কবি হেলাল হাফিজ ও ব্যক্তিগত অনুভূতি

কবি ও আমি। তাঁর ৬৪তম জন্মদিন এর রাতে তলা। হোটেল কর্ণফুলী।

কবি ও আমি। তাঁর ৬৪তম জন্মদিন এর রাতে তলা। হোটেল কর্ণফুলী।

nullমুল লেখাঃ
কবি হেলাল হাফিজের সাথে আমার পরিচয় খুবই অদ্ভুত ভাবে। এক বিকেলে চারুকলার সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ঢেলে সাজানো বই গুলোর দিকে চোখ বোলাতেই একটি বই চোখে লেগে যায়। যে জলে আগুন জ্বলে। চোখে লাগার মতোই বই। অদ্ভুত শিরোনাম। বই হাতে নিয়ে কয়েক পাতা ওল্টাতেই একটা কবিতা চোখে পড়ে। এক নিমিষেই পড়ে ফেলি।

“প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট
নদী এবং নারীর কষ্ট
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট
কষ্ট নেবে কষ্ট?”

কবির সাথে

কবিতার লাইন গুলো চেনা পরিচিত। কোথাও শুনেছি,কিন্তু মনে করতে পারছি না। মুহুর্ত অপেক্ষা না করেই বইটা কিনে ফেলি। একে একে পড়ে ফেলি “উৎসর্গ” “নাম ভূমিকায়”,”অহংকার” কবিতা গুলো। হঠাত্ করে মনে হলো আরে এতো শুধু কবিতা নয়,আমার মনের কথা গুলোই শব্দের শৈল্পিপ কারুকার্যে এখানে সাজানো হয়েছে। সেই বিকেলে আর বই মেলায় যাই না। অজস্র মন খারাপ নিয়ে ঢুকে পড়ি সোহরাওয়্যার্দী উদ্যানে। উল্টে পাল্টে দেখি বই এর প্রতিটা পাতা,খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি প্রত্যেকটি কবিতা। এই প্রথম কোন কবিতার বই যার প্রতিটি কবিতা ভালো লাগে। প্রতিটি কবিতাই মানুষের মনের কথা। বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা কবিতার লাইন। মাথায় ঘুরতে থাকে,

“বুকের সীমান্ত বন্ধ তুমিই করেছো
খুলে রেখেছিলাম অর্গল।
আমার যুগল চোখে ছিলো মানবিক খেলা
তুমি শুধু দেখেছো অনল।“

(অহংকার)

বুকের সীমান্ত আপাতত বন্ধ থাক এবার চোখের সীমান্ত দিয়ে কবিকে খোঁজার সময় এলো। বই এর ফ্ল্যাপে কোন কবি পরিচিতি নেই। প্রথম ফ্ল্যাপে কবির প্রথম যৌবনের ছবি এবং শেষ ফ্ল্যাপে পরিণত যৌবনের। দুটো ছবির মাঝে পার্থক্য বিস্তর। মৃদু হাসিমাখা কবির প্রথম যৌবনের ছবি পরিণত যৌবনে এসে কবিকে করে দিয়েছে বিষণ্ণ। দাঁড়ি আর গোঁফ এসে কবির সুন্দর মুখটাকে এতো অসহায় ভাবে ঢেকে দিয়েছে যে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। কিসের এতো কষ্ট কবির? একটা মানুষের এতো কষ্ট কিভাবে থাকে? কিংবা কতো টা কষ্ট সহ্য করতে পারে একটা মানুষ? কাকে ভেবে এই কবিতা লেখা? কোন মানবীর অবহেলায় কবির এই অবস্থা। মনের মাঝে এমন অসংখ্য প্রশ্ন এসে ভীড় করে। কৌতূহল বেড়ে যায়। বেদনায় কুঁকড়ে খাওয়া বিষাদময় একটি মুখ সমস্ত নিউরনে নিউরনে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। খুঁজে ফিরি কবিকে।
বাসায় ফিরে হেলাল হাফিজ লিখে গুগল এ খোঁজ দেই। তেমন কোন তথ্য নেই। শুধু এটুকু জানতে পারি কবির জন্ম নেত্রকোনায়। পড়ালেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন বিভাগ কিছুই জানি না। কবির একমাত্র বইটি প্রকাশ পায় ১৯৮৬ সালে। অর্থাত্ আজ থেকে সাতাশ বছর আগে। এর মাঝে কবি আর কিছু লিখেন নি। তবে কি কবি বেঁচে নেই?বেঁচে থাকলে কোথায় আছে?ক্যামোন আছে? আমি পাগলের মতো হয়ে যাই।
টুকটাক সাহিত্য চর্চার কারণে সাহিত্য জগতের অনেকের সাথেই পরিচয় আছে আমার। পরিচিত সবাইকে জিজ্ঞেস করি। কেউ বলতে পারে না। ধরেই নেই কবি মৃত। ভাবি এই জীবনে আর কবির সাথে দেখা হবে না। কবি তখন আমার কাছে দেবতার তুল্য। কবির প্রতিটা কবিতা মুখস্ত। নিজের কষ্টের সাথে কবিতার কষ্ট মিলিয়ে মনে মনে আবৃত্তি করি,

এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো,পত্র দিয়ো।
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালীর তাল পাখাটা
খুব নিশিথে তোমার হাতে কেমন আছে পত্র দিও।

(প্রস্থান)

বুকের ভেতরটা কেঁদে ওঠে। চোখ ভিজে যায়। কষ্ট কতোটা গভীর হতে পারে। কতোটা কষ্ট জমলে বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা শব্দরা কবিতা হয়। হেলাল হাফিজের কবিতা পড়লে বোঝা যায়। হেলাল হাফিজের কবিতা পড়েই অনুধাবন করি প্রেমকে,নারীকে। কবির মতো করে কে বলবে,

একবার ডাক দিয়ে দেখো আমি কতোটা কাঙাল
কতো হুলস্থূল অনটন আজন্ম ভেতরে আমার।
তুমি ডাক দিলে নষ্ট কষ্ট সব নিমিষেই ঝেড়ে মুছে
শব্দের অধিক দ্রুত গতিতে পৌঁছুবো
পরিণত প্রণয়ের উত্সমূল ছোঁব
পথে এতোটুকু দেরিও করবো না।

(তুমি ডাক দিলে)

কবির কিছু কিছু কবিতা শুধু কবিতা নয়। আরো বেশি কিছু। ব্যবধান কবিতায় কবি তাঁর প্রিয়তমাকে খুব বেশি নিকটে আসতে নিষেধ করেছেন। কি সুন্দর ভাষার ব্যবহার।

“অতো বেশি নিকটে এসো না,তুমি পুড়ে যাবে,
কিছুটা আড়াল কিছু ব্যবধান থাকা খুব ভালো।
বিদ্যুত্ সুপরিবাহী দুটি তার বিজ্ঞানসম্মত ভাবে যতোটুকু দূরে থাকে
তুমি ঠিক ততোখানি নিরাপদ কাছাকাছি থেকো
সমূহ বিপদ হবে এর বেশি নিকটে এসো না।

এইসব কবিতা পড়ে পড়ে হেলাল হাফিজ তখন জীবনানন্দের পরে আমার সবচেয়ে প্রিয় কবির জায়গা দখল করে নিয়েছে।

“তোমাকে শুধু তোমাকে চাই পাবো
পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাবো

কিংবা

“আয় না পাষাণী একবার পথ ভুলে
পরীক্ষা হোক কার কতো অনুরাগ।“

প্রতিটি কবিতা হৃদয় ছোঁয়া। হেলাল হাফিজ শুধু প্রেমের কবিই নয় তিনি দ্রোহেরও কবি। তাঁর কবিতায় নারী এসেছে ভিন্ন ভাবে। তিনি নারীকে কল্পনা করেন একজন প্রতিবাদী নারী হিসেবে। তাই শারিরীক কামনা ও চিরাচরিয়ত নারীকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে ছাপিয়ে তাঁর কবিতায় নারী স্থান পায় এক মহিয়সী নারী হিসেবে। তাই চাইলেই যে কোন বিপ্লবী ঘটনায় তাঁর কবিতা অনায়াসে চালিয়ে দেয়া যায়। ঘরোয়া রাজনীতি কবিতায় তিনি লেখেন,

ব্যর্থ হয়ে থাকে যদি প্রণয়ের এতো আয়োজন
আগামী মিছিলে এসো
স্লোগানে স্লোগানে হবে কথোপকথন।
আকালের এই কালে সাধ হলে পথে ভালবেসো
ধ্রুপদী পিপাসা নিয়ে আসো
যদি লাল শাড়িটা তোমার পরে এসো।

