“এ আলোয় তোমায় দেখিনা”

1.
ঝুম বৃষ্টির মাঝে রিকশা পাওয়াটা কষ্টের। ঢাকা শহরের রিকশাওয়ালা গুলো এম্নিতেই জমিদার। তারপর বৃষ্টি এলে এদের ভাব আকাশ চুম্বী হয়ে যায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে ঠিকই কিন্তু কেউ বললে যাবেনা। বিরক্ত মুখে আসিফ একজনকে বলে ফেলল,মামা তাহলে জাহান্নামে যাবা? শাহবাগ থেকে কলাভবন যদি না যাও তাহলে কোথায় যাবা? আসিফের কথা রিকশাওয়ালা ভ্রুক্ষেপ করলোনা। বেচারা আগের মতই বলিউড টানতে শুরু করল। কিছুদূরে একটা ফাঁকা রিকশা দেখতেই আসিফ ডাক দিল, এই খালি….। একপ্রকার দৌড়ে রিক্সায় উঠতে যাবে এরমধ্যেই হূট করে একটি মেয়ে রিক্সায় উঠে পড়লো। আসিফ মোটামুটি হতভম্ব হয়ে গেল। রিক্সার কাছে এসে হতাশ গলায় বলল, এটা কী হল? আমিই এত কষ্টে রিক্সাটা ডাকলাম আর আপনি?
আসিফের কথা শুনে মেয়েটি নির্বিকার ভঙিতে উত্তর দিল, দেখুন রিক্সাটা আমার জন্যেই ভাড়া করা হয়েছে। একটু দূরেই আমার বান্ধবী আছে। আপনি একটু দাঁড়ান। ও আসলেই সমস্যার সমাধান হবে। আসিফ মেয়েটির দিকে তাকালো। শান্ত শিষ্ট ভদ্র চেহারার মেয়ে। চোখে কালো সানগ্লাস। ঝুম বৃষ্টির মাঝে সানগ্লাস পড়ার কোন অর্থ খুঁজে পেলনা। হতে পারে এটা বর্তমান মেয়েদের ফ্যাশন। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগ মেয়েদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। শুরুটা করেছিলেন বেগম রোকেয়া আর শেষটা কে করবে কে জানে। সাতপাঁচ ভাবতেই আর একটি মেয়ে রিক্সার কাছে এসে দাঁড়াল। সানগ্লাস পড়া মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কৌতুহলের স্বরে বলল, কি রে কোন ঝামেলা?
মেয়েটি বলল, দেখনা এই লোকটা বলছে তিনি রিক্সা আগে ঠিক করেছে। তুই ওনাকে একটু বুঝিয়ে বলতো।
আসিফ এতক্ষন সবকিছু দাঁড়িয়ে শুনছিল। নিজের কাছে নিজেকেই খুব অপমানিত মনে হল। আসিফ নির্ভেজাল ছেলে। ঝামেলা টামেলা পছন্দ হয়না। একপ্রকার অপরাধীর সুরেই বলল, আমার ভুল হয়েছে। আপনারা আসুন।
মেয়েটি স্মিত হেসে সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,দুঃখিত আপনার জন্যে কিছুই করতে পারছিনা, আমাদের অনেক জরুরী কাজ আছে। না হলে রিক্সাটা ছেড়ে দিতাম।
মেয়েটির কথা শুনে আসিফের গা জ্বলে উঠলো। বিপদে পড়লে সবাই করুনা দেখায়। মেয়েটার ভাব দেখেও আসিফ অবাক হলো। একবার আসিফের দিকে তাকালোও না। আসিফ দেখতে খারাপনা। অত্যন্ত একবার ও তাকানো যাবেনা এমন ছেলে নয়। আসিফ রাগ চেপে শীতল গলায় বলল,থাক। করুনা দেখাতে হবেনা। আপনারা আসতে পারেন। মেয়েটি কিছু একটা বলতে যাবে এর আগেই রিক্সা টান মেরে কিছুদূর এগিয়ে গেলো। আসিফ দাঁড়িয়ে রইল রাস্তার মাঝখানে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো পরীক্ষার বিশ মিনিট চলে গেছে। নিজের ওপর প্রচন্ড মেজাজ গরম হল ওর। সাতপাঁচ ভেবে সোজা টি এস সির দিকে চলে গেল। মাঝে মাঝে দু একটা পরীক্ষা না দিলে কিছু হয়না। আসিফ মনে মনে ভাবলো।

