মন খারাপের মেয়ে

মন ভালো করা আর যুদ্ধ জয় করা সমান। মোটামুটি একটা যুদ্ধ জয়ের প্রস্তুতি নিলাম। তানির মন খারাপ। শুধু খারাপ না অনেক খারাপ। কিছু কিছু মেয়ে আছে যারা সহজে মন খারাপ করেনা। কিন্তু একবার মন খারাপ করলে মন সহজে ভালো করতে চায়না। তানি অনেকটা এরকম মেয়ে। চুপচাপ স্বভাবের। কখনো বলবেনা মন খারাপ। কিন্তু আমি বুঝতে পারি। ভালোবাসা নামক যে অদৃশ্য বস্তু প্রকৃতি আমাদের দান করেছে তার মাধ্যমে দুটি বিচ্ছিন্ন মনের অবিচ্ছিন্ন আবেগ খুব সহজেই আমরা বুঝতে পারি। আর তাই হয়তো ভালোবাসাবাসিটা সত্যিই অদ্ভুত।

অন্য সব মেয়েদের চেয়ে তানি একটু আলাদা। অল্পতেই খুশী। অন্যসব মেয়েদের ক্ষেত্রে সপ্তাহে তিন চারবার দেখা করাটা বাধ্যতা মুলক। তানির ব্যাপারটা ভিন্ন। আমাদের দেখা হয় খুব অল্প। ব্যস্তার ভীড়ে যদিও ওকে আমি খুব একটা সময় দিতে পারিনা। তারপরেও ওর কোন আক্ষেপ নেই। গত বিজয় দিবসের কথা। আগে থেকেই প্লান করা সারাদিন আমরা ঘুরবো। তানি আমার জন্যে খুব সুন্দর একটা পাঞ্জাবী কিনল। আমি ওকে একটা লাল সবুজ রঙের শাড়ী উপহার দিলাম। দুজনেই মহান দেশ প্রেমিক। হঠাত্‍ করে পনের তারিখ রাতে ফোন এল আম্মা অসুস্থ। আমি উদভ্রান্তের মত বাড়ি ছুটে গেলাম। তানিকে একটা ফোন পর্যন্ত দেয়ার সুযোগ পেলাম না। ষোল তারিখ সকালে তানির ফোন এল। আমি অনেকটা লজ্জিত ভাবে ওকে সব বুঝিয়ে বললাম। আমার কথা শুনে তানি বলল ‘আচ্ছা আমি কি অন্য সব মেয়েদের মত? আমাকে এত কৈফিয়ত দিতে হবেনা। তোমার মা অসুস্থ। পৃথীবিতে এর চেয়ে জরুরী কাজ আর কিচ্ছু নেই। শোন, তুমি সাবধানে এসো। আমি রাগ করিনি। তানির কথা শুনে মুগ্ধ হলাম। একটা মেয়ে এত ভালো কেন? চারিদিকে ভালোবাসাবাসির এত দুরবস্থা। অথচ এই মেয়েটি কি অদ্ভুত মায়ায় আমাকে বেঁধে রেখেছে। আমি শুধু তানিকে বললাম ‘পৃথীবির সব ভালোবাসা আমাদের দুজনের মনে. . .ওপাশ থেকে তানি বলল ‘পাগল একটা,এত দিনে জানলে. . . . .

তানির পুরো নাম তানিশা। তবে আমি ওকে সংক্ষেপে তানি ডাকি। মাঝেমাঝে ওকে হেলেন ও ডাকতাম। তবে তানির এতে বেশ অভিযোগ। ও বলত ‘দেখ,আমার বাবা মা আমার সুন্দর একটা নাম রেখেছে। তুমি আমাকে ধার করা নামে ডাকবেনা। পারলে এই নামে ডেকো। দেখতাম তানির কন্ঠে অভিমানের টোন। মনে হচ্ছে একটু বাতাস লাগলেই চোখে সিডর বয়ে যাবে। আমি ওকে বললাম ‘আচ্ছা ম্যাডাম আপনাকে তানি নামেই ডাকবো। ভুল হবেনা। তানি হাসত। আনন্দ আর বেদনা মিশ্রিত হাসি। আমি অবাক হয়ে ওকে দেখতাম আর ভাবতাম আমি আসলেই অনেক ভাগ্যবান। তানিকে কারনে অকারনে আমি অনেক কষ্ট দেই। তবে ওর রাগ অভিমানে পৌঁছানোর আগেই তা ভেঙে ফেলি। আমি চাইনা তানির চোখ থেকে অভিমানের একটিও অশ্রুবিন্দু ঝড়ে পরুক। আমার পৃথিবীটা তাহলে সত্যিই এলোমেলো হয়ে যাবে।