মূলত এরশাদ বিরোধি আন্দোলনের সময় কবিতাটি রচিত হলেও এর বোধ শ্বাশত,চির অমর। তাই শাহবাগ আন্দোলন থেকে শুরু করে যে কোন আন্দোলনে একজন প্রেমিক পুরুষ তাঁর প্রেমিকাকে এভাবে চাইতেই পারে। রাজনীতির আদলে এইসব প্রেমের কবিতা মানবিক প্রেমের রূপকে দেশের প্রতি ভালোবাসাও প্রকাশ করে। এছাড়াও তাঁর কবিতা কতোটা যুগের সাথে মানানসই তা অনুধাবন করতে পারি রাজাকার বিরোধী আন্দোলনে। দেশের সবর্ত্র উচ্চারিত হয় তাঁর ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি। প্রতিটি প্রজন্ম চত্বরের তরুণেরা বলে ওঠে,

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।

সভ্যতা,শ্রেণী সংগ্রাম,অভিমান কামনা সবকিছু নিয়েই ভাবেন তিনি। তাই তাঁর কবিতাতেই থুথুর মতো বিষয় উঠে আসে। তিনি বলেন,থুথুও পবিত্র হয় দুজনের ধ্রুপদী চুম্বনে। অথবা প্রেমিকার প্রতি অস্বাভাবিক শ্রদ্ধাবোধ থেকে তিনি বলেন, তোমার বুকের ওড়না আমার প্রেমের জায়নামাজ।
সভ্যতা নিয়েও হেলাল হাফিজের চিন্তা ছিল অন্যসব কবিদের চেয়ে আলাদা। নারীর কাছে তিনি আশ্রয় চেয়েছেন। “দুঃখের আরেক নাম” কবিতায় তিনি নিজেই কষ্টের সমার্থক শব্দ হিসেবে ভেবেছেন। “পাখিদের নীলাকাশ বিষাক্ত হয়ে গেছে সভ্যতার অশ্নীল বাতাসে” এই লাইনের মাধ্যমে তিনি জানান দেন বিষাক্ত প্রেমের কথা। পরিবর্তিত ভালোবাসার কথা। আর তাঁর কবিতা,

নিউট্রন বোমা বোঝ
মানুষ বোঝ না

এর মাধ্যমে তিনি সভ্যতার হিংস্রতা ও মানুষের প্রতি নিবিঢ় ভালোবাসার কথা জানান দেন। এভাবেই কবি পরিপুষ্ট প্রেমিক হয়ে ওঠেন। হয়ে ওঠেন যোগ্য কবিতা। যাকে পাঠকেরা খুঁজে বেড়ায়,তরুণীরা যাকে পেতে হাহাকার করে। প্রেমিক পুরুষেরা যার কবিতায় ফিরে পায় প্রেম।

তাঁর কবিতা পড়ে পড়ে যখন তাঁর প্রতি আরো আকৃষ্ট হচ্ছি এরমাঝে হুট করে একদিন ফেসবুকে কবিকে পেয়ে যাই। প্রথমে ভাবি হয়তো ফেক আইডি। অনেকক্ষণ ওয়াল ঘাঁটার পর বুঝতে পারি এটা কবির সত্যিকারের প্রোফাইল। এর মানে কবি জীবিত। তুমুল আনন্দ নিয়ে বন্ধু রিকোয়েস্ট পাঠাই। গ্রহন হয় না। তবুও নিয়মিত চোখ বোলাতে থাকি কবির ওয়ালে। একদিন কোন এক কমেন্ট বিনিময়ে কবি কাউকে তাঁর মুঠোফোন নম্বর দিচ্ছেন। সেখান থেকেই পেয়ে যাই কবির নম্বর। দূরতম নক্ষত্রের দ্বীপের মতো কবি আস্তে আস্তে নিকটে আসতে থাকে। আমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করি সে দ্বীপের কাছে পৌঁছানোর।

কবির বিগত জন্মদিন এ তোলা ছবিঅবশেষে গত বছর কবির ঠিক জন্মদিনের সন্ধ্যাবেলা কবিকে ফোন দেই। এর আগে যদিও একবার কবির সাথে কথা হয়েছিল তবুও নিজ মুখে কবিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে পারবো এ যেন আমার চরম সৌভাগ্য। আমার উচ্ছ্বাস মাখা কন্ঠ শুনে কবিকে আবেগে আপ্লুত হলেন। আমাকে বললেন তাঁর কাছে চলে যেতে। রাতে থাকতে হবে। সেই মুহুর্তে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মনে হলো। দশমিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে রওনা দিলাম কবির উদ্দেশ্যে। মনের মাঝে সীমাহীন আনন্দ। কবিকে যখন বলতাম,দাদা তোমার কবিতার বই আমার বালিশের নীচে থাকে। আমি সবসময় ওটা কাছে রাখি। কবি বলেছিলেন,এখন থেকে কবিই তোমার পাশে থাকবে। এতোটুকু প্রাপ্তি হয়তো একটু বেশেই ছিলো। প্রেস ক্লাসে পৌঁছালাম রাত নয়টার কিছু পরে। এদিকে আমি নিজেও হত বিহ্বল। কবির জন্যে কি নেয়া যায়। সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন একলা মানুষটা কিই বা ভালোবাসে আমি জানি না। তবুও কিছু ফল কিনলাম। ভীরু ভীরু পায়ে প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পর কবি এলেন। আমার স্বপ্নের দেবতা আমার কবি ঠিক আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। কবিকে সালাম করলাম। কবি আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো। যেন আমরা বহুদিনের চেনা পরিচিত। কিংবা সেই হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকা যাকে কবি বলেছিলেন,

