রঙিন জাঙ্গিয়া

বছরখানেক আগে আমার একটা স্টুডেন্ট ছিলো।সদ্য ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে ওঠা।ঢাকার মোটামুটি নামজাদা কলেজের।কাছাকাছি বয়সের হওয়ায় পড়াশুনার চেয়ে ওর সাথে গল্পগুজবই হত বেশি।তাসরীফের(আমার ছাত্র) একটা প্রেমিকা ছিলো,ওর ৩বছরের ছোট(ক্লাস নাইন পড়ুয়া),একটা ব্যান্ড টীম ছিলো নাম COOL-5,একটা ফুটবল ক্লাব ছিলো,নাম ভুলে গেছি,সেইসাথে ভিডিও গেমস খেলার প্রচন্ড নেশাও ছিলো।পড়াতে বসলেই এসব কথা উঠে আসত।ও ওর স্বপ্নের কথা বলত।গার্লফ্রেন্ডকে পালিয়ে নিয়ে দার্জিলিং যাওয়ার স্বপ্ন,ব্যান্ডটীম নিয়ে রকনেশানে যাওয়ার স্বপ্ন,একটা এক্সবক্স কেনার স্বপ্ন,আরো অনেক কিছু।কিছু মাথায় ঢুকত,কিছু মাথার উপর দিয়ে চলে যেত।এরপরেও হাসি হাসি মুখ করে মাথা নাড়তাম ওর কথা শুনে।কোন পরামর্শ দিতাম না,পাছে যদি আমার অজ্ঞতা প্রকাশ পেয়ে যায়।কারণ ঠিক ওই বয়সে,সদ্য দ্বাদশ শ্রেণীতে ওঠার পরে আমার একটাই স্বপ্ন ছিলো,কলেজে একটা মোবাইল ফোন ফোন নিয়ে যাওয়া!!!

শুনে অনেকেই হাসবে মে বি।আমরা ২০১১সালে পাসড আউট।মোবাইল তখন সহজলভ্য।আমাদের কাছে ক্লাস নাইনে থাকা অবস্থায়ই(২০০৭ সালে) ছিলো।এরপরেও আমার স্বপ্ন  মোবাইল আনা ছিলো কেন???খুলে বলি তাহলে,

এসএসসি পরীক্ষার কিছু পরে প্রিন্সিপাল হয়ে কলেজে আসলেন বজলুর রশীদ স্যার।উনার পরিচয় এই ফোরামে দেওয়ার দরকার আছে বলে মনে হয়না।যাই হোক,এসএসসির রেজাল্ট বের হওয়ার পরের কথা।১০০% এ+ পেয়েছে ব্যাচ থেকে।দিনগুলো কাটছিলো স্বপ্নের মত।হঠাত খবর আসলো ৩টা বন্ধুর বাসায় চিঠি আসছে,প্রস্তর যুগের কোন এক অপরাধের জন্য তাদের বহিস্কার করা হয়েছে কলেজ থেকে।আমাদের বজলুর রশীদের সাথে পরিচয় এভাবেই।

ক্লাস ইলেভেন,প্রিন্স অফ ক্যাডেট কলেজ হয়ে কলেজে আসার পরে দেখলাম ২মাসে কলেজ বদলে গেছে।এখন জুনিয়রদের পাছায় হ্যাঙ্গার স্টিকের বাড়ি দেওয়ার আগে সবাই বাবার ৫০,০০০/- দিয়ে কলেজ থেকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে কিনা চেক করে নেয়,ক্লাস টুয়েলভ নিয়মিত ভেস্ট পরে,মোজা পরে,ডাইনিং হলে ভেজিটেবল খায়।রাত ১২টার সময় প্রিন্সিপ্যাল রুমে এসে কে স্লিপিং ড্রেস পরেনি চেক করে যায়।মোটামুটি ভীতিকর অবস্থা।সেইসাথে এডজুট্যান্ট মেজর মোবাশ্বের।ক্যাডেট থাকা অবস্থায় বজলুর রশীদ নাকি মোবাশ্বের স্যারের ফর্ম মাস্টার ছিলো,একজন আরেকজনের ফটোকপি বলা যায়।বন্ধু শাকিলের ভাষায় জীবন “সাফা কুর কুরা।”সবাই তখন নিয়মিত অজু করে নামাজ পড়ে।মোনাজাত ধরে দোয়া করে,বজলুর রশীদের যেন খুবই পেইনফুল মৃত্যু হয়।