মেয়েদের ভালোবাসা আর মেয়েদের অভিমান এর মধ্যে কোনটা প্রবল তা বলা মুশকিল। আমার প্রতি তানির অভিমান কখনো পাহাড় সমান। কখনো সাহারার মত বিস্মৃত। আর ভালোবাসাও ঠিক যেন প্রশান্ত। তানির অজস্র ভালোবাসার তীব্র স্রোতে সত্যিই আমার কষ্ট গুলো ভেসে যায়। মাঝেমাঝে ভাবি জীবনটা এত মায়াময় শুধু এজন্য যে এর অনেকটাই প্রিয় মানুষের কল্পনায় গড়া। ব্যস্ততার জন্যে তানিকে সময় দেয়া হয়না। মেয়েটার এতে কোন আক্ষেপ ও নেই। আক্ষেপ থাকলেও মনের মাঝে চাপা রাখে। কখনোই বলবেনা। একবার তানির জন্মদিনে আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি। অফিসের একটা কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। পরে জেনেছিলাম সেই জন্মদিনে তানি অভিমানে কেক পর্যন্ত কাটেনি। অথচ আমি ফোন করতেই ও বলল ‘মন খারাপ করবেনা। আমি জানি তুমি ইচ্ছে করে এমন করনি। ভালোভাবে ফিরে এস,এক সাথে দুজন কেক কাটবো। তানির কথা শুনে ইচ্ছে করছিল পৃথীবিটাকে চিত্‍কার করে বলি ‘পৃথীবি,তোমার কাছে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। এমন একটি মেয়ে উপহার দেয়ার জন্যে। আসলে বিশেষ কোন দিন এলেই অফিসের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। এবারো তাই। তানির অনেক আগে থেকেই প্লান করা নববর্ষে আমরা সারাদিন ঘুরবো। আমিও মোটামুটি সব কাছ আগে থেকেই গুছিয়ে রেখেছি। কিন্তু হঠাত্‍ করেই বসের ফোন এল। অফিসের কাজে বরিশাল যেতে হবে। কর্পোরেট লাইনে চাকরীর এই এক বড় অসুবিধা। মোটা অংকের পারিশ্রমিক দিলেও গাধার মত খাঁটাবে।আমি বসকে অনেক অনুরোধ করলাম। কিন্তু কোন ভাবেই তাকে রাজী করাতে পারলাম না। ভয়ে ভয়ে তানিকে ফোন দিলাম। ওকে সব কিছু বলার পর ও কোন উত্তর না দিয়েই ফোন কেটে দিল। এমন কখনো হয়নি। এর আগেও ও অনেকবার অভিমান করেছে। মন ভালো করতে দু একটা কবিতাও পাঠাতাম। শেষ পর্যন্ত ও আমাকে ফোন দিত। আমিও ওর জন্যে মোবাইলের ওয়েলকাম টিউন দিয়েছি ‘আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে. . .গানটি।আমার সাথে কথা বলার আগেই যেন ওর মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু এই প্রথম ওর ফোন এলনা। আমি ভড়কে গেলাম। আসলেই ভাগ্যটা অনেক খারাপ। মন ভালো করার অনেক পদ্ধতি ই আমার জানা। তবে এবার সব পদ্ধতিই অকেজো হয়ে যাবে ওর কাছে। হঠাত্‍ মনে হল ‘গভীর ভালোবাসার অভ্যন্তর থেকে যে বোধের সৃষ্টি হয় তার নাম ই কি প্রেম? যার জন্যে পৃথীবিতে এত আয়োজন। এত অশ্রু জল। এত রাত জাগা। অনেক কিছু ভেবে চোখের পাতা ঝাপসা হয়ে এল।
..

