দেখে এলাম ভারতবর্ষঃ পর্ব ৩

আমাদের ট্রেনের নাম কালকা মেইল,স্লিপার ক্লাস।সিট অনেকটা আমাদের দেশের শোভন শ্রেণীর মত,তবে সাইজে অনেক বড় এবং পুরোটাই একজনের জন্য।আছে ফোন চার্জ দেওয়ার সুব্যবস্থা।সেইটা দেখে প্রেমিককুলের মুখের হাসি ছিলো দেখার মত।

ট্রেনে উঠে দেখি আমাদের উপরের বাংকে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন দুই ভদ্রলোক।আমাদের সীট বলতেই বললেন,ঘুমানোর সময় বললেই নেমে যাবেন।উনারা যাবেন আসানসোল কিংবা বর্ধমান পর্যন্ত।

জানা ছিলো,এই ট্রেন দিল্লীতে যেতে কমপক্ষে ২৪ঘণ্টা সময় নেবে।আমি আগেই সবাইকে বলেছিলাম,যে চাইলে এই ট্রেনে আমরা কালকা পর্যন্ত যেয়ে সেখান থেকে ২ঘণ্টায় সিমলা পৌছাতে পারি।কিন্তু আমার ব্লগ পড়া জ্ঞানে ওদের ভরসা ছিলনা।অথচ ট্রেনে উঠেই পাশের সীটের এলাহাবাদগামী দাদা যখন একই কথা বললেন,তখন সবাই রাজি হয়ে গেল।আর আমরা রেডি হলাম,লাইফের দীর্ঘতম ট্রেন জার্নি করতে।সবাই ফুলানো যায় এমন বালিশ,কম্বল নিয়ে উঠেছিলাম।একটু পরেই ট্রেনের লোক ডিনার করবো কিনা জানতে আসলো।দুই ধরণের খাবার,ভেজ-ননভেজ।হালাল-হারাম বিবেচনায় ভেজ নিলাম সবাই।

বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।মাঝে মাঝে চলে আসে ছোট-বড় স্টেশান।মেইল ট্রেন বিধায় শুধু বড় স্টেশানে থামে এইটা।তাও কম না,টোটাল ৩০টা স্টেশানে দাঁড়ায় কালকা মেইল।সামনের সীটে ছিলো ধানবাদগামী এক ছাত্র।মাইনিং এর উপর পড়াশুনা করছে কলকাতায়।হিন্দী ঝালিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে তাকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দীতে জিজ্ঞেস করলাম,ধানবাদ দেখতে গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর মুভির ধানবাদের মত কিনা?হেঁসে দিয়ে বললো,”নেহি ভাইয়া,বহত বাড়িয়া সিটি হ্যায় হামারি ধানবাদ”

একটু পরেই ডিনার চলে আসলো।সবার হাস্যজ্জল মুখ কালো হয়ে গেল।কালিজিরা দেওয়া সরু এবং লম্বা চালের ভাত,২টা পরোটা,পনির-মাশরুম-মটরশুটি দেওয়া ২রকম কারি,একটা ডাল,দই আর চাটনী।ডাল বাদে কোনটার স্বাদই তেমন ভালো না,চাটনীটা তো পুরাই জঘন্য।প্রচন্ড খিদে থাকায় কোনরকমে পেটে চালান করে দিলাম।পুরো ট্যুরে এই খাবারের কষ্ট অনেক ভুগিয়েছে।

বাইরে কিছুই দেখা যায়না।ঘুটঘুটে অন্ধকার।ট্রেন নতুন প্রদেশে ঢুকলেই ফোনে টেক্সট চলে আসছে।টেক্সট দেখে বুঝে নিচ্ছি,এখন আমরা বিহার,কিংবা ঝাড়খান্ড……বাতি নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে শুয়ে ফোনে মুভি দেখলাম কিছুক্ষন।এরপর ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে উঠে বাথরুমে যেয়ে দেখি পানি প্রায় শেষের দিকে,অল্প অল্প করে পড়ছে।আগে ভাগেই সব কাজ সেরে নিয়ে বাকিদেরও তুলে দিলাম।এবার আর খাবার নিলাম না ট্রেনের,নিজেদের কেনা কেক-বিস্কুট খেয়ে ব্রেকফাস্ট করলাম।ট্রেনে বার বার চা নিচ্ছিলো শরীফ,আমিও নিলাম।জঘন্য স্বাদ,দামও ভয়াবহ,১০রুপি!!!