“আমার কী এসে যাবে,
কিছু মৌল ব্যবধান
ভালোবেসে জীবন উড়ালে একা
প্রিয়তম দ্বীপের উদ্দেশে।
নষ্ট লগ্ন গেলে তুমিই তো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে
সুকঠিন কংক্রিটে জীবনের বাকি পথ হেঁটে যেতে যেতে
বারবার থেমে যাবে জানি আমি ভেবে একে তাকে দেখে।“

যেন আজ সেই রাত। ফিরে আসার রাত। কবির চোখ ভিজে উঠলো। চোখ ভিজলো আমারো। এতো ভালোবাসা কিভাবে একটা মানুষ জমিয়ে রাখতে পারে?ভেবে কুল পাই না। কবি আমাকে দেখে একটু রাগ করলেন। নিজে সেলুনে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ি গোফ কামিয়ে দিলেন।বুঝলাম ভালোবাসার কাঙাল মানুষটা নিজেও কত যত্নশীল। সেই রাত ছিল মুগ্ধতার রাত। সেই রাত শেষ হয়েছিল শুধুই গল্প করে। সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন কবি। তবে সরাসরি নয়। জিজ্ঞেস করি হিরণবালা কে। ক্যানো তিনি বলেছিলেন,

“যৌবনে এই তৃষ্ণা কাতর লকলকে জিভ
এক নিশীথে কুসুম গরম
তোমার মুখে কিছু সময় ছিলো বলেই সভ্য হলো
মোহান্ধ মন এবং জীবন মুক্তি পেলো।“

জানলাম হেলেন কে ছিল। কিংবা একজীবনের সব হাহাকার বুকে নিয়ে অভিশাপ দেয়া ব্রক্ষ্মপুত্রের মেয়েটিই বা কে। কার বিরহে ছাব্বিশ বছরের নির্বাসিত জীবন। ইকবাল হল(বর্তমান সার্জন্ট জহরুল হক হল) এ থাকা কালিন ছাত্র রাজনীতির কথা। জানালেন সমসাময়িক অনেক কবির কথা। শৈশবে মাকে হারানোর যন্ত্রণার কথা। এমনকি কয়েকবার জীবন থেকে চলে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টার কথাও। কবি নিজেই আবৃত্তি করে শোনান,

ইচ্ছে ছিলো রাজা হবো
তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো
আজ দেখি রাজ্য আছে রাজা আছে ইচ্ছে আছে
শুধু তুমি অন্য ঘরে।

১৯৭৩ সালের সাত ফেব্রুয়ারি ঠিক কাকে ভেবে এই কবিতা লিখেছিলেন তিনি বলেন না। শুধু বিষাদঘেরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। অন্যঘরে থাকা সেই মানুষটা এখন কোথায় আছে ক্যামোন আছে কবি হয়তো জানে না। জীবনের নিয়মে তবুও কেটে যায় চল্লিশটি বছর। তবুও কবিতা এখনো স্মৃতির নির্জন সাক্ষর। কবিকে কারা কষ্ট দিয়েছে কবি বলেও না। শুধু বলে সবাই ভালো থাক। এটাই দোয়া করি। আর তাই কবি বলেন,

হয়তো তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি
নয়তো গিয়েছি হেরে
থাকনা ধ্রুপদী অস্পষ্টতা
কে কাকে গেলাম ছেড়ে।

