রাজহাঁসের চিঠি

প্রিয় পানকৌড়ি,
বেসামরিক ভালোবাসা নিও। কথা ছিল আর কয়েকটা দিন পরেই পুরো ঝকঝকে তকতকে ইউনিফর্মের সামরিক পোশাক পরার। কাঁধের ওপর তারা চকচক করবে। সূর্যের প্রতিফলিত রশ্নি সে তারার ওপর অপূর্ব কারুকার্য এঁকে দেবে। অথচ আমি দেখবো না। কথা ছিল আর কিছুদিন পরেই পাসিং আউট প্যারেড হয়ে গেলে তোমাকে সশস্ত্র স্যালুট দিয়ে ব্যস্ত জনস্রোতে বলবো,ভালোবাসি। হয় নি। এক জীবনে মানুষ যা চায় তা হয় না। আজ অনেক দিন পর তোমার কাছে লেখা এ খোলা চিঠি। তেমন কোন বিশেষ ইচ্ছে ছিল না লেখার। তবে আজ এই কুয়াশার রাতে কিছু পুরনো স্মৃতি মনে পরতেই লেখার ইচ্ছাটা ভয়ংকর ভাবে চেপে বসলো।

আচ্ছা তোমার কি মনে আছে সেই সময়ের কথা? কলেজ ছুটি হলে খাকি পোশাকের আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতাম কি ব্যাকুল ভাবে। কতোদিন পর আমাদের দেখা হতো। তোমারও অজস্র অজুহাত দেখিয়ে বাসা থেকে বের হওয়া। সেই শাদাশাদি কলেজের পোশাকেই আটপৌরে তোমার আমার সামনে আসা। দুজন এক রিক্সা ভাড়া করে পুরো শহরটা ঘুরে বেড়াতাম আর সারা শহরের মানুষ গুলোর অজস্র চোখ এক নাগাড়ে তাকিয়ে দেখতো আমাদের পাগলামি। কি একটা সময় ছিল আমাদের। চোখ এড়িয়ে,চেনা চৌহদ্দীর বাইরে গিয়ে কিছুটা সময় আপাতত দুজন মুখোমুখি কিছুক্ষণ বসে থাকা। জীবনানন্দের শহরটা এত ছোট ছিল যে চাইলেও নিজেদের মতো করে সময় কাটাতে হয়তো পারতাম না আমরা। মানুষের ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা দেখে গর্বে তোমার বুক ভরে যেত। তুমিও আমাকে দেখতে চাইতে “ইউনিফর্মের” জীবনে আজীবনের জন্যে। চাইতে আমিও “চির উন্নত মম শিরের” জীবন বেছে নেই। সেই জলপাই রঙ গাড়ি,চকচকে সু পলিশ,দুপদাপ বুটের শব্দ,সাবধান,আরামে দাড়া,সালাম,স্যালুট…সেই স্টাফ,বি.এস.এম, সি.এস.এম..এন.সি.ও,ঘামে ভেজা শরীর,রোদে পোড়া তামাটে চামড়ার মানুষ গুলো,কমান্ড,বাগান বিলাস,শান বাঁধানো পুকুর ঘাট,স্থাপনা,বড় বড় দেয়ালে ছোট ছোট উক্তি,মখমল ঘাসের প্রলেপে খেলার মাঠ…শান্ত নিঃস্তদ্ধ পরিবেশ আর প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা সামরিক জীবন যাপন। এক তারা দুই তারা করে কাঁধে তিন তারা উঠলেই সারাজীবনের জন্যে তোমাকে কাছে পাওয়ার অফিসিয়াল অনুমতি পেয়ে যাবো। আমাদের বিয়ে হবে আলোকসজ্জিত কোন সামরিক কুঞ্জে। বিয়ের কয়েকদিন পরেই হয়তো অন্য দেশের শান্তি রক্ষায় তোমার শান্তি নষ্ট করে পাড়ি জমাতে হত আফ্রিকান কোন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে। তুমি লুকিয়ে কাঁদবে। বিদায়ের সময় এলে কান্না সংবরণ করে বলবে, সাবধানে থেক।

