে সে। জীবন এরকমই আসলে…একঘেয়ে জীবনটাকে অরন্য তাই চোখ বন্ধ করে মুছে ফেলার চেষ্টা করে..চলে যায় স্বপ্নের জগতে।

অরন্যের স্বপ্নের জগতটা অনেক মজার। ও যা ইচ্ছা তাই করে, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে। আরেফিন রুমীকে পরাজিত করে সে ওখানে তিনটা বিয়েও করেছে…বউগুলোও একদম হুরপরী। তাকালে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা হয়…!

অরন্যের কাঁধ হঠাৎই কেমন যেন ভারী ভারী লাগছে।পাশে বসা লোকটা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অরন্যের কাঁধে এসে পড়েছে। মুখ থেকে পান খাবার পর কিছু লালাও পড়েছে অরন্যের হালকা নীল শার্টটাতে। স্বপ্নের জগত থেকে ফিরে আসে অরন্য, ফিরিয়ে আনে পাশের লোকটাকেও, “ভাই আপনার কমন সেন্স নাই? আমার শার্টটাতো একেবারে নষ্ট করে দিছেন!” লোকটা এরকম অপ্রত্যাশিত আচরণের জন্য নিজেও বিব্রত। অরন্য আরোও কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হলো, ভদ্রলোকের কোনার সিটে বসে থাকা মেয়েটা ওদের দিকেই তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। কি মনে করে অরন্য যেন চুপসে যায়, মেয়েটার দিকে আবার তাকায়। ভয়াবহ সুন্দরী বলতে যা বোঝায় এই মেয়েটি তাই!

অরন্য আড়চোখে তাকায় মেয়েটার দিকে, কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে মেয়েটা খুব জোরে হাসছে। কানে হেডফোন থাকায় শুনতে পারেনা সে। আর আশপাশে সমাজ নামের একটি বিশাল পর্দার কারনে ঠিকমতো তাকাতেও লজ্জা পায় সে। খুব অসহায় মনে হয় অরন্যের নিজেকে। পাশে বসা লোকটাকে ডাকে সে, “আঙ্কেল, জানালার পাশটা না আপনার সিট?” সায় দেবার পর অরন্য সিটটা পাল্টায়..অবশেষে লাজলজ্জার মাথা খেয়ে অরন্য মেয়েটার আরোও কাছে আসতে পারলো। কান থেকে হেডফোনটাও খুলে রাখে অরন্য, একটুকু গলার স্বরটা শুনে দেখার প্রচেষ্টা, বাহ! কি মিষ্টি কন্ঠ!

খুব আফসোস লাগে, ইশ মেয়েটা যে কেন পাশে বসলোনা! অরন্য চুপচাপ গান শুনবার অভিনয় করে মেয়েটার কথাগুলো শোনার চেষ্টা করতে থাকে। মেয়েটার পাশে তার মা, আর অরন্যের ঠিক সামনের সিটটায় মেয়েটার বাবা বসে, কোলে ছয় সাত বছর বয়সী একটা বাচ্চা। দেখে মধ্যবিত্ত পরিবার বলেই মনে হয় অরন্যের।

সামনে বাবার কোলে বসা বাচ্চাটার সাথে ভাব জমাবার চেষ্টা চলে। বাচ্চাটা কেমন যেন, মিশতে চায় না! অরন্যও অবশ্য কম যায় না, মেয়ে না পটাতে পারলে কি হবে, তার নিজের মাঝে বাচ্চামো স্বভাব থাকায় বাচ্চা পটাতে ওস্তাদ সে। ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাবার মতো, বাপের কোলের বাচ্চাটাকে পটিয়ে ফেলে অরন্য, কোন এক অজানার প্রত্যাশায়!

বাচ্চাটা ক্লাস টুতে পড়ে, আর ওর আপুটা ইন্টার দিয়েছে। ওর আব্বু ছোটখাটো ব্যাবসা করেন । চট্টগ্রামে এসেছিল চাচার বাসায় বেড়াতে আর এখন ঢাকা হয়ে জামালপুর যাবে।ওখানেই নাকি ওদের বাড়ি।

জামালপুরের কথা শুনে অরন্যের চোখ উজ্জ্বল হয়ে যায়। অরন্যের বেস্ট ফ্রেন্ড, সোহান। ওর সাথেই ক্যাডেট কলেজে পড়েছে, বাড়ি জামালপুর। ও অবশ্য আগেও শুনেছিল যে জামালপুরের মেয়েরা নাকি সুন্দর ..কিন্তু বেস্টফ্রেন্ডের চাপাবাজি কোনদিনও বিশ্বাস করেনি সে। শুধুমাত্র আজকের দিনটা বাদে…!!