বাসায় ফেরার পথে তানির জন্যে একটা পুতুল কিনলাম। পুতুল তানির খুব পছন্দ। অনেক খোঁজাখুঁজি করে একজোড়া নুপুর ও কিনলাম। আর তানির পছন্দের কয়েকটা কবিতার সিডি। তানি আবৃত্তি শুনতে খুব ভালোবাসে। কাল বছরের প্রথম দিন। অথচ আমি ওর পাশে থাকবোনা। আমি চাই কোনভাবেই যেন ও আমার শুন্যতা বুঝতে না পারে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটা মেয়ে বেলি ফুলের মালা বিক্রি করছিল। সেখান থেকে তিনটা মালা কিনলাম। বেলী ফুল আমার খুব পছন্দের। একধরনের স্নিগ্ধতা বয়ে বেড়ায়। এক গাদা জিনিস নিয়ে বাসায় এলাম। বেলী ফুলের মালা গুলো পানিতে ভিজিয়ে রাখলাম। সমস্ত রুম অদ্ভুত মিস্টি গন্ধে ভরে উঠল। হঠাত্‍ করে মনে হল ‘রুমের কোথাও তানি লুকিয়ে আছে। আমার পাগলামী দেখে হাসছে। ভালোবাসা মানে আসলেই পাগলামি। সারাদিন উদ্ভট চিন্তা। রঙ বাহারী কল্পনা। আরো কত কি। ঠিক করলাম বরিশাল যাওয়ার পথে শর্মির কাছে জিনিস গুলো দিয়ে যাবো। শর্মি তানির রুমমেট। খুব ই ভালো বন্ধু ওরা। কিছুক্ষন পর শর্মিকে ফোন দিলাম। এর রিং হতেই শর্মা ফোন রিসিভ করলো। বলল ‘ভাইয়া আপনি? এত রাতে? আমি বললাম ‘ম্যাডাম কি করছেন? শর্মি বলল ‘ও তানি ঘুমিয়ে পড়েছে। একটু আগে। এতক্ষন গান শুনেছিল। কোন কারনে মনে হয় মন খুব খারাপ। আমি বললাম ‘শোন,কাল তানির সাথে ঘোরার কথা ছিল। কিন্তু অফিসের কাজে বরিশাল যেতে হচ্ছে। তানির জন্যে কিছু জিনিস কিনেছি। তুমি সকালে একটু নিয়ে যেয়ো। শর্মী বলল “আচ্ছা ভাইয়া . . .ফোনটা রাখার পর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। তানি কে সত্যিই সময় দিতে পারিনা। নতুন একটা বছরের শুরু এমন হবে কল্পনাও করিনি।

সকালে ঘুম ভাঙল বসের ফোন পেয়ে। সবকিছু শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। বরিশাল যেতে হবেনা। হঠাত্‍ করেই মনে হল শতাব্দীর সবচেয়ে সুন্দর সূর্যটা আজ উঠেছে। শর্মিকে ফোন দিয়ে বললাম ‘তোমার বান্ধবীকে নিয়ে ঠিক দশটার সময়ে জয়নুল আর্ট গ্যালারীর সামনে আসবে। আর শোন বরিশাল যাচ্ছিনা। তোমার বান্ধবীকে একথা বলবেনা। ও বলল আচ্ছা ভাইয়া।
ঘড়ির দিকে তাকালাম। আটটা বাজে। তড়িঘড়ি করে গোসল করলাম। ফ্রেশ হয়ে তানির দেয়া নীল পাঞ্জাবীটা পড়লাম। বের হতে হতে পৌনে দশটা বাজল। আড়াল থেকে দেখলাম তানি দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওর মোবাইলে কল দিলাম। ভেবেছিলাম ও ফোন রিসিভ করবেনা। কিন্তু কিছুক্ষন পর ফোন রিসিভ করল। আমি বলল ‘গুড মর্নিং,হ্যাপি নিউ ইয়ার ক্যামন আছো? তানি বলল ‘ভালো আছি। তুমি ঠিক ভাবে রওনা দিয়েছো?
–এইতো কিছু আগে। তোমার মন ভালো হয়েছে?

–না. . . . .

–আচ্ছা তুমি কি খুব রাগ করেছো?

–না. . . . . .

–আমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে?

–হ্যাঁ

–কতটুকু?

–অনেক. . . . . .

–আচ্ছা আমি যদি এখন তোমার কাছে থাকতাম তবে তুমি কি করতে?

তানি বলল ‘দেখ এম্নিতেই মন ভালো নেই। তারপর অসম্ভব কথা বলবেনা। মন আরো খারাপ হয়ে যাবে।
আমি বললাম ‘ঠিক পেছনে তাকাও. . . . .

তানি পেছনে তাকালো। আমাকে দেখে চমকে উঠল। হঠাত্‍ করে খেয়াল করলাম ‘তানির চোখ থেকে টপাটপ পান ঝড়ছে। কিছু কিছু আবেগ আছে যা ঝড়িয়ে দিতে হয়। এ কান্না আনন্দের। হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা অজস্র আবেগের বহিঃপ্রকাশ। আমি ওকে থামালাম না। কোন ভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে ও বলল ‘তুমিহ?. . .
আমি বললাম ‘হ্যাঁ আমি, কেন বিশ্বাস হচ্ছেনা? ছুঁয়ে দেখতে পারো। আমি তানির দিকে আমার হাত বাড়িয়ে দিলাম। পরম নির্ভরতায় তানি আমার হাতে হাত রাখল। যেন আমিই ওর শেষ আশ্রয়। আমি বললাম ‘মন ভালো হয়েছে?
ও মুচকি হেসে বলল ‘হ্যাঁ. . . .
আমি বললাম “যাক যুদ্ধে তাহলে জয়লাভ করলাম।
তানি কিছু না বুঝেই জিজ্ঞেস করলো ‘মানে?????. . . . . . .

১,৫৪৯ বার দেখা হয়েছে

১৫ টি মন্তব্য : “মন খারাপের মেয়ে”

মওন্তব্য করুন : রাব্বী (২০০৫-২০১১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।