বেঁচে থাকার গল্প

ময়নার মা,ও ময়নার মা।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে মন্তাজ মিয়ার ডাক।রাত প্রায় দুইটা।ঢাকা শহরের নাগরিক কোলাহল একটু আগে থেমে গিয়েছে।রাস্তার দু পাশে সোডিয়ামের বাতি গুলো ঝাপসা।সেখান থেকে যতটুকু আলো আসে তাও কুয়াশার সাথে মিশে অস্বচ্ছ এক আবহ তৈরি করেছে।পলিথিনের তৈরি অস্থায়ী ঘরের ফাঁক দিয়ে তার কিছুটা আলো ময়নার মার মুখে পরেছে।ষাটোর্ধ মন্তাজ মিয়া কাছে মনে অস্বচ্ছ এই আলোয় ময়নার মাকে আরো মায়াবী লাগছে।কল্পনায় চল্লিশ বছর আগে চলে যায় সে।ঢাকা শহরে নতুন এসেছে ।থাকার জায়গা নেই।একদিন কমলাপুর রেলস্টেশন অন্য দিন গাবতলী যাত্রী ছাউনি।মাঝেমাঝে দোতলা লন্চের ছাঁদে চড়ে সুদূর বরিশাল যাতায়াত করা হত।একসময় বুড়িগঙ্গার গন্ধযুক্ত পানিকে খুব বেশি আপন মনে হত।সবেমাত্র মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে।দেশের অবস্থা বেগতিক।একবেলা খাবার আশায় তাই শহরে পাড়ি জমানো।গ্রামে মন্তাজ মিয়াদের গেরস্থলি ছিল।গোয়ালে তিন চারটা গরু।পুকুরে মাছ।ক্ষেতে সবজি।সবমিলিয়ে একটা সাজানো সংসার।দিনকাল ভালোই কাটছিল।এর মাঝে হঠাত শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।ফরমান আলীর কমান্ডো বাহিনীতে যোগ দেয় মন্তাজ মিয়া।সুঠাম দেহ আর লম্বা চওড়া শরীর থাকায় প্রায় সব অপারেশনেই মন্তাজ মিয়া নেতৃত্ব দিত।এভাবেই কেঁটে গেল অনেক দিন।একসময় যুদ্ধ শেষ হল।গ্রামে ফিরে নিজের ঘর বাড়ি খুঁজে পেলনা।পাকিস্তানী হানাদাররা লন্ডভন্ড করে দিয়েছে সব।বাড়ির সামনে কয়েকটা নতুন কবর দেখে বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল।সেদিন ই শহরে পাড়ি জমাল মন্তাজ মিয়া।একরাশ বুক ভরা অভিমান নিয়ে।

যাযাবর জীবনের মাঝে একদিন হঠাত্‍ করে পরিচয় হয় পরিবানুর সাথে।মন্তাজ মিয়ার মনে পরে টানা তিন না খাওয়া।এরমধ্যে কারা যেন খিচুড়ি দিচ্ছে।মন্তাজ মিয়া লাইনে গিয়া দাঁড়াল।এরমধ্যে কেউ একজন এসে মন্তাজ মিয়ার কাছে টিকেট দেখতে চাইল।মন্তাজ মিয়া কিছুই বোঝার আগে লাইন থেকে বের করে দেয়া হল।অনেক ক্ষন ধরেই পরীবানু ব্যাপারটা খেয়াল করছিল।অসহায় মন্তাজ মিয়ার কাছে এসে বলল মিয়া ভাই,স্বাধীন দ্যাশে কোন কিছুই স্বাধীন ভাবে করতে পারিনা।এম্মে আয়েন,ভাগাভাগি কইরা খাই।মুখডা এমন শুকনা লাগতাছে ক্যান?মেলা দিন না খাউন্যা বুজি?

সেদিন থেকে আছ চল্লিশ বছর হলো ওরা একসাথে আছে।পরীবানু গার্মেন্টস এ চাকরী করত।মন্তাজ মিয়ার কাছে যুদ্ধের কাহিনী শুনে পরীবানু তার প্রেমে পড়ে।মাঝেমাঝে মন্তাজ মিয়া গল্প শোনাত।বুজলা পরী গ্রামে আমাকো বিশাল একডা পুকুর আছিল।বিকেল ব্যালা করতাম কি বড়শি দিয়া মাছ ধরতাম.. ইয়া বড় বড় মাছ।বড়শির ছিপ মাছের টাইন্যা লইয়া যাইত।একবার একটা বোয়াল মাছ ধরছিলাম ছয়ফুট লম্বা।পরীবানু লাফ দিয়ে উঠত।ছয়ফুট লম্বা?কি কইতাছেন আমনে?আমারে পাগল পাইছেন?হোনেন মেয়া মুই কিন্তু শিক্ষিত মাইয়া।ছয়ফুডের হিসাব কিন্তু মুই জানি।মন্তাজ মিয়া একটু লজ্জা পেত।আসলে ছোট বেলা থেকে একটু বাড়িয়ে বলার অভ্যাস তার।মাঝেমাঝে পরীবানুর সাথে অনেক আজগুবি গল্প করত।পরীবানু এর অনেকটাই বুজতে পারতো।শুধু স্বামীর খুশীর জন্যে বলত ‘আপনি তো ম্যালা সাহসী,এক্কারে সুপুরুষ’

