ত্রিশ কোটি হাত বনাম ক্যান্সার

কিরে ব্যাটা মন খারাপ?ধুর বোকা ক্লাস সেভেনে একটু আধটু এরকম হয়।এজন্যে মন খারাপ করতে হয়না।পেছন তাকিয়ে দেখি হোসেন ভাই।
তার সেই চির চেনা হাতটা মাথার ওপর।আমি আরো জোড়ে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললাম।একটু আগেই রুম লীডারের রুমে ছিলাম।টানা দশমিনিট জানালার গ্রিলের সাথে পা ঝুলিয়ে।ক্যাডেট কলেজের ভাষায় যার নাম লং আপ।হোসেন ভাই তখন রুমে ছিলেন।আমার অবস্থা দেখে ভেতরে ভেতরে হয়তো একটু আধটু কষ্টও পেয়েছিলেন।কিন্তু ক্লাসমেট এর মুখের ওপর কথা বলা নিয়মে নেই।তাই তিনি এখানে নির্বাক দর্শক।
২০০৫ সালের কোন এক রাতের ঘটনা এটি।বাবা মা কে রেখে এক আদর্শ জীবন গড়ার তাগিদে ক্যাডেট কলেজে এসেছি।ক্যাডেট কলেজের অনেক নিয়ম কানুন।সিনিয়রের চোখের দিকে তাকানো যাবেনা।কথা বলার সময় রোবটের মত হাত পা টানটান করে রাখতে হবে।সিনিয়রের গায়ে টাচ লাগলে জোড়ে সরি বলতে হবে।সিনিয়র পাশ দিয়ে গেলে জোড়ে জোড়ে সালাম দিতে হবে।আরো কত কি।বারো বছরের পিচ্চি একটা ছেলের মাথায় এতকিছু ধরে না।তাই মাঝে মাঝে নিয়ম ভঙ্গের কারনে পানিশমেন্ট খেতে হয়।এর কোন টা হাসির কোন টা ভয়ংকর।

সিনিয়রের গায়ে টাচ লাগলে সরি বলাটা ক্যাডেট কলেজের একটা নিয়ম।যদি কোন ভাবে টাচ লাগে তা হলে সাবধান হয়ে সরি ভাইয়া বলতে হবে।একদিন টি ব্রেকের কথা।ডায়নিং হলে আমাদের সিনিয়র জুনিয়র পাশাপাশি বসতে হয়।হঠাত্‍ করেই আমার পাশে বসা জুনিয়র বললো ‘সরি ভাইয়া. . .
আমি একটু অবাক হলাম।কারন ওর গায়ে টাচ লাগেনি।আমি বললাম ‘অই সরি বলছো ক্যান? জুনিয়র বললো,ভাইয়া জগ সরাইতে গিয়ে আপনার কলায় টাচ লাগছে।. . . .(!!!) ডায়নিং হলে টি ব্রেক টাইমে আমাদের কলা খেতে দিত।সমস্ত টেবিল সহ সেদিন হাসতে হাসতে মারা যাচ্ছিল।
আমার টেবিল লীডার ছিলেন মহামান্য কলেজের মাসল ম্যান(?) খ্যাত মুস্তাকীম ভাই।সত্যি কথা বলতে আমি আমার একজীবনে এত ভালো টেবিল লীডার পাইনি।তার টেবিলে থাকা কালীন একবার হাত দিয়ে পরোটা খেতে গিয়ে ধরা খেয়েছি।ব্যাপারটা একটু গুছিয়ে বলি।তখন আমাদের ডায়নিং হলের দায়িত্বে ইতিহাসের হেদায়েতুননবী স্যার।
বিখ্যাত কার্টুনিস্ট রফিকুননবীর ছোট ভাই।ভীষন পার্ট নিয়ে চলাফেরা করেন।একদিন ব্রেকফাস্টের পর তিনি আমাকে ডাকলেন।কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম।আমাকে সাদা একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন ‘আজ যা করেছো তা সুন্দর করে গুছিয়ে ল্যাখো।বরাবর প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে।আমি আরো ভয় পেলাম।বললাম স্যার আর হবেনা।তিনি আমাকে ধমক দিলেন।ক্লাসে গিয়ে একটা দরখাস্ত লিখলাম।হাত দিয়ে পরোটা খাবার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে প্রিন্সিপাল বরাবর।লান্চ টাইমে তিনি আমার দরখাস্ত নিলেন।দেখে বললেন ‘তুমি আজ হাত দিয়ে পরোটা খেয়েছো?কই দেখিনিতো।আমি তো বললাম তুমি আজ মুজা পরো নাই।তাই লিখতে।’
ক্লাস নাইনে বসে হাত দিয়ে পরোটা খাওয়া কিংবা মোজা না পরা দুটোই বিশাল অপরাধ।স্যার আমাকে পরদিন দেখা করতে বললেন।এবং আমার হাউস লীডারকে বিষয়টা জানালেন।আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলাম।অবশেষে মুস্তাকীম ভাইয়ের আশ্রয় নিলাম।তিনি আমাকে বললেন ‘চিন্তা কইরোনা মিয়া।যাও একটা গল্পের বই নিয়া আসো।তাইলে মাফ পাইবা……
আমি কয়েকটা গল্পের জোগাড় করে ভাইকে দিলাম।আশ্চর্য জনক ভাবে স্যার কিংবা হাউসলীডার কারো কাছে ই পানিশমেন্ট খেতে হয়নি।