2.
টি এস সিতে অনেক প্রকার চা পাওয়া যায়। এদের নাম গুলোও অদ্ভুত। মালটোভা চা,হরলিকস চা, কমপ্লেন চা,কফি চা,খাঁটি দুধ চা,লেবু চা,আদা চা আরো ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব চায়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একসাথে দুটোর ফ্লেভার পাওয়া যায়। আশি শতাংশ চায়ের সাধ আর বাকী বিশ শতাংশ যা মেশানো হয় তার সাধ। আসিফের পছন্দ আদা চা। সাহাবুদ্দীন নামের চায়ের দোকানী আসিফদের খুব পরিচিত। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মঞ্জুর বলল, পরীক্ষাটা দিলেই পারতি। ম্যাডামকে বুঝিয়ে বললেই হত বৃষ্টির কারনে দেরী হয়েছে। আমার মনে হয় ম্যাডাম বুঝতো। আসিফ বলল, আর বলিস না। ইদানিং এত বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। সব ই তো শুনলি। চিন্তা কর মেয়েটা একবার তাকালোও না। মঞ্জুরের উত্তর দেয়ার আগেই টুপ করে একটা শব্দ হলো। আসিফ ছোট একটা ধাক্কা খেলো। কাপ থেকে চা পায়ের পাতার ওপর পড়তেই পেছন থেকে ছোট একটা কন্ঠস্বর বলল,এই সরি সরি। বিরক্ত মুখে আসিফ পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো সেই মেয়েটি। পাশে থাকা বান্ধবী মিটমিট করে হাসছে। আসিফ এবার রাগের স্বরেই বললো, আচ্ছা আপনার সমস্যাটা কোথায়? দেখে চলতে পারেন না? মেয়েটি চিকন সুরে বলল, আপনার চোখ সুন্দর। আপনিও তো দেখে চলতে পারেন, আর পুরো জায়গা জুড়ে না দাঁড়িয়ে একটু সাইড করে দাঁড়ান। পথচারীদের একটু যেতে তো দেবেন।
আসিফ বলল, আমার দিকে না তাকিয়েই বলে দিলেন আমার চোখ সুন্দর। আপনারা মেয়েরা পারেন ও । সকালে আপনার জন্যে পরীক্ষা দিতে পারিনি। এত কষ্টে একটা রিক্সা পেলাম তাও আপনি ভাগিয়ে নিলেন। এখন ধাক্কা মেরে উল্টো আমাকে কথা শোনাচ্ছেন। মেয়েরা আসলেই অদ্ভুত। আসিফ হর হর করে এক গাদা কথা বলে ফেলল। মেয়েটি এবার অপরাধীর সুরেই বলল, ও আচ্ছা আপনিই তাহলে সকালের ছেলেটি। স্যরি। আমার ভুল হয়ে গেছে মাফ করবেন। আসিফ ভারী কন্ঠে বলল, আপনার মেমরী কি গোল্ড ফিশের মত? নাকি না চিনে ভাব নিচ্ছেন?
মেয়েটি বলল, দেখুন চোখ মেলে তাকালেই সব কিছু দেখা যায়না। কিছু কিছু ব্যপার অনুভবের। আপনার চোখ সুন্দর অনুভব থেকে বলছি। হয়তো আপনিও দেখতে সুন্দর। আর চিনলামনা কই এই যে চিনলাম। ভালোথাকবেন। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আসিফ কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারলোনা। আসিফের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে মঞ্জুর বলল,দোস্ত মেয়েটা কিন্তু জটিল ছিল। আসিফ একপ্রকার অস্বস্তির স্বরে বলল, বাদ দেতো। মেজাজ গরম হচ্ছে।

3.

কিছু বৃষ্টি আছে মন খারাপ করিয়ে দেয়। পাতা ঝরার শব্দের মত টুপটাপ ঝরে পরে আর ঝুপঝাপ সুরে মনের ব্যথা গুলো জাগিয়ে দেয়। আজ সারাদিন বৃষ্টি একটুও অবসর নিলনা। কাকভেজা হয়ে আসিফ বাসায় ফিরল দুপুরের দিকে। বৃষ্টিময় একটি দিন যতটা ভালো হবে ভেবেছিল তার কিছুই হলনা। শরীর মুছে নিজের রুমে যেতেই মনমরা ভাবটা জেগে উঠলো। পরীক্ষাটা দেয়া যেত। সামান্য জেদটুকু না করলেও হত। পরীক্ষার কথা মনে হতেই আবার মেয়েটিকে মনে পড়লো। পৃথিবীটা অনেক বিচিত্র আরো বিচিত্র মেয়েদের মন। আকাশে এখনো এখনো টুকরো টুকরো মেঘ ভাসছে। মনে হচ্ছে সীমাহীন নীলের মাঝে বিচ্ছিন্ন কিছু সাদা নৌকা। এমন আবহাওয়া মানুষের কবি সত্তাকে জাগিয়ে দেয়। আসিফ কবি না। তারপরেও মাঝেমাঝে কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে। দুই লাইন লেখে আবার ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আসিফ খাতা বের করে মেয়েটিকে ভাবার চেষ্টা করলো। ওকে অবাক করে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে কয়েকটি লাইন মাথায় চলে আসল। আসিফ লিখল,