অনেক রাতে পরীবানু ঘুমিয়ে পড়ত।মন্তাজ মিয়া গল্প বলে যেতে থাকতো।টের পেতনা।গল্প শেষ করে যখন সে বলত ‘বুজলা পরী,তারপর সেই জমিদার সাব আমারে গোল্ড মেডেল দিল।তার পালোয়ান বেচারার মুখ দিয়া তখনো রক্ত পরতাছে’ স্ত্রীর কাছ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে মন্তাজ মিয়া বুঝতো পরী ঘুমিয়ে পড়েছে।এ ঘটনা প্রায়ই ঘটত।তাই বরাবরের মতই মন্তাজ মিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলত ‘তুমি আসলে বড় খাটখোট্টা টাইপ মাইয়া।রসকস নাই।
সে বুঝতো সারাদিন পরীবানু অনেক খাটনি করে।গার্মেন্টস এর কাজ।এরপর দুই বাসায় রান্নাবান্নার কাজ করে সন্ধ্যার পর বাসায় ফেরে।এসে মন্তাজ মিয়ার জন্য রান্না করে।এরপর যখন ঘুমাতে যায় তখনি প্যানপ্যানানি শুরু করে।স্বামীর মন রক্ষায় অনেক ক্ষন হুঁ হাঁ করলেও একসময় দু চোখ বেয়ে নামে ক্লান্তির ঘুম।মন্তাজ মিয়ার গল্প তখন হয়তো ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে মাত্র আসল কাহিনীতে এসে মিলিত হয়েছে।

এভাবেই কেটে যায় অনেকটা সময়।অনেকটা পথ।শুরুতে মন্তাজ মিয়া পরীবানুকে পরী নামে ডাকতো।একটা সময় তাদের ঘর আলো করে আসে ময়না।সেদিন থেকেই পরীবানু হয়ে যায় ময়নার মা।তখন ওরা কমলাপুরের একটা বস্তিতে থাকতো।চারবছর বয়সের কালে ময়না একবার সবার খেতে খেলতে যায়।আর ফিরে আসেনি।অনেক খোঁজাখুজি করেছিল ওরা।কিন্তু কোন হদিস পাওয়া যায়না।ময়না চলে গেলেও ময়নার মা উপাধিটা এখনো বয়ে বেড়ায় পরীবানু।মাঝেমাঝে বুকের ভেতর শীতল স্রোত বয়ে যায়।বুকটা কেঁদে ওঠে।

ময়না হারিয়ে যাওয়ার পর এক এক করে ওদের ঘরে জন্য নেয় মফিজ,আবুল আর হোসেন।পাঁচ জনের সংসার চালাতে মন্তাজ মিয়া বেছে নেয় কামলা গিরি।মাঝে মাঝে সদরঘাটে গিয়ে কুলির কাজ করতো।দু জনের উপার্জনে দিন কাল ভালোই চলত।গরীবের সাধ,আকাঙ্ক্ষা খুব অল্প।তাই প্রতিদিন দু বেলা খেতে পারলেই ওরা বেশ খুশী থাকতো।একপর্যায়ে মন্তাজ মিয়া শুনতে পায় সরকার মুক্তিযোদ্ধাতের ভাতা দিচ্ছা।নিভে যাওয়া স্বপ্নের প্রদীপটা আবার যেন জ্বলে উঠতে শুরু করে।গ্রামে ফিরে চেয়ারম্যান সাব রে সব গুছিয়ে বলে।চেয়ারম্যান বলে ‘ধুর মিয়া,তুমি মুক্তিযোদ্ধা আছিলা নাকি?কোথা দিয়া উইরা আইসা জুইরা বইছ।দলের মানুষ গুলারে এহনো সার্টিফিকেট দিতে পারি নাই।আর তুমি মিয়া আইছ সার্টিফিকেট নিতে।এক কাম করো।দলে যোগ দাও।দেহি কিছু করতে পারি কিনা।মন্তাজ মিয়ার স্বপ্নের প্রদীপটা দপ করে নিভে যায়।চোখের পাতা ভিজে যায়।যুদ্ধের স্মৃতি মনে করে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।এই মকবুল চেয়ারম্যান ই শান্তি কমিটির প্রধান ছিল।মনেপরে ফরমান কমান্ডার রে নিজ হাতে জবাই দিয়া মুন্ডুটা নিয়া আনন্দ উত্‍সব করছিল।আজ সেই গ্রাম শাষন করছে।অসহায় মন্তাজ মিয়া আবার শহরে ফিরে আসে স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা নিয়ে।