আমি কয়েক হাজার মাইল থেকে টের পাবো তোমার কান্না ভেজা কণ্ঠ। তোমার প্রতিটি দিন কাটতো আতঙ্কে। এরপর একদিন ফিরে আসতাম। একটা অলস বিকেল হয়তো কাটিয়ে দিতাম তোমার কোলে মাথা রেখে। আমার পুড়ে যাওয়া তামাটে চামড়ায় তুমি তোমার সবচেয়ে কোমল স্পর্শটুকু ঢেলে দিতে। কোথাও সন্ধ্যা নামতো শান্ত সুরে। পৃথিবী তার সব আলো নিভিয়ে ফেললে জমাট বাঁধা গাঢ় অন্ধকারে বসে থাকতাম আমরা দুজন।

খুব কম সময়ের মাঝে সমবয়সী দুজনের অপূর্ব মিলনের সুযোগ এই চাকরী ছাড়া আর কেউ দিতে পারে না। জানতে তুমিও। আর তাই হয়তো সব জেনেও আমার শরীর থেকে কবিতার কোমল চাদর খুলে নিয়ে কঠিন এক “ইউনিফর্ম” পরিয়ে দিতে চাইতে। তুমি বুঝতে তোমাকে নিয়ে লেখা এতসব কবিতা,উপমা,চিত্রকল্প শুধু কাগজেই ভালো মানায়। সীমাহিন বাস্তবতার পৃথিবীতে যার মুল্য সামান্য। তোমাকে কখনোই দোষ আমি দেই না। অন্যসব বাঙালি নারীর মত তুমিও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে। চাইতে নিশ্চিত জীবনের নিরাপত্তা।

তাই হয়তো নিজের ইচ্ছাটাকে চেপে রেখে তোমার স্বপ্নপুরণে উঠে পরে লাগলাম। খুব কাছাকাছি গিয়েও প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির সেই চিরায়ত ব্যবধানে সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। লাল টিকেট পেয়ে সেদিন যখন ফিরে এলাম ওদের নিয়োগ বোর্ড থেকে আমি ভেঙেই পরেছিলাম। নিজেকে তোমার কাছে এত ভয়ংকর অপরাধী আর কখনো মনে হয়নি আমার। জীবন যাপনে সেদিনের পর থেকে কি আমূল পরিবর্তন এলো। চোখের পলকে বদলে গেল চারপাশ। বদলে গেল মানুষের মন, বদলে গেল সবাই। প্রিয়তমা, আমি দেখেছি জীবনের কঠিন দুঃসময়ে মানুষ কিভাবে বদলায়। আমি দেখেছি কতটা অবহেলা জমলে একটা মানুষ জীবন থেকে চলে যেতে চায় নীরবে। সেদিনের পর থেকে জীবন থেকে অনেক কিছু হারালো। বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী,জৌলুস, বিলাসিতা, সবকিছু। শুধু সেই পুরনো তুমিটা আঁকড়ে ধরে রইলে আমাকে এক সমুদ্র ভালোবাসা নিয়ে। তুমিই সেখালে নতুন জীবন। সব হারানোর শেষের ভোরের নতুন আলোর আশা নিয়ে বাঁচতে শেখালে। এখন আমার এ মুক্ত জীবনটাই ভালো লাগে। এই যে অনাদরে মসৃণ গাল ঢেকে দিচ্ছে অমসৃণ দাড়ি, এই যে চোখের নিচে রাত জাগা কালো দাগ, আমার একেই আপন মনে হয়। সবার চেয়ে আপন। জানি, যে ভয়াবহ অনিশ্চিত জীবন আমরা যাপন করছি তার কোন গন্তব্য নেই। তবুও অবিকল সেই পুরনো তুমিটা এখনো আগের মতই আমায় ভালোবাসো জেনে আমি প্রাণ শক্তি পাই। অনেক কিছু না পাওয়ার জীবনে এটাই কি পরম পাওয়া নয়, তুমিই বল। এক জীবনে এই বিরল ভালোবাসা কজনের ভাগ্যে জোটে?

তুমি আর কবিতাকে আঁকড়ে ধরে যে কষ্টের জীবন যাপন করতে সংকল্পবদ্ধ সে জীবনে সবচেয়ে ভয়ংকর অনুপ্রেরণার নাম ভালোবাসা । আর কিছু না হোক অন্তত এইটুকু দিয়ো।

ইতি
তোমার রাজহাঁস
২৪।১২।১৩

১,২৬৭ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “রাজহাঁসের চিঠি”

মওন্তব্য করুন : মুরাদ (২০০২-০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।