“তাঁর চুলের সাথে মেঘ করেছে আজন্ম এক সন্ধি
নিকষ আঁধার সেই চুলের ই শুধু প্রতিদ্বন্দী
তাঁর চোখের সাথে কাজ দিঘীর মিল হয়েছে তাই
রৌদ্রালোকে চেয়ে দেখি দিঘীর জল নাই।”

কবিতা জিনিসটাই মিথ্যায় ভরপুর। এক গাদা অসম্ভব কল্পনা। অনেকটাই তরল পদার্থের মত যা মেয়েদের মনকে পিচ্ছিল করে দেয়। কবিতাটির দিকে তাকিয়ে আসিফ কিছুক্ষন ভাবলো। চোখের ব্যাপারটা কবিতায় আনা ঠিক হয়নি। মেয়েটির চোখ সানগ্লাসে ঢাকা ছিল। আসিফের মন খারাপ হয়ে গেল। এত সুন্দর একটি মেয়ের চোখ দুটিও হয়তো সুন্দর। হয়তো কাজল দিঘীর স্বচ্ছ জলের মত কিংবা জীবনানন্দের কবিতার “বেতফলের মত চোখ” অজস্র মমতার গাঢ় আচ্ছাদন যেখানে ছলছল করে। কবি হলে আরো সুন্দর উপমা দেয়া যেত। সাহিত্যে “পাখির নীড়ের মত চোখ”,হরিনীর মত চোখ,আরো অজস্র চোখের বর্ননা দেয়া আছে। কাজল দিঘীর মত কোন চোখ কি আছে? আসিফ মনেমনে ভাবলো। মেয়েটাকে আবার পেলে হয়তো জিজ্ঞেস করা যেত। পৃথিবীটা চক্রাকার। কারো সাথে একবার দেখা হলে আবারো দেখা হওয়ার চান্স বেশি। সে হিসেবে তাঁর সাথে দুবার দেখা হয়েছে। হয়তো কাকতালীয় কিংবা কোকিলতালীয়। তারপরেও হয়েছে তো। আসিফ ছোট নিঃশ্বাস ফেলল। ঘুম ঘুম ভাব চলে এসেছে। ছোট্ট একটা ঘুম দিলে খারাপ হয়না।

বিছানায় কিছুক্ষন এপাশ ওপাশ করার পরেও আসিফের ঘুম এলোনা। ইদানিং অদ্ভুত এক রোগ হয়েছে। কোন চিন্তা মাথায় একবার ঢুকলে আর বের ই হতে চায়না। আসিফ কম্পিউটার অন করলো। কিছুক্ষন গান শুনলে খারাপ হয়না। রবীন্দ্রনাথের বর্ষা নিয়ে অনেক গুলো গান আছে। গান গুলো শুনতে শুনতে পুরনো হয়ে গেছে। বর্তমান যুগের মিউজিশিয়ানরা অনেক বেশি কর্মাশিয়াল। গানে কথার চেয়ে মিউজিক বেশি থাকে। আবার রবীন্দ্রনাথের পুর্নজন্ম হলে ভালো হতো। তা সম্ভব নয়। মিফতাহর গান শোনা যায়। ছেলেটা ভালো গায়। নিখাদ গলা। কন্ঠে অনেক মায়া। আসিফ গান ছাড়ল,

“এখানে অনেক আলো যদিও
এ আলোতে তোমায় দেখিনা
এক আকাশের অযুত তারা
সে আলো ও তোমায় টানেনা
আজ চোখের আলোয় যদি স্বপ্ন ছোঁয়া যেত
আমি দুহাত ভরে কুড়িয়ে নিতাম
মনের ই কষ্ট গুলো
যদি কখনো মেঘ হতো
বৃষ্টির মত ঝড়িয়ে দিতাম. . . . . . . .

