চিন্তা খেলা করে ৩

সম্পর্কের রসায়ন

কি জটিল প্রক্রিয়ায় নারী ও পুরুষের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে জানা নেই। জানি না এই শহরে কেমন করে প্রেম হয়। গড়ে ওঠে সম্পর্কের বীজ। চারদিকে অজস্র সম্পর্ক গড়ে ওঠার মিছিল দেখে মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় ভীড়ের মাঝে আমিও ঢুকে পড়ি। কিন্তু এইসব মিছিলে নিজেকে ‘ফিশ আউট অফ ওয়াটার’ মনে হয়। ভাবি, গড়পরতা এইসব সম্পর্কের শেষটা আসলে কোথায়?

কলাভবনের সামনে তেঁতুলের আচার চাটতে দেখে যে নারীকে অপার্থিব সৌন্দর্যের দেবী মনে হয়েছিল, একদিন বর্ষার বিমুগ্ধ প্রহেলিকায় হুড তোলা রিক্সায় এক লোমশ হাত পেছন থেকে তার কোমড় ধরে বসে ছিল বলে, দেবীত্বের আসন থেকে মন যেন সহসাই তাঁকে নামিয়ে দিয়েছিল সাধারণ মেয়েদের কাতারে। কেন যে জানি না, অধিকারহীন এক নারীর জন্য বুকের মাঝে ছ্যাঁত করে ওঠা এই দৃশ্যপটের ভয়ে ভীতু আমি আর কোনদিন হুড তোলা রিক্সার দিকে তাকাইনি।

জ্বরগ্রস্ত মায়া মায়া এক নিশুথি রাতে যখন মাহবুব এসে হাত রেখেছিল মাথায়, বলেছিলাম তোর হাতটা হাতের ওপর রাখ। বহুদিন কেউ হাতের ওপর হাত রাখেনি। এ কথা শুনে ও হাত রাখার বদলে সরিয়ে নিয়েছিল সে হাত। অবাক বাকরুদ্ধ আমাকে অসহায়ের মত বলেছিল, দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় এক মেয়ে বলেছিল তোমার হাত খুব শক্ত মাহবুব। সেই থেকে আমি কারো হাত ধরি না ভাই।
জানি না সে মেয়ে আজ অন্য কারো হাতের নিগড়ে বন্দী কি না।

মনে পড়ে বরিশাল শহরের এক নিরিবিলি রেস্তোরায় সাদা ইউনিফর্ম পড়া কলেজ বালিকা রুক্ষ্ম আমার হাত ধরে একদিন বলেছিল, শোন রাব্বী, জীবন পথে অনেক সম্পর্কই তোমাকে পদে পদে বিভ্রান্ত করবে। কিন্তু এই অমোঘ সত্যটুকু যেন, তোমারই প্রিয় শংখ ঘোষের,
হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়,
সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়….

দ্বিধাগ্রস্ত এই আমি সারা জীবন বইতে পারবো না বলে আজো সম্পর্কের কোন কঠিন পথে পা বাড়াইনি। অথচ, বছরের পর বছর একসাথে ঘর করা পুরুষটা জানেনা স্ত্রীরও নিজস্ব ঘ্রাণ আছে।

শুধুই নিজের কথা কেন লিখি। বরং অন্যের কথাও হোক দু একটা। কার্জনের এক নির্জন বিকেলে বন্ধু লাবণ্য বলেছিল, এই সত্য তোরা ছেলেরা কবে বুঝতে শিখবি? একটা মেয়ে শরীর দেয়ার আগে মন দেয়। মানসিক ভাবে কাউকে গ্রহণ করতে না পারলে শারীরিক ভাবে তাকে গ্রহণ করা যায় না রে। তোরা পুরুষরা শুধুই পশুর মতো শরীরটাকে কামড়াতে জানিস। পর্নোগ্রাফি দেখে দেখে পাভার্ট তোরা সেক্স আর লাভ মেকিং এর পার্থক্যটুকুও জানিস না।

শরীর না দিতে পারা লাবণ্যের জন্য যেদিন হাসপাতালের করিডোরে নির্ঘুম রাত জেগেছিলাম আমরা ক’জন, সেদিন জেনেছিলাম জীবন থেকে চলে যাবার কষ্ট কতোটা নির্মম। আত্মঘাতী অভিমানে যে লাবণ্যকে হারিয়ে ফেলেছিলাম ক্যাম্পাস জীবনের শুরুতে, তাঁর কাছ থেকেও তো শেখা যেত সম্পর্কের রসায়ন।

