ইচ্ছের বর্ষায়

শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি নামল। ঝুম বৃষ্টি। করিডোরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ছোঁয়ার চেষ্টা করলাম। বৃষ্টির কয়েকটা ফোঁটা এসে মুখের ওপর পড়ল। একটু পরেই শুরু হল বাতাস। প্রকৃতির পাগলামি আজ একটু বেড়েছে। বৃষ্টি এলেই পুণ্যিকে খুব মনে পড়ে। মেয়েটা ভীষণ বৃষ্টি পাগল ছিল। ক্লাশ শেষে প্রায়ই টি.এস.সিতে আড্ডা দিতাম। পুণ্যি বলতো ” ইস যদি বৃষ্টি হত। কেন যে বছরের ছয়টি ঋতুই বর্ষা হলোনা। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজতাম। ” পুণ্যির কথা শুনে হাসতাম। বলতাম ” এক ঋতুর বর্ষাতেই ঢাকা শহরের রাস্তা ঘাটের যে অবস্থা হয়। আর ছয় ঋতু বর্ষা হলে তো ঢাকা শহরকে খুঁজে পাওয়া যেতোনা।” পুণ্যি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলতো ” অনেক রসকষ হীন মানুষ তুই। একটুও কি বদলাবি না? আচ্ছা তোর বউ যদি কখনো বলে ‘ দেখ,চাঁদটা কত সুন্দর’ তুই নিশ্চয় তখন বলবি চাঁদের নিজস্ব কোন আলো নেই।সবটাই সূর্য থেকে ধার করা। তুই আসলেই একটা আঁতেল। চোখের সামনে থেকে দূর হ।” আমি পুণ্যির দিকে তাকিয়ে দেখতাম ওর চোখ ছলছল করছে। মেয়েটা বড় বেশি অভিমানী। পুণ্যির সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে সেদিন খুব ইচ্ছে করছিল। প্রচণ্ড। কিন্তু সাধ্য ছিলনা।

পুণ্যি ছিল আমাদের ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে। দোহারা গড়ন। পাতলা শরীর। চোখে মুখে লাবণ্যতার কমতি ছিলনা। প্রতিদিন ছোট্ট একটা টিপ পড়তো। কপালের ঠিক মাঝখানে। মনে হতো প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে ছোট একটি দ্বীপ। ভালোবাসার অথৈ সমুদ্রে পড়া নাবিক যেখানে শেষ আশ্রয় নিতে পারে। পুণ্যি ছিল অনেক ফর্সা। সাধারণত অতি ফর্সা মেয়েদের দেখতে ধবল রোগীদের মত মনে হয়। পুণ্যি ছিল আলাদা। ওর চেহারাটা ছিল ব্যতিক্রম। কাঁচা হলুদের সাথে দুধ মেশালে যে বর্ণ পাওয়া যায় অনেকটা তেমন। শান্ত শিষ্ট লক্ষ্মী মেয়ে। কথা বলতো খুব গুছিয়ে। মনে হত প্রতিটি লাইন অত্যন্ত ভেবে চিন্তে বলছে। আমাদের ক্লাসের মাহফুজ ছিল ওর অন্ধ ভক্ত। পুণ্যিকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো। মাহফুজটা ছিল বেশ লাজুক প্রকৃতির। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারতোনা। আমাকে অনেক অনুরোধ করেছিল পুণ্যিকে মাহফুজের ব্যাপারটা খুলে বলতে। আমি ধমক দিয়ে বলেছিলাম ” এসব ব্যাপারে নিজেকেই আগাতে হয়। আমি পারি তোকে খুব সুন্দর একটা চিঠি লিখে দিতে। তুই পুণ্যির বইয়ের ভেতর রেখে দিবি।” মাহফুজ হাসলো। মলিন হাসি। বললো ” এই ফেসবুকের যুগে ওকে চিঠি দেব? কী বলিস তুই? আমি বলতাম ” চিঠি হচ্ছে নান্দনিক ভালোবাসার এক অনন্য স্মৃতিস্মারক। ধর আজ থেকে চল্লিশ বছর পরে ফেসবুক নাও থাকতে পারে। কিন্তু তোর চিঠিটা থাকবে। পুণ্যি তখন বুড়ী হয়ে যাবে। খুরখুরে বুড়ী। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে হয়তো তোর চিঠি পড়ে শোনাবে নাতী নাতনীদের। আর বলবে এটা আমার প্রথম প্রেমিকের চিঠি। ” মাহফুজ বললো ” তোর যুক্তি ঠিক আছে। একটা কাজ করবি? আমাকে একটা চিঠি লিখে দে। যা খেতে চাস খাওয়াবো।” আমি বললাম ” কিছু খাওয়াতে হবেনা। লিখে দেব।” পরদিন তিন লাইনের একটা চিঠি লিখে মাহফুজকে দিলাম।
“পুণ্যি,
জীবনের সকল স্বপ্নে তোমাকে চাই। জীবনের সকল ভালোবাসায় তোমাকে চাই। আজন্ম কাল আমি তোমাকে চাই।”