অরন্য বাচ্চাটার কাছে আরও শুনে, ওর নাম নাফি আর ওর আপুর নাম নিশা। ওদের বাসা বকুলতলা নামে একটা এলাকায়। সোহানের বাসায়ও জিগাতলা না কোন এক তলায় যেন…!তবে অরন্য এটা ভালোই জানে যে জামালপুরে বিভিন্ন গাছ আর সেই গাছতলার নামেই নাকি এলাকার নাম দিতে পছন্দ করে মানুষ! আজব এলাকার লোক, আজব এলাকার নাম! তবে যাই হোক, এইরকম মেয়ে সে আগে দেখেনাই!

অরন্যের কোলে নাফি, ভালই খাতির জমেছে দুজনে। মেয়েটাও বারবার তাকাচ্ছে অরন্যের দিকে। ভাইটাকে দেখভাল করার জন্যে, নাকি অন্য কোন কারনে, ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। নামটা শুধু মনের মাঝে গেঁথে গেছে অরন্যের, নিশা! রাত, রাত্রি, নিশা, পূর্নিমা, অমানিশা …বাহ! অসাধারণ নাম! এই মেয়েকে হারানো যায় না!

অরন্য জানেনা, ওদিকটায় মেয়েটা কি ভাবছে। তাই একটা সুযোগ নেয় সে। ফোনটায় নিজে থেকেই রিংটোন বাজিয়ে নিজেনিজেই কথা বলা শুরু করে, “হ্যা…লেফটেনেন্ট শাহনেওয়াজ বলছি। রাইট..শাহনেওয়াজ রহমান অরন্য। হ্যা, তুমি আমার নাম্বারে ফ্লেক্সি করতো। নাম্বার জানোনা? জিরো ওয়ান সেভেন…” ট্রেনের বিকট আওয়াজকে হার মানিয়ে অরন্য আরও জোরে বলতে থাকে। সে নিজেও বোঝে, ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য না। তবুও, লেগে গেলে ক্ষতি কি!

অরন্যের এই কাহিনীর পর মেয়েটা একটা কেমন করে জানি হাসলো অরন্যের দিকে তাকিয়ে। অরন্য অনেক স্মার্ট, আর্মি অফিসার। কোনদিকেই কিছুতে কম নয়, তবু কেমন যেন নিজেকে অসহায় মনে করে। নিজের করা এই কাজটার জন্য আফসোস হয় তার…না করলেও পারতো এই ছোটলোকি! এখন মেয়েটা হয়তো বুঝেই ফেলেছে ..আর বুঝলে কি ভাববে সে! নিজেকে নিচু আর ছোট মনে হয় অরন্যের। বুঝেনা সে কি করবে।

ট্রেন সাইরেন বাজাচ্ছে … খেয়ালই করেনি অরন্য ছয় ঘন্টার যাত্রা কখন শেষ হয়ে এসেছে। পাশের লোকটা তার ব্যাগ নামিয়ে অরন্যের পায়ের সামনে রেখেছে, বসতে সমস্যা হচ্ছে ওর। নিশা আর নাফির বাবাও তাদের ব্যাগ গুলো নামাচ্ছেন, নিশা সেগুলো গুনে গুনে দেখছে। অসহায় বোধ হয় অরন্যের, নাহ জীবনে অনেক ট্রেন মিস না করেও মিস করেছে সে। হয়তোবা আজকেও করবে, কিন্তু চেষ্টা করতে দোষ কই?

তাড়াতাড়ি ব্যাগ নামিয়ে একটা কাগজে দ্রুত অরন্য নিজের নাম্বারটা লিখে ফেলে…গুটিসুটি করে মেয়েটার সামনে মেঝেতে ফেলে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে নেমে যায় অরন্য। পেছনে তাকাতে গিয়েও তাকায়না অরন্য, থাকুকনা একটু টেনশন! নাইবা জানলাম মেয়েটা কাগজের টুকরোটা নিলো কি নিলোনা! নিলেতো নিলোই, আর না নিলে? নিয়েছে, হয়তো একদিন কল দিবে.. এই আশাটা থেকে যাবে অরন্যের কাছে! এই কি বেশী না?

৮২৯ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “একটি ছয় ঘন্টার প্রেমকাহিনী”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    খারাপ না; ভালই।
    তবে আর্মি অফিসারের ছেবলামি চোখে লাগলো।
    ভাগ্য ভালো গল্প, আত্ম্জীবনী না!


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আশহাব (২০০২-০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।