আবার সেভেনে ফিরে যাই।আমার রুমমেট এহসানের মন খারাপ।মন খারাপের চেয়েও বেশি ভয়।পরদিন প্রিন্সিপাল প্যারেড।ভালো জুতো পালিশ করতে পারার সুবাদে বেচারার কাছে সব ভাইয়েরা জুতো দিয়ে যায়।দশ থেকে বারো জোড়া জুতো পালিশ করতে গিয়ে বেচারার অবস্থা অনেক
খাপরা।এর মাঝে কখন যে টি ব্রেকের বাঁশি দিয়েছে ও টের পায়নি।টি ব্রেকে নামতে গিয়ে খেয়াল করল ওর চুল কাটানো হয়নি।কলেজের নিয়ম অনুযায়ী প্রতি প্রিন্সিপাল প্যারেডের আগে চুল কাটাতে হয়।আর চুল না কাটানোর শাস্তি কল্পনাতীত।কলেজের অ্যডজুটেন্ট এর দায়িত্বে তখন মেজর নুরুল আলম স্যার।কলেজের ঘাস পর্যন্ত তাকে ভয় পায়।আমরা এহসান কে বললাম টি ব্রেকের পর চুল কাটাতে যেতে।সেদিন ছিল শুক্রবার।টি ব্রেক শেষ করে ও নাপিতের কাছে গেল।কিন্তু ভাগ্য খারাপ থাকলে যা হয়।বার্বার ততক্ষনে চলে গেছে।বেচারার অসহায় ভাবে ঘোরাঘুরি চোখে পড়ল তেইশ তম ব্যাচের মাকজুম ভাই এর।এরপর তিনি যা করলেন তা ক্যাডেট কলেজের ইতিহাসে কেউ কোনদিন করেছে বলে মনে হয়না।তিনি নিজে এহসানের চুল কেটে দিলেন।রুমে এসে এহসান শুধু বলেছিল ‘দোস্ত,ক্যাডেট কলেজের ভাইয়েরা এত ভালো কেন???

কয়েক বছর পরের কথা।আমাদের অলটারনেট ব্যাচ থেকে এরই মধ্যে জুনিয়র প্রিফেক্টশিপ দিয়ে দিয়েছে।জনৈক জুনিয়র প্রিফেক্ট একবার আমাদের পানিশমেন্ট দিচ্ছেন।স্বভাবতই আমরা একটু ঘাড় ত্যারামো শুরু করছি।এখানে বলা বাহুল্য ভাইয়া নিজেকে খুব খাইস্টা দাবি করতেন।কমান্ডের এক পর্যায়ে তিনি বললেন ‘ক্লাস টেন Don’t limit the cross. . . . .:-D
এখানে একটি কথা উল্লেখ করতে হয়।এই কাহিনীর পর তিনি বেশ কয়েক দিন গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন।এই ভাইয়ের ই আরেকটা ঘটনা।প্রিন্সিপাল ইনসপেকশন শুরু হতে কিছুক্ষন বাকি।তিনি তড়িঘড়ি করে ছুটলেন জুনিয়র করিডোরে।উদ্দেশ্য ফল্ট ধরবেন।একরুমে ঢুকে শিকার পেয়েও গেলেন।রুমের দেয়ালে মাকড়সার জাল ঝুলছে।বেচারা নিজেকে সংবরন করতে না পেরে কমান্ড দিলেন ‘room leader,come here. . . .still there is mosquito net on the wall. . . . .:-D
ক্যাডেট কলেজের জীবনে ভাইয়াদের সাথে এমন কত কাহিনী যে জড়িয়ে আছে তা লিখলে কখনো শেষ হবেনা।মনে পড়ে সপ্তম শ্রেনীর কথা।কলেজের এইসব ভাইয়েরাই শিখিয়েছিল কিভাবে চামচ দিয়ে খেতে হয়।কিভাবে টাই পরতে হয়।মনে পরে প্রতিটি হাউস কম্পিটিশনের আগে এদের অদম্য মনোবল কিভাবে আমাদের সামনে যেতে সাহায্য করে।মনে পরে প্যারেন্টস ডের পর বেড কভার মুরি দিয়ে কান্নার কথা।তখন এই রুম লীডারের দু একটা স্বান্তনার কথাই হয়তো বাকী দিন গুলো কলেজে থাকার অনুপ্রেরনা যুগিয়েছে।আর তাই হয়তো আজ আমরা সফল এক্সক্যাডেট।