ইচ্ছে করেই মাহফুজের নাম লিখলাম না। যদিও ওর নিষেধ ছিল।

এটাকে চিঠি বললে ভুল হবে। চিরকুট। প্রথম বারের মত কারো প্রক্সি দেয়া। চিরকুটটা পুণ্যি পড়েছিল। এরপর আমার কাছে এসে বলল ” তুই আমার বইয়ের ভেতরে কিছু রেখেছিস?” আমি থতমত খেয়ে গেলাম। বললাম ” কই নাতো,কি?” পুণ্যি বলল ” আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল।” কিছু কিছু চোখ আছে পবিত্র। যার দিকে তাকিয়ে মিথ্যে বলা যায়না। আমি গড়গড় করে সব বলে দিলাম। মাহফুজের ব্যাপারটাও বুঝিয়ে বললাম। আমার কথা শুনে মনে হল পুণ্যি ভেতরে ভেতরে অনেক কষ্ট পেয়েছে। চাপা কণ্ঠে বললো ” অন্যের হয়ে চিঠি লিখতে তোর লজ্জা করেনা? কখনো তো আমাকে নিয়ে কিছু লিখিসনি। আর ফেসবুক খুললেই হোম পেজে তোর কবিতা ভর্তি। আমার জন্যে কিছু একটা লিখে দে। যেটা সম্পূর্ণ ই আমার।” পুণ্যির আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠ মনের অতল গহ্বরে ভালোবাসার দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হল। আমি বললাম ” শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবিতাটা আমি তোর জন্যে লিখবো” পুণ্যি হাসলো। কান্না চাপা হাসি।

কিছুদিন পর পুণ্যিকে একটা কবিতা লিখে দিলাম।

“আমার আকাশ ভরা মেঘ
তোর আঁচল ভরা নীল
আমার আবোল তাবোল কাব্যে
তুই অবাক অন্ত্যমিল।

আমার রাতের নীরবতা
তোর আলতো পায়ে আসা
আমি পাবোনা জেনেও
শুধু তোকে ভালোবাসা।

তুই মেঘের মাঝে লুকাস
তোর কান্না ভেজা চোখ
আমি চাইছি এবার তবে
ভালোবাসার বৃষ্টি হোক।

আমি ভিজবো তার ই ধারায়
যদি হাতে রাখিস হাত
তুই বর্ষা দেশের রাণী
আমার ভেজা শ্রাবণ রাত”