শুধুই ভুল মানুষকে নির্বাচন করি আমরা। ট্রায়াল এন্ড এরর মেথড এই জীবনে খুব প্রাসঙ্গিক নয় বলে, আমরা হেঁটে বেড়াই ভুল মেমোরি লেনে। ক্লাসের যে মেয়েটা নোট নিয়ে অপেক্ষায় থাকে, তাঁকে কোনদিন ভালো লাগে না আমাদের। আমাদের ভালো লাগে রিক্সায় যেতে যেতে চুল বাঁধতে থাকা কোন অচেনা নারীকে। আমাদের ভালো লাগে স্টেডিয়ামে হঠাত চোখ যাওয়া কোন অচেনা পুরুষ, অথচ ভালোবাসার অথৈ সমুদ্র নিয়ে অপেক্ষমান যুবককে মনে হয় স্রোতের জলে ভেসে আসা ঝিনুক। সেই ঝিনুকের মাঝেই যে মুক্তা ছিল, তাকে আবিষ্কার করা হয় না বলে আমরা একটা জীবন কাটিয়ে দেই পুঁতির মালার সাথে। আমরা কাঁচকে হীরা ভেবে ভুল করি। আমরা ভাবি, সহজেই যা পেয়েছি তার আর কিসের মূল্যায়ন। অথচ জানি না, জীবনের বেঁচে থাকার জন্য সব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আমরা সহজে পেয়ে যাই।

অক্সিজেন এবং পানির মূল্য যেমন বোঝা যায় এর দুষ্প্রাপ্যতায়, তেমনি সহজলভ্য মানুষগুলো সহজাত অভ্যাসে মিশে গেলে তাদের মূল্য মেলে হারিয়ে ফেলার পর। আমরা হারিয়ে ফেলতে ভালোবাসি, কারণ নতুনের প্রতি আমাদের আগ্রহ অনেক। অথচ জানি না, সম্পর্ক পুরনো হলেই ঋণ বাড়ে। নতুন সম্পর্কের কাছে আমাদের দাবী আদায়ের কোন মিছিল থাকে না।
সম্পর্কের এইসব জটিল রহস্যের সমাধান যেদিন খুঁজে পাবো, সেদিন একটি চিরস্থায়ী সম্পর্কের কথা ভাবা যাবে। আপাতত মিছিলের মুখগুলো নিয়ে ভাবি।

স্টেরেওটাইপ

প্রতিদিন নিয়ম করে কথা বলার বাধ্যবাধকতা যে সম্পর্কে, সে সম্পর্ক এক ঘেয়েমিতায় রূপ নেবে, এতো খুব স্বাভাবিক।

প্রতিদিন কি আমাদের গল্প জমে? খাচ্ছি -দাচ্ছি দাড়ি কামাচ্ছির জীবনে প্রজাপতির ডানায় চেপে প্রতিদিনতো গল্প আসে না। অথচ, প্রেমিকা প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকবে নতুন নতুন গল্পের।
বানিয়ে বানিয়ে তাকে শোনাতে হবে আরব্যরজনীর মতো কোন মনোমুগ্ধকর গল্প, যে গল্পে সাসপেন্স থাকবে, বিষয়বস্ত হতে হবে রোম্যান্টিক, গল্পের ফিনিশিং দিতে হবে শ্রোতার মনের মত করে।

কিন্তু, তেমন গল্প তো খুব অহরহ ধরা দেয় না। ঘুম থেকে উঠলাম, ক্লাসে গেলাম, ক্লাস থেকে ফিরে ঘুমালাম, ঘুম থেকে উঠলাম, টিউশনিতে গেলাম, ডিনার করলাম, এখন ঘুমাবো, ঘুম থেকে উঠে আবার ক্লাসে যাবো….
এই ক্লিশে, এক ঘেয়েমিতে পরিপূর্ণ, জরাগ্রস্ত গল্প শোনাতে হবে বাধ্যতামূলক ভাবে, প্রতিদিন মধ্যরাতে। যেসব গল্পের নির্দিষ্ট কোন প্লট থাকবে না, যেসব গল্প ভাবনার জগত কে নাড়িয়ে দেবে না, যেসব কথোপকথন আপাত ভাবে পৃথিবীর কোন কাজেই আসবে না, শুধু মুঠোফোন কোম্পানিগুলোর ব্যবসা সমৃদ্ধ হবে।