এই ট্রেনের অবস্থা বাংলাদেশি ট্রেনের মতই,মাঝে মাঝেই খুব আস্তে চলে,কখনো কখনো তো একদমই দাঁড়িয়ে পড়ে।দিনের বেলা ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে রোদ পোহাতে গিয়ে দেখলাম,ট্রেনটা আক্ষরিক অর্থেই বিশাল।আর বাইরের চিত্র বাংলাদেশের মতই।ধু-ধু মাঠ,কিংবা ক্ষেত,খোলা প্রান্তরে হুট-হাট চোখে পড়ে ছোট্ট একটা মন্দির।সামনের সীটে বসে থাকা দেহাতি বাহেনজি আর তাঁর কিউট দুই পিচ্চির সাথে খুনসুটি করতে করতেই টের পেলাম,পেটে ছুঁচো বুকডন দিচ্ছে।কিন্তু এবার আর কেউ ট্রেনের ওই অখাদ্য খেতে রাজি না।আলীগড় স্টেশানে নেমে প্যাটিস আর ২টা রাইস প্ল্যাটার কিনে আনলাম।খেয়ে দেখি একই কন্ডিশান,উল্টা খরচ আরো বেশি।ঠিক করলাম,রাতে আর হালাল-হারাম মানবো না,ননভেজ খাবো!অর্ডার দেওয়ার সময় শুনলাম ডিম আছে,ডিমই নিলাম।খাওয়ার সময় দেখি দুইটা করে ডিম বরাদ্দ একেকজনের জন্য।পেট পুরে খেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।দিল্লী স্টেশানে আসার পর আমাদের তুলে দিলো একটা পাঞ্জাবি পরিবার।আমাদের টিকেট দিল্লী পর্যন্ত,বাকিটুকুর জন্য এই সীট তাদের।দৌড়ে নেমে কালকার টিকিট কাটলাম,যদিও সেইটা জেনারেল ক্লাসের।টিটিকে জরিমানা+ঘুষ দিয়ে সীট ম্যানেজ করে আবার ঘুম।

কনকনে শীত আর ফোনের টেক্সট জানিয়ে দিল,আমরা এখন হিমাচল প্রদেশে।কালকা স্টেশান সী-লেভেল থেকে আড়াই হাজার মিটার উঁচুতে,সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে সেইটা সবাইকে জানানো হয়েছে স্টেশানে।শীতে কাঁপতে কাঁপতে গেলাম কালকা স্টেশানের কাউন্টারে।এখান থেকে রোজ সিমলার উদ্দেশ্যে টয় ট্রেন ছাড়ে।কিন্তু গিয়ে দেখি কোন সীট এভেইলেবল নেই,জেনারেল ক্লাসে দাঁড়িয়ে যেতে হবে।৩৬ঘন্টা ট্রেনে থেকে কাহিল সবাই।বাসের খোঁজে নেমে পড়লাম।

স্টেশানের বাইরেই ট্যাক্সি স্ট্যান্ড।অনেক দরদাম করে একটা ট্যাক্সি ঠিক করলাম,১৩০০ রুপিতে।কিছুদূর যেয়েই বেয়াদব ড্রাইভার নামিয়ে দিলো আমাদের,ওদের এসোসিয়েশানের জীপে উঠিয়ে দিবে,ট্যাক্সিতে যেতে হলে নাকি আরো ২০০রুপি দিতে হবে!!!