প্রথম চার লাইনে ভালোবাসার কথা লেখা ঠিক হয়নি। আসলে কবিতার অন্ত্যমিলের জন্যেই শব্দটা দেয়া। ‘আসা’ এর সাথে মিল রাখতে হলে ভালোবাসা শব্দটাই যথার্থ। এছাড়া যে শব্দ গুলো মাথায় আসে তা বেশ হাস্যকর। যেমন হাসা,চাষা। দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে পুণ্যিকে কবিতাটি দিলাম। বললাম “তোর জন্যে। কবিতাটি পড়ে পুণ্যি কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। জীবনের কিছু কিছু মুহূর্ত আছে যা মনে হয় অনাদি কাল চলতে থাকুক। এই সময়টুকু যেন হবার নয়। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি যখন একধারায় এসে মিলিত হয় তখন তৈরি হয় স্বপ্নময় এক বাস্তবতা। মনে হয় সমস্ত পৃথিবীটা শুধুই ভালোবাসাবাসির। আমি পুণ্যির চোখের সামনে হাত নাড়ালাম। ওর চোখের পলক পড়লো। সাথে এক ফোঁটা জল। চোখের পানি পড়ার কোন কারণ খুঁজে পেলাম না। এটা কি ভালোবাসার জল নাকি অনেকক্ষণ পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকার নিছক এক ফোঁটা তরল। বুঝলাম না। আমি বললাম ” কিরে কিছু বলবি? পুণ্যি বললো “মিথ্যে কথা কবিতায় লিখেছিস কেন? আমাকে তো তুই ভালোবাসিস না। তারপরেও কেন লিখলি?
আমি ওকে বললাম ” শোন কবিতার অন্ত্যমিল খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই কবিতার জন্যে মিল দিতে গিয়ে. . . .। আমার কথা শেষ হবার আগেই ও হনহন করে চলে গেল। আমি ওকে থামাতে গিয়েও থামালাম না। শুধু ভাবলাম মেয়েদের মন অনেক জটিল সমীকরণে গড়া একটি সরল অংক যার ফলাফল বের করা দুরূহ।

পরের বেশ কিছুদিন পুণ্যির কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখলাম। পুণ্যিকে টি.এস.সির আশে পাশে দেখলে আমি শহীদ মিনারের দিকে চলে যেতাম। ক্লাশেও ওর থেকে দূরে বসতাম। পুণ্যি বুঝতো। মাঝে মধ্যে আমার দিকে তাকাতো। আবার চোখ নামিয়ে ফেলতো। মানুষ হিসেবে আমি খুব জঘন্য প্রকৃতির। মানুষের ভালোবাসার মূল্য দেইনা। আবেগের মূল্য দেইনা। আমি বুঝতাম পুণ্যি আমার প্রেমে পড়েছে। এবং ভয়ংকর ভাবে। আমি যে পড়িনি তাও না। ভালোবাসা নামক অদৃশ্য এই বস্তুটা কারো মনে একবার জন্মালে তাকে আর থামিয়ে রাখা যায়না। আর যদি ভালোবাসার মানুষটা তা গভীর ভাবে অনুধাবন করতে পারে তাহলে তো কথাই নেই। নিউটনের গতিতত্ত্বের তৃতীয় সূত্রের মত তার হৃদয় থেকে ভালোবাসা ফেরত আসবে। অবশ্য অনেকের ব্যাপারেই এটা হয়না। ভালোবাসার মত ভালোবাসলে গভীর প্রেমের মহাস্রোত কখনোই এক দিকে ধাবিত হতে পারেনা। তবুও কখনো কখনো ভালোবাসাটা এক তরফা হয়ে যায়। ইচ্ছে থাকলেও উপায় থাকেনা। সামাজিক আর পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি দুটি মনকে আলাদা করে রাখে। আমিও পারিনি। আমাদের সমাজটা খুব অদ্ভুত। মানুষ যন্ত্র না তাই তাকে অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। সকল প্রকার কষ্টের মধ্যে তাই ভালোবাসার কষ্টটাই প্রখর। হৃদয়টাকে কার্বন মনো অক্সাইডের মত নীরবে শেষ করে দেয়। পুণ্যিকে ভালোবাসার ক্ষমতা থাকলেও তা প্রকাশ করার মত শক্তি আমার ছিলনা। পুণ্যি সৃষ্টিকর্তাকে ভগবান নামে ডাকে আর আমি আল্লাহ। নাম দুটির সত্তা একজন হলেও এরমাঝে ব্যবধান বিস্তর। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা আর গতানুগতিক জীবনের মাঝে এক অভেদ্য দেয়াল। যা ভেদ করা গুরুতর অপরাধ। তাই নিজ থেকেই ব্যবধান বাড়ালাম। পুণ্যি বুদ্ধিমতী মেয়ে। সহজেই ধরে ফেলল। ব্যবধান জিনিসটাই এমন। যদি তা একবার বেড়ে যায় তবে তা বাড়তেই থাকে। জীবনের সরল রেখার আবর্তিত পথে বৃত্তের মত করে ভালোবাসা ঘিরে থাকে। আর যখন হতাশা আসে ভাঙন আসে তখন বক্ররেখার মত জীবন এলোমেলো হয়ে যায়। এরই নাম জীবন। আমি বরাবর ই জীবনকে দর্শন দিয়ে বিবেচনা করি। তাই পুণ্যিকে জীবন বৃত্তে জড়ানোর সাহস আমার হয়নি। একদিন ক্লাশ শেষে পুণ্যি আমাকে বললো ” তোকে একটা কথা বলার ছিল। তোর কখন সময় হবে? আমি ইতস্তত বোধ করলাম। বললাম ‘কাল বিকেলে বলিস। শোন আমার জরুরী কাজ আছে। আসিরে।”