এই নির্মম সত্যগুলোই বুঝতে চায় না মুঠোফোনের ওপাশের মানুষটা। খেয়ে নিও, ভালো থেক আর নিজের খেয়াল রেখ, এই পৌনঃপুনিক আলাপচারিতার ঘেরাটোপে আটকে থাকে সম্পর্ক। অথচ, সম্পর্ক মানেইতো বন্ধন। ফোনে নয়, মনে মনে জীবনের গল্প সাজানো। আচমকা দমকা হাওয়ার মত উড়ে আসা কোন কাহিনী, কোন দৃশ্যপট। যা বলার ইচ্ছে হয়, লিখতে ইচ্ছে হয়।

বিষন্নতাও এক ঘেয়েমি হয়ে যায়, কখনো সখনো। আর গতবাধা প্রেমের আলাপ তো লালনের গান নয়, বারবার শুনতে ইচ্ছে হবে।
কথাগুলো জমিয়ে রাখা ভালো। জমতে জমতে কথাগুলো মেঘের মতো হৃদয়ের আকাশে ভেসে বেড়াবে। একদিন অনেক কথার মেঘে ভারি হবে আকাশ, ভারি হবে বাতাস। বাতাস ভারি হলে থোকাথোকা ক্ষত গুলো বাড়িয়ে দেবে ক্ষতির পরিমাণ। এরপর কোন এক মধ্যরাতে ভারি বর্ষণ শুরু হলে ফোন দেব প্রিয় কোন নাম্বারে।
মায়াবী পাড়ের কোন কন্ঠ ভেসে আসবে বেতার তরংগে।
‘তোমার কথা খুব মনে পড়ছে’
শুধু একটি বাক্য, এরপর নীরবতা….রাতের আকাশে সেসব নীরবতা জন্ম দেবে অজস্র গল্পের….

কোন মুক্তিই মুক্তি নয়

সম্পর্কের মতো বন্ধন কারো কারো জন্যে নয়। কেউ কেউ মুক্ত থাকতে চায়। যারা মুক্ত থাকতে চায়, তারা কি মুক্ত থাকতে পারে আদৌ? কবিতায় লিখেছিলাম,
কোন মুক্তিই মুক্তি নয় নতুন একটি শৃংখলে বাধার পূর্ব প্রস্তুতি।

মাঝেমাঝে মনে হয়, এই প্রস্তুতি পর্ব নেয়াই অনেকের শেষ হয় না। মানুষ ভাবে, এই ফেসবুক, ভাইবার, স্কাইপি,হ্যাং আউটসের ভার্চুয়াল জগতে সম্পর্ক গড়ে তোলা খুব সহজ।

কিন্তু মানুষ জানে না, সম্পর্ক গড়ে ওঠার জন্য যে স্থিরতা দরকার, একাগ্রতা দরকার, এক নিষ্ঠতা দরকার তা এই ভার্চুয়াল জগতে নেই।
এই ভার্চুয়াল জগত মানুষের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। একেকটি আইডি, যেন একেকটি স্টল। স্টলে সাজানো মানুষের ব্যক্তিত্ব, অনূভুতি, নিজস্ব জীবন। বহুনির্বাচনী প্রশ্নের মতো, মানুষ বেছে নেয়ার সুযোগ।

কিন্তু সুযোগ যখন অনেক, তখনই মানুষ ভুল করে। জীবনে যতো বেশি অপশন, তত বেশি বিভ্রান্ত হতে হয়। এই ভার্চুয়াল জগত আমাদের অজস্র অপশন দিয়ে রেখেছে। তাই দ্বিধান্বিত মানুষ ঠিক কার কাছে যাবে, কার কাছে জমিয়ে রাখবে মনের কথাগুলো বুঝে উঠতে পারে না।
রাতে যার সাথে আলাপ করে মধুর ঘুম এলো, দুপুরের ভাতঘুমে হয়তো সে অনলাইনে নাও থাকতে পারে। তারই মতো কাউকে ভেবে যখন ভুল আইডিতে নক করা হয়, তখন ভুল দরোজায় কড়া নাড়ার মতোই হয়ে যায়। ভার্চুয়াল জগতে আমরা যত সহজেই মানুষকে কাছে টেনে নেই, যে যে প্যারামিটার দিয়ে মানুষকে জাজ করতে চাই, সেগুলো সম্পর্ক পাতানোর জন্যে খুব প্রাসংগিক নয়।

বলছিলাম, বন্ধন কারো কারো জন্যে নয়। সম্পর্কের বন্ধন। বন্ধন মানেইতো মিল। মিলেমিশে থাকা। কিন্তু মিল না হয়েও মিলেমিশে থাকার ভাণ করার মানে হয় না। মানুষকে তাই মুক্ত করে দেয়ার কিছু নেই, প্রতিটি মানুষই মুক্ত। কিন্তু, বন্ধন যখন বন্দীত্বের মতো হয়, সে বন্ধন ছিন্ন করাই শ্রেয়…..