কিছুটা অস্পষ্টতা কবি রেখে দিতে চান। সব কথা বলেন না। তাই হয়তো তিনি কবি। তিনিই পেরেছেন ভালোবেসে এক মানবীকে ছাব্বিশ বছরের নির্বাসিত জীবন মেনে নিয়ে সংসারহীন এক বৈরাগ্য জীবন যাপন করতে। এরপর কবির সাথে আমার প্রায়ই দেখা হয়। কখনো খুব কষ্ট জমা হলে বুকে আরেক কষ্টের কবির কাছে গিয়ে মন হালকা করি। হয়তো আমাকেই প্রিয়তম ভেবে কবি অভিমানের কন্ঠে বলেন,তুই এতোদিন পরে এলি? দেখতে এসেছিস তোর কবি বেঁচে আছে না মরে গেছে। জীবনের সীমাহীন বাস্তবতা আর ব্যস্ততায় হয়তো কবির কাছে নিয়মিত আর যাওয়া হয় না তবুও তাঁর প্রতি ভালোবাসা আকাশ ছোঁয়া। প্রতিটি সকাল শুরু করে তাঁর কবিতা পড়ে ঘুমাতেও যাই তাঁর কবিতার এলবাম শুনে শুনে। অপ্রাপ্তির কোন খেদ তাঁর মনে নেই। আজন্ম প্রচার বিমুখ মানুষটাকে নিয়ে কিছু একটা করার সময় এখন এসেছে। যাঁরা ভালোবাসার মতো ভালোবাসেন প্রেমকে উপলব্ধি করেন তাঁরা অবশ্যই হেলাল হাফিজ পড়বেন। তুমুল কষ্টের মধ্যেও যেন বলা যায়,

“শুনেছি সুখেই বেশ আছো।
কিছু ভাঙচুর আর তোলপাড় নিয়ে আজ আমিও সচ্ছল,
টলমল অনেক কষ্টের দামে জীবন গিয়েছে জেনে
মূলতই ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়,
বিরহে উজ্জ্বল।“

(প্রতিমা)

অল্প কয়টি কবিতা লিখে এতো ভালোবাসা,এতো জনপ্রিয়তা পাওয়া মানুষটা বেঁচে থাক আরো কয়েক বছর। হেলাল হাফিজ ছড়িয়ে যাক সব প্রেমিক পুরুষদের হৃদয়ে। কবির জন্মদিনে এটাই চাওয়া। শুভ জন্মদিন কষ্টের কবি প্রিয় হেলাল হাফিজ।

(আমার এ লেখাটি প্রথমে অনলাইন নিউজ পোর্টাল নতুন বার্তাতে প্রকাশিত হয়েছে। সি সি বি এর সবার জন্যে আবার দিলাম)

৩,০৯৬ বার দেখা হয়েছে

২৩ টি মন্তব্য : “কবি হেলাল হাফিজ ও ব্যক্তিগত অনুভূতি”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ভাল লেখা।
    হেলাল হাফিযের লেখার সাথে এত পরে পরিচয় হল কেন ভাবছি!

    কলেজে তাইলে পোলাপান পড়ে কী!


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. সামিউল(২০০৪-১০)

    "যে জলে আগুন জ্বলে" বইটা পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলাম একবার।
    হেলাল হাফিজের সাথে আমারও পরিচয় ওটার মাধ্যমেই।
    আহা, বই একখান।


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    কবিতা নিয়া সবচেয়ে বড় ফাইজলামি যেটা করে ক্যাডেট কলেজ তা হলো ৬ জন প্রতিযোগিই একই কবিতা আবৃত্তি করে।
    ৬ জন ৬ টা কবিতা আবৃত্তি করলে বাঙলা ও ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি অনেক বেশি আনন্দের হতো বোধ হয়।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  4. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    এই লেখাটা আমার কি যে ভালো লেগেছে বলে বোঝাতে পারবোনা। হেলাল হাফিজ আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন কবি -- সেই কোন আমলে বিটিভিতে ওঁকে 'ফেরিওয়ালা' কবিতাটা পাঠ করতে দেখেছিলাম।

    প্রিয় কবির সান্নিধ্য পাবার জন্যে তোমার আকূলতা এবং একনিষ্ঠতা আমাকে নাড়া দিয়েছে। তুমি যে জাত-রোমান্টিক ও বোহেমিয়ান সেটা তোমার এই কাজকর্মে স্পষ্ট।

    আশা করি হেলাল হাফিজ সুস্থ আছেন; বেশ বয়স হয়েছে অনুমান করতে পারি। ইদানিং কি লিখছেন, কি ভাবছেন জানা নেই। এ নিয়ে একটি লেখা দিতে পারো? পারো তো একটা সাক্ষাতকার দাও, ভিডিও সহ -- ইতিহাস হয়ে যাবে সেটা।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাব্বী (২০০৫-২০১১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।