কলেজের প্রতিটি ব্যাচ বিদায়ের সময় অনেক কাঁদতাম।বুঝতাম না এত কিসের মায়া।তারপরেও জড়িয়ে ধরে পাগলের মত চিত্‍কার করতাম।সমস্ত আকাশ বাতাস কাঁপানো শব্দে বিধাতার আরশ কেঁপে যেত।হয়তো সপ্তম আসমানে থাকা সৃষ্টি কর্তা আমাদের দেখে হাসতেন।বলতেন ‘ক্যাডেট হয়েছো বলেই তোমাদের এত মায়া’ আল্লাহ কে আরো একবার ধন্যবাদ।এখনো কলেজের কোন ক্যাডেট দেখলে আনন্দে লাফ দিয়ে উঠি।মনে হয় ভালোবাসা আর বেদনার সমস্ত মায়ায় জড়ানো এসব ভাইয়েরা এক অভিন্ন সত্তা।অবিছিন্ন আবেগ।

বেশ কয়েক দিন আগে ক্যাডেট কলেজ ব্লগে দেখলাম আমাদের কলেজের তের তম ব্যাচের ক্যাডেট সাজ্জাদ ভাই কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত।দেখেই মনটা খারাপ হয়ে গেল।বুয়েটে পড়া এই অদম্য মেধাবী ভাইয়ের চিকিত্‍সার জন্যে অনেক টাকা প্রয়োজন।হঠাত্‍ করেই অনুভব করলাম চোখের পাতা ভিজে যাচ্ছে।কিছুদিন আগে হারালাম ক্যাডেট কলেজ পরিবারের একজন মা কে।রকিমুন্নেছা ম্যাডাম কে আমরা বাঁচাতে পারিনি।তবে চেষ্টা করেছি সাধ্য মত।জীবনের শেষ লগ্নে তিনি যে অপরিসীম ভালোবাসা পেয়েছেন আমার মনে হয় তার মানব জন্ম সার্থক।কলেজে থাকতে হারিয়েছিলাম ওয়াহেদ কে।কিছু ই করার ছিলনা।ওকে বাঁচাতে না পারলেও ওর শেষ কৃত্যের পুরোটাই করেছিলাম আমরা।গোসল করানো থেকে শুরু করে কফিনে বরফ দেয়া,গাড়িতে লাশ তুলে দেয়া।সব ই করেছিলাম।ভ্রাতৃত্বের টানে।কারন আমরা ক্যাডেট।এখানে আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়।
আজ আরো একবার সময় এসেছে আমাদের হাতে হাত রাখার।শুধু ক্যাডেট নয় আমরা একজন ভাইকে বাঁচাতে চাই।সাজ্জাদ ভাইয়ের চিকিত্‍সার জন্যে প্রয়োজন প্রায় আশি লক্ষ টাকা।পনের কোটি মানুষের ত্রিশ কোটি হাত কি পারেনা সাজ্জাদ ভাইকে ক্যান্সারের কারাগার থেকে ছিনিয়ে আনতে?

আমরা আমাদের ভালোবাসা দিয়ে ক্যান্সারকে এর আগে অনেক বার প্রতিহত করেছি।আমরা সাবিনা ইয়াসমিন কে ফিরিয়ে এনেছিলাম ক্যান্সারের দুয়ার থেকে।আমরা হূমায়ুন আহমেদকে বাঁচানোর জন্যে আজ দৃঢ় প্রচেষ্ট।ভালোবাসার অনন্ত গভীর মায়া দিয়ে আজ আরো একটি প্রান বাঁচাতে চাই আমরা।ত্রিশ লক্ষ ভাই হারিয়েছি স্বাধীনতা যুদ্ধে।আর কোন ভাই আমাদের চোখের সামনে দিয়ে চলে যাবে আমরা তা মেনে নেব না।কিছুতেই না।সাজ্জাদ ভাই,আমরা আপনাকে ক্যান্সারের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনবোই।বিস্তারিত নিচের লিংক এ পাবেন
সাজ্জাদ ভাইকে সাহায্য করার ঠিকানা।

http://www.ankur-international.sazzad_mostofaorg/_94_cncr.htm

Monirul (Murad) – 01711505253
Masum – 01729292925

Sydney, Australia –
Razu – (02) 8814 8801 Mob: 0414901137
Fazle Rabbi – 02-87 899 317 Mobile: 0430-120-357

North America –
Mahbub – (651) 845-4062
Sayeem – (408) 480-6760

লেখাটি শেয়ার করার জন্যে অনুরোধ করছি. . . .

২,০৭২ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “ত্রিশ কোটি হাত বনাম ক্যান্সার”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    শেয়ার করলাম।
    সবার সহযোগিতায় ভালো হয়ে যান সাজ্জাদ ভাই এই কামনা রইলো।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)
    আমার টেবিল লীডার ছিলেন মহামান্য কলেজের মাসল ম্যান(?) খ্যাত মুস্তাকীম ভাই।

    x-( x-( x-( x-(

    সত্যি কথা বলতে আমি আমার একজীবনে এত ভালো টেবিল লীডার পাইনি।

    :shy: :shy: :shy:

    দোয়া করি আল্লাহ ভাইয়াকে তারাতারি সুস্থ্য করে তুলুন...


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।