মোবাইল ফোন তো দূরের কথা।একটা বেনসন এন্ড হেজেস ম্যানেজ করাই তখন দুষ্কর।১০টাকা দিয়ে বারবারদের কাছ থেকে স্টার সিগারেট নিয়ে খাওয়া লাগে,৩মাইল দূর থেকেও যেইটার গন্ধ পাওয়া যায়।অনেকে আবার নন-স্মোকার হয়ে গেল।গেঞ্জি-আন্ডারওয়ার-মোজা কিনতে কিনতে আমাদের বাপদের পকেট হাল্কা হতে লাগলো।আড্ডায় বসলে একেকজনের মুখ দিয়ে বের হত হাহাকার।কিছুদিন পরেই ক্লাস টুয়েলভ হয়ে যাবো।অথচ একটা সিগারেট ও থাকেনা কাছে।পুরা কলেজে একটা মোবাইল ফোন নেই।জুনিয়ররা হাসাহাসি করবে আমাদের নিয়ে,ধইঞ্চা ক্লাস টুয়েলভ বলবে,এই চিন্তায় সবাই পারলে সুইসাইড করে।

কয়েকমাস পরেই খবর পাওয়া গেল,বজলুর রশীদ রিটায়ার করবে,আমরা টুয়েল্ভে ওঠার পরপরই।কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে।মার্কামারা একেকজনের নামের পাশে ২/৩টা করে বন্ড-প্যারেন্টস কল।আর যাদের নাম ক্লিয়ার,তাদেরকে পিটায়েও কোন অবৈধ কাজ করানো যাবে না।নতুন যিনি আসতেছে তার নাম রাখাল চন্দ্র ধর।চুড়ান্ত মাত্রার বিরক্তিকর হলেও কলেজ আউট করার রেকর্ড নাকি তার নেই।মনে মনে আশায় ছিলাম,এবার হয়ত কিছু হবে।

কিন্তু আমরা একজনের কথা ভুলে গেছিলাম,মেজর মোবাশ্বের।ছুটি থেকে এসে কলেজে ঢোকার সময় ক্লাস টুয়েল্ভের ব্যাগের সেলাই ব্লেড দিয়ে কেটে চেক করান তিনি,এমনকি পরে থাকা খাকির কলার টিপে টিপে দেখা হয়।কঠিন অবস্থা!!!ফোন তো দূরের কথা,সিম ঢোকানোই অসম্ভব।টেবিলে যেয়ে জুনিয়রদের সামনে মাথা নিচু করে বসে থাকি,কথা বলিনা।পাছে,এরা যদি কখনো ফোন ইউজ করতে চায়।টেবিল লীডারেরই তো দায়িত্ব এইসব আবদার মেটানো।কিন্তু আমরা অক্ষম টেবিল লীডার।এইভাবে আর কতদিন!!!রুমমেট সাদিকের সাথে মিলে পরিকল্পনা করলাম,সামনের বার যেইভাবেই হোক ফোন আনবো।

প্ল্যান করা হল,ফোন ঢুকবে পকেটওয়ালা জাঙ্গিয়ার ভিতরে করে,চার্জ যেন না দেওয়া লাগে,তাই এক্সট্রা ২টা ব্যাটারি চার্জ দিয়ে নিয়ে আসা হবে।চার্জ বাচানর জন্য ব্যাটারি শুধু কথা বলার সময়ই ঢুকানো হবে।প্ল্যানিং প্রসেসে থাকলেও এক্সিকিউশনে সাদিক নেই,ওইটা আমারই করা লাগবে।পরের ছুটিতে বগুড়ার জাঙ্গিয়া বাজার ওলট-পালট করে বের করলাম বড় পকেটওয়ালা জাঙ্গিয়া।জমানো সব টাকা চলে গেল একটা নোকিয়া ১৬০০ আর এক্সট্রা ব্যাটারির পিছনে।

ছুটি শেষে কলেজে ঢোকার দিন যে পরিমাণ উত্তেজিত ছিলাম,এখন পর্যন্ত এরকম নার্ভাস কখনো হইনি।৩টা বন্ড লেখা আছে নামের পাশে,ক্যাডেটশীপ ঝুলছে ছেঁড়া সুতার মত।সব ঠিকঠাক চলতেছে,হেয়ার কাট নিয়ে ব্যাগ চেক করাতে গেলাম।স্টাফ ব্যাগ নিয়ে বলল,”আমরা চেক করতেছি,আপনি হসপিটালে যান।”হসপিটালে যেয়ে দেখি সবাইকে একজন একজন করে মেডিকেল অফিসারের রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।আগেরজন বের হয়ে আসলো,দেখি ভিতরে শুধু মেডিকেল স্টাফ দাঁড়ানো,তার সামনে জাঙ্গিয়ার একটা স্তুপ।মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো।ইচ্ছে করতেছিলো এক দৌড়ে কলেজের বাইরে চলে যাই।স্টাফ ভিতরে ডাকলো,গেলাম,প্যান্ট খোলার নির্দেশ আসলো।যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক থেকে প্যান্ট খোলা শুরু করলাম,স্টাফ এক নজর দেখেই বলে,”আপনারও রঙ্গিন জাইঙ্গা,ওইটা খুইলা রাইখা যান,জানেন না,সাদা জাইঙ্গা ছাড়া অন্য জাইঙ্গা পরা নিষেধ।”আমি তব্দা খেয়ে দাঁড়ায়ে থাকলাম।কি করবো মাথায় আসতেছিলো না।স্টাফ ঝাড়ি দিতে যেয়ে দেখে ক্লাস টুয়েলভ আমি।একটু গলা নরম করে বলল,”আচ্ছা,আমি বাইরে যাচ্ছি,আপনি খুলেন।”বলে উনি বাইরে গেলেন।আমি প্যান্ট খুলে নিচে নামালাম,এরপরে আবার পরে ফেললাম।বেল্ট লাগাতে লাগাতে বের হয়ে আসতেছি,এমন সময় স্টাফ ডাক দিলো,”খুলছেন?”,আমি মাথা নাড়লাম।”কোনটা আপনার,দেখায়ে যান,”আমি প্রায় একই কালারের অজ্ঞাত কারও ঘামে ভেজা রঙিন আন্ডারওয়্যার উঁচু করে দেখায়ে বললাম এইটা আমার।এরপরে কোনরকমে ব্যাগ টানতে টানতে রুমে এসে বিছানায় ঝাপ দিলাম।

সেইটাই ছিলো ২৮তম ব্যাচের ক্লাস টুয়েল্ভে ওঠার পরে আনা প্রথম ফোন।ফোন ঢুকানোর পরে প্রথম যে সমস্যায় পড়ছিলাম সেইটা খুবই ফ্রাস্ট্রেটিং।সমস্যাটা হচ্ছে,এই দুই নম্বুরী ফোন দিয়ে কথা বলার মত কেউই ছিলনা আমার।বাসায় কথা বলার জন্য তো কলেজের বৈধ ফোনই আছে।এত রিস্ক নিয়ে আনা ফোন গেম খেলা ছাড়া আর কোন কাজেই লাগাতে পারিনি কখনো। এখন যখন দেখি জুনিয়ররা কলেজে বসে সেলফি আপলোড দিচ্ছে,আর তাতে কলেজেরই অনেক টিচার লাইকও দিচ্ছে,তখন সেইদিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।

২,৯২৯ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “রঙিন জাঙ্গিয়া”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ভাবছিলাম এই সব জাংগিয়া টাংগিয়া নিয়া লেখার কারণে ঝাড়ি দিবো।
    পুরাটা পড়ে মায়া লাগলো, আহারে।

    আমাদের সময় মোবাইল ছিলো না।
    আজ অনেক ক্ষেত্রে বুঝি নিয়ম মেনে চলাটাই ভালো।
    মনে হয় বয়স হচ্ছে।

    কিন্তু কলেজ অথরিটি এতো নির্দয় ভাবা যায় না।
    আমাদের ৬ বছরে কলেজ আউট দেখেছি হাতে গোণা।
    কলেজ অথরিটিকে কখনো বন্ধু না হলেও এইরকম হতচ্ছাড়া রকম শত্রু মনে হয় নাই।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    আহারে ! কলেজে আমার মোবাইল নিয়ে যাওয়া নিয়ে ম্যাড়মেড়ে এক খান কাহিনী আছে 🙁 লিখে ফেল্বো নাকি চিন্তা করছি।

    উল্লিখিত শিক্ষকের নাম (নাম বলতে চাই না) আমাদের কলেজে একবার প্রভুভক্ত প্রাণীটির গলায় শোভা পাইয়াছিল। বোধ করি তারপর উহার সমার্থক শব্দই হইয়া গিয়াছিল। এখনো ওই নামখানা ভুলি নাই। রাস্তা ঘাটেই মনের অজান্তে বের হয়ে যায়, ঐ **লা দূরে যা।


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    আমাদের সময়ে ক্রেজ চিল ওয়াকম্যান। দারুন সব এডভেনচার আছে এর পিছনে।

    লেখা ভাল লেগেছে :thumbup:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।