একে তো হিন্দী বলতে পারিনা ঠিকমত,ওদের কি বলবো মনে মনে সাজানোর আগেই আমাদের ব্যাগ সেই গাড়িতে তুলে ফেলেছে ওরা,তার উপর টায়ার্ড সবাই,২০০রুপি বেশি দিতে রাজি হলাম।বাংলায় অশ্রাব্য কিছু গালাগাল দিলাম ড্রাইভারকে।চুপ করে হজম করলো সে।আর বেশি কিছু বললাম না,কারণ,পাহাড়ি রাস্তায় ড্রাইভারকে না খেপানোই ভালো।

কালকা থেকে সিমলার রাস্তা ভয়ংকর সুন্দর।চারপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়,একটু পরপরই বিশাল সব বাঁক।ড্রাইভার দক্ষ হাতে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।ঘণ্টাখানেক পর ড্রাইভার একটা হোটেলের সামনে থামলো।দাম দেখে চুপসে যেয়ে চা নিলাম শুধু সবাই।সাথে আগের দিনের কেনা কেক-বিস্কুট।এত উঁচুতে ওঠায় কানের উপর কেমন একটা চাপ ফীল করছিলাম।শরীফ কাহিল হয়ে পড়েছিলো,বমিও করলো।৩ঘন্টা পর পৌঁছুলাম স্বপ্নের শহর সিমলায়।সুন্দরী মহিলা ট্রাফিকের স্বাগতম জানিয়ে কিছুক্ষন দাঁড় করিয়ে রাখলেন সিগন্যালে।আমরাও চাঙ্গা হয়ে গেলাম!!!

যাই হোক,একবারে অনেক লিখে ফেলেছি।আসল ট্যুরের শুরু এখান থেকেই।সেইটা পরের পর্বের জন্য তোলা থাকুক।সাথে কিছু জ্ঞান দিয়ে দেই-

১.ট্রেনে অবশ্যই খাবার নিয়ে উঠুন,হোক শুকনো কিংবা রান্না করা,ট্রেনের খাবার বেশ খরচসাপেক্ষ এবং ফালতু।আর ফেরিওয়ালারা অনেক বেশি দাম হাঁকে।

২.এসি ক্লাসে ভ্রমণ না করলে অবশ্যই বালিশ-চাদর/কম্বল সাথে রাখবেন।

৩.লাগেজ সীটের সাথে তালা মেরে রাখুন,নতুবা গায়েব হতে পারে।

৪.স্টেশানে প্রচুর বানর/হনুমান দেখতে পাবেন,অবাক হবেন না,বিরক্তও করবেন না।ইন্ডিয়াতে সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বানর আছে।কেউ কিচ্ছু বলেনা।আমাদের দেশে থাকলে বেকার সমস্যা অনেক কমে যেত,সবগুলাকে দিয়ে নাচানো হত শিওর 😛

৫.বাথরুমের জন্য আলাদা করে একটি বোতল রাখুন।ইন্ডিয়াতে বদনা বলে কিছু নেই।

৬.ট্রেন জার্নি খুবই লেংদি।ফোনে করে মুভি/গান রাখা উত্তম।বড় গ্রুপ হলে কার্ড নিয়ে যেতে পারেন।

৪,০৪৯ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “দেখে এলাম ভারতবর্ষঃ পর্ব ৩”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    ভাল হচ্ছে।
    এগিয়ে যাও।
    এই অংশটা তো বেশ কষ্টের গেছে বলে মনে হলো।

    বাই দ্যা ওয়ে, আসলেই যাদের ভ্রমনের বাতিক থাকে, তাদের এত হারাম-হালাল বাছ-বিচার করলে কি চলে? (সম্পাদিত)


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আমার ভারত যাবার খুব শখ।
    পাকিস্থানেও।
    তবে সত্যি বলতে কি বাঙলাদেশ টাই ঠিকমতো দেখা হয় নি।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।