কোথাও কেউ অপেক্ষায় নেই

একদিন ঘুম না আসা মধ্যরাতে কাউকে মনে পড়বে। কিন্তু কাকে, সে কথা স্পষ্ট করে জানান দেবে না মন। আমাদের মুঠোফোনে থাকবে কয়েক হাজার নাম্বার। নাম্বারগুলোকে মনে হবে অচেনা। মানুষ গুলোকেও। অধিকার নিয়ে এই মধ্যরাতে কাউকেই ফোন দেয়ার থাকবে না বলে, আমরা ফেসবুকের হোম পেজ স্ক্রল করবো। সেখানে বিচিত্র অনুভূতির স্টল সাজিয়ে বসে আছে ভার্চুয়াল কিছু মানুষ। আমরা আগ্রহ নিয়ে কিংবা হতে পারে আশা নিয়েই দেখবো কার কার নামের পাশে জ্বলে আছে সবুজ বাতি।

সবুজ বাতি জ্বলে থাকা মানুষগুলোকে মনে হবে কাছের কেউ। অথচ, তারা প্রত্যেকেই যেন বিচ্ছিন্ন একেকটি দ্বীপ। ঠিক কোন দ্বীপে আশ্রয় গড়ে তোলা যায়, এই নিয়ে বিভ্রান্ত আমরা আরো বিভ্রান্ত হবো। হেডফোনে বেজে উঠবে রবীন্দ্রনাথ। অনেক বছর আগেই এই বিভ্রান্ত নিয়ে যিনি লিখেছিলেন,
দিবস ও রজনী আমি যেন
কার আশায়য় আশায় থাকি…..
এভাবে অনেক রাত কেটে যাবে। অনেকদিন সকাল দেখে ঘুমাবো আমরা। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কেটে যাবে। আমরা তখন আর কারো অপেক্ষায় থাকবো না। আমরা বুঝে যাবো,
কোথাও কেউ অপেক্ষায় নেই…….

৪,২৫৫ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “চিন্তা খেলা করে ৩”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    "কোথাও কেউ অপেক্ষায় নেই……." - সত্যিই কি কেউ নেই কোথাও?
    নাকি যে আছে, সেও একইরকমের সংশয়ে আছে দেয়ালের ওপাশে থাকা মানুষটাকে নিয়ে?
    এই যে চারিদিকে এক একটা দেয়াল গড়ে রাখি, এটা কি এক এক সময় প্রটেকশন দেয়ার চেয়ে কমুনিকেশন ব্যারিয়ারই বেশি তৈরী করে ফেলে না?
    আর সেই কারনেই দুইপক্ষেই ইচ্ছা থাকার পরেও বলা হয় না কত কত কথা।
    অপেক্ষা থাকে দু'পক্ষেই, কিন্ত তা জানতে বা জানাতে পারে না কেউই...


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. আসাদ (৭৭-৮৩)

    "একদিন ঘুম না আসা মধ্যরাতে কাউকে মনে পড়বে। কিন্তু কাকে, সে কথা স্পষ্ট করে জানান দেবে না মন। আমাদের মুঠোফোনে থাকবে কয়েক হাজার নাম্বার। নাম্বারগুলোকে মনে হবে অচেনা। মানুষ গুলোকেও। অধিকার নিয়ে এই মধ্যরাতে কাউকেই ফোন দেয়ার থাকবে না বলে, আমরা ফেসবুকের হোম পেজ স্ক্রল করবো। সেখানে বিচিত্র অনুভূতির স্টল সাজিয়ে বসে আছে ভার্চুয়াল কিছু মানুষ। আমরা আগ্রহ নিয়ে কিংবা হতে পারে আশা নিয়েই দেখবো কার কার নামের পাশে জ্বলে আছে সবুজ বাতি।" -অসাধারন!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : পারভেজ (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।