আস্ত আস্তে আবুল মফিজেরা বড় হয়।ওদের ও থাকার জায়গার পরিবর্তন হয়।কখনো এ স্টেশন কখনো ও স্টেশন।জীবন নামের রেলগাড়ীর সত্যিই স্টেশন খুঁজে পায়না।তবুও জীবনকে বয়ে বেড়ানোর কত আয়োজন এই পৃথীবিতে।বেঁচে থাকার নেশায় ভালোথাকার আশায় জীবন কেটে যায় আপন নিয়মে।ছেলেদের এক এক করে বিয়ে দেয় মন্তাজ মিয়া।পড়ালেখা কেউ ই করতে পারেনি।তাই কেউ রিকশা চালায়।কেউ কুলি গিরি করে।সবার ই অভাবের সংসার।এরমধ্যে কেউই গিয়ে থাকতে পারেনা।

গরীব হলেও পরীবানু আর মন্তাজ মিয়া বিবেকবান।প্রথম দু জন আলাদা থাকতো।পরীবানু একছেলের সাথে।আর মন্তাজ মিয়া অন্য যে কোন ছেলের সাথে।কিন্তু মন্তাজ মিয়া সুখ পেতনা।ময়নার মার কাজ করার ক্ষমতা নাই।তবে মন্তাজ মিয়ার এখনো শক্তি আছে।আর তাই জীবনের শেষ সময়ে একসাথে থাকার জন্যে ওরা ছেলেদের বাসা থেকে বের হয়ে এসেছে।দুজন মিলে পলিথিনের একটা ঘড় করেছে সোহরাওয়্যার্দী উদ্যানের একটু দূরে।ময়নার মা কাজে যেতে পারেনা।মন্তাজ মিয়া রিকসা চালিয়ে যা আয় করে তাতে কোন মতে চলে যায়।ষাটোর্ধ মানুষের রিকসায় কেউ চলতেও চায়না।মন্তাজ মিয়ার মনে পরে ময়নার মা একসময় কত কষ্ট করত।চোখের পাতা ঝাপসা হয়ে আসে।তবুও ময়নার মা কে স্বপ্ন দেখায় ‘বুজলা পরী,একদিন তোমারে নিয়া হিন্দী সিনেমা দেখতে যামু।আমাগো একখান ঘর হইবো।তোমারে বিলাতী জ্যাকেট কিন্না দিমু।গতকাইল কি হইছে জানো?আমার রিকসায় একজন সুন্দরী আফা উঠছে।দেখতে এক্কারে পরীর লাহান।কি সুন্দার।গাঁয়ে ঝিকমিক ঝিকমিক কোর্তা।আমি কইলাম আফা এইডা কি?কইল জ্যাকেট।বিদ্যাশী।আমি তোমারে একটা কিন্না দিমু পরী।তুমি শীতে আর কাঁপবানা।মন্তাজ মিয়া নিজের চাঁদরটাও পরীর গায়ে দিয়ে দেয়।নিজে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে।মন্তাজ মিয়ার গল্প এগিয়ে চলে।স্বপ্ন দেখার গল্প।ভালোবাসার গল্প।রাজার কুমার পঙ্খীরাজের গল্প।মন্তাজ মিয়ার সাহসীকতার গল্প।কিছুটা মিথ্যে কিছুটা কল্পনায় গড়া।সবই স্ত্রীকে মুগ্ধকরার জন্যে।একসময় পরী ঘুমিয়ে পরে।মন্তাজ মিয়া বুঝতে পারে।তবুও গল্প চালিয়ে যায়।

পরীর চোখে অনেক ক্লান্তির ঘুম।ভোর চারটা।ঢাকা শহর এখনো ঘুম থেকে জাগেনি।মন্তাজ মিয়া হয়তো এখনো বুজতে পারেনি তার পরীর ঘুম আর ভাঙবেনা।শীতের সাথে যুদ্ধে অনেক আগেই পরাজিত সে।সকালে ঘুম থেকে উঠে বলবেনা ‘দাঁড়ান,আপনার তামুকডা সাজাইয়া দেই।শোনেন তাড়াতাড়ি বাড়িত ফিরা আইসেন।আইজকা আপনার জন্যে কই মাছের ঝোল রানমু. . . . . . . . .

৭৩৮ বার দেখা হয়েছে

১টি মন্তব্য “বেঁচে থাকার গল্প”

মওন্তব্য করুন : রেজওয়ান (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।