এইচএসসি’র পরেঃপর্ব ১

সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃএকান্তই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লেখা।

কলেজ থেকে বের হওয়ার পরে সবচেয়ে কঠিন সময় হচ্ছে তার পরের কয়েক মাস।এই সময়েই নির্ধারিত হয়ে যায়,কার ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে।অনেকে সাবলীল্ভাবে পার করে দেয় এই সময়টা,অনেকে পিছিয়ে পড়ে।এই লেখায়,আমি আমার এই সময়টার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই।

বেশিরভাগ বন্ধুই কলেজ থেকে বের হওয়ার পরে ঢাকায় তাদের সাময়িক নিবাস নিয়ে ব্যস্ত,আমার বাসা ঢাকায় হওয়ায়,আমার সেই চিন্তা ছিলো না।ওদের ছিলো খাওয়ার কষ্ট,পানির কষ্ট,যাতায়াতের কষ্ট,টিপে টিপে খরচ করার কষ্ট।আর আমার ছিলো একা থাকার কষ্ট।থাকতাম বারিধারা ডিওএইচএসে।আশেপাশে ব্যাচমেট তো দূর কি বাত,পরিচিত কেউই ছিলো না।উদ্ভাস থেকে দেওয়া লেকচার শীট পড়তে বসলে মনে হত,না বুঝলে বুঝায়ে দেওয়ার মত কেউ আশে-পাশে নেই,পড়ে লাভ কি???কম্পিউটারে বসলে ঘুরে-ফিরে চলে যেতাম সেই ফোল্ডারে,যেখানে আছে আমার কলেজ লাইফের সব স্মৃতি।সেই ছবিগুলো দেখে বুকে মোচড় দিত।অদ্ভুত একটা ফিলিংস।একই ফিলিংস হয়েছিলো সেইসব দিনের অনেকদিন পরে।১৫ জানুয়ারী ২০১২ তে।ডিপার্টমেন্টে প্রথম ক্লাস করতে যেয়ে একটা মেয়েকে দেখেছিলাম।ক্লাস শেষের পরে তাকে তার বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে চলে যেতে দেখে।আজব না???দুইটা সম্পূর্ণ আলাদা ঘটনা,অথচ কষ্টটা এক।

উদ্ভাসে ভর্তি হয়েছিলাম,কারণ ক্যাডেটদের জন্য আলাদা ব্যাচ ছিলো ওদের।দিনে এই অল্প কিছুক্ষনের জন্য সবার সাথে দেখা হত,ক্লাসের চেয়ে ওদের সাথে আগের মত আড্ডা মারাটাই ছিলো ইম্পরট্যান্ট।ক্লাস শেষের পরেই ছুটতাম ফোকাস কোচিঙয়ের নিচে।কারণ কলেজ লাইফের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর ক্লাস তখন শেষ হয়েছে।টানা ৪বছর রুমমেট ছিলাম আমরা,গভীর রাতে একসাথে ব্লকে পায়চারী করতাম,এক হেডফোন দিয়ে গান শুনতাম,চার বছর এমন কিছু নেই,যা আমরা একসাথে করিনি।আর তখন!!!ওর সাথে তাই কাটানোর মত ১টা মিনিট সময়ও নষ্ট করতে চাইতাম না।কয়েকবন্ধু মিলে স্কয়ার হাসপাতালের পিছনে বাসা নিয়েছিলো,বেশিরভাগ সময়ই সারাদিন ওখানেই আড্ডা হত,সন্ধায় বাসায় ফিরে হত ফেসবুকে আড্ডা।পড়াশুনার চিন্তা তখন আর মাথায় নেই,৪ বছরের রুমমেট,সবচেয়ে কাছের বন্ধু,যেতে চায় আর্মিতে।আমার অন্য কোথাও যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

দেখতে দেখতে আইএসএসবি চলে আসলো,ক্যাডেট নাম্বারের দিক দিয়ে এগিয়ে থাকায়,সাদিক(আমার রুমমেট) এর আগেই আমার আইএসএসবি।এবং,সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাদ পড়লাম।বাইরে বের হয়েই দেখি আব্বু দাঁড়িয়ে আছে,আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আব্বু আর কিছুই জিজ্ঞেস করলো না।গাড়ির দরজা খুলে দিলো।জীবনে প্রথমবারের মত মনে হল,ক্যান্টনমেন্টের ভিতর ট্রাক/বাস চলছে না কেন???ঝাপ দিতে চাই।কলেজ থেকে বের হবার পরে ওইদিনই প্রথম সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছিলাম।আব্বুর সেই হতাশ চাহনি ভুলতে পারছিলাম না।ভবিষ্যৎ কি হবে,আব্বু-আম্মুর এত দিনের আশা আমি কীভাবে নষ্ট করলাম,এখন কীভাবে তাদের সামনে মুখ দেখাবো,এই চিন্তাতেই পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।অনিশ্চয়তার অভিজ্ঞতা যে কতটা ভয়ংকর,জীবনে প্রথমবারের মত তখনই টের পেয়েছিলাম।

“থ্রি ইডিয়টস” মুভিতে একটা লাইন ছিলো,”বন্ধু ফেল করলে খারাপ লাগে,কিন্তু প্রথম হলে,তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগে।”রাতে চ্যাট অফ রেখে ফেসবুকে ঢুকে গ্রিন কার্ডধারীদের উল্লাস দেখে এই কথাটার বাস্তবতা বুঝতে পারতাম।দেখা হলেই ওরা হয়ত স্বাভাবিক ভাবেই তাকাতো,কিন্তু আমার কাছে মনে হত,ওদের দৃষ্টিতে মেশানো আছে উপহাস।

আমার এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কাছের বন্ধু সাদিক গ্রিন কার্ড পাওয়ার পরে যেইদিন প্রথম দেখা হল আমাদের,সেইদিন আমার মন খুব খারাপ ছিলো।সত্যি সত্যি আমাদের দুই জনের রাস্তা আলাদা হয়ে যাচ্ছে!!!কোনমতে একটা হাসি ঝুলিয়ে ওর সামনে দাড়িয়েছিলাম।ও এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রথম যে কথাটা বলেছিলো,তা হচ্ছে,”টেনশন নিস না,তুই ডি ইউনিটে ফার্স্ট হবি।”ফার্স্ট হয়ত হতে পারিনি,কিন্তু যা হয়েছিলাম,তাও হতে পারতাম না,যদি ওইদিন ও ওই কথাটা না বলত।স্রোতে ভেসে যাওয়ার সময় খড়কুটোর মত ছিলো ওই কথাগুলো।মনে হয়েছিলো,আমার পক্ষেও কিছু করা সম্ভব।

বেশ কিছুদিন কেটে গেছে তখন,ভার্সিটিগুলোর ফর্ম ছাড়ার সময় চলে এসেছে কাছাকাছি,আব্বু একদিন ডেকে বলল,আমার উপর তাদের এখনো আস্থা আছে,বুয়েটে যেন আমি অবশ্যই চান্স পাই।আবার পড়ে গেলাম অথই পানিতে।লেকচার শীট উল্টে-পাল্টে দেখি,কিছুই মাথায় ঢোকে না,ক্লাসে টীচারদের লেকচার শুনে মনে হয় মঙ্গল গ্রহের ভাষা।সবাই গম্ভীর মুখে লেকচার শোনে,মাথা নাড়ে,আর আমি ভয়ে মাটিতে মিশে যাই।কোনোই আশা দেখিনা।এরই মধ্যে মেরিন অ্যাকাডেমির ভর্তি পরীক্ষা হল,৭দিনের অধ্যাবসায়ে সুযোগ পেলাম লিখিত পরীক্ষায়।অনেকদিন পরে সেইদিন আরাম করে ঘুমিয়েছিলাম।আর যাই হোক,একটা না একটা গতি হবেই,এই ভরসায়।বুয়েটে পরীক্ষাই দিলাম না।আইইউটিতে কোনরকমে আধাঘন্টা হলে বসে থেকে বের হয়ে গেলাম।মেডিকেলে পরীক্ষা দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।আর কেন যেন আমি বেসরকারী ইউনিভার্সিটি দেখতে পারতাম না,বাপের টাকায় বিদেশ যেয়ে পার্ট-টাইম জবের নামে থালা-বাসন ধোয়া লাগবে,এমন একটা ধারণা ঢুকে গিয়েছিলো ভিতরে।লক্ষ্য তখন একটাই,মেরিন অ্যাকাডেমি।

ভাইভা-মেডিক্যাল চেক-আপের জন্য গেলাম চিটাগাং।টিকেও গেলাম।কিন্তু অ্যাকাডেমি দেখেই মন খারাপ হয়ে গেলো।এক্সকারশানে গিয়ে আর ছবি দেখে বিএমএ’র একটা ছবি মনে ঢুকে গিয়েছিলো,সেটার সাথে মেরিন একাডেমীর তুলনা করে হতাশ হয়ে গেলাম।বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে একই শহরে কিন্তু আলাদা একাডেমিতে থাকতে হবে,যেইটা কিনা বিএমএ’র তুলনায় কিছুই না,এই চিন্তা আমি মাথা থেকে সরাতে পারছিলাম না।বার বার মনে হচ্ছিলো,এই ভাগাড়ে থাকলে হয়ত সবচেয়ে কাছের বন্ধু করুণার দৃষ্টিতে তাকাবে,যেইটা বহন করা আমার পক্ষে অসম্ভব।যদিও চিন্তাটা ছিলো অ্যাবসার্ড,কিন্তু তখন মন থেকে সরাতে পারছিলাম না।সিদ্ধান্ত নিলাম,এই একাডেমিতে কোনভাবেই ভর্তি হব না।ফলাফল,আবারও অনিশ্চিত জীবন।আগের থেকে পার্থক্য,হাতের অপশন তখন প্রায় শেষের দিকে।

খড়কুটোর মত আগলে ধরলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের “ডি ইউনিট”কে,পার্টনার হিসেবে আইসিসিএলএলএম-০৮ এ কুইজ কম্পিটিশনে পারফর্ম করা কৌশিক ভাই আগের বছর “ডি ইউনিট” এ প্রথম হয়েছেন,উনিই তখন প্রেরণা,হাতে সময় দুই সপ্তাহ।দৃশ্যপটে এল তখন দুই বন্ধু,অনিক-ইসতিয়াক।তাদের অবস্থাও আমার মতই।তখনো কোন গতি হয়নি।পড়া বাদ দিয়ে ৩জন শুরু করলাম অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা।সেইখান থেকে সেই আলোচনা,কলেজের টিচারদের নিয়ে হাসাহাসি,নতুন সিনেমা,গান,ফেলে আসা দিনের কাহিনী,ফুটবল,বলিউড,হলিউড আরো অনেক জায়গা দিয়েই ঘুরতে থাকলো,কিন্তু ভুলেও পড়ার দিকে গেলো না।৩ দিন  হাসতে হাসতে কেটে গেলো,পড়া হলো না।পরীক্ষার দিন ভয় ধরে গেলো ৩জনের মধ্যেই।মনের সুখে একজন আরেকজনকে গালি দিলাম,পড়তে না পারার জন্য,চান্স না পেলে কে কাকে কীভাবে বলাৎকার করবে,তার ইশতেহার ঘোষণা হতে থাকলো,এরপরে একসাথে ৩জন পরীক্ষা দিতে গেলাম।আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে ১০০ প্রশ্নের প্রায় ৮০টাই কমন,খুশিতে ডগমগ হয়ে ভুলেই গেলাম,দুনিয়াতে নেগেটিভ মার্কিং বলে একটা সিস্টেম আছে।বাকি ২০টাও দিলাম আন্দাজে দাগায়ে।হল থেকে বের হয়ে উত্তর মিলিয়ে দেখি,ওই ২০টার ১৮টাই ভুল,সেইসাথে কমনগুলোর মধ্যেও ৩/৪টা ভুল।আবারো অনিশ্চিত সবকিছু।

যাই হোক,রেজাল্ট আশানুরূপ না হলেও একদম ফেলে দেওয়ার মত হয়েছিলো না।কিন্তু নিজের পায়ের তলায় মাটি ফিরে পাওয়ার আনন্দ ফিকে হয়ে গিয়েছিলো,অনিক-ইশতিয়াকের রেজাল্টে।

যদি এইচএসসি পরীক্ষা দেয়নি,এমন কেউ এই ব্লগ পড়ে,তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে,ভবিষ্যৎ নিয়ে যাই পরিকল্পনা কর না কেন,সবসময় একটা প্ল্যান-বি,আর পারলে প্ল্যান-সি রেখো।আল্লাহ না করুক,প্ল্যান-এ কাজ না করলে আমার মত যেন কারোর সুইসাইড করতে মন না চায়।অনিশ্চয়তার কষ্টের মত কষ্ট দুনিয়ায় খুব কমই আছে।

 

১,৮৯৪ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “এইচএসসি’র পরেঃপর্ব ১”

  1. সৌরভ(০৬-১২)

    "যদি এইচএসসি পরীক্ষা দেয়নি,এমন কেউ এই ব্লগ পড়ে,তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে,ভবিষ্যৎ নিয়ে যাই পরিকল্পনা কর না কেন,সবসময় একটা প্ল্যান-বি,আর পারলে প্ল্যান-সি রেখো।" :boss:

    ওদের আসলেই পড়া দরকার... (সম্পাদিত) (সম্পাদিত)


    মুক্তি হোক আলোয় আলোয়...

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ভালো লেখা।
    জীবন সম্পর্কে আরো বেশি প্রয়োজন আমাদের সবার। বেশি করে কলেজ কতৃপক্ষের, বাবা-মার।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    প্রতি বছর ৪৫০ ছেলে বের হয়। সামরিক বাহিনীতে যায় দেড়শ জন কম-বেশি। যে বড় অংশটা বাইরে থেকে গেলো তাদের নিয়ে চিন্তা করার কেউ নেই।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহসান আকাশ (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।