পুণ্যির কথা আমার শোনা হয়নি। বিকেলে মাহফুজের ফোন এল। কান্না ভেজা কণ্ঠ। ” দোস্ত, পুণ্যি ….ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়।” আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ও ফোন কেটে দিল। হাসপাতালে পৌঁছলাম বিকেল চারটায়। তার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে পুণ্যি ঘুমিয়েছে। অনেক ক্লান্তির ঘুম। ওর নিথর দেহটার চারপাশে কয়েকজন ক্লাসমেট। পুণ্যিটা একটু সময় ও দিলনা। ডাক্তার বললেন “লিউকেমিয়া,….অনেক দেরি হয়ে গেছে।” কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পুণ্যির কপালের টিপটা তখনো স্পষ্ট শোভা পাচ্ছিল। একটু বাঁকিয়ে গেছে। বরাবরের মত ওকে ছুঁতে গিয়ে হাত গুটিয়ে নিলাম। মনে হলো এক্ষুণি পুণ্যির ঘুম ভাঙবে। আমাদের দিকে তাকিয়ে শাসনের সুরে বলবে ” আর কতবার টিপ ঠিক করে দেয়ার অজুহাতে আমায় ছুঁবি? তুই আসলেই একটা ভীতুর ডিম”…

মেঘ চিড়ে বৃষ্টি নামলো। ঘন শ্রাবণের অবাধ বর্ষণ। জীবনে প্রথম বারের মত খুব বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করলো। পুণ্যির হাত ধরে। মনে পড়লো পুণ্যি কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। পুণ্যির শান্ত মুখটির দিকে শেষবারের মত তাকালাম। কিছু একটা বলতে চাওয়ার প্রবল আকুতি। মনে হলে হয়তো ও বলবে ওর প্রিয় মিফতাহ এর সেই গানটি
“জীবনের সে হিসেবে যদি
মিলে যায় সময়
তোমায় যাবো নিয়ে
ভিজতে ইচ্ছের বর্ষায়. . . . . .

১,৭২৪ বার দেখা হয়েছে

১৭ টি মন্তব্য : “ইচ্ছের বর্ষায়”

মওন্তব্য করুন : রাব্বী (২০০৫-২০১১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।