গান শুনতে শুনতে আসিফ এক প্রকার ঘোরের মাঝে হারিয়ে গেল। গানের কথা গুলো অসম্ভব সুন্দর। আসলেই,মনের কষ্ট গুলো মেঘ হলে ভালোই হত। বৃষ্টির মত ঝড়িয়ে দেয়া যেত। পেছন থেকে দৃষ্টির ডাকে আসিফের ঘোর কাটলো। ভাইয়া,তোমাকে না কতবার বলেছি এই গানটি জোড়ে সাউন্ড দিয়ে শুনবেনা। আমার কষ্ট হয়। আসিফ থতমত খেয়ে গেল। দৃষ্টির দিকে তাকাতেই মন খারাপ হয়ে গেল। দৃষ্টি আসিফের ছোট বোন। জন্মান্ধ। মাঝেমাঝে দৃষ্টির জন্য আসিফের খুব খারাপ লাগে। বেচারী জানতেই পারলোনা পৃথিবীটা এত সুন্দর। জন্মের পর একবার চোখ মেলে তাকিয়েও দেখলো না ওর বাবা মাকে। অন্ধ মানুষদের পৃথিবীটা ক্যামন আসিফের জানতে ইচ্ছে হয়। পৃথিবীতে এত আলো অথচ সে আলো চোখের পাতা ভেদ করে আঁধার দূর করতে পারেনা। অনেকটাই এই গানটির মত। তাই দৃষ্টির গানটি অনেক অপছন্দের। এই গানটি শুনলেই দৃষ্টির কান্না চলে আসে। আসিফ শান্ত গলায় বলল, স্যরিরে। তুই এখানে? কিছু বলবি?
দৃষ্টি বলল, ভাইয়া আমার জন্যে যে আপু ঠিক করেছিলেনা। সে পড়াতে এসেছে। পড়ানোও শেষ। ড্রয়িং রুমে বসে আছে। ওকে একটু নিচে নামিয়ে দিয়ে আসো। আর শোন, তুমি আজই কম্পিউটার থেকে এ গান ডিলেট করে দেবে। তোমার এ গান শুনে আপুকেও কাঁদতে শুনলাম। আমিতো চোখে দেখিনা তবে ঘন ঘন শ্বাস পড়ার শব্দ শুনেই নিশ্চিত হলাম। আসিফ বললো, ঠিক আছে। তুই এখানেই থাক। আমি তোর আপুকে নিচে নামিয়ে দিয়ে আসছি।

4.
ড্রয়িং রুমে এসে আসিফ মোটামুটি একটা ধাক্কা খেল। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝামাঝি আসিফ কৌতুহল ভরে সোফায় বসা মেয়েটির দিকে তাকালো। দুপুরে যার সাথে শেষ দেখা হলো। কত কল্পনা,এক পলকেই হঠাত্‍ দেখে ভালো লাগা,কবিতা লেখা, তাকে আজ এই অবস্থায় আসিফ কিছুতেই মানতে পারলোনা। দৃষ্টিকে অন্ধদের বিশেষ শিক্ষা পদ্ধতি ব্রেইল শেখানোর জন্য অনেক আগে থেকেই গৃহশিক্ষক খোঁজা হচ্ছিল। আর এ জন্য RIHD ( rehabilition institute and hospital for the disabled) থেকে দৃষ্টিকে ব্রেইল শেখানোর জন্যে এই মেয়েকেই দেয়া হয়। আসিফ কিছুক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কথায় আছে কারো সাথে একবার দেখা হলে দ্বিতীয়বার তার সাথে দেখা হবেই। আর তৃতীয়বার দেখা হলে তার অবশ্যই কোন মানে আছে। এক মুহূর্তে আসিফের মনের অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলে গেল। ঝুম বৃষ্টির মাঝে সানগ্লাস পড়ে থাকা,আসিফের দিকে না তাকিয়েই নির্বিকার ভঙ্গিতে কথা বলা কিংবা ধাক্কা দিয়ে চা ফেলে দেয়ার কথা। সব কিছুই খুব দ্রুত চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তার মানে মেয়েটিও…আসিফ কিছুই ভাবতে পারলোনা। আসিফের উপস্থিতি টের পেয়ে মেয়েটি বলল,
স্যরি আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। আসলে আমার সাথে সবসময় আমার বান্ধবী থাকে।
আমাকে এখানে ওই নামিয়ে দিয়ে গেছে। একটু আগে ও ফোন দিয়েছিল। বলল, বৃষ্টিতে আটকা পড়েছে। আমাকে যেন একটা সি এন জি অথবা ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দেয়া হয়। আপনার শুধু এই কষ্ট টুকু করতে হবে। কি করবো বলুন, চোখে দেখতে পাইনা। তাই মানুষকে বিরক্ত করি।হয়তো আপনাকেও করছি। আপনি আমার হাতটা একটু ধরবেন প্লিজ. . . . .
পৃথিবীতে কিছু কিছু মুহূর্ত মানুষকে নির্বাক করে দেয়। আসিফ কিছুক্ষন ইতস্তত বোধ করলো। মেয়েটি তখনো হাত বাড়িয়ে আছে। আসিফের নীরবতা উপলব্ধি করে মেয়েটি বলল,কথা বলছেননা যে? ও আপনাকে তো বলাই হয়নি। আমার নাম আলো। কিছুক্ষন আগে একটা গান শুনছিলেন। দেখুননা গানের সাথে কি অদ্ভুত মিল। এখানে অনেক আলো তবুও আপনাকে দেখছিনা।আর একটা কথা। আমি আর দৃষ্টিকে পড়াতে আসবোনা। আসলে তখন এক প্রকার হুট করেই ওকে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই। আজ আমার আসার কথা। না আসলে খারাপ দেখায় তাই এসেছি। আর আমি আগামি সপ্তাহে কানাডা যাচ্ছি। চোখের চিকিত্‍সা করাতে। দোয়া করবেন। আপনি দোয়া করলে হয়তো আবার দৃষ্টি শক্তি ফিরে পেতে পারি। কি ব্যপার হাত ধরবেননা?”

এক সময় সব সংকোচ আর দ্বিধাকে কাটিয়ে আসিফ আলোর হাত ধরলো। বুকের ভেতর চিকন ব্যথা অনুভূত হল। আসিফ শান্ত গলায় বলল, চলুন। হঠাত্‍ আসিফের মনে হলো কিছু আলো আঁধার দূর করতে পারেনা। এদের বসবাস আঁধারের মাঝে। নিজেকে আঁধারে বিলিয়ে দেয়ার মাঝেই চরম সার্থকতা। আসিফের খুব কাঁদতে ইচ্ছে করলো। পৃথিবীটা এত অদ্ভুত ক্যানো? সিঁড়ি দিয়ে নামার কয়েক মুহূর্ত আসিফের মনে অজানা এক অনুভূতি তৈরি করলো। আর কিছুক্ষন পরে আলো চলে যাবে। হয়তো এটাই আলোর সাথে শেষ দেখা। প্রথম ও শেষ হাত ধরা।পৃথিবীতে এরা আসে বিজলির আলোর মত। এক পলকের জন্য আসে আর এরপর হৃদয়ে তুমুল মেঘের গর্জনের মত ব্যথা জেগে ওঠে। গেটের সামনে এসে আলো বললো, ধন্যবাদ এই কষ্ট টুকু করার জন্যে। আর শুনুন আপনাকে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। চোখে দেখিনা ঠিকই তবে অনুভব করতে পারি। মনে হয় এর আগে কোথাও আপনাকে দেখেছি। আচ্ছা আমি কি আপনাকে চিনি?
আসিফ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। কিছুক্ষন চুপ করে রইল। একসময় অস্পষ্ট একটা কন্ঠস্বর বলে উঠলো, না. . . . . . . . .
আসিফের মনের ভেতর জ্বলতে থাকা ভালোবাসার প্রদীপটা দপ করে নিভে গেল। আসিফের খুব ইচ্ছে হল আলোর চোখের দিকে তাকাতে। কাজল দিঘীর সাথে এ চোখের মিল আছে কিনা জানতে। আসিফ তাকালোনা। তাকালেই হয়তো মায়া বেড়ে যাবে। কিছু কিছু ইচ্ছে আছে অপূর্ন রেখে দিতে হয়। আলো শান্ত গলায় বলল, ভালো থাকবেন। আর কাছের মানুষ গুলোকে ভালো রাখবেন।

একটু পরেই বৃষ্টি নামলো। আলোকে বহন করা সি এন জিটা ধূসর বৃষ্টির মাঝে হারিয়ে গেল। আসিফ বৃষ্টির মাঝে একা হেঁটে চললো। আকাশ থেকে ঝরে পড়া ঘন শ্রাবনের অবাধ বর্ষনের সাথে কয়েক ফোঁটা লোনা জল মিশে গেল সহজ অভ্যাসে. . . . . .

১,৪৬৭ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : ““এ আলোয় তোমায় দেখিনা””

মওন্তব্য করুন : রাব্বী (২০০